‘ঘরের কাজগুলো ভাগাভাগি হওয়া দরকার’

করেছে Suraiya Naznin

কর্মজীবি নারীর প্রধান সমস্যা হলো অফিস সামলেও তাকে ঘরের কাজ করতে হয়। ঘরের কাজগুলো ভাগাভাগি হলেই নারীরা আরো অনেক বেশি নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাবে বলে আমি মনে করি এভাবেই বলছিলেন নেক্সাস টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নির্মাতা জাকিয়া সুলতানা– তিনি নারী দিবসে রোদসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুরাইয়া নাজনীন

ক্যারিয়ার শুরু করার সেই সময়ের গল্প যেমন ছিল

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে মাস্টার্স করে ২০০৬ সালে বৈশাখী টিভিতে সহকারী প্রযোজক হিসাবে কর্মজীবন শুরু হয়। সম্মান ও সফলতার সাথে এখন পর্যন্ত কাজ করে যা”িছ। প্রযোজনার পাশাপাশি সরাসরি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা হয়।

জীবনের প্রতিবন্ধকতা ছিল কী? থাকলে তা কেমন আর কিভাবে সেগুলো অতিক্রম করা হয়েছে?

আমাদের সমাজে নারীর যে অবস্থান সেই জায়গা থেকে বলতে গেলে আমি খানিকটা প্রিভিলেজড। আমার পরিবারে নারী হিসাবে আলাদাভাবে ট্রিট করেনি কেউ কখনও আর বিয়ের পরও আমি ততটাই সুবিধা পেয়েছি যতটা বিয়ের আগে পেতাম। তবে নারী হিসেবে সামাজিক ঘেরাটপগুলো আমাদের মগজে প্রথিত থাকে বলে কিছুক্ষেত্রে আমরা পিছিয়েই থাকি। সন্তান জন্মের পর আমার কর্মবিরতি ছিল। বাচ্চাকে টেক কেয়ারের জন্য নির্ভরযোগ্য অবস্থা না থাকায় কর্মবিরতি নিতে হয়। যদিও আমি সেসময়টাকে আমার উচ্চশিক্ষায় কাজে লাগাই।

নারী হিসেবে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঘরে ও বাইরে?

কর্মজীবি নারীদের প্রধান সমস্যা হলো অফিস সামলেও তাকে ঘরের কাজ করতে হয়। ঘরের কাজগুলো ভাগাভাগি হলেই নারীরা আরো অনেক বেশি নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাবে বলে আমি মনে করি। আর অন্যদিকে অফিসে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তাকে পুরুষ সহকর্মীর চাইতে বেশি কাজ করতে হয় নারীদের। আবার নারীরা অফিসে ভালো করলে বাহবার বদলে পুরুষ সহকর্মীরা তার মনোবল ভেঙে দিতে চেষ্টা করে নানাভাবে। আমাদের দেশে এখনও কখনও কখনও পুরুষের চাইতে কম বেতন দেয়া হয়। নারী-পুরুষের বৈষম্যের কারণে বেসরকারি সংস্থায় সমান যোগ্যতা থাকার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর বেতন পুরুষের বেতনের চেয়ে কম। আবার এক অফিসে নারী ও পুরুষ কর্মকর্তা একই পদমর্যাদার হলেও অধস্তনেরা পুরুষ কর্মকর্তাকে যতটা মানেন, নারীর ক্ষেত্রে ততটা না। রাস্তাঘাটে যানবাহন সমস্যা তো রয়েছেই। সবমিলিয়ে নারীর জন্য এখনও আমাদের সমাজব্যবস্থা সহনশীল অবস্থায় পৌঁছায়নি। তাই পরিবেশ ও মানসিকতার বদল হওয়া জরুরী।

নারীর আত্মনির্ভরশীলতার সঙ্গা কি?

আমাদের দেশের নারীরা নিজের মতের গুরুত্ব না দিয়ে বাবা-ভাই-স্বামীর হাত ধরে জীবন পার করে দেয়। কিন্তু সময় বদলেছে। নারীর আত্মনির্ভরশীলতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আত্মনির্ভরশীলতা মানে নিজের ওপর নির্ভরশীলতা। একজন নারী যখন অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেই নিজের অবস্থান তৈরি করেন, তার চাহিদা মেটান, তার পছন্দমত স্বা”ছন্দ্যে চলতে পারেন সেটাই আত্মনির্ভরশীলতা।

 

নারী আত্মনির্ভরশীল হতে হলে কি কি থাকা দরকার বলে মনে হয়?

আত্মনির্ভরশীলতা হলো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। প্রথমত নারীশিক্ষা জরুরী এরপর তাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারী অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। একজন মানুষ তার নিজস্ব শক্তি ও আত্মনির্ভরশীলতা থেকেই নিজের স্বাধীনতা অনুভব করে। শুধুই সংসার ও পরিবার প্রতিপালনে নারী কখনোই সুখী হতে পারে না, কারণ চাকরিটা তাঁর কাছে যতটা না আর্থিক প্রয়োজনের, তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকাশের পরিচিতির। তাই নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়া জরুরী। আত্মনির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে যেকোনো অসুবিধাকে জয় করা যায়।

নারীর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পেছনে সমাজ ও পরিবারের কি কি করনীয় আছে?

আমাদের পরিবার থেকে কন্যা সন্তানদের এভাবেই গড়ে তোলা হয় যে, বিয়ের পর নারীদের প্রধান এবং একমাত্র অবলম্বন স্বামী। স্বামীই তাদের সর্বস্ব, স্বামীই দেবতা। কিš‘ বর্তমান নারীরা ঘরের বাইরেও নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। দেশ ও দেশের বাইরেও তাদের সমান বিচরণ। তবু মান্ধাতা আমলের প্রথা থেকে তারা মানসিকভাবে এখনও বের হতে পারেনি। আসলে নারীদেরকে এই অবস্থা থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। তাই নারীরা পরিবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে; তাদের নির্ভরশীল করে তোলা হয়। শিশুকাল থেকেই একজন ছেলে সন্তানকে যতটা বহির্মুখী করে গড়ে তোলা হয়, কন্যাসন্তানকে ততটা অন্তর্মুখী। এভাবে নারীরা শৈশব থেকে এত বেশি ঘরমুখো হয় যে, তাদের নির্ভরশীলতাও মজ্জাগত হয়ে পড়ে। তাই নারীরা বাবার বাড়িতে যেমন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বাবা-ভায়ের দেখানো পথে চলে, তেমনি জীবন পরিচালনা করতে আরও একটু বাড়তি সংযোজন ঘটে স্বামীর পরিবারে এসে। হুট করে বিপ্লব ঘটিয়ে নিজের অধিকার বা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা নারীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যুগ যুগ ধরে যে নিয়মের বেড়াজাল তৈরি হয়েছে পরিবার ও সমাজে তার বদল ঘটতে হবে সমাজ থেকেই। সমান মর্যাদায় গড়ে তুলতে হবে কন্যা ও পুত্র সন্তানকে। শিক্ষার সমান পরিবেশ দিতে হবে। তাহলেই পরিবর্তন আসবে হয়তো।

চাকরি কিংবা ব্যবসা যাই হোক পরিবারের সাপোর্ট কতটুকু দরকার?

পুরোটাই দরকার। পরিবারের বাইরে গিয়ে কাজ করা ভীষণ কষ্টসাধ্য। পরিবারের সবার সহযোগিতা পেলে তার জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যায়। আর নারীরা কাজ করার ফলে অর্থনৈতিক সুফল তো সবাই ভোগ করবে তাই সহযোগিতাটা খুব প্রয়োজন।

চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের ভূমিকা ও টিকে থাকার লড়াই সম্পর্কে জানতে চাই

শুরুতেই বলেছি, আমি অন্য অনেকের চাইতে বেশ সাপোর্ট পেয়েছি তাই আমার চ্যালেঞ্জ খানিকটা কমই ছিল । পরিবারে মানুষের বাইরের কথা যদি বলি তাহলে বলবো আমি যে বিষয়ে পড়ালেখা করেছি তখন শুনতে হতো নাটক বিষয়ে পড়ে কী করবো, ক্যারিয়ার কী হবে ইত্যাদি। আমি যে সময়ে জবে জয়েন করি তখন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ভরপুর সময়। রেজাল্ট বের হবার আগেই চাকরী পেয়ে যাই তাই বেকার থাকতে হয়নি। মিডিয়ার কাজটা অন্যান্য অফিস জবের মত না। আমি একজন অনুষ্ঠান নির্মাতা। আউটডোরে শুটিং থাকে, সরাসরি অনুষ্ঠান থাকে ফলে সেই সময়গুলো মেইনটেইন করতে হয়। একটু তো পরিশ্রম হয় কিš‘ আমি বলবো সৃষ্ঠির একটা আনন্দ শেষমেশ পাওয়া যায়।

একজন গনমাধ্যমকর্মী হিসেবে অন্য নারীর অনুপ্রেরণার জায়গা নিশ্চয়ই?

গনমাধ্যমে কাজ করার ফলে এর কন্টেন্ট নির্মাণ করতে নিজেকে হতে হয় বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। গবেষণা থেকে শুরু করে পান্ডুলিপি তৈরি, উপস্থাপন সম্পাদনা, পরিচালনা। আবার একটি টিম পরিচালনা করার দক্ষতা ও সকলের সাথে মানিয়ে চলার একটা যোগ্যতা তৈরি হয়। নানা ধরনের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ যেমন রয়েছে তেমনি নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গের জীবনযাপন সবকিছুর সাথে একাত্মতার ফলে গনমাধ্যমে কাজ করা মানুষটি একজন শুদ্ধ ও রুচিশীল মনন লাভের সুযোগ পায়। একজন শুদ্ধ, সুচিন্তার মানুষই পারেন সমাজে পরিবর্তন আনতে। নারী উন্নয়নে নারীর আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিতে আমরা নির্মান করছি নারীদের মন খুলে কথা বলার একটি প্ল্যাটফর্ম লেডিস ক্লাব। এখানে বিভিন্ন শ্রেনি পেশার নারীদেরকে তাদের কাজ সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। গৃহিনী থেকে শুরু করে সবাই এসে কথা বলার সুযোগ পায় ফলে তাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তুমিই প্রথম অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের প্রথম নারীদের জীবনযাপন, প্রতিবন্ধকতা, সফলতা তুলে ধরা হয় যা অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার। অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসাবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই ভালো মানের অনুষ্ঠান নির্মাণের প্রতি মনোযোগ থাকে। নির্মাতা হিসাবে নারীরা খুব কম কাজ করেন। সৃজনশীল এই পেশায় সৃষ্টির আনন্দ রয়েছে।

নারীকে স্বাবলম্বি হতে চাকরী না ব্যবসা? কোনটা বেশি সহজ করে

আমাদের দেশে নারী শিক্ষা বৃদ্ধির সাথে সাথে নারী চাকরিজীবীর হার বেড়েছে। তবে প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবীদের মধ্যে নারী এখনো অনেক কম। এর কারণ উচ্চশিক্ষার অভাব। এছাড়া নারী দীর্ঘসময় চাকরিতে টিকে থাকে না। বিবাহিত নারীর চাকরিজীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতারকতার মধ্যে পড়তে হয়। অনেককেই সন্তান জন্ম বা প্রতিপালনের জন্য স্বামীর জোরাজুরিতে চাকরি ছাড়তে হয়। বদলির কারণেও অনেক নারী হয় চাকরি ছাড়েন, না হয় দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন। অনেকে চাকরির অনুমতি পান এ শর্তে যে তাঁর বেতনের পুরোটাই স্বামীর হাতে তুলে দিতে হবে। এত সব হতাশা নিয়ে চাকরি করতে গিয়ে নারীদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় আর দিনের বেশির ভাগ সময় অসš‘ষ্টির মধ্যে কাটিয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসু¯’ হয়ে পড়েন তারা। এমনকি আমাদের দেশে এখনো কোনো কোনো অফিসে নারীর জন্য আলাদা প্রক্ষালন কক্ষের সুবিধা নেই। সন্তান পালন বা নানাবিধ কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী ঝরে পড়ে। সংসার সামলানো একটা বড় দায়িত্ব হলেও এর অর্থনৈতিক কোন মুল্যায়ন নেই তাই ব্যবসা একটা ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক নারী উদ্যেক্তাদের জন্য লোনের সুযোগ দিচ্ছে। ব্যবসা হতে পারে নারীর আত্ম কর্মসংস্থানের ভালো একটা ক্ষেত্র। এতে বাড়ির সংস্পর্শে থেকেই ঘর বাহির দুইই সামলানো যাবে।

এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নারী-পুরুষের সমতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি’ এ বিষয়ে কিছু বলুন

ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট ভিত্তিক নানা কর্মকান্ডে নারীরা পিছিয়ে নেই। করোনাকালীন সময়ে ই কর্মাসে নারীর অগ্রগতি চোখে পরার মতো। তারা যেমন আত্মনির্ভরশীল হয়েছে তেমনি পরিবারের পাশে থেকে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো বেশি জোরদার করেছে নারী। সামনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে সফল করতে হলে নারী পুরুষ সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে; ডিজিটাল যুগের সাথে সমানভাবে দক্ষ হতে হবে নারী পুরুষ সকলকে।

সমাজের কথিত দৃষ্টিভঙ্গি আছে নারী মানেই না পারার দলে’ তাই কী?

নারী মানেই এক শক্তির আধার। একজন নারী প্রকৃতিগতভাবেই ধারণ করার শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যে জন্ম দিতে পারে তার পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা। আর প্রয়োজন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তাহলেই দেশের অগ্রগতি দ্রুত সম্ভব। নারীদেরকেও দৃঢ় মনোহল রাখতে হবে। আমি নারী আমি সব পারি নিজের প্রতি এই বিশ্বাস রাখতে হবে।

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

one × 4 =