আজ ৮ মার্চ। অন্য আর আট দশটা দিনের মতো হলেও এই দিনটার তাৎপর্য বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি। কারণ আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী এই দিনটি একটি সামাজিক দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীদের সাফল্য উদযাপন করা হয়ে থাকে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অবদান নিয়ে আলোচনা হয় বিশ্বব্যাপী। তবে নারী দিবসের মূল বক্তব্যটা কিন্তু সেই লিঙ্গ সমতাকেই ত্বরান্বিত করার মধ্যেই প্রথিত।
আন্তর্জাতিকভাবে, বেগুনি রঙ মূলত নারীদের প্রতীকরূপে মানা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের সামাজিক এবং রাজনৈতিক নারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বেগুনি, সবুজ এবং সাদা রঙের সংমিশ্রণের সূত্রপাত ঘটেছিল। বেগুনি ন্যায়বিচার ও মর্যাদার প্রতীক। সবুজ আশার প্রতীক। আর সাদা শুভ্রতা, বিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতার প্রতীক বলে মানা হলেও; এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কিত ধারণা থাকায় বর্তমানে এই রঙটিকে আড়াল করে রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস এক যুগ বা দেড় যুগের নয় বরং এক শতাব্দীর ইতিহাস। ১৯০০ শতকের শুরুতে পৃথিবী যখন বদলাতে শুরু করেছিল তখন একইসাথে বদলে গিয়েছিল নারীদের চিরাচরিত প্রথাকে ত্যাগ করা। মধ্যযুগের বর্বরতাকে দূরে ঠেলে সমাজকে অবাক করে দিয়ে শুরু হয়েছিল নারীদের বিশ্বজয়। আর আজকের দিনে নারী বিশ্ব জয় করে পা রেখেছে মহাকাশ জয়ে। তাই নারী দিবসের তাৎপর্যের মতোই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাসও তাৎপর্যমণ্ডিত।
১৯০৮ সাল
উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই নারীদের সকল প্রবঞ্চনা আর অশান্তিগুলো ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর সেসব সমালোচনা ধীরে ধীরে বিতর্কে রূপ নেয়। নারীদের প্রতি এই নিপীড়ন এবং বৈষম্যগুলো নারীদের পরিবর্তনের প্রচারে আরও সোচ্চার এবং সক্রিয় হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করছিল প্রতিনিয়ত।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায় পনের হাজার গার্মেন্টসকর্মী কাজের সময় কমানো, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় মিছিল করে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও পঞ্চাশ বছর আগেই ঘটেছিল। ১৮৪৮ সালে দাসত্ববিরোধী সম্মেলনে নারীদের কথা বলতে নিষেধাজ্ঞার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন এবং লুক্রিয়া মট নিউ ইয়র্ক শহরে দেশে প্রথমবারের মতো নারীর অধিকার বিষয়ক সম্মেলনে কয়েকশ লোককে জড়ো করেছিলেন।
তারা সকলে অনুভূতি এবং সমাধানের ঘোষণাপত্রে নারীদের নাগরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার দাবি করে। আর এভাবেই একটি আন্দোলনের জন্ম হয়।
১৯০৯ সাল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক দল পরের বছর ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সমগ্র দেশব্যাপী জাতীয় নারী দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৩ সালের আগ অবধি নারীরা জাতীয় নারী দিবস (এনডব্লিউডি) ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবারই উদযাপন করতেন।
১৯১০ সাল
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে কর্মজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্লারা জেটকিন (জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দলের একমাত্র নারী নেতা) নামে এক নারী আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণাটি উপস্থাপন করেন সেখানে।
তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, প্রতিবছর এই দিনে প্রত্যেকটা দেশে একযোগে একটা দিবস পালিত হবে – নারী দিবস – যেই দিবসে তারা তাদের দাবি আর অধিকারের কথাগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। সেই সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জনেরও অধিক নারী ছিলেন যাদের মধ্যে- ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক দল, কর্মজীবী নারী ক্লাবের সদস্য এবং ফিনিশ সংসদে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত তিনজন নারী সংসদ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন- যারা জেটকিনের এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয় এবং এভাবেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস তার দিক চিনে।
১৯১১ সাল
বিগত বছরের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯১১ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ প্রথমবারের মতো অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবসে প্রায় এক লাখেরও অধিক নারী এবং পুরুষ আন্তর্জাতিক নারী দিবস শিরোনামের এক র্যালিতে অংশগ্রহণ করে; যেখানে নারীদের কাজ করার, ভোট দেয়ার, প্রশিক্ষিত হওয়ার, সরকারি চাকুরি এবং বৈষম্যতার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করা হয়। তবে এর এক সপ্তাহ পরই ২৫ মার্চ ‘ট্রায়াঙ্গল ফায়ার’ অগ্নিকুণ্ড প্রায় ১৪০ জন কর্মজীবী নারীর জীবন কেড়ে নেয়; যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ইতালিয়ান এবং ইহুদি অভিবাসী। এই বিপর্যয়কর ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজের পরিস্থিতি আর শ্রম আইন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে যা পরবর্তীকালে নারী দিবসের পথ সুগম করেছিল।
১৯১৩-১৯১৪ সাল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শান্তি প্রচারের প্রাক্কালে, রাশিয়ান নারীরা ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার তাদের জন্য প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। ১৯১৩ সালের সেই দিবসেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ স্থানান্তরিত করা হয় এবং তখন থেকেই এটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তী বছরে নারীরা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং মহিলাদের সংহতি প্রকাশের লক্ষে জনসমাবেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ নারীরা ভোটাধিকারের সমর্থনের আশায় বো থেকে ট্রাফালগার স্কয়ার অবধি পদযাত্রা করে।
১৯১৭ সাল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ মিলিয়ন রাশিয়ান সৈন্যের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার রাশিয়ান নারীরা “রুটি ও শান্তির” জন্য ধর্মঘট শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা বিরোধিতা হওয়া সত্ত্বেও নারীরা চার দিন ধরে ধর্মঘট চালিয়ে যান। এবং বাধ্যতামূলকভাবে জার সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। এবং চাপে পরে অস্থায়ী সরকার মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রদান করে। মহিলা ধর্মঘট শুরু হওয়ার তারিখটি ছিল রবিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি। রাশিয়ায় তখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হত। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এই দিনটি অন্য কোথাও মার্চ মাসের ৮ তারিখ ছিল।
১৯৭৫ সাল
আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথমবারের মতো ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়েছিল। তারপরে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলির দ্বারা বছরের নির্দিষ্ট এক দিন নির্দিষ্ট এক দিবস হিসেবে পালিত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের নারী অধিকার ও আন্তর্জাতিক শান্তির দিবস হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
১৯৯৬ সাল
অবশেষে জাতিসংঘ ১৯৯৬ সালে একটি বার্ষিক বিষয় গ্রহণ করে – যা ছিল “অতীত উদযাপন আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা গ্রহণ।” এই বিষয়টিই পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে “উইমেন অ্যাট পিস টেবিল” এবং ১৯৯৮ সালে “উইমেন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস” মহিলা এবং ১৯৯৯ সালে “ওয়ার্ল্ড ফ্রি অভ ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন” গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে তা বছর বছর সংশোধিত হতে থাকে। সাম্প্রতিক বিষয়টি আরও বিস্তৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, “পল্লী মহিলাদের ক্ষমতায়ন”, “দারিদ্র্য ও ক্ষুধার সমাপ্তি” এবং “একটি প্রতিশ্রুতি কেবলই প্রতিশ্রুতি”, “কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতার অবসানে”।
২০০০ সাল
নতুন শতকের আগমন সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কার্যকলাপ স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিশ্ব এগিয়ে গেলেও নারীবাদ তখনো জনপ্রিয় বিষয় ছিল না। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পুনরায় উত্থান দরকার ছিল।
লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবি: সংগ্রহীত