পরাজয়

করেছে Sabiha Zaman

ইমন চৌধুরী

এক.
অনেক দিন বাদে আজ ঈশিতাকে দেখে আমি চমকে উঠি। কত বছর পর ওকে আবার দেখলাম, মনে মনে হিসাব করতে থাকি। প্রায় সতেরো বছর পর! অনেক দীর্ঘ সময়। মাত্র সতেরো সেকেন্ডের ব্যবধানে পৃথিবীতে কত পরিবর্তন ঘটে যায়! আর এ তো সতেরো বছর!
এই এত দিন বাদে বসুন্ধরা সিটির একটি পোশাকের দোকানে ওকে আবার খুঁজে পেলাম আজ। আমি প্রায় মিনিট দশেক ধরে দোকানটিতে ঘুরে ঘুরে টি-শার্ট দেখছি। ছেলেদের পোশাকের একটি পরিচিত ব্র্যান্ডের শোরুম এটি। দশ থেকে বারো জন বিক্রয়কর্মী। ক্রেতার সংখ্যাও নেহাত কম না। সবাই যে যার মতো কেনাকাটায় ব্যস্ত।
ঈশিতা কি আমাকে দেখতে পেয়েছে! এতক্ষণে একবার হলেও দেখার কথা। খুব একটা ভিড় নেই দোকানে। দেখেছে বোধ হয়। তাই হয়তো মাথাটা একটু বেশি নিচু করে এক ক্রেতার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। সেলস গার্লরা সচরাচর চোখে চোখ রেখে ক্রেতার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে। নানান রকম ছল করে ক্রেতাকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত করে। ঈশিতা মাথাটা এত নিচু করে রেখেছে কেন! তার মানে আমাকে হয়তো দেখতে পেয়েছে। সতেরো বছর ধরে আমার শরীর খানিকটা বেড়েছে। কিন্তু চেহারা তো আগেরটাই আছে!
আমি একটা নীল রঙের টি-শার্ট দেখতে দেখতে আড়চোখে ওকে দেখছিলাম। আগের চেয়ে দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে ঈশিতা। শরীরও আগের তুলনায় ভরাট হয়েছে। সেই রোগাটে শরীরের মায়া মায়া চেহারার কিশোরীটি নেই আর। এর মধ্যে পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠেছে।

আমার কি দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত! কিন্তু কেন বের হব! নীল রঙের একটি টি-শার্ট অলরেডি পছন্দ হয়ে গেছে আমার। ওটা আমি কিনতে চাই। ক্রেতা হিসেবে টি-শার্ট কেনার পূর্ণ অধিকার আছে আমার। আমি আমার সেই অধিকার প্রয়োগ করতে চাই।
টি-শার্টটা হাতে নিয়ে আমি ঈশিতার দিকে এগিয়ে আসি ধীরে ধীরে। আমার বুকে কি হাতুড়িপেটার শব্দ হচ্ছে! কত দিন বাদে আবার দেখা হচ্ছে আমাদের! আমি নিজেকে সামলে নিলাম খানিকটা। সতেরো বছর আগের অসংখ্য স্মৃতি আমার চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে ভাসতে শুরু করেছে। একটার পর একটা। আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি স্মৃতির অতল গহিনে।

ঈশিতার বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো। স্কুলপড়ুয়া এক চঞ্চল কিশোরী। আমরা তখন একই শহরে একই পাড়ায় থাকতাম। আমি তখন কলেজে উঠেছি কেবল। আমাদের চার বাড়ি পরই ছিল রায়হান ভাইদের বাড়ি। সেখানে ভাড়া থাকত ঈশিতারা। ওর বাবা পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন। বদলি হয়ে এসেছিলেন আমাদের শহরে। ঈশিতাকে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে দেখতে দেখতে একসময় বুঝতে পারি ওকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।


আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। মিনিট-ঘণ্টার হিসাব থাকত না। প্রিয় কোনো মানুষের জন্য অপেক্ষা কত মধুর হতে পারে, আমার প্রথম যৌবনে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। মফস্বল শহরে হুট করে একটা মেয়েকে ভালোবাসি বলার সুযোগ খুব কম। ছোট শহর। প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। কে কখন দেখে ফেলে এই ভয়ে এমনভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, কেউ দেখলে ভাবত মনে হয় এমনিই দাঁড়িয়ে আছি! অথচ আমার হƒদয়জুড়ে থাকত চুলে দুই বেণির স্কুল ড্রেস পরা এক মায়াবী কিশোরী।
ঈশিতা প্রথম কিছুদিন বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। কিন্তু দিনের পর দিন ওর স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে আমাকে দেখতে দেখতে একসময় বুঝতে পারে, একজন রোজ ওকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। ফেসবুক তখনো আমাদের জীবনে আসেনি। মোবাইল ফোন এলেও হাতে হাতে হয়নি তখনো। বড়রা কেবল ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। আমাদের বন্ধুদের দু-একজন অবশ্য কিনে ফেলেছে তত দিনে। ওদেরটাই নেড়েচেড়ে দেখতাম। আর স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমাদের হাতেও আসবে। তাই রাস্তায় ঈশিতার স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ওই একটু দেখাই ছিল আমার সারা দিনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আমার অক্সিজেন!
আমি ঈশিতার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে থাকি। আমার জীবনজুড়ে তখন ওর প্রবল উপস্থিতি। একদিন স্কুল ছুটির পর বাসায় ফেরার পথে ঈশিতাকে একা পেয়ে সাহস করে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে। খানিকটা দ্বিধা আর খানিকটা আতঙ্ক নিয়ে আমার চিরকুটটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সেদিন দ্রুত পা চালিয়েছিল ঈশিতা। পৃথিবীটা যেন সেদিন আমার হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল!
আমার মনে হলো ঈশিতাও বোধ হয় আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। নয়তো আমার দেওয়া চিরকুট নেবে কেন! কোনো প্রতিবাদই সেদিন করেনি ঈশিতা। খুব বেশি কিছু লেখা ছিল না চিরকুটে। কেবল একটি শব্দ ভালোবাসি! বহুল চর্চিত। অথচ চিরনতুন!
এই একটি শব্দের কাছে পৃথিবীর হাজার হাজার শব্দও যেন অসহায়! ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া মিছিলের উত্তাল স্লোগানের চেয়েও হাজার গুণ বেশি ক্ষমতা এই একটি শব্দের। ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি!


তারপর মাঝেমধ্যেই ঈশিতার স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে একটুখানি কথা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম আমি। মাঝেমধ্যে পেয়েও যেতাম। চারপাশের চেনা-অচেনা দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ ছিল না আমাদের। দু-একটা শব্দ। বড়জোর দু-একটা বাক্য। বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে এক ফোঁটা জলের মতো সেই সব শব্দ আমরা লুফে নিতাম পরস্পর।
বেশ কিছুদিন পর ঈশিতা আমার চিরকুটের জবাব দিয়েছিল আমার মতোই মাত্র একটি শব্দে আমিও! তারপর আমরা দুজন পাখি হয়ে উঠলাম। কল্পনার আকাশে ডানা মেলে উড়তে লাগলাম দুজন।
একবার ঈদের দিন কয়েক আগে ঈশিতা তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে আমার জন্য একটি নীল রঙের টি-শার্ট কিনে পাঠিয়েছিল। সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট নীল টি-শার্টে ভালো লাগে! ঈশিতার এই সব সংক্ষিপ্ত চিরকুট আমার কাছে প্রিয় কোনো লেখকের শত শত পৃষ্ঠার উপন্যাসের চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক ছিল।
কিন্তু বেশি দিন আমাদের এই গোপন প্রেম গোপন রইল না। ছোট্ট মফস্বল শহরগুলোতে যা হয় আরকি! এক কান দুকান হতে হতে আমাদের সম্পর্কের কথা ঈশিতার বাবা-মায়ের কানেও চলে গেল। তারপর আমাদের জীবনে নেমে এল এক গভীর অন্ধকার!
খবর পেলাম ঈশিতার বাবা ওকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছেন! ঈশিতার সেই শরীরের ব্যথা আমি  অনুভব করলাম। কিন্তু আমার পক্ষে কিছুই করার ছিল না তখন। নাকি ছিল! আমি আজও ঠিক নিশ্চিত নই।

এরপর ঈশিতার সঙ্গে আমার কথা বলা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠল। তত দিনে ঈশিতার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এসেছে। স্কুলও ছুটি হয়ে গেছে। আমি কোনোভাবেই ঈশিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমার মনে হলো কোনো অচেনা সড়ক ধরে আমি একাই হাঁটছি মাইলের পর মাইল! যুগের পর যুগ! এক নিঃস্বঙ্গ পথিক আমি! গন্তব্যহীন জীবনের ছোট্ট একটা ব্যাগ আমার হাতে!
বাবা-মায়ের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও একদিন ঈশিতা তার এক বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠাল আমার কাছে। আমার সঙ্গে সে পালিয়ে যেতে চায়! শুনে আমি যতটা পুলক বোধ করলাম, তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হলাম। ওকে নিয়ে কোথায় পালাব আমি! কী খাব আমরা! কীভাবে চলবে আমাদের! আমি তখন কলেজে পড়ি কেবল। পরিবারের বড় সন্তান। নিজেই আমি মায়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-এক শ টাকা নিয়ে হাতখরচ চালাই। আর তিন বেলা বাবার হোটেলে খাই!
আমার পক্ষে কী করে একটি মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব! এ তো আর চাট্টিখানি কথা না! আমি ঈশিতার প্রেমের কাছে হেরে গেলাম। আমি সেদিন প্রেমিক হয়ে উঠতে পারিনি। সবাই প্রেমিক হতে পারে না। কেউ কেউ পারে। আমি তাদের দলে নই। আমি সেদিন যাদের দলে যোগ দিয়েছিলাম, তারা কখনো প্রেমিক হতে পারেনি।
এর কিছুদিন পরই ঈশিতার বাবা বদলি হয়ে পরিবার নিয়ে অন্য শহরে চলে গেলেন। ঈশিতা হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। চিরতরে! আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে!


দুই.
সতেরো বছর পর আজ আবার ঈশিতা ফিরে এল আমার জীবনে। অন্য ভূমিকায়। আজ আমরা আর প্রেমিক-প্রেমিকা নই। আমাদের সম্পর্ক আজ ক্রেতা-বিক্রেতার!
ঈশিতা চোখ তুলতেই আমি জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ?’
জবাব না দিয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল সে। কম্পিউটারের পর্দায় দৃষ্টি স্থির হলো তার। ঈশিতা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না! কেন চায় না! হয়তো অভিমান!
একটু আগেই একজন ক্রেতা বিদায় করেছে ঈশিতা। তার হিসাবটা কম্পিউটারে হয়তো যাচাই করে নিচ্ছে শেষবারের মতো!
কয়েক সেকেন্ড পর আবার চোখ তুলল ঈশিতা। তারপর মৃদু কণ্ঠে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন হাঁকাল, ‘কেমন আছেন আপনি?’
‘আপনি! আমি তোমার কাছে আপনি হয়ে গেলাম!’ বিস্ময়ে টুপ করে আমার চোয়াল ঝুলে গেল খানিকটা।
‘ভুলে যাচ্ছেন কেন, সতেরো বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে!’ সময়ের হিসাবটা আজও ঠিক মনে রেখেছে ঈশিতা।
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলাম। ঈশিতা কি আজও আমার ওপর অভিমান করে আছে! আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘হুম, সতেরো বছর অনেক দীর্ঘ সময়!’
‘একাই শপিং করতে এসেছেন?’ বলতে বলতে দৃষ্টি নামিয়ে নিল ঈশিতা।
‘নাহ আমার স্ত্রীও এসেছে। পাশের শাড়ির দোকানে আছে।’
‘আপনার বিলটা কী করব?’

ঈশিতার কথায় আমি বাস্তবে ফিরি। হাতের টি-শার্টটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হুম। এটার বিল করুন।’ বলতে বলতে আমার হাতের নীল টি-শার্টটা ধরিয়ে দিলাম ঈশিতার হাতে। ওর কি মনে আছে আজ থেকে সতেরো বছর আগে টিফিনের টাকা জমিয়ে ঈশিতা আমাকে একটা নীল রঙের টি-শার্ট কিনে দিয়েছিল! আর বলেছিল, নীল রঙের টি-শার্টে আমাকে ভালো দেখায়!
বেমক্কা পেছন থেকে রূপার কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘দেখি কী কিনেছ?’ বলতে বলতে প্রায় ছোঁ মেরে ঈশিতার হাত থেকে টি-শার্টটা কেড়ে নিল রূপা। টি-শার্টটা একনজর দেখেই বলল, ‘তোমার কালার সেন্স খুব খারাপ, এটা কি তুমি বুঝতে পারো? ব্লু কালারে তোমাকে খুব বাজে দেখায়!’
আমি বোকার মতো রূপার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। টি-শার্টটা নিয়ে রূপা এবার ঈশিতার দিকে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলল, ‘সরি, আমি কালারটা একটু চেঞ্জ করে আনছি।’


বলতে বলতে রূপা আমার হাত ধরে টানতে লাগল। আমি পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঈশিতার কাছে কি চিরকালই আমাকে এভাবে হেরে যেতে হবে! আমি মরিয়া হয়ে রূপাকে বললাম, ‘এটা খারাপ কী! আমার কাছে তো ভালোই লাগছে।’
আমাদের স্বামী-স্ত্রীর এই মৃদু বচসা দেখে ঈশিতা এবার মুখ খুলল, ‘স্যার, আমার মনে হয় ম্যাম আরও ভালো চয়েস করতে পারবেন। প্লিজ চেঞ্জ করে নিয়ে আসুন, আমি বিল রেডি করছি।’

আমার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। আমার মনে হলো ঈশিতার সঙ্গে এভাবে আবার দেখা না হলেই ভালো ছিল। সতেরো বছর আগে প্রথমবার আমি ঈশিতার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। আজ দ্বিতীয়বারের মতো হেরে গেলাম!

 

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

18 − 6 =