শায়লা জাহান:
বলা হয় বিয়ে হলো দিল্লি কা লাড্ডু; যে খেলো সেও পস্তালো, আর যে খেল না সেও পস্তালো। আবার অনেকে তো এক কাঠি সরেস। তাদের মতে, পুরুষ মানুষ হল দু’প্রকারঃ জীবিত ও বিবাহিত। বিবাহিত মানে প্রকারন্তরেতে মৃত। যতই কৌতুকপূর্ণ মতামত চালু থাকুক না কেনো, যুগ যুগ ধরে বিয়ের প্রথাকে মঙ্গলজনক ও ঐতিহ্যবাহী বন্ধন হিসেবে মনে করা হয়। এটি এমন এক সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ একত্রে এক নতুন জীবনের সূচনা করে। পারিবারিক বিয়ে নাকি প্রেমের বিয়ে, কিসে সুখী হয় বেশী? এই নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। আসো এই ব্যাপারে আমরাও কিছু জেনে নিই।
বিয়ে হচ্ছে আজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি এবং এটি কেউই লাক বায় চান্স বলে ছেড়ে দিতে পারেনা। তাই সঠিক সঙ্গী বেছে নেয়াতে সাফল্য ও সুখের চাবিকাঠি নিহিত। পারিবারিক বিয়ে এবং প্রেমের বিয়ে- দুটিই বিয়ে করার দুটি পথ হলেও এদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের শেষ নেই। ১৮শতক পর্যন্ত পরিবারের জন্য একটি সম্পর্ক সংগঠিত করার প্রয়াসে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজকে আদর্শ উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এই ব্যবস্থাগুলো সাধারণত পরিবারের অভিভাবক অর্থাৎ দম্পতির পিতামাতা বা দাদা-দাদি দ্বারা সম্পন্ন হতো। শুধু বর-কনে নয়, দুই পরিবারের সদস্যদের সম্মতি ও অংশগ্রহনের মাধ্যমে এই পারিবারিক বিয়েগুলো হয়ে থাকে। অন্যদিকে বর্তমানে তরুন প্রজন্মের কাছে লাভ ম্যারেজ অত্যধিক জনপ্রিয়। এখানে মূলত দম্পতির একক সিদ্ধান্ত থাকে এবং তারা তাদের পছন্দের কারও সাথে গাঁটছড়া বাঁধতেই বেশি পছন্দ করে।
পারিবারিক বিয়ে বনাম প্রেমের বিয়ে
পারিবারিক ভাবে বিয়ে বেশি টেকসই নাকি প্রেমের বিয়ে-এই বিতর্ক অনেক পুরনো। কেউ প্রেমের বিয়ে পছন্দ করেন তো কেউবা পারিবারিক বিয়ের পক্ষে। এই দু’ধরনের বিয়ে ব্যবস্থার তুলনামূলক কিছু সুবিধা-অসুবিধা উল্লেখ করা হলঃ
পারিবারিক বিয়ের সুবিধা
-এই ধরনের বিয়ে যেহেতু দু’পক্ষের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পরেই হয়, তাই এতে সম্পর্কের ভিত্তি হয় মজবুত এবং পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
-যেহেতু এটি অভিভাবকদের পারস্পরিক সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে, তাই প্রেমের বিয়েতে যতটা না সম্মান থাকে তার থেকে এতে দুজনের মধ্যে অনেক বেশি সম্মানের বিষয়টি জড়িত থাকে।
-অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে, বাবা-মা একে অপরের পরিবার এবং তাদের সার্কেল সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। নিজ সন্তানের আগ্রহ, পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি মাথায় রেখেই তার জীবনসঙ্গী বেছে নেন। তারা শুধুমাত্র এমন কাউকে বেছে নেবেন যার মূল্যবোধ, লক্ষ্য এবং বিশ্বাস সবকিছুই নিজেদের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ থাকবে।
-নিঃসন্দেহে তুমি যখন অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করছো, তখন তোমার কাছে অফুরন্ত সংখ্যক অপশন এভেলএবেল থাকবে। তুমি যে ধরনের ব্যক্তিকে বিয়ে করতে চাও এবং বাকি জীবন কাটাতে চাও তা বেছে নিতে পারো।
-আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডক্টর রবার্ট এপস্টেইনের গবেষণা অনুসারে, প্রেমের বিয়েতে প্রেম সময়ের সাথে সাথে ম্লান হয়ে যায়, যেখানে পারিবারিক বিয়েতে প্রেম সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায়।
-সর্বোপরি, এটি একটি পরিবারের সংস্কৃতি, জাতিসত্তা, নৈতিকতা এবং পরিচয়ের ঐতিহ্য বজায় রাখে।
পারিবারিক বিয়ের অসুবিধা
-অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ অনেকটা লটারির মতো। দম্পতিদের মধ্যে পরস্পরের জন্য প্রেম, অনুভূতি জাগতে পারে আবার নাও পারে।
-যেহেতু দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিবার থেকে আগত। বিয়ের আগে একে অপরকে চেনার পরিসর কম থাকে। তাই এক্ষেত্রে অনেকসময় পারস্পরিক এডজাস্টমেন্টের সমস্যা হতে পারে। আর এটা যদি বাড়তে থাকে তবে বিয়ে ভাঙার মতো অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-যদিও তুলনামূলকভাবে প্রেমের বিয়ের তুলনায় পারিবারিক বিয়েতে বিচ্ছেদের হার কম থাকে, তবুও বলা যায় না যে তারা সুখী দম্পতি। এমন অনেকেই আছে যারা বৈবাহিক জীবনে তেমন সুখী নয়, কিন্তু সামাজিক চাপ, লোকলজ্জার ভয়ে বিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে না পেরে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়।
-অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের নামে আজও অনেক জায়গায় জোরপূর্বক বিয়ে দেয়ার প্রচলন রয়েছে।
লাভ ম্যারেজের সুবিধা
-এই বিয়েতে যেহেতু পার্টনার একে অপরকে আগে থেকেই ভালভাবে জানে তাই বিয়ের পরে তাদের মাঝে বোঝাপড়ার সমস্যা থাকেনা।
-প্রেম বিবাহ বিশেষভাবে উদার মনের ব্যক্তিদের জন্য বোঝানো হয়। এখানে নিজ সঙ্গী নির্বাচনের পুরোপুরি স্বাধীনতা রয়েছে।
-একে অপরের জন্য সবচেয়ে বড় সাপোর্টিভ হয়ে উঠবে। পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য একে অপরকে বিশ্বাস করা, সম্মান করা আগে থেকেই চলে আসে। তুমি যে ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে ছিলে এবং যে তোমাকে খুব ভালবাসে তার চেয়ে ভাল উপায়ে আর কে সমর্থন করতে পারে।
লাভ ম্যারেজের অসুবিধা
-এই বিয়েতে বিচ্ছেদ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কখনও কখনও দম্পতিদের মাঝে প্রেম ফুরিয়ে যায় বা অনেক সময় তারা একে অপরের প্রতি ক্লান্ত হয়ে যায়।
-এমন বিয়েতে অনেক সময় তোমার সঙ্গী নির্বাচন পরিবার এবং বন্ধুদের দ্বারা অনুমোদিত নাও হতে পারে। তাই তুমি যখন চলার পথে কোন সমস্যায় পড়বে, সেখান থেকে মুক্তির জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত কাউকে নাও পেতে পারো।
-সাংসারিক জীবনে বিরোধের দেখা দিতে পারে। বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরে লাইফ স্টাইল অনেক পরিবর্তন হয়ে যায় উভয়ের। এটা মেনে না নিতে পেরে শুরু হয়ে যায় সাংসারিক ঝামেলার।
-জীবনে যে শুধুমাত্র ভালোবাসাই প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। পারিবারিক পটভূমি, অর্থনৈতিক অবস্থা, বেড়ে উঠার পরিবেশ এগুলোও বিবেচ্য বিষয়। তাই বিয়ের মত এতো বড় সিদ্ধান্তে আবেগ থেকেও বাস্তবতা যাচাই করা উচিৎ।
প্রেমের বিয়েই হোক কিংবা পারিবারিক বিয়ে, সম্পর্ক তখনই কাজ করবে যখন পরস্পরের মাঝে সৎ, শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। আজকাল অবশ্য পারিবারিকভাবে বিয়ে ব্যবস্থায়ও একে অপরকে জানতে সময় নিচ্ছে। জীবনসঙ্গীকে জোর করে নয়, নিজের মনের মতো করে নির্বাচন করা উচিৎ।
-ছবি সংগৃহীত