অসি নয়, মসিতে আস্থা তার : কাজী রাফি, কথাসাহিত্যিক, মেজর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

করেছে Rodoshee Magazine

বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সেকেন্ড লেফ্টেন্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু। কিন্তু প্রচুর পাঠাভ্যাসের কারণে ছোটবেলা থেকেই ভেতরে ভেতরে লালন করেছেন লেখক হয়ে ওঠার প্রবল ইচ্ছা। বাংলার মাটির সন্তান হিসেবে এই ভূমির প্রতি নিজের দায়বোধ আছে বলে মনে করেন তিনি। বলা হচ্ছে, কথাসাহিত্যিক কাজী রাফির কথা। প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ লিখে অর্জন করেছেন এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার। কাজী রাফি বর্তমানে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার (মেজর) হিসেবে ঢাকায় কর্মরত আছেন। অথচ এক সময় এই চাকরি থেকেই অব্যাহতি চেয়ে বসেছিলেন তিনি! কিন্তু কেন? জানা যাবে রোদসীর এই আয়োজনে। কথপোকথনে স্বরলিপি।

কী হতে চেয়েছিলেন?

ছোটবেলা থেকেই অনেক বই; বিশেষত গল্প-উপন্যাস পড়তাম। একদিন আমার ছোটবোন আমাকে প্রশ্ন করেছিলো ‘ভাইয়া, এই যে তুমি এতো বই পড়ো, তুমি আসলে কী হতে চাও?’ আমি তাকে বললাম,‘কী হতে চাই, তাতো বলতে পারছিনা, তবে আমি একজন ভালো পাঠক হতে চাই। আর সম্ভব হলে লেখক হবো।’ এই কথাটি আমি দুষ্টুমি করেই বোনকে বলেছিলাম। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারি, অবচেতনে-আনমনে আমি হয়তো লেখক হওয়ার ইচ্ছাটা লালন করতাম বলেই অনেক পরে হলেও কলম ধরেছি। আমার আটাশ বছর বয়সে আমি প্রথম লেখা শুরু করলাম। ঘোরের বসেই আট মাসের মধ্যে লেখা শেষ হলো আমার প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’।

পরিবার কী চাইছিলো

আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাস বাবার ছিলোনা। তিনি পড়াশোনাটা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে বলতেন। কিন্তু আমি তো কেবল পরিবারের একজন সদস্য না, একটি সমাজেরও সদস্য। আমাদের সময় প্রচলিত ধারণা ছিল-ভালো ছাত্র হলে হয় ডাক্তার, না হয় ইঞ্জিনিয়ার অথবা সশস্ত্রবাহিনীর একজন অফিসার হতে হবে। তাই সেভাবেই আমার ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। বড়দের কারও কাছে কখনো বলা হয়নি ‘বড় হয়ে লেখক হতে চাই’। কারণ, এই সমাজ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের এই কথা বলার স্পেসটুকু দেয় না। কেননা এখানে আর্থিক উন্নতির বিষয়টি নিশ্চিত নয়।

অদম্য ইচ্ছা

ইচ্ছা ছিলো ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবো। চান্সও পেলাম কিন্তু যেদিন বিশ্বাবিদ্যালয়ে ভর্তির তারিখ ছিল সেদিন আমি আটকা পড়ে গিয়েছিলাম আইসএসবি পরীক্ষার জন্য। আমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেতে পারিনি। আমার কখনো বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা হয়নি। তবে অফিসার হওয়ার পর নিজ উদ্যোগে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছি।

ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা

আমি মনে করি একজন মানুষ কী করতে ভালোবাসে আগে সেটা জানা উচিত। মানুষ যদি তার ভিতরের শক্তিটা আবিষ্কার করে ফেলতে পারে তবে সেদিকেই তার পদচারণা হয়। মানুষের যেদিকে অভিযাত্রা থাকে, যদি তার ইচ্ছার প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে সেই কাজের জন্য তার মগ্নতা তৈরি হয়। এই মগ্নতা থাকলে মানুষ জীবনের যে দিকটায় বিস্তৃত হতে চায় সেখানেই তার অবস্থানকে বড় এবং শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

লেখক হয়ে ওঠা

চিঠি লেখার একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিলো অষ্টম শ্রেণি থেকে। বাবাকে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতাম। বাবা শিক্ষক ছিলেন, সুন্দর করে গুছিয়ে চিঠি লিখতেন। আমিও চেষ্টা করতাম যথাসম্ভব গুছিয়ে চিঠি-লিখতে। মাকেও চিঠি লেখা হতো। কিন্তু মা কখনো ফিরতি চিঠি লিখতেন না। এরপর আমার যখন অ্যানগেইজমেন্ট হয়ে গেল-তখন স্ত্রীকে লম্বা চিঠি লিখতাম। আমি যেখানেই থাকতাম প্রতিটি চিঠিতে তার চারপাশের প্রকৃতি নিয়ে কোনোনা কোনোভাবে লেখা হতো। এমনকি আমি যখন বাবাকে চিঠি লিখতাম তখনও। মিলিটারি একাডেমিতেও লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়তাম। তবে আমার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন আমার মা এবং আমার গ্রামের প্রাকৃতিক অবগুণ্ঠনে ঢাকা আমাদের সুনশান বড়-বাড়িটা। এমন সুনশান পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছাড়াও মা’র মুখের ফল্গুধারার মতো ঝরে পরা কবিতা শুনেশুনে কৈশোর অতিক্রম কালে আমার ভিতরে এক ধরণের অনুপ্রাস তৈরি হয়েছিল। সেই অনুপ্রাস আমাকে সবকিছু দেখে অবাক হতে শিখিয়েছিল। অবাক হয়ে গভীর মনোযোগে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার প্রবণতাই আমার লেখকসত্তার শক্তি হয়ে উঠেছিল আমার অজান্তেই।

চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন

(হাহাহা)। হ্যাঁ। ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাস লেখার সময় আমার খুব সমস্যা হচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে আর একটা গল্প বলতে হবে। আমার বাড়ি বগুড়া। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাড়িও বগুড়ায় ছিলো। উনার ইচ্ছা ছিলো একটা উপন্যাস লিখবেন, যেখানে পুন্ড্রু-সভ্যতার ছায়া থাকবে। কিন্তু তিনি লিখে যেতে পারেননি। একথা আমি যখন জানতে পারি, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। এরপর ২০০৭ বা ২০০৮-এর দিকে এশিয়ান উইক-এ একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ছিলো পান্ডুয়া নামক স্থানে (মহাস্থান গড়ের মতো যে নিদর্শন) সেগুলো পাওয়া গেছে। পত্রিকাটি আর্য-মৌর্য হয়ে পালদের গড়ে ওঠা সভ্যতা এবং তার অবস্থান হিসেবে ভারতের কথা লিখেছিল। ওই প্রতিবেদন পড়ার পর, সেই পু-্রভূমির সন্তান হিসেবে আমার মনে হয়েছে; আমারও একটা দায় আছে। আমাদের এই সভ্যতাকে একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি অন্যের হয়ে যেতে দিতে পারিনা। ভাষা এবং সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপন্যাসের চেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার আর কিছু হতে পারেনা। সেই অনুভব থেকেই লেখা শুরু করলাম ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসটি। কাজটি আমার জন্য অনেক কঠিন ছিলো। আমার গল্পকে সাজানোর ইচ্ছা ছিলো কাশ্মির থেকে জয়াপীড় এবং পুন্ড্র সভ্যতা হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। আমি আসলে বাঙালির জাতি সত্তার সভ্যতা, ঐতিহ্য এবং কৃষ্টির স্থান থেকে শনাক্ত করতে চেয়েছিলাম। কাজটাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছিলো। ২০০৮ সালে উপন্যাসটি লিখতে শুরু করলাম, তবে একটা সময় খুব ক্লান্ত বোধ হলো। পেশাগত কারণে তা ঠিক মনমতো হয়ে উঠছিলো না। তারপর আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে অবশ্য চাকরিটা ছাড়তে হয়নি- বরং সহযোগিতা পেয়েছি। আমার অ্যাপেনডিক্স লেটার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেননি। ২০১৩ সালে উপন্যাসটি লেখা সম্পন্ন করেছিলাম।

এতো বড় সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?

আমি উপন্যাসটি শেষ করতে চাইছিলাম। ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাস সৃষ্টিকালে মনে হচ্ছিল চাকরির চেয়ে উপন্যাস সৃষ্টিটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কাজটি করার সময় আমার বারবার মনে হয়েছে একজন শিল্পীর জন্য তার পেশাটা অন্তরায় হয়ে ওঠে। আমার স্ত্রী এই কাজে সবার আগে সম্মতি দিয়েছিল।

তরুণদের জন্য কী বলবেন

ব্রিটিশরা আমাদের নেটিভ বলতো। শোষণ করতো। ওদেরকে আমরা ঘৃণা করতাম। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ৮০০ বছরের শাসন-শোষণে ভারতবর্ষের মানুষদের ডিএনএর মধ্যেই এক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তা হলো শাসক শ্রেণির প্রতি ঘৃণাবোধ করা। অনৈতিকভাবে অর্জন করা অর্থবিত্ত প্রতিপত্তি, ক্ষমতাকে বাঙালিরা পছন্দ করতো না। তাই শাসক শ্রেণিকে তারা যেমন ঘৃণা করে তেমনি আবার ওদের মতোই হয়তো হতে চায়। সেজন্য বাঙালি ক্ষমতা লাভ করলে মাঝে মাঝে তাদেরকে আমরা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি। যে কাজে ক্ষমতা বেশি, প্রভাব বেশি আমাদের সমাজে সেই কাজের মূল্যায়ন করা হয়। সেদিকেই সন্তানদের এগিয়ে দিতে চান-পরিবারের সদস্যরা। মহৎ জীবনাভ্যাস ব্যাতিত এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

রোদসী/আরএস

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

16 + 18 =