পাহাড়ের চাঁদ – কাজী রাফি

করেছে Wazedur Rahman

উঁচু এবং শেষ পাহাড়টা অতিক্রম করলেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গন্তব্যে। সেখানে আছে প্রাচীন আমলের এক মন্দির, বর্তমানকালে গড়ে ওঠা কয়েকটা নান্দনিক অবকাশযাপন কক্ষ। তার আশপাশে ট্র্যাকিং করলে পাওয়া যায় নাকি বেশ কিছু ঝরনা। সেই সব বাংলো থেকে পাহাড়ের চাঁদটাকে নির্জন রাতে কেমন লাগে, তা নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প। যে যেভাবে এই পাহাড়ের চাঁদকে অনুভব করে, এখান থেকে ফিরে গিয়ে সেভাবেই তারা ফেসবুকে গল্প ছড়িয়ে দেয় বলে এখন এত মানুষের আনাগোনা এই দুর্গম পাহাড়েও। অথচ দশ বছর আগে এখানে মানুষ আসার ঘটনা খুব কম ঘটত। পথের যাতনাটুকুই বড় ছিল। যারা আসতেন তাদের কাছ থেকে এই পাহাড়-মন্দিরে গল্প যত মানুষ শুনতেন তার চেয়ে বেশি শুনতেন যন্ত্রণাভোগের করুণ কাহিনি। বেশি মানুষের উপস্থিতির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলে মানুষ মনে হয় যন্ত্রণার মাঝে বীরত্ব খোঁজে। কষ্ট পাওয়ার চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করার স্মৃতি তখন তখন তাদের কাছে বড় হয়ে যায়।

আমার কেন যেন মনে হয়- মানুষের উপস্থিতি দেখার আনন্দ-নেশায় মেতে ওঠার জন্য স্রষ্টা এমন করে সাজিয়েছেন এই অপরূপ বিশ্বকে। মানুষের উপস্থিতিতেই পাহাড়ের সত্তা সাত্তিক, ঝরনার হৃদয় কলকল, প্রকৃতির আত্মা উন্মুখ, নদী-সাগরের মন টলমল করে ওঠে! কারণ আর কিছুই নয়- প্রকৃতি হয়তো মানুষের অনুভূতিকেই নিজের মাঝে ধারণ করে। তারই প্রতিফলন ঘটে মানুষের উপস্থিতে। সে জন্যই এই ব্রহ্মাণ্ডের লুকানো আত্মা মানুষের স্বপ্নের ভাষা বুঝতে ব্যগ্র এবং ব্যাকুল বলে নির্জন পাহাড়ে রাতের ডেকে যাওয়ার তান বড় অনন্য।
গত পাঁচটা দিন পাহাড় অতিক্রম করতে করতে আমাদের শরীরে ভয়ানক শ্রান্তি আর অবসন্নতা। ক্লান্তিও যে উপভোগ্য- এমন নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতির কাছে না এলে তা আর টের পেতাম না।
জনমানবহীন নীরব, নিস্তব্ধ প্রকৃতি-আকাশের কাছাকাছি এবং ঘাস-গাছ-লতাপাতার এই সবুজ বেষ্টনীর মাঝে ক্লান্তিতে প্রায় বিধ্বস্ত আমাদের শরীর। সামান্য বিশ্রাম, ঝরনার জল আর খাবার পেলেই কী এক সঞ্জীবনী শক্তিতে সামনে যাওয়ার তাড়নায় তা জেগে উঠছে। অদ্ভুত এবং অনন্য প্রেরণায় এগিয়ে যেতে যেতে ভাবি, সামনে তো এমনি লতা-ঘাস আর পাহাড়ি গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু কী আর নতুনত্ব দেখার নেশায় এমন কষ্টকর পথ পাড়ি দেওয়া!  সতীর্থ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে তার উত্তরও পাই- আমরা কয়েকজন আসলে এই পথচলাতেই মানবের সমগ্র জীবনের তুচ্ছতাকে উপলব্ধি করছি বলে অজানা গন্তব্যও আজ আমাদের কাছে মহার্ঘ! তা ছাড়া ডাক্তারি বিদ্যায় নতুন এক ডিগ্রি লাভ করতে গিয়ে কঠোর সময়ানুবর্তিতার নির্মম চাবুকে আমাদের জর্জরিত জীবন যেন নির্বাণ লাভ করেছে। পাঠ শেষের আনন্দ মিশে গেছে এসব থেমে থাকা পাতার মর্মরে। নিস্তব্ধ রাতে নির্মল নীলের অবারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথার কাছে নেমে আসা আলোয় ধোয়া চাঁদের দিকে তাকালে কত-কী যে অনুভব করি- তা আর ভাষায় বোঝাই কী করে!

আমাদের মতো আরও বেশ কিছু দলবদ্ধ মানুষও জীবনের এই মায়ার কুহেলিকা খুঁজতে ছুটছে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। মানুষের আত্মা, খুব সম্ভবত জগতের প্রাকৃতিক মিথস্ক্রিয়ায় ধুয়ে উঠলেই তৃপ্ত হয়। অবারিত দিগন্তের দিকে না তাকাতে পারলে তাদের সৃজনশীল সত্তা জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। সে জন্যই কি উঁচুতে উঠে দূর-দূর দিগন্তকে দেখার নেশা মানুষের রক্তে লুকানো? হবে হয়তো। এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর একজন দার্শনিকের কাছেও নেই বলেই আমার ধারণা। দলবদ্ধ মানুষগুলো তাই হয়তো নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ছুটছে পাহাড়ে। নিজেকে জোছনায় ধুয়ে তারা এক একজন চাঁদ হয়ে উঠবে বলে! তাদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে গেলেই তারা পরশপাথর গোছের কিছু একটা পেয়ে যাবে অথবা এই জগৎ এবং ঈশ্বরের মাঝে যে সম্পর্ক সেখানে লুকিয়ে আছে- তার সূত্রের সন্ধান পাওয়ার কাছাকাছি তারা প্রায় পৌঁছে গেছেন। এ মানবজীবনের এক ট্র্যাজেডি বটে!

জীবনের এই মায়াময় সব সূত্র একসঙ্গে আমার অনুভবে তোলপাড় আন্দোলন তুলল, যেদিন সন্ধ্যা নামার আগেই পূর্ণিমার চাঁদকে মাটিতে দেখলাম। তার আগে বলে নিই, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি খাড়া পথ এত উঁচুতে এসে যেন একটু থিতু হয়েছে। হাঁটুতে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দূরে নিচুতে ফেলে আসা সমতল ভূমির দিকে তাকালাম। একদম মানচিত্রের মতো না হলেও মনে হলো ছোট ছোট টিলাগুলো পেরিয়ে অসংখ্য রেখার সীমানা অঙ্কিত মনুষ্য বসতির ওই স্থানটুকু সবুজের গালিচা আর জলের ফোয়ারা দিয়ে সাজানো। অস্তমিত হওয়ার আগে সূর্যমামা তার ঝাঁজ কমালেও প্রকৃতির মাঝে যে ভ্যাপসা গরম নিজেদের বিকিরিত করছে, তাতে দুপুরের চেয়ে এখন শরীর থেকে বেশি ঘাম ঝরছে। ‘ভ্যাপসা’ শব্দ যখন উচ্চারণ করছি অথবা যখনই শব্দটা মনে আসছে তখন তার সঙ্গে পাহাড়ি বুনো ফুলের ঘ্রাণটুকু আমাকে আচ্ছন্ন করছে।

আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল তেষ্টায় শুকনা ঠোঁট এবং পিপাসায় কাতর আমার খাদ্যনালি জলে ভিজতে চাইল। আর বিশ্বাস হলে করুন, না হলে না-ই বা করুন এই শব্দের সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার-স্যাপার আমাকে আনমনা স্বপ্নের ঘোরে তলিয়ে নিচ্ছে, যা বলতে আমি দ্বিধান্বিত। তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি, আমি এই শব্দের সঙ্গে পাহাড়ের ঘ্রাণ মিশিয়ে কোনো একজন স্বপ্নতরুণীকে কল্পনা করছি, যার ঘর্মাক্ত শরীরে এমন বুনো সব ফুলের ঘ্রাণ আর বনস্পতির স্নিগ্ধতা জেগে থাকে। ওপর থেকে দূর, বহুদূর পর্যন্ত দেখার সময় স্মৃতিগুলোও কেমন মায়াময় হয়ে ওঠে!

পাহাড়ে কি মানুষ আসে তাহলে নিচে, এক অনন্ত আকাশতলে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষদের জীবন-অভিযোজনে সুখ-দুঃখের ব্যঞ্জনার আড়ালে অনিত্যতাকে দেখে নেওয়ার জন্য? স্রষ্টাও কি একই উদ্দেশ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছেন? বিচিত্র সব প্রাণ আর প্রাণীর মাঝে মানুষকে লাগামহীন বিবেক-বুদ্ধি দিয়েও ‘সময়’ নামক এক যাযাবরের লাগামে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অনন্ত লীলা দেখে দেখে নিজের অসীম সময়কে উড়ে চলার পাখনা বানিয়েছেন? আমার নিজের কাছেই এই সব কোনো সম্ভাবনাকে খুব জুুতসই বলে মনেও হয় না। আবার কোনো ভাবনা যে একেবারেই অর্থহীন তা-ও মনে হয় না। সম্ভাবনাহীনতার মাঝে জীবনের যে উদ্দেশ্য, ডাক্তারি বিদ্যা পাঠের কারণে আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানে!

আমার দলের কারও মনে হয় ওপর-নিচ, এই জীবন আর তার অনিত্যতা- এসবে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। তারা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথবা তারা এত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত যে পাহাড়ের বিশ্রাম কক্ষের প্রশান্তি-কল্পনার তাড়নায় তারা দ্রুত পৌঁছাতে চাইছে পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু পেছনে ফেলে আসা সমতলভূমির দিকে তাকিয়ে কী এক নস্টালজিয়ায় আমার আর সামনে এগোতে ইচ্ছা করল না। মাটিতে হেলে পড়া একটা গাছের ডালে শরীর এলিয়ে কাঁধের থলে থেকে জলের বোতল বের করলাম। হ্যাঁ, তখনই দেখলাম তাকে। পড়ন্ত বেলায় সেই পাহাড়ের চাঁদ আমার পাশে আমার ভঙ্গিতেই তার শ্রান্ত শরীরকে বিশ্রামে নিল। জলের বোতলের মুখটা আর খোলা হলো না। কেন না, তার শরীর থেকে বনস্পতি আর আপেলের মিষ্টি ঘ্রাণটুকু আমার কাছে তখন এত মহার্ঘ্য যে, পিপাসার্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তের প্রচেষ্টার কারণে তা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি স্থির হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। তারপর জলের বোতলে চোখ পড়তেই পরক্ষণেই সেই হাসি তার মিলিয়ে গেল। তার চোখের নিচে, গলার কাছে ঘামের স্বেদবিন্দু যদিও আমার জলতেষ্টা দ্বিগুণ করে তুলল। তবু আমি মেয়েটার দিকে বোতল এগিয়ে বললাম, তুমি মনে হয় খুব পিপাসার্ত।

কোনো দ্বিধা এবং দ্বিরুক্তি ছাড়াই তরুণী আমার জলের বোতল হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে গলায় জল ঢালতে ঢালতে হঠাৎই থামল। ততক্ষণে আধা বোতল জল শেষ! আমার দিকে মিনতির চোখে তাকিয়ে সে বলল, সরি, আমি এত পিপাসার্ত যে, তার বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে আশ্বস্ত করলাম, ঠিক আছে, তোমার পিপাসা না মেটা পর্যন্ত তুমি জলটুকু খেতে পারো। তরুণী আমাকেও তুমি সম্বোধন করতে দ্বিধাহীন।
বলল, কিন্তু, তুমি-
আমার তেমন পিপাসা নেই, একটু আগেই আমি জলপান করেছি। এবার বোতলের বাকি জলটুকু মুখে চালিয়ে দেওয়ার আগে থেমে গিয়ে সে বলল, এখন বললে ‘জলপান’, তখন বললে ‘জল-খাওয়া’- মাথাটা তোমার পুরাই গেছে।
এবার ঢকঢক করে বাকি জলটুকু সে এত পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করল যে আমার খুব ইচ্ছা করল হাঁ করে জলপানরত তার মুখের ভেতর থেকে চঞ্চু দিয়ে একটু পানি দিয়ে আমার জিহ্বা ভিজিয়ে নিই। আহা, আমার মুখটা যদি এখন একটা পাখির ঠোঁট হয়ে যেত! জলপানের মাঝে জগতে এত বিস্ময় থাকে তা আমার জানা ছিল না। আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি বলতে কি, আমি এটুকু বলতে মোটেও লজ্জিত নই যে, আমি তার জলপানের দিকে নয়, তাকিয়ে আছি তার গোলাপি ঠোঁট হয়ে লাল টুকটুকে মুখগহ্বরের ভেতর। যেখানে জল পড়লেও তার আগুনটুকু নিভে যাচ্ছে না! কোনো নারীকে এত কাছ থেকে এমন করে দেখার জন্য এবার একটু লজ্জা পেলাম। মেয়েটা খালি বোতল আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, সত্যিই তোমার পিপাসা নেই তো? চার ঘণ্টা আগেই আমার সব পানি শেষ হয়েছে। কত মানুষের কাছে এক ঢোঁক জল চাইলাম। সবাই বলে যে তার পানি শেষ হয়ে গেছে- আর তুমি কিনা আস্ত এক বোতল পানি বাঁচিয়ে রেখেছ! তোমার বউ খুব ভাগ্যবতী হবে-
কেন? আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা এবার ডালের উঁচু অংশে গিয়ে বসল। পা দোলাতে দোলাতে বলল,
এই যে, তোমার এত ধৈর্য, সে জন্য। বাপ রে, পাহাড় যে কী বস্তু, আজ তা টের পাচ্ছি।
দেখলে তো এক বোতল পানি, এক ঢোঁকের বেলায় কেমন ‘জল’ হয়ে যায়!

আমার কথায় লাজুক ভঙ্গিতে চোখে আড়াল তুলে তবু মুগ্ধ হয়ে সে আমাকে দেখল। ঠিক তখন ভ্যাপসা গরমকে পাশ কেটে স্নিগ্ধ আর মিষ্টি বাতাস বয়ে গেল। না, তা আমার মনে শুধু নয়; শরীরে স্পষ্ট অনুভূত হলো। অপরূপা সেই ভঙ্গিমায় তখনো আমাকে দেখছিল। তার অপলক চাহনি আমাকে করাত দিয়ে কেটে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। আমি এক থেকে দুই, দুই থেকে চার এবং শেষে অযুত সংখ্যায় পরিণত হয়ে নিযুত অনু-পরমাণুতে মিশে গেলাম। মিশে গেলাম করতল হয়ে কপোলে, শরীর থেকে হৃদয়ে স্নিগ্ধ আবেশ তোলা সেই মিষ্টি হাওয়ার সঙ্গে। এবং আমি হাওয়ার পাখনায় নিজের পাখনা মেলে পাশের এই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তরুণীকে নিয়ে উড়ে চললাম নীল আকাশের শেষ সীমানায় যেখানে এক বিন্দু সাদা মেঘ একটা কুঁড়েঘরের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রবল পিপাসার বোধ আমাকে আবার অসীম থেকে নিযুতে ফিরে আনল। ফিরে আনল আমার এই একটা মানব শরীরে। পিপাসার্ত আমি পানির বোতলটার দিকে তাকালাম। তার তলানিতে কয়েক ফোঁটা জল। আহা, এটুকু জল দিয়েই যদি জিহ্বাটা একবার ভিজিয়ে নিতে পারতাম! তরুণী বোতলটার মুখ অ্যান্টি-ক্লক ঘুরিয়ে বন্ধ করে তবেই আমার হাতে ফেরত দিয়েছে। জলের ফোঁটাগুলোর দিকে একবার আর তরুণীর কাঁধে-গলায়, চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দুর মতো ঘামের দিকে কয়েকবার তাকালাম। মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের এক আধারকে ঈশ্বরবিন্দুর মতো কয়েক ফোঁটা পবিত্র শিশির আঁকড়ে আছে। জলপিপাসার চেয়ে তা হৃদয়পিপাসা এত বাড়াল! বোতলের জল খেয়ে যত না বাঁচতে ইচ্ছা করল, কেন যেন মেয়েটাকে ভালোবেসে তার চেয়েও বেশি মরে যেতে ইচ্ছা করল। সারা জীবন পড়েছি, শিখেছি- বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আর কিছুই নয়। কিন্তু আজ আমি এই প্রথম জানলাম, মরে যাওয়ার কোনো এমন কারণ পৃথিবীতে থাকতে পারে যার জন্য মরে যাওয়ার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো বড় শিল্পময় আনন্দ আর হয় না। আমি মরে গিয়ে তার গলগণ্ডের টিলায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নীলজলের খালের মতো চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দু হয়ে থাকতে চাই। যদি সে আমাকে তার লম্বা আঙুলের অধিকারী হাত-বাহুতে একবার জড়িয়ে নেয়, তাহলে জীবনভর কল্পনা করা স্বপ্ন নামের সব পিপাসা; সত্যি নিমেষেই মিটে যেত।

এবার মেয়েটা তার হাতের নিকষ-কালো বিড়ালের চোখের মতো ঘড়িটায় চোখ রেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওপরের দিকে তাকাল এবং কাউকে কোথাও না দেখে বলল, আমার দলের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ওরা মনে হয় এতক্ষণে অবকাশকেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।
না, উঁচুতে দূরের বস্তুকেও অনেক কাছের বলে মনে হয়। আমার দলও নিশ্চয়ই এখনো পৌঁছায়নি।
জানো, আমার সারাজীবন ইচ্ছা করত-
আমি আমার আগ্রহ ধরে রাখতে পারছিলাম না। অধৈর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী ইচ্ছা করত?
কোনো একদিন এমন আকাশ-মেঘের কাছে, সবুজ ঘাস-গালিচার পরিচ্ছন্ন এক পাহাড়ে একটা কুঁড়েঘর পেলে সেখানেই থেকে যেতেÑ
মেয়েটার কথায় কী হলো আমি জানি না। তাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো এক কুঁড়েঘর খোঁজার ইচ্ছা মনে হয় প্রবল হলো। কিন্তু পিপাসায় ছটফট করা শরীর এই ইচ্ছার ভার সইতে পারল না। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি এক কুঁড়েঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে বাঁশের তৈরি এক ছোট্ট ঝাঁপির ওপর যে অদ্ভুত মাটির প্রদীপ। আমার মুখের দিকে ঝুঁকে থাকা নারীর আলোময় বিভাকে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন প্রদীপের সামান্য আলোর ইচ্ছা। আকাশ-পাহাড়ে এক কুঁড়েঘরে নেমে আসা পূর্ণিমার চাঁদ আমার হৃদয়কে ঝলসে দিল। বেড়ার ঘরের ফাঁক দিয়ে দূরদিগন্তে ছড়িয়ে পড়া জোছনায় রহস্যময় পাহাড়ি প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে মায়ার কুহেলিকা। আমি অপরূপার দিকে তাকালাম। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
বড্ড ভয় পেয়েছিলাম। তুমি ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, বুঝিনি। তোমার মুখ খুলে পানি দিতে গিয়ে বুঝলাম, আমার কারণেই তুমি মরতে বসেছিলেÑ
আমি তাকে বলতে চাইলাম, না, না বরং তোমার জন্য আমি নতুন করে বাঁচলাম। এমনই এক জীবন সব সময় কল্পনা করেছিলাম। আকাশ-মেঘের কাছে বাইরে জোছনার রূপালি আস্তরণ আর ভেতরে এক মাটির প্রদীপের পাশে তোমার মতো আকাশ থেকে নেমে আসা এক চাঁদপরি!

কিছুই বলা হলো না। আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলেই চলছে, তোমার এত পিপাসা ছিল অথচ তুমি কিনা সব পানি আমাকে পান করালে। শোনো বোকা, মেয়েরা নিজের প্রয়োজন ঠিক বোঝে। তুমি কেন তোমারটা বুঝলে না?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব জানি না। তাকে আবার বলতে চাইলাম, আমি তো আসলে এভাবে মরার আনন্দেই মেতে উঠতে চেয়েছিলাম। এই পাহাড়ে আমার সঙ্গে কীভাবে তুমিও দলচ্যুত হলে তা ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিল ঈশ্বর নিশ্চয়ই কেউ আছেন। না হলে এই পাহাড়ের আত্মা কীভাবে সারাজীবন লালিত আমার মনের কথাকে এখানে উসকেই শুধু দিল না, সত্যিও করল।

কিন্তু আমার ভেতরের এত কথা সব কথার কাঁপন হয়ে ভেতরেই রয়ে গেল। সে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি কথা বলতে ভুলে গেছ? কিছু মনে পরছে না?
আমি মায়াভরে তার দিকে তাকালাম। তার একটা আঙুল স্পর্শ করতেই তুমুলভাবে আবার বেঁচে উঠলাম। বললাম, আমি আর অতীত মনে করতে চাই না। আজ থেকে যদি আমার অনন্ত জীবন শুরু হতো! পেছনে ফেলে আসা জীবন নয়, শুধু সামনে থাকবে পাহাড়ি এই অবারিত দিগন্ত আর-

এতক্ষণে মনে পড়ল ওর নামটাও আমার জানা হয়নি। ওর নামটা জানার জন্য অস্থির হয়ে তার চোখে চোখ রাখলাম। তার নীল-কালো অক্ষিগোলক আমাকে নিবিরভাবে দেখার সঙ্গে আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যেন আমার কথার অর্থটুকু বোঝার চেষ্টা করছে। ধীর গতিতে একটা শব্দের দুই অক্ষর তার ঠোঁটে খেলা করল, আর? তার প্রশ্নে দ্বিধাহীন হয়ে তাকে বললাম, তুমি এবং তোমার আকাশ-মেঘের কাছে একটা কুঁঁড়েঘর! কিন্তু দেখো, তোমার নাম, জন্মস্থান কিছুই আমার জানা হয়নি।

আমি ইয়াগমুর মার্ভি। তুমি আমাকে মার্ভি বলেই ডেকো। আমার জন্ম সেখানে যেখানে দুই মহাদেশ মিলেছে এক বিন্দুতে। আমার জন্মস্থান বিশ্বের সেই বিন্দুতে যেখানে মাঝে মাঝে বরফ দিনের সূর্য আর রাতে চাঁদের আলোর সঙ্গে খেলা করে।
অমন সৌন্দর্যের মাঝে তোমার দেশের মানুষ চিত্রকর্ম, সুর, আর গানের মাঝে তলিয়ে গিয়ে জীবনের অর্থটুকু বেশি খুঁজে পায়, না?
তা তো হবার নয়। এই বিশ্বের সব প্রান্তেমানুষ এখন মানুষকে নিয়েই ব্যবসার ফন্দি আঁটতে গিয়ে আত্মার সব সৌন্দর্য হারিয়েছে। তোমার এখন কি একটু ভালো লাগছে।

লাগছে। খুব লাগছে। কিন্তু আমাকে এখানে-
হ্যাঁ, তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে। বেলা ডুবে যাচ্ছিল। আমি চিৎকার করে সাহায্য চাইলাম। এই পাহাড়ের একজন বাসিন্দা দুইদিন আগে বাজার করতে সমতলে গিয়েছিলেন। তিনি ঘরে ফিরছিলেন। তার কাছ থেকে জল নিয়ে তোমার মুখে ঢাললাম। তারপর আমার দলের গন্তব্য বাদ দিয়ে এখন আমরা তারই বানানো বিশ্রাম-কক্ষে। অতিথিদের ভাড়া দেওয়ার জন্য এমন নির্জনে তিনি ভাগ্যিস ঘরটা বানিয়েছিলেন। ঘরটার নাম দিয়েছেন তিনি জুমঘর।
কী আশ্চর্য! মনে হচ্ছিল, কোনো এক চলচ্চিত্রের নায়িকার কাছ থেকে তারই মাত্র সম্পন্ন করা অভিনয়ের একটা পর্বের গল্প শুনছি এবং সেই নায়িকার নায়কটাকে ভাবতে গিয়ে আমার হৃৎস্পন্দন এত দ্রুত হলো যে, আমি ঘেমে উঠলাম।
অনেকেই নাকি পৃথিবীর মনুষ্য-জগৎ পালিয়ে থেকে নিরিবিলি আর নির্জনে ‘জুমঘর’ নামের এই প্রশান্তির নিবাসে আসে।
মানুষের কাছ থেকে মানুষ কি আসলে পালায়?
-না
তাহলে?
যে মানুষের সঙ্গে এই জুমঘরে কেউ কয়েকদিন বাস করে তারা আসলে একে অন্যকে আবিস্কার করে। খুঁজে ফিরে। প্রিয় মানুষকে আবিস্কার করে তার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ কি আর আছে, বলো?

মার্ভি নামের স্বর্গের এক পরির মুখে জীবনবোধের অথবা দর্শনের কথা শোনার চেয়ে তার চোখে চেয়ে তা উপলব্ধি করাতেই চেয়ে যে বেশি প্রশান্তি তা জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। তার কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে তাই তার চোখের দিকে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে তার কপাল হয়ে কানের পাশে বিস্রস্ত বিন্যাসের কেশের লালিত্যে তাকিয়ে আমি কত কী যে কল্পনা করলাম। তাকে নিয়ে কত কত রঙিন জীবন এক নিমিষেই পার করে দিলাম। মার্ভিকে বলতে চাইলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ বলা হলো না। কেন যেন ভয় হয়।

এমন এক রাষ্ট্রে আমার যৌবন শুরু হয়েছে, যেখানে মানুষ স্বপ্নের চেয়ে তার পতনবিন্দুকে আগাম দেখার অভ্যাসে আমরা অভ্যস্ত। স্বার্থের কারণে একে-অন্যকে দোষারোপ এবং গুম হয়ে যাওয়ার এক অনিশ্চিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হলে মনে হয় এমনই হয়! তাকে পাওয়ার আগে তাই তাকে হারানোর ভয়ে মনে হয় ভিতরে কেমন এক আন্দোলন শুরু হয়েছে। মার্ভি উঠে গেল। জুমঘরের মালিকসহ একটু পরে ঘরে ঢুকল। মালিকের পুত্র-কন্যা গরম খাবার নিয়ে তাদের পেছনে এসে দাঁড়াল। পাশের উঁচু মাচাতে তারা পর পর খাবারগুলো সাজিয়ে রাখল। আমার মরে যাওয়া খিদে পুনর্বার চনমনে হয়ে উঠল। মার্ভি আমার হাত ধরে উঠাল। তার প্রয়োজন ছিল না। তবু, মার্ভির হাত ধরার ইচ্ছায় এই দুর্বলতার ভানটুকু নিজের কাছেই মহার্ঘ্য মনে হলো।

পরম তৃপ্তিতে দুজন খেলাম পেটপুরে। তারপর কুঁড়েঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। পাহাড়ের প্রান্তে কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অন্য একটা দেশের আরো উঁচু উঁচু পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসেও আমার সব মনোযোগ বস্তুত মার্ভির দিকে। চাঁদের আলোয় নিচে নেমে আসা আকাশের নীলের সঙ্গে ফিসফিস কথোপকথনের অন্তরালে গাঢ় প্রেমে মেতে ওঠা পাহাড়ি প্রকৃতির প্রেম-নিবেদনের কৌশল থেকে মার্ভির প্রতিনিজের প্রেম নিবেদনের ধরণ কেমন হবে তা ভাবছি। প্রাণ-মন শীতল করেও শরীরে প্রেমের অনল ছড়ানো, নয়নে স্বপ্নের বান ডাকা ঝির ঝির বাতাস ঘাসে-পাতায় শিরশির শিহরন তোলার তালে আমাকেই কি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে? যাই-ই করুক পাতার শব্দ কেন মর্মর তা আজ আমি আত্মার অনুরনণে অনুভব করছি। জোছনার ডানা মেলা পাহাড়ের এমন প্রান্তর কি এটা? নাকি আমার মৃত্যুর পর স্রষ্টা আমাকে স্বর্গে পাঠিয়েছেন?

মার্ভিই আমার হাত ধরল। শরীর ঘেঁষে নিবিড় হতেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ প্রেমানল হয়ে আমাকে পোড়াল। দ্বিধা ভেঙে আমি মার্ভিকে বাহুলগ্না করলাম। মার্ভির ত্বক আর চুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে যেন পাহাড়ের প্রতিটি ঘাস-গুল্মের প্রাণ হয়ে চিরহরিৎ পাতার অনুতে, আকাশের নীল থেকে বাতাসের ছুটে চলা পথের বাঁকে বাঁকে।

মার্ভি আমাকে জড়িয়ে ধরল। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বিভাময় মুখশ্রী ছাড়া সমগ্র বিশ্বে আর কিছুই যেন সত্যি নয়। আমি বাঁধনহীন হয়ে উঠতে চাওয়ার আগেই সে তাঁর ঠোঁটের স্পর্শে আমার সব স্বপ্নকে একসঙ্গে তোলপাড় অনুভূতির সঙ্গে তলিয়ে নিল। এবার শুধু মুখশ্রী নয়, মার্ভি তার নিজের আলো ছড়িয়ে পাহাড়ের এই রাতকে ঝলসে দিতে তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। খোলামেলা স্থানবলে আমি দ্বিধান্বিত হলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এক বিদেশিনীকে নিয়ে এই পাহাড়ে আমি! কয়েকদিনের মধ্যে পত্র-পত্রিকা যদি তার ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নিয়ে খবর ছড়ায়? ভেবে আমি শিহরিত আর চিন্তিত হয়ে উঠলাম। মার্ভির হাতে তখন আমার টি-শার্ট। সে বলল, তুমি আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের সবচেয়ে প্রিয় সেন্টটা নিজের শরীরে মেখে আমার সর্বনাশ করেছ!

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণযুক্ত পৃথিবীখ্যাত এক সুগন্ধির সঙ্গে টি-শার্টটা আমার মামা লন্ডন থেকে ফেরার সময় আমার জন্য এনেছিলেন। বিয়ের জন্য দেশে আসার তিন মাসের মাথায় আমার মামাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিয়ের পরপরই মামি বিধবা হয়েছেন। প্রিয় ভাইয়ের অন্তর্ধানে আমার মা পাগলপ্রায়। আমার কিছু হলে মাকে আর হয়তো বাঁচানোই যাবে না। এ ভাবনা আমার উদ্বিগ্নতা এত বাড়িয়ে তুলল যে আমি ‘ভালোবাসা’সংক্রান্ত সব অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। অথচ মার্ভির উদ্ভিন্ন, বুনো সৌন্দর্য দেখে তখন প্রকৃতিও এত মাতাল হয়ে উঠেছে যে, বাতাসের এলোমেলো দিক পরিবর্তন মার্ভির ছোট করে রাখা কেশগুচ্ছেও উন্মাতাল। মার্ভি ছোট বেঞ্চটায় আমাকে ততক্ষণে শুইয়ে দিয়েছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে তার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করলাম। সে আঙুলটা কামড়ে দিল। উন্মত্ত হওয়ার পরিবর্তে আমি আরও শান্ত হয়ে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করলাম। সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে অনেকক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ফিসফিস করে বলল, এই-ই আমার প্রথম ছিল এবং আমি যতদূর জানি, ছেলেদের জীবনে ‘পিরিয়ড’ বলে কোনো শব্দ নেই।

আমি তার চুলে বেণি কাটলাম। উদ্বিগ্ন একজন মানুষের স্পর্শ মার্ভির কাছে প্রেমিকের চেয়ে মনে হয় পিতার স্পর্শের মতোই লাগল। সে তবু প্রশ্ন করল, ভদ্রছেলে! বাইরে অস্বস্তি বোধ করছ? ঘরে চলো। কিন্তু সারাজীবন ধরে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, পণ করেছিলাম যে, পাহাড়ে-জোছনায় এমন নির্জনে প্রিয় কাউকে যদি কখনো পাই তাহলে তার কাছেই অবারিত হয়ে যাব।

কথাগুলো বলে মার্ভি অবাক বিস্ময়ে চতুর্দিকে এমন করে তাকাল যেন সে একজন স্রষ্টাকে তার চোখ খুঁজছে। সে আবার বলেই চলল, কী আশ্চর্য, আমার চাওয়া স্রষ্টা এভাবে মিলিয়ে দিলেন! ঠিক আমার কল্পনার ছকে ছকে। নিজের মাঝে সযত্নে লালিত আমার আলোটুকু বিলিয়ে দেওয়ার জন্য এই রাতের এই লগ্নের মতো আর কোনো লগ্ন উত্তম হতে পারে না। এবং আমার জন্য আজকের সব ঘটনা এবং এমন পাহাড়ি রাত স্রষ্টার ইঙ্গিতেই নির্ধারিত হয়েছে বলে তোমার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে চাই।

একজন প্রাণবন্ত মানুষ হঠাৎ নাই হয়ে গেলে এবং তার বেঁচে না থাকার পরও লাশটুকুও পাওয়া না গেলে এক পরিবারের সদস্যদের কেমন অনুভূতি হয় তা মার্ভিকে কীভাবে বোঝাই। আমার ভেতরের উদ্বিগ্নতার কথা তার কাছে গোপন করলাম। মিষ্টি হেসে বললাম, আমি তোমাকে পেতে চাই নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।
মানে?
এত সহজে স্বর্গের অপ্সরাকে পেলে যদি তাকে অবমূল্যায়ন করি কখনো। ইউ আর ভেরি এক্সপেনসিভ মার্ভি।

খুলে ফেলা পোশাকগুলো শরীরে সামলে নিয়ে উঠে বসল সে। খুলে দেওয়া ঘন চুলগুচ্ছকে বেঁধে নিয়ে বলল, আই’ম স্যরি! বলে সে মাথা নত করল। আমি বুঝলাম, ভেতরের উদ্্গীরিত লার্ভাকে সে তখনো সামলাতে পারেনি। তার মুখে ‘স্যরি’ শব্দটুকু তার উদ্্গীরিত অনলের জন্য জল হয়ে উঠল তাও বুঝলাম। উঠে বসে তাকে ধরতে গেলেও সে নিজেকে আর ধরতে দিল না। ক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে সে দ্রুত বেঞ্চির এক প্রান্তে গিয়ে বলল, ফার্স্ট বি এক্সপেনসিভ ফর মি। আই’ম ভেরি এক্সপেন্সিভ। কিছুক্ষণ আমার চুপচাপ কেটে গেল। একসময় মৃদু স্বরে মার্ভি বলল, ঈশ্বর আর মানুষের ভালোবাসার কত তফাত। তিনি ভালোবাসার জন্য এই বিশ্বকে এমন অবারিত করে সাজিয়েও মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলেন না এত অপরাধ করার মতো, ষড়যন্ত্র করার মতো এবং তা প্রতিকারে কানুন তৈরি এবং তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার মতো সময় তিনি মানুষকে দেননি!

কথাটা বলেই সে দ্রুত পদেই ঘরে চলে গেল। প্রদীপ নিভিয়ে দিল এবং দুই বিছানার মধ্যে একক বিছানায় শুয়ে কাঁথা দিয়ে শরীর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল কি জেগেই থাকল তা আর জানা হলো না।

পরের সারাটা দিন আমাদের কাটল আশপাশের পাহাড়ে ঘুরে। পাহাড়ি ফল সংগ্রহ করে এবং ঝরনায় গোসল করে। দুপুরের খাবার আমি তাকে মুখে তুলে তুলে খাওয়ালে সে কৃতজ্ঞতা আর গভীর মায়ার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা খুবই সত্যি, ঈশ্বর আর শয়তানের ভালোবাসায় অনেক পার্থক্য। তুমি অনেক ভালো।

আমি মার্ভিকে বারবার আমার মুগ্ধতা আর ভালোবাসার কথা জানালাম। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। সে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছুই না বলে বারবার আমাকেও মনে করিয়ে দিল এক্সপেন্সিভ কিছু পেতে হয় না, তা অর্জন করতে হয়।

রাত নেমে এলে আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। মার্ভি তার ঠোঁট পর্যন্ত বাধা না দিলেও আমি উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। সে আলতো ভঙ্গিতে একসময় আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে শান্ত হতে বলল। সে আমাকে যতই শান্ত হতে বলল, ততই তাকে পাওয়ার জন্য আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকল। পরিশেষে আমার আগ্নেয়গিরির লার্ভাসম অনল নিভে গেল তার একটা বাক্যে,
আজ রাতে নয়। আই’ম স্যরি।
কবে তাহলে?
কয়েক দিন পর। ছেলেদের না হলেও মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ শব্দটার ভেতর দিয়ে যেতে হয় তো। বাক্য দুটি বলার তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। সে পুনরায় বলল, সময় বলো, স্রষ্টা বলো তারা চেয়েছিলেন বলে আমি অবারিত হয়েছিলাম। তবে সময়ের ইঙ্গিতে আমাদের সংকুচিত হতেই হয়।
পরদিন দুপুর হওয়ার আগেই আমি কুঁড়েঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত গত বছরের একটা দেয়ালপঞ্জিতে চোখ রেখে সময়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে তারিখ লেখা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে উঠলাম। মার্ভিকে নিয়ে ঝরনায় গোসলের চেয়ে তারিখ নামের বস্তুটার চলে যাওয়ার দিকে আগ্রহ তখন আমার রক্তে পাহাড়ের বুনো গন্ধের মতো উন্মাতাল।

কিন্তু রক্তের এই ডাক দেয়ালপঞ্জির তিনটা দিন অতিক্রম করতে না করতেই ঘাম ঝরিয়ে শীতল হয়ে এল। তিন দিনের মাথায় মার্ভির দলের ঘর্মাক্ত সদস্যরা আরও ঘামে জবুথবু পুলিশের সঙ্গে এই পাহাড়ে এসে হাজির হলো। পাহাড়ের নিচু ঢালে আড়াল নিয়ে তারা কলস্বরে মার্ভিকে ডাকল। পুলিশের সদস্যরা তাদেরও পেছনে এমন ভঙ্গিতে গোলাগুলির শায়িত অবস্থান নিয়েছে যেন মার্ভিকে একজন মাফিয়া হাইজ্যাক করে এখানে এনেছে এবং কাছাকাছি হলেই যে হাইজ্যাকার একে-৪৭ বের করে গোলাগুলি শুরু করতে প্রস্তুত। তাদের কার্যকলাপ জানালার ফাঁক দিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। একজন নারী কণ্ঠের চিকন চিৎকার আমার রক্ত হিম করে দিল,
মার্ভি আমরা জানি তুমি এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে এখানেই অবস্থান করছ। সামরিক হেলিকপ্টার তোমাদের গতিবিধি সব দেখেছে। শয়তানটাকে সমর্পণ করতে বলো। তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে সে কোনোভাবেই বাঁচবে না।
সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে রিকোনাইসেন্স করে মার্ভির অবস্থান কখন বের করে ফেলেছে নিজেদের মধ্যে আমরা এত ডুবে ছিলাম, ডুবে ছিলাম একে অন্যের চোখের মমতামাখা নিমেষহীন চাহনির মাঝে যে, আমরা ওসবের কিছুই টের পাইনি। আমি কেন হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠি এমন প্রশ্নের উত্তরে মার্ভিকে তার রহস্যও পরিশেষে বলেছিলাম। সে জন্যই পুলিশ দেখে মার্ভি হয়তো ভয় পেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘দেশ’ কখনোই ‘স্বাধীন’ হয় না যতক্ষণ না সে দেশের মানুষের আত্মা ‘পরাধীন’ থাকে। আমি চাই না, ওরা তোমার অবস্থান জানুক। টয়লেটের দরজা দিয়ে পেছনের দিকে পালিয়ে যাও। ভালো থেকো। যত্ন নিয়ো নিজের। চলে গেলেও আমি থেকে যাব এই জোছনার আলোধোয়া পাহাড়ি প্রকৃতিতে। তোমাকে আমি মনে রাখব এই পাহাড়ের ঈশ্বর হিসেবে। মনে রেখো।

মার্ভি ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। একটু থেমে কিছুই না বোঝার ভান করে, যেন সে প্রশান্তির ঘুম থেকে উঠে নিজের মানুষদের দেখে আনন্দিত এমন উদ্বেগহীন গতি নিয়ে সামনে এগুলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার থেকে যত দূরত্ব বাড়াল আমি ততই ক্ষুদ্র এই জীবনের অর্থবহতার মাঝে অর্থহীনতার সব আয়োজনকে আলিঙ্গন করলাম।

আমার দলের লোকগুলো আমাকে আর খুঁজতেও এলো না। গুম হওয়া সংস্কৃতি একবার চালু হলে এবং তা নিয়ে কথা বলার ভয় যে সমাজে তৈরি হয় সে সমাজ মানুষ তো আর হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে হারানোর পরিস্থিতি তৈরি করবে না।

মার্ভি চলে গেলে পাহাড়ি এই অনাড়ম্বর অবকাশকেন্দ্রের মালিক এসে আমার হাত ধরে বলল, তুমি যে গেলে না, বাবু? তোমরা পালিয়ে এসেছিলে, তাই না? আমার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি অস্থির হয়ে বললেন, মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হেঁটে বিকেলের আগেই আমরা গঞ্জে পৌঁছাতে পারি। ওখানে তোমার জন্য একটা চেম্বার রাখব।

দিন দিন রোগী আসে। রোগী ফিরে যায়। থেকে যায় একজন ডাক্তার। পাহাড়ের চাঁদের দিকে মুগ্ধ তাকিয়ে চাঁদটার সঙ্গে কী সব কথা বলে যায় সে। প্রদীপের আলোয় পেনসিল স্কেচে সে মার্ভির শরীরে চাঁদের আলো পরিয়ে দিতে গিয়ে উল্টো জোছনার আলোতে মার্ভির ত্বকের লাবণ্য ছড়িয়ে দেয়। তারপর সেই বিমূর্ত শরীরকে ধরতে গিয়ে তার মনে পড়ে তার প্রেমে পড়া বারণ! সে মার্ভির কণ্ঠস্বর আঁকে। ঝরনায় গোসলের সময় দুজনের উচ্ছলতার আনন্দ আঁকে। আঁকে কলকল ধ্বনি। মার্ভির সুন্দর আঙুলগুলো ছুঁতে গিয়ে সে থমকে যায় আবদ্ধ চেতনা দিয়ে অমন সুন্দর এবং অবারিত স্বাধীনতার প্রতীক আঙুলগুলো তো ছুঁতে নেই।

পৃথিবীর আর কেউ জানল না, যার প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ তারই প্রেমে একজন ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করা মানুষ, পাশের ঝরনায় ক্ষণে ক্ষণে চাঁদের আলো ভেবে সেই নারীকে খুঁজে খুঁজে ছুঁয়ে দেয় বস্তুত নুড়ি-পাথরের হৃদয়। শুধু অনিন্দ্যে নিসর্গের পাহাড়গুলো হাজার বছর পর জেনে গেল একজন ডাক্তার মানুষের শরীর বুঝলেও, একজন শিল্পী কেন এবং কীভাবে আত্মা আর সত্তাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজের আত্মাকে মিলিয়ে দেয় ব্রহ্মাণ্ডের ঝিঁঝি পোকার কলতান তুলে ডেকে যাওয়া অযুত সত্তার সঙ্গে!

অলংকরণ: শাহরিন 

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

18 − 10 =