চায়না জার – ইশরাত জাহান ঊর্মি

করেছে Wazedur Rahman

ইশতিয়াকের কথা

শোনো তৃষা, আমার খুব জানার ইচ্ছা তোমার কিসের এত অহংকার? অথবা এত এত অবহেলা তুমি আমাকে করার সাহস কী করে পাও? অথবা তুমি খুব দুঃখী? কেন? তোমাকে কী দিইনি আমি? আমার থেকে কী দুঃখ তুমি পেয়েছ বলো? আমি প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে এই কথাগুলোই ভাবি। ফ্রি থাকলেই ভাবি। ভাবি আর আহত হই। আমার আহত মুখ, আহত ভেতরটা তোমাকে কখনো পোড়ায় না। আমি অবশ্য সব সময় আহত মুখ দেখিয়ে বেড়াই না। বউয়ের আঁচল ধরা পাওনি আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে থাকা কি পুরুষের জন্য খুব সম্মানের? আমি তো তোমার কোনো অভাব রাখিনি!

তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আমার। আমাদের পরিবারের সবার। তুমি অনিন্দ্যসুন্দরী। পড়ালেখায় ভালো, সভ্য। আমার বাবা-মা, ভাইবোন, চাচা, ফুফু-খালা সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করল। তুমিও সবাইকে খুব ভালোবাসলে। সবাইকে আপন করে নিলে। আমাকেও তোমাদের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে। এখনো তোমাদের বাড়িতে মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে সবাই যতটা সম্মান কওে, তা এমনি এমনি আসেনি। তা আমি অর্জন করেছি। তোমার বাবা-মাকে আমি ঠিক ততটাই সম্মান-শ্রদ্ধা করি, যেমনটা ওরা আমাকে ভালোবাসে। কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু দিন গেল আর তুমি আমার থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে। আমি অনেক ভেবেও এর কোনো কারণ খুঁজে পাই না। ছোটখাটো সমস্যা স্বামী-স্ত্রীতে হয়। পৃথিবীর সব স্বামী-স্ত্রীতেই হয়। কাদের মধ্যে হয় না? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী কি সুখী ছিলেন? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম আমি জানি না কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা কি স্বীকার করতেন যে রবিঠাকুর খুব রোমান্টিক ছিলেন? জগৎজোড়া রোমান্টিসিজমের জন্য বিখ্যাত কবি তো শুনেছি তার বৌদির সঙ্গে পরকীয়া করতেন! বেশি রোমান্টিক পুরুষেরা এমনই হয়। আমি জানি আমার প্রতি তোমার অভিযোগ আছে যে আমি রোমান্টিক নই। আমি সত্যি, অত সব ইয়ে জানি না। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি তৃষা। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকেই ভালোবাসি না।

হ্যাঁ, আমার একটু রাগ বেশি। রেগে গিয়ে হয়তো অনেক সময় উল্টোপাল্টা বলি। কিন্তু সেটা কি আমার মনের কথা? বলে কি আমি নিজে শান্তি পাই? তোমার সঙ্গে ঝগড়া হলেই কি আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের ওপর প্রতিশোধ নিই না? আমার একটা সমস্যা আছে, আমি সহজে সরি বলতে পারি না। সে তো আমি আমার মাকেও বলি না। মাকে কি আমি কম কড়া কথা বলি? কই মা তো তোমার মতো রাগ করে, অহংকার দেখিয়ে দূরে থাকে না। তাহলে তুমি কেন পারো না? মা যদি পাওে, তুমি কেন পারো না তৃষা? আমি তোমার সঙ্গে কী করেছি বলো তো? কোনো দিন তোমার গায়ে হাত তুলেছি? আমি কেন, আমার চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ বউ পেটায়নি।

তোমাকে কোনো দিন রাগ করে বলেছি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও? কত শিক্ষিত লোকই তো শুনি বউকে খানকি বেশ্যা বলে গালি দেয়, আমি কোনো দিন এসব বলেছি তোমাকে? যখনই রাগারাগি করে দু-একটা গালি দিয়েছি, রাগ পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সরি না বললেও তোমার মন রাখতে নানান চেষ্টা করেছি। তুমি শাড়ি খুব পছন্দ করো, আমি রাগ ভাঙলেই টুক করে শাড়ি কিনে তোমাকে দিয়েছি। তুমি কোনো দিন হাসিমুখে সে উপহার গ্রহণ করোনি তৃষা। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেছি। তোমার কোনো অভাব-অভিযোগ রাখিনি। তোমাকে এত বড় বাড়িটা দিয়েছি। মা-বাবা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, তবু একটা ফ্ল্যাট আমি তোমার নামে করেছি, বলেছি ফ্ল্যাটের ভাড়া তুমিই তুলবে, তোমার মতো করে খরচ করবে।

তুমি হিসাবে খুব কাঁচা, তাই মাঝেমধ্যে হিসাবটা চেয়েছি। সে তো তোমার ভালোর জন্যই। আমার যা কিছু সম্পদ তা তো তুমিই ভোগ করবে। তাই তোমার বেহিসাবি স্বভাব মাঝেমধ্যে আমাকে চিন্তায় ফেললে আমি হিসাব চেয়েছি, এর বেশি কিছু না। একটা লাল রঙের গাড়ি আমি তোমার জন্য দিয়ে রখেছি। সর্বক্ষণ। মাকেও গাড়ি নিতে হলে আমার অনুমতি নিতে হয়, তোমার জন্য একজন ড্রাইভার বরাদ্দ রেখেছি। তৃষা, আমি একজন সুস্থ-সবল পুরুষ। আর কোনো নারীর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু ঠিক কত দিন তোমার-আমার মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই, সেটা কি তোমার মনে আছে? হ্যাঁ, আমি সেক্স লাইফের কথাই বলছি। তুমি আমার সঙ্গে শোও না।

আমি অন্য পুরুষদের মতো জানোয়ার নই যে তোমার ওপর জোর খাটাব, জোর করে স্ত্রী ধর্ষণ করব। কিন্তু কেন তুমি এত শীতল তৃষা? আমি কি তোমাকে তৃপ্ত করতে পারি না? আমি মনোচিকিৎসকের সঙ্গে গোপনে কথা বলেছি তোমার এই শীতলতা নিয়ে। ডাক্তার বললেন, তুমি আর কারও সঙ্গে এনগেজ কি না খোঁজ নিতে। খোঁজ নিয়েছি। তেমন কিছু পাইনি। তবে ঠিক কি হয়েছে তৃষা তুমি আমাকে বলবে? বিয়ের ছয় বছর কেটে গেল, বাড়ির সবাই এত চাপ দিচ্ছে বাচ্চা নেওয়ার জন্য অথচ তুমি বাচ্চা নেবে না। আমি কী করেছি তুমি আমাকে বলবে প্লিজ? তৃষা, আমার কোমল হৃদয় ভেঙো না। ডোন্ট ব্রেক মাই চায়না জার তৃষা। ডোন্ট ব্রেক।

তৃষার কথা

ইশতিয়াক, বিয়ের দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিন আমার ঠিক মনে নেই। তখনো রিসেপশনের অনুষ্ঠান হয়নি। রিসেপশনের পরদিন আমরা নেপাল যাব। হানিমুনে। আমি কী খুশি! নতুন পেয়েছি না হলেও শখানেক শাড়ি। শাড়ি-গয়না পরে নতুন বউ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের বাড়ি থেকে আমার মা একটা দশ-বারো বছরের মেয়েকে দিয়েছিল আমার ফাই-ফরমাশ খাটতে। মেয়েটা এসেই কান্নাকাটি। গ্রামের মেয়েদের যা হয় আরকি। এ বাড়ির যতই চাকচিক্য থাকুক না কেন, সে বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। বিয়েবাড়ির সবাই খুব বিরক্ত। তুমিসহ তোমার বাড়ির কেউ মেয়েটার সঙ্গে আদর করে কথা বললে না। আমার অলংকারের ঝনঝন শব্দের ভেতরেও একটু যেন কাঁটা মিশে রইল। এর মধ্যেই মেয়েটা হাত থেকে অসাবধানে ফেলে একটা তরকারির বাটি ভেঙে ফেলল।

সাধারণ তরকারির বাটি। তোমার মা মেয়েটার কান বরাবর সপাটে চড় লাগালেন। তুমি কিছুই বললে না, যেন কিছুই হয়নি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুপুরে তোমরা আমাকে খুব যত্ন করে খাওয়ালে। আস্ত মুরগির রোস্ট, সেই মুরগির পেটে মসলা মাখানো ডিম। আমি কোনো খাবারের স্বাদ পেলাম না। আমরা পরদিন নেপাল গেলাম। প্লেনে আমার কানে ফিসফিসিয়ে কত কী বললে তুমি। আমার কিন্তু কিছুই ভালো লাগল না। বারবার শাপলা মানে ওই মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। না আমি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্রের মৃণালিনীর মতো সাহসী নই। তাই শাপলাও আমাকে মৃণালিনীর মতো ঘরের বাহির করেনি। কিন্তু বিয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকেই কানের নিচে একটা চড়ের অপমান নিয়ে আমি সংসার শুরু করলাম।

এরপর কত দিন গেছে। কখনো কখনো ঝগড়ার পর শান্তভাবে আমরা কথা বলতে শুরু করলে অনেকবার শাপলার ঘটনাটায় যে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, তা বলার চেষ্টা করেছি। তুমি হেসে উড়িয়ে দাও। বলো, কবে কোন কাজের মেয়েকে কী বলা হয়েছে সেইটা তুমি ধরে বসে আছো? ইশতিয়াক, সমাজসংসারের বিচারে তুমি খুবই ভালো মানুষ। আমাকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছ। আত্মীয়স্বজন সবাই আমার ভাগ্যে আনন্দিত, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত। টাকাপয়সার অভাব নেই, বিলাসী জীবনযাপন করি। সবাই বলে, তৃষার তো অমনই হওয়ার কথা ছিল, অত সুন্দরী। কিন্তু তোমার এই সব ‘দেওয়া’র ভেতরে আমি একটা বৃত্ত টের পাই।

আমি জানি কতটুকু আমার সীমা, আমি জানি আমার স্বাধীনতা তোমার পকেটে। তুমি মোটা দাগে খুব ভালো মানুষ। আমি ছাড়া কোনো নারীর প্রতি তোমার কোনো আসক্তি নেই। কিন্তু ধরো কোনো দিন আমরা একসঙ্গে একটা সিনেমা দেখিনি, কোনো দিন একটা কবিতা পড়িনি। তোমার এসব ভালো লাগে না। কোনো দিন একটা বৃষ্টি বা জোছনার রাত আমরা একসঙ্গে উপভোগ করিনি। তুমি অত প্রকৃতিপ্রেমিক না। কিন্তু আমি তো তাই। আমার জন্যও তুমি কখনো এসব করোনি। তোমার মনেই আসেনি আমি কী চাই! কিন্তু স্বামী কবিতা পড়ে না বা জোছনা দেখে না এই অপরাধে তো তাকে ত্যাগ করা যায় না! তুমি ভালোবাসা বলতে বোঝ প্রতি রাতের শরীরী সম্পর্ক। ‘লাভ মেকিং’ বলে যে একটা শব্দ আছে, ক্রিয়া আছে, তা-ই তুমি জানো না।

সবচেয়ে বড় কথা ইশতিয়াক, তুমি আমার ভাষা বোঝো না। তোমার প্রেম আর পৌরুষ বা মর্দামিকে এক করে ফেলা ভালোবাসা আমি নিতে পারিনি। দিনে দিনে তাই শরীরের আগ্রহ কমেছে। শাপলার মতো বা শরীরের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ফলাফল আমাদের আজকের অকার্যকর সম্পর্ক। আমি জানি তুমি এসব বুঝবে না। আমিও বুঝিয়ে বলতে পারব না। নারীর সেন্সিটিভিটি এক অদ্ভুত ব্যাপার। পুরুষেরা সেসব কখনো বুঝতে শেখেনি। নারীর কান্নার অনুবাদ পুরুষেরা করতে জানে না। সেই যে শাপলাকে তোমার চড়া গলার ধমক আর তোমার মায়ের চড়, সেই ধমক আর চড়েই ভেঙে গিয়েছিল সুদৃশ্য চায়না জার-আমার সেন্সিটিভিটি। তুমি আমার কোমল হৃদয় ভেঙেছ ইশতিয়াক। ইউ ব্রেক মাই চায়না জার। ইউ ব্রেক।

অলংকরন: শাহরিন

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

fifteen + two =