প্রেমহীন এই নিথর ধরা যেন অসার
পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করে আবার।
কবিতা হচ্ছে ছন্দ, দোলা এবং স্পন্দন নিয়ে রচিত একগুচ্ছ শব্দমালা। অথবা, কবিতা বা পদ্য হচ্ছে শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস; যা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে আর তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে।
কবিতা। তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ অথচ এর বিশালতা আর গভীরতা অকল্পনীয়। হ্যাঁ সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয়। জীবনের প্রত্যেকটি উপাদান আর উপাত্ত নিয়েই কবিতা। একটি জীবনের আলোকে সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয় কবিতা। কবিতা হাসায়, কবিতা কাদায়। কবিতা আনন্দ দেয়, কবিতা বেদনা শেখায়। তাই একজন কবির কাছে তার কবিতা নিজের সন্তানের মতো, নিজের সহধর্মিণীর মতো যে তাকে ভালোবেসে পাশে থাকে দুঃখের সময়েও।
২০২০ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নৈঋতা ক্যাফে থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ শিরোনামে। বইটির প্রচ্ছদ করেছে চারু পিন্টু। প্রচ্ছদ বেশ মানানসই হয়েছে কাব্যগ্রন্থের কাব্যগুলো অনুসারে।

খুবই সাদামাটা না আবার খুব বেশি ঝমকালো নয়; যতটুকু অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার ততটুকুই যেন। বইটির পেইজ, বাইন্ডিং বেশ স্ট্যান্ডার্ড মানের। আর যেহেতু কাব্যগ্রন্থ তাই গাউন পেপারের ব্যবহার যেন বইটির আউটলুককে আরও পরিপূর্ণ করেছে।
শ্রাবণ জুড়ে মেঘ থাক, আশা রাখি
কেটে যাক দাবদাহ জ্বর, প্রসন্ন হাসি;
ফিরে আয় মেঘমালা- বিষণ্ণ ঢাকি
পোড়া চোখে বৃষ্টি ঝরুক, তোমায় ভালোবাসি।
কবিতা এমন একটা ব্যাপার যেটা আসলে পড়ে, অনুভব করে অন্যকে ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানোর নয়। তবুও কিছু কথা জড়ো হয় যে কোন কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষেই। এই বইটি পাঠ শেষেও তেমন কিছু কথাই জড়ো হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে অর্ধশতেকের বেশি কবিতা স্থান পেয়েছে। সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলে এই পর্যোলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আর পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তাই যেসব কবিতা ভাবনার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো নিয়েই বরং আলোচনা করা যাক।
কবিতা লিখেন কে? একজন কবি। পাঠকের মনের অজানা কথাগুলোই যেন ভেসে উঠে পঙক্তি হয়ে কবির কবিতার। পাঠক নিজের না বলা কথাগুলো গুচ্ছ আকারে লিপিবদ্ধ দেখে আনন্দে হয় আত্মহারা; কিন্তু কখনো কি ভাবে কবির কথা! সেই আক্ষেপটাই যেন কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে তিনি বলেন –
কে শুনবে কার কথা?
এই ধরো আমার কথা-
নিদারুণ দুঃখ বোধ,
ভিতরে-ভিতরে ক্ষয়রোগ;
কবির আক্ষেপটাই যেন প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভটাই যেন কবিকে প্ররোচিত করে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান দেয়ার। তখন কবি বলেন –
এই অন্ধকার থেকে আলোর মুখ কবে বের হয়ে আসবে?
সেদিন কোথায় যেদিন সম্মিলিত প্রতিরোধ হবে… আর কত দিন…???
কবি মানেই রোমান্টিক আর কবিতা মানেই রোমান্টিকতা। হোক না তা দ্রোহের কবিতাগুচ্ছ সেখানেও চুপিসারে রয়ে যায় কবির অজানার প্রেমের কথা। কবির অজানায় হারিয়ে যাবার কথা। এমনই হারিয়ে যাবার উপাখ্যানে কবি বলেন –
দাঁড়াও, আমিও আসছি, হাওয়ার তরী –
বেয়ে-বেয়ে তোমার অজানা দ্বীপে।

হাজার মানুষের ভীড়ে ছুটে চলা মানুষটার একাকীত্ব আর ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো পাখিটার শূন্যতায় কবি যেন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন খুঁজে পান। সেই মানুষটা কিংবা সেই পাখিটার যে ভালোবাসার মানুষটাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাই ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। কবির ভাষ্যে-
অসহ্য যন্ত্রণায় ওড়ে পাখি –
নিয়ে ডানায় শ্বাসহীন রাখী।
তথাকথিত সমাজের ভালোবাসা মানেই যেন জৈবিক চাহিদার এক আঁতুড়ঘর। আসলেই কি তাই? ভালোবাসা তো মনের সঙ্গে মন বুনার এক কাজ। ভালোবাসা সে তো অশরীরী – না ধরা যায় না ছোঁয়া যায়। ভালোবাসার সেই অকথিত কোমলতার কথাই কবি বলেছেন ভালোবাসা এত কোমল কবিতাটিতে। কবি বলেন –
নশ্বর শরীর পাবে না এর নিগূঢ় ভেদ-
তাইতো ভালোবাসা আজ অভাবনীয় নিঃশেষ!
স্বপ্ন আর মিছিল যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। স্বপ্ন যেন কবিতার মতো। প্রতিবার পড়ার সময় তা নিজেকে আরো মেলে ধরে, নিজের আরো বিস্তৃতি বাড়ায়। আর মিছিল!! স্বপ্ন হোক কিংবা মিছিল সে তো শুরু করে একজনই। কিন্তু তার কি কোনো শেষ আছে? স্বপ্ন আর মিছিলের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায় কোনো না কোনো এক সুবোধ। তাই কবি বলেন –
স্বপ্নটা পৃথিবীর তাবৎ সুবোধ-
প্রাণের আকুতি নিয়ে জনাকীর্ণ এক মিছিল।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে কত শিল্পী আর মনীষী এই দেশের প্রেমে পড়েছেন তার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু আধুনিকতার কবলে পড়ে ক্রমশ নদী হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। কিন্তু সেই নদীর এমন দগ্ধতা আর ক্ষতের কথা কতজনে মনে রাখে? কতজন সেই নদীর হাহাকার শোনে? কবি সেই হাহাকারের খানিকটা তুলে ধরেন এভাবে –
আমি এখন খরায় পোড়া ক্ষত-
আমাকে নিয়ে ভাবছে সবাই কত?

প্রেম। প্রকৃতির অদ্ভুত এক সৃষ্টি। প্রেমের বন্ধন যে কতটা গাঢ় তা তো যুগে যুগে ইতিহাসই প্রচার করে এসেছে। কিন্তু সেই গাঢ়তা কি খানিকটা ম্লান হয়নি? হয়েছে বটে আর তাই তো বেড়েছে প্রেমের ব্যর্থতা আর বিচ্ছিন্নতা। সেই বিচ্ছিন্নতার জ্বালা সইতে পারে এমন কজনাই বা আছেন? তাই কবি নিজের ভাষায় বলেন –
নিঃস্ব জীবন- প্রেমহীন প্রেমিকা-
এক দৌড়ে হচ্ছে সভ্যতার গণিকা!
কথার কোনো ক্ষয় আছে কিংবা শেষ আছে? কথা স্রোতস্বিনী নদীর মতো; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে, যুগ থেকে যুগান্তরে। কথার কোনো ক্ষয় নেই কিংবা শেষ নেই তবে কথা থাকে অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষায় পালা শেষ হয় কিন্তু কথা তবু ফুরোয় না। গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে কথাগুলো জমতে জমতে একদা হারিয়ে যায় কোনো অতলে, কোনো এক অজানার দেশে। তাই কবি বলেন –
অবশেষে, অপেক্ষমাণ কথাসমূহের দল-
ফিরে যায় অজানার দেশে!
এই আমরা প্রতদিন সমাজ বদলের কথা বলি। নিত্যনতুন নিয়ম গড়ি। সমাজকে নিয়ে চলি আগামীর তলে। কিন্তু আসলেই কি সমাজ বদলায়? যদি তাই হয় তাহলে দিনমজুর এখনো দিন এনে দিন খায় কেন? নাকি কেবল আমরা মুখেই বলি শুধু সমাজ বদলাই। কবি তার নিজের ভাষায় এভাবে বলেন-
এখনো দিনমজুর দিন আনে দিন খায়-
আমরা সবাই অহরহ সমাজ বদলাই।
কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের জন্ম কুষ্টিয়াতে। তবে বর্তমানে ঢাকার বাসিন্দা। স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই কবিতার প্রতি মায়া, মমতা, ভালোবাসা এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ২০১২ সালের প্রথম কবিতার বই ‘একজন মোনালিসা চাঁদের গহবরে মুচকি হাসে।’ এরপর সময় যেন থমকে গেল দীর্ঘ আটটি বছরের জন্য। কিংবা হয়তো বলা যায় কবি আটটি বছরের জন্য কবিতায় সিদ্ধহস্ত হতে সময় নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ’।
কবিতার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো সুবিধা হলো একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। অবাধ্য শৈশবকে যেমন অনুভব করা যায় তেমনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়। এভাবেই কবি নিজের গান গেয়ে অন্যকে করে প্রভাবিত। আর কবিতার বই একরাশ মুগ্ধতায় রয়ে যায় পাঠকের মনে হয়তোবা ক্ষণিকের জন্যে কিংবা হয়তো আজীবনের জন্যে। যেমনটা কবিও যেতে যেতে বলে যান –
মনুষ্যত্বের বাহক খাক হয়ে যায়
কিছুমানুষ আমৃত্যু স্বপ্নহীন থেকে যায়।
বই: পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ
লেখক: সোহাগ ওবায়দুজ্জামান
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
প্রকাশনী: নৈঋতা ক্যাফে
মূল্য: ২৫০ টাকা মাত্র
লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবি: সংগ্রহীত