উদ্যোক্তাদের উদ্যোক্তা : আফরোজা পারভীন, রূপ বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা

করেছে Rodoshee Magazine

আফরোজা পারভীন। তিনি রূপবিশেষজ্ঞ, একজন সফল উদ্যোক্তা। নিজের ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অন্য অনেক নারীর সফল ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা করার পেছনে তিনি হয়েছেন সারথি। ব্যক্তিজীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন দৃঢ় মানসিক শক্তি দিয়ে। কথা হলো তার সঙ্গে জানা গেল নানা কথা। কথপোকথনে স্বরলিপি।

অনেক নারীর ক্যারিয়ার গড়ে দিচ্ছে উজ্জ্বলা। আপনার ক্যারিয়ারে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। উজ্জ্বলার বর্তমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

আমি নিজে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার কারণে একজন নারীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা বুঝতে পারি। নিজে যখন কাজ শুরু করেছিলাম, আমি দেখছিলাম আশপাশের কিছু মানুষ আমার কাজকে উৎসাহ দিচ্ছে আবার কিছু মানুষ ‘ও আচ্ছা’ ‘কী টাইপের কাজ’ এই ধরনের কথাবার্তা বলছিল। সমাজের অনেকেই মনে করে, মেয়েরা আর কত দূরই বা করতে পারে। আমার চারপাশের এই পরিবেশ শুরু থেকেই আমাকে ভাবিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বাধা আসছিল। আমি সৌভাগ্যবতী, সেগুলো পার করে আসতে পেরেছি। আমি আমার জায়গা করে নিতে পেরেছি। কিন্তু লাখ লাখ মেয়ে আছে যারা কাজ শুরু করছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। উজ্জ্বলা সেই নারীদের সহযোগিতা করতে হাত বাড়িয়েছে, যারা উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে চেয়েছে।
উজ্জ্বলার যিনি ফান্ডিং চেয়ারম্যান আছেন, তিনি আমার খুব ভালো বন্ধু। তিনি করপোরেট ওয়ার্ল্ড থেকে আমি আমার ওয়ার্ল্ড থেকে নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম ক্রিয়েশন নিয়ে কাজ করব বলেই ঠিক করেছিলাম, সেই অনুযায়ীই কাজ চলছে।

বড় পরিসরে নারীদের নিয়ে কাজ করার ভাবনা যেভাবে এলো

অনেক দূরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন বিডব্লিউসিসি এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েছি, আমি দেখেছি সামান্য একটু প্রশিক্ষণেই একেবারে বদলে যায়। ওরা পরবর্তী সময়ে অনেক ডিমান্ড তৈরি করেছে। এর আগে আমি ব্যাকএন্ডে সারা দেশে মেয়েদের ট্রেনিং দেওয়ার কাজটি করেছি। তখন আমি দেখেছি, বিভিন্ন জেলার মেয়েরা কতটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কত ধরনের ক্রাইসিস তাদের হচ্ছে। সেগুলো দেখার পর আমার মনে হয়েছে, মেয়েদের জন্য এমন একটা জায়গা দরকার, যেখানে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা এবং টিকে থাকার জন্য সাপোর্ট সিস্টেমটা পেতে পারে।
নিজেরা লিটারেলি পড়াশোনা করে, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে, পরিসংখ্যান চালিয়ে ঠিক করলাম সেক্টর ওয়াইজ এডুকেশন জরুরি। একজন উদ্যোক্তার জন্য প্রপার এডুকেশন, ব্যাংকের হেল্প বিশেষভাবে দরকার। এসব জায়গায় উদ্যোক্তাদের সাপোর্ট দিচ্ছে উজ্জ্বলা।

পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা

টোটাল চারটি সেক্টর নিয়ে কাজ করব। একটা হলো আমরা এখন যেটা করছি বিউটি অ্যান্ড গ্রুমিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করছি। সামনে হেলথ, হসপিটালিটি এবং রিটেইল সেক্টর নিয়ে কাজ করব।

ক্যারিয়ার যেখানে থমকে যেতে পারত

১৬ বছরের সংসার ভেঙে যাওয়ার পর সন্তান এবং প্রতিষ্ঠানকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। আমার মূল আত্মশক্তির জায়গা হচ্ছে আমার পরিশ্রম। আমার পরিশ্রমই আমাকে শক্তি দেয়। কাজের মধ্যে ডুবে হানড্রেড পার্সেন্ট ফলাফল বের করে নিয়ে আসতে চাই। আর যখন আমি দেখি একটা কাজে এফোর্ট দেওয়ার পরে হানড্রেডের ওপরে ফলাফল আসছে, তখন আমার মনের সাহস অনেক বেড়ে যায়। অনেক প্রতিকূলতা তো প্রত্যেক মানুষের জীবনেই আসে। আমার কাছে প্রতিটা বিপদ, প্রতিটা বাধা একেকটি শক্তি হয়ে এসেছে। কারণ, আমি সেগুলোকে পজিটিভলি নিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, সামনে আরও স্ট্রংলি এগিয়ে যেতে হবে। ওই কঠিন সময়টাতে আমি নিজেকে প্রতি মুহূর্তে পজিটিভলি বদলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।

ডিভোর্সের পর সন্তানকে নিজের কাছে রেখেছেন। সেই কঠিন মুহূর্তে সন্তানকে কীভাবে সামাল দিয়েছেন?

আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। আমি তাকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ভিন্ন বাসায় চলে এলাম। আমার সন্তান মানসিকভাবে ইনসিকিউরিটির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আমাকে তো কাজে বের হতে হতো, এমনও হতো ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করত। ছাড়তে চাইত না। ওকে আমার মা-বাবার কাছে রেখে ঘর থেকে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যেতাম। অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমার কষ্টটা কমে যেতে থাকত। কাজ শেষ করেই আমি ফিরে যেতাম আমার সন্তানের কাছে। অনেক সময় কাজের মাঝে একটু সময়ের জন্য বাসায় ফিরতাম।
সারা দিনে কোনোভাবে যদি আমি দুই ঘণ্টা সময়ও পেতাম, বন্ধুু গ্রুপকে ডেকে আমার সন্তানসহ ওদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। সিঙ্গেল হয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার সন্তানের জন্য এমনভাবে সময় কাটিয়েছি যে আমারও সময় ভালো কেটেছে, আবার আমার সন্তানও ওর অনেক ধরনের খারাপ লাগা ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ওই সময় একজন কাউন্সেলরের পরামর্শ গ্রহণ করেছি। প্রতিদিন তার সঙ্গে কথা বলে আমি আমার সন্তান সম্পর্কে কী করব- কী করব না সেই ডিসিশন নিতাম।

আর্লি ম্যারেজ হওয়ার কারণ কী, বিয়েটা কি পরিবারের ইচ্ছায় ছিল?

না। প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর হঠাৎ একদিন বললাম ‘চলো বিয়ে করি’। এরপর সেও রাজি হয়ে গেল। বন্ধুরা সহযোগিতা করেছিল। এক এক করে চারটি কাজি অফিস আমাদের বিয়ে পড়াতে পারবে না বলে না করে দিয়েছিল। পঞ্চম কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করি। এরপর যে যার বাসায় চলে যাই। বিয়ের পর চার বছর পর্যন্ত আমরা যে যার বাসাতেই ছিলাম। এরপর পরিবার থেকে বিয়েটা মেনে নেয়। বিয়ের ১৬ বছর পর মনে হলো, আলাদা হওয়া দরকার। মানসিকতার দ্বন্দ্ব মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরে সেপারেশন নিলাম। কাজে আরও বেশি ডুবে গেলাম।

এখন জীবন যেমন

কাজ আমাকে ছেড়ে কখনো যায়নি, আমিও কাজ ছেড়ে দিইনি। ডিভোর্সের পর পাঁচ বছর সিঙ্গেল ছিলাম। এরপর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেছি। জীবনসঙ্গী হয়ে এখন যে এসেছে, আমি মনে করি সে আমার জন্য এবং আমার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
অদম্য কর্মশক্তির উৎস
সামান্য একটি ট্রেনিং নিয়ে যখন কোনো নারীকে বদলে যেতে দেখি, সফল হতে দেখি, তখন আমার কাজ করার ইচ্ছা আরও বেড়ে যায়।

সফলতার মানে

সফলতা মানে আমার কাছে ‘স্বস্তি’। যখন আমি জানব কোন দিকে যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি- যখন জানব যেখানে পৌঁছেছি সেটা ঠিক আছে। রিল্যাক্স মনে হবে। সেই তো সফলতা। নিজের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করে তার পাশে দাঁড়িয়ে স্বস্তিবোধ করাই তো সফলতা।

ছবি : আফরোজা পারভীনের সৌজন্যে

রোদসী/আরএস

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

3 × three =