বাংলাদেশে শুধু এই রাজধানীতেই গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হয় ৮৪ ভাগ নারী। হয়রানির ধরন বিভিন্ন। বাসে তুলতে না চাওয়া, তোলার পর হেল্পার এবং চালক এবং পুরুষ বাসযাত্রীদের কটুবাক্য, অশ্লীল বাক্য, চোখ দিয়ে টিপ্পনী এবং সর্বশেষ যৌন নিপীড়ন। যৌন নিপীড়নের ধরনও ভিন্ন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেওয়া থেকে শুরু করে পুরুষাঙ্গ শরীরে চেপে ধরা পর্যন্ত। এসব নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। কখনো কখনো মহিলা বাস চালু করার কথা শোনা যায়। নানান অনিয়ম আর লসে পড়ে সে বাস আর চালু থাকে না বেশি দিন। তারপর আবার একইভাবে চলতে থাকে। নারীরা কেউ শুধু যাতায়াতের কষ্টেই কখনো কখনো কাজ ছেড়ে দেয় বা বদলে ফেলেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির কবলে পড়ে চলাচল সীমিত করে ফেলেছে। বা বেতনের টাকায় অধিকাংশ দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা অন্য যান ব্যবহার করছে। এদের ৮১ শতাংশ মনে করে, এসব নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই। পুলিশকে তারা সহায়তাকারী ভাবে না।
এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সরকার আইন করার কথা ভাবছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৭-এর খসড়ায় নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে কোনো পুরুষ বসলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা এক মাসের কারাদণ্ড। যে যাই বলি, যদি আইনটা করা হয় হবে একটা হাস্যকর আইন।
প্রথমত, যদি সত্যি আইনটিই মানা হতো তাহলে এক কথা ছিল। অন্তত গর্ভবতী বা শিশু কোলে একজন নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আইন কার্যকর হলে সংরক্ষিত আসনে অন্তত আইনের জোরে বসতে পারবে নারীটি। খুব ভালো।
কিন্তু মুশকিল হলো তা কখনো হবে না। আর এই আইনটি করা কেন তা একটু খতিয়ে দেখা দরকার। পুরুষদের আইন মানতে বা নারীদের সাহায্য করতে বাধ্য করা? বাধ্য করে কি কখনো কিছু করা যায়?
এখন নারীর কর্মক্ষেত্র বেড়েছে। বাসে-ট্রেনে উঠে আজকাল কোনো নারী এই আহ্লাদ করবে না যে সিটে বসে থাকা কোনো পুরুষকে বলবে, ‘সিট ছেড়ে উঠুন। আমি নারী তাই বসে যাব।’ ভিড়ের বাসে ধাক্কাধাক্কি হবে, গায়ে গা লাগবে তাতে কিছু আসে-যায় না কিন্তু। কিন্তু নারী বুঝতে পারে কোনটা আনডিজারায়েবল টাচ আর কোনটা নয়। এই যৌন নিপীড়ন থেকে রেহাই পেতেই কিন্তু নারীরা আলাদা বাস চায়, আলাদা বসার সিট চায়। পুরুষ যদি নিশ্চিত করে যে তারা তাদের জিহ্বা আর হাত সামলাবে, তাহলে নারীও আলাদা কোনো বসার আসন চাইবে না নিশ্চিত থাকেন।
আইন করে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলানো যাবে না। আসলেই এ জন্য চাই পুরুষের অন্তর্গত বদল। এই যে নারীরা কাজ করছে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র কখনো কি ভাবে, কতটা চ্যালেঞ্জ পার হয়ে নারীকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ঘর থেকে বের হয়ে প্রথম নিপীড়ন গণপরিবহনে। এখন এই নিপীড়নের প্রতিবাদ কি প্রতিদিন করা সম্ভব? সকালবেলা অফিস যেতে শুরুতেই যদি আপনি বাসে ট্রেনে ঝগড়া করতে থাকেন এবং প্রতিদিন আপনার কি ইতিবাচক কাজের শক্তি আর বেঁচে থাকবে!
তার উপর এই আইনের ফলে উল্টো কত ধরনের টিপ্পনী যে নারীকে শুনতে হবে তার ইয়ত্তা নেই। উপকার তো হবে না, উল্টো এবার পুরুষের জিভের ধার সহ্য করতে হবে প্রতিদিন কর্মজীবী নারীদের।
আর এসব নপুংসক আইন কাদের মাথা থেকে আসে সত্যি আমি অন্তত বুঝি না। প্রতিবন্ধী আর শিশুদের কাতারে ফেলে নারীর জন্য আইন! অদ্ভুত! রাষ্ট্রই তো নারীকে দুর্বল আর অর্ধমানব ভাবে। সে জন্যই আলাদা বাস, আলাদা আসন ইত্যাদির ধারণা শুরু করেছে। সবার আগে তো পুরুষের জন্য মানসিকতা বদলের প্রকল্প নেওয়া দরকার। আর নারীদেরও অবিরাম গলা না তুলে উপায় নেই। প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। হয়তো এই প্রজন্মের আমাদের প্রতিবাদই পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের জন্য নিরাপদ আর সম-অধিকারের একটি পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।