নব্বইয়ের দশকে লেখালেখিতে হাতেখড়ি। ছাত্র অবস্থায় ‘চলতিপত্র’তে ফিচার লিখতেন। সেখান থেকেই সাংবাদিকতায় প্রবেশ। ক্যারিয়ারের সামনে দেয়ালও এসেছে। কিন্তু একেবারে থামেননি। রক্তের সঙ্গে প্রেস কথাটি জড়িয়ে আছে বলে জানান কালের কণ্ঠ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী কাকলী প্রধান। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজাদুল ইসলাম সাফা।
মজার কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?
মজার অভিজ্ঞার শেষ নেই। প্রথম দিকে প্রত্যন্ত এলাকায় কাজে গেলে সবাই ভাবত আমি বিদেশি। কালো চামড়া, আবার বিদেশি এটা নিয়ে দ্বিধায় থাকত। অনেক সময় আমাকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করেছে, কী শব্দ করি। গ্রামের মানুষ যতটুকু ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করত আমি কোন দেশের? কাজে সুবিধার জন্য বলেও দিতাম বিদেশি। এতে সুবিধাও পেতাম। কাজ শেষে সত্যিটা জানাতাম।
টিভি ক্যামেরায় কাজের ইচ্ছে জাগে না?
ইদানীংকালে সিনেমা বানানোর খুব শখ জেগেছে। ছোটবেলায় ভূত চেপেছিল সিনেমা বানাব। গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে নেশাটা আবার জেগেছে। তাই ভিডিওগ্রাফিটা জানা থাকলে ভালো হতো। এখন মনে হয় শিখি।
ছবি তোলার সঙ্গে কীভাবে মিশে গেলেন?
২০০৪ সালে নিজের ক্যামেরা নিই। তার আগে বাবার ক্যামেরাই ভরসা। বাবারও ছবি তোলার শখ ছিল। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে ছবি তুলতেন। বাবা পিকনিকবাজ ছিলেন। সব সময় ফুর্তিতে থাকতেন। তার চার-পাঁচটা ক্যামেরা ছিল। পরিবার-বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে তা দিয়ে ছবি তুলেছি। পোর্ট্রেটটা অজান্তেই ভালো হচ্ছে।
এত ছবি তুলতেন, মা রাগ করতেন না?
মা আমাদের মডেল। বাবা মায়ের ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। প্রথম দিকের ছবিগুলো নেই। বন্যায় অনেক ছবি নষ্ট হয়েছে। বাবার স্টাইল, লোকেশন বাছাই, সাবজেক্ট প্রেজেন্ট করা পরবর্তী সময়ে আমার খুব কাজে লেগেছে।
প্রশিক্ষণ ছাড়া সে সময়ের ফটোগ্রাফি, কীভাবে দেখেন?
আমাদের পুরোনো ফটোগ্রাফাররা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা ছাড়াই ভালো ছবি তুলতেন। এখন আমরা অনেকে শিখেও পারি না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকার কারণে আমরা একজন পুরুষ, নারী কিংবা শিশুকে কীভাবে উপস্থাপন করব জানছি। এই সচেতনতার চর্চা আমাদের এখানে খুবই প্রয়োজন।
সংবাদকর্মীদের কি সচেতনতার ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেওয়া উচিত?
অবশ্যই সাংবাদিকদের দায়িত্ব। আমার খুব ইচ্ছা যেখানে কাজ করব, এসবের চর্চা হবে। ফটোসাংবাদিকেরা চিন্তা করবে, আলোচনা হবে। একজন মানুষকে কীভাবে উপস্থান করব সেই জ্ঞানটা ফটোগ্রাফিতে থাকা জরুরি।
অনেক জায়গায় ছুটছেন, পরিবার চিন্তায় থাকে না?
বাবার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ি থেকে কম টেনশনের অভ্যাস। স্বামী প্রচন্ড চিন্তায় থাকে। তবে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সাপোর্ট না পেলে একজন মেয়ে হিসেবে কাজ করা হতো না।
ছোটবেলার স্মৃতির কিছু কথা বলবেন?
শৈশব কেটেছে দিনাজপুরে। এক দুরন্তময় সময়। বড় সীমানাপ্রাচীরঘেরা বাড়ি হওয়ায় বাসায় খেলাধুলার অনেক সুযোগ ছিল। দিনাজপুর থেকেই এসএসসি, এইচএসসি পাস। তারপর ঢাকায় ইডেন কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স।
ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল সাংবাদিক কিংবা ব্যারিস্টার হবো। নিরীহ মানুষগুলো মামলায় হেরে যায়, আমি তাদের জন্য লড়ব। আর সাংবাদিকতায় প্রচুর ভ্রমণের সুযোগ। ছেলেবেলা থেকেই পত্রিকার সঙ্গে বেড়ে ওঠা। আমার রক্তের মধ্যে প্রেস শব্দটা আছে। আমার বাবার প্রেস ছিল। আমরা ধ্বংসের শেষ দেখেছি। প্রেসের যন্ত্রপাতির মধ্যে খেলে বড় হয়েছি।
সাংবাদিকতায় কীভাবে এলেন?
ছোটবেলা থেকেই আমার উড়নচন্ডী স্বভাবের কারণে নানা-দাদার মতো সিনিয়ররা বাবাকে বলতেন, তোর মেয়েকে সাংবাদিক বানাস। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাংলায় গ্র্যাজুয়েশন করেছি। বাংলায় আমি এমনিতেই ভালো। খুবই ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়া না হলে সাংবাদিকতায় পড়ার।
অনার্সে ঢুকে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৯৩ সালে ‘ভোরের কাগজ’-এর তরুণদার সঙ্গে বাংলামোটরে ভোরের কাগজ অফিসে গেলাম। এরপর থেকেই মেলা নামে ফিচার পাতায় কাজ শুরু। সেখাসে অনেক প্রাণময় দিন ও সময় কাটিয়েছি।
ভোরের কাগজে কেমন চ্যালেঞ্জে পড়েছিলেন?
হঠাৎ নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। সুমনা শারমীন আপু (এখন প্রথম আলোয়) নারী পাতা, অন্য পক্ষের জন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। নারী নির্যাতন কাকে বলে? এভাবে রচনার আদলে মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে দিলাম। আপু তো হাসছেন। তারপর বুঝিয়ে দিলেন। এই আমার লেখার যাত্রা শুরু।
লেখার গঠনটা, লেখাটা কত রকমভাবে সুন্দর সম্ভব মেলা পাতার পেজ এডিটর সঞ্জীবদার (গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী) শিখিয়েছেন। আমার লেখার কয়েকটা লাইন এডিট করে দিয়েছিলেন, এই আমার ঘুরে দাঁড়ানো। তারপর আমার হ্যাজবেন্ড তুষার আবদুল্লাহ হাতে ধরে রিপোর্ট লেখা দেখিয়েছে।
তুষার ভোরের কাগজে সম্ভবত ক্রাইম রিপোর্টার ছিল। এরপর ১৯৯৬ সালের দিকে আমি আর তুষার চলে গেলাম চলতিপত্র ম্যাগাজিনে। নিজেদের অজান্তেই পরবর্তী জীবনের জন্যই পা বাড়িয়েছি।
তারপর রিপোর্টিং, সেখানে ছোট্টগল্প অনুকাহনও লিখতাম। সঞ্জীবদা আমাকে মেয়ে বলে ডাকত। তার খুব ইচ্ছে, আমার বাবার কাছ থেকে দত্তক নেবে। সব সময় বলত ‘আমার মেয়ে কী লিখে ফেলল, বাপরে বাপ’। এটা আমাকে খুবই অনুপ্রেরণা জোগাত।
রাগ করে একদিনের নোটিশে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। চলতিপত্র থেকে অন্বেষায়, সেখান থেকে সাপ্তাহিক ২০০০। সাপ্তাহিক ২০০০-এ চিফ রিপোর্টার একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিতে বললেন। আমার ভয়ংকর অভিমান হলো। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম।
ফটোগ্রাফিতে কীভাবে এলেন?
১৯৯৯ সালে সেশনজটে মাস্টার্স হলো। পরপরই তুষারের সঙ্গে বিয়ে হলো। একটা কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দিই। ওখান থেকেও অভিমান করে আসা। তুষার বলল, তুমি ফটোগ্রাফিতে গ্র্যাজুয়েশন করো। পাঠশালায় তিন বছরের কোর্স করলাম। সমকাল পত্রিকা সে সময় আসবে। পোর্টফোলিও জমা দিই। পোর্টফোলিও দেখার সঙ্গে সঙ্গে গোলাম সারওয়ার ভাই তার টিমে নিলেন। ২০০৫ সালে আমার ফটোসাংবাদিকতার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু। সমকালে দুই বছর। তারপর জোর করে সারওয়ার ভাই যুগান্তরে নিলেন। সারওয়ার ভাই যুগান্তর ছেড়ে দিলেন। আমাকেও একটা হলুদ খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছুদিন বসে থাকলাম। ২০০৯ সালে কালের কণ্ঠে যোগ দিই।
নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েননি?
নারী হিসেবে কখনোই সমস্যায় হয়নি। তবে রাস্তাঘাটে আমাদের সহকর্মীরাই মেয়ে হিসেবে সুযোগ নিচ্ছি বলে সমালোচনা করতেন।
কেবলই বিনোদন কিংবা ফিচারের ছবি তুলতেন?
ফিচার সেকশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও মাঠেই থাকতাম। আমার নেশা ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি। নিউজের ছবিও সরবরাহ করতাম। কালের কণ্ঠে আসার পর কাজের পরিধি কমে। প্রায় ১০ বছর হয়ে যাচ্ছে। খুব বেশি ফ্যাশন রিলেটেড হওয়ায় মনে একটু অস্থিরতা। আমার মানসিক গঠনও সেটা না। এই প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে এত বছর। এখানে কাজের পরিবেশও ভালো পেয়েছি।
ফটোগ্রাফিতে এখনকার মেয়েদের কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
খুবই ভালো কাজ করছে। জ্ঞান দিতে চাই না। ক্যামেরা অনেক শক্তিশালী মাধ্যম। তাদের নিজের এবং যন্ত্রটির প্রতি সচেতন হওয়া উচিত। প্রথমেই নিজেকে মানুষ ভেবে কাজে আসো। মেয়েদের কাজের অনেক পরিবেশও সুন্দর হয়েছে।
পরিবারকে কীভাবে সময় দিচ্ছেন?
আমার পরিবারকে আইডল মনে করি। আমার মা সারাদিন সামাজিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তবু পরিপাটি সংসার। হাতের মুঠোয় সংসার কিন্তু উনি সারাক্ষণই ব্যস্ত। পার্টি-মহিলা পরিষদের কাজ নিয়ে চষে বেড়াতেন। ভিকটিম মেয়েদের আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। বাবা জমিজমা নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও আমরা সার্বক্ষণিক কেয়ারিংয়ের মধ্যে বড় হয়েছি। এ জন্যই আমার গঠনটাও এ রকম হয়েছে। যতই কর্মব্যস্ত থাকি, আমার আরেকটা চোখ ঘরেই।