ক্লাস শেষে করিডরে জল, পেছনে রিমি; সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস ছিল ওদের। এখন বাজে দশটা। আজ একটাই ক্লাস। পুরো দিনই ফ্রি। জলকে রিমি বলে, এই চল রেললাইনে যাই।
-মরতে? সাতসকালে রেললাইনে?
-আরে, মরতে যাব কোন দুঃখে? যাব তো তোকে মারতে।
-কাকে?
-কেন, তোকে?
-হঠাৎ আমারে মারার সুপারি নিলি কেন?
-তোর মরা আমার হাতেই; আমি তোর আজরাইল।
-রেললাইনে নিয়ে মারতে পারবি তো?
-কেন পারব না?
-রেললাইনে বডি দেব, মাথা দেব না। মারবি কী করে? মারতে তো পারবিই না, উল্টো নিজে মরবি।
-কেন?
-মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে আর রেললাইনে গিয়ে তুই প্রেমে কাটা পড়বি। রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম, বুঝলি, সুন্দরী?
-এই ইয়ারকি রাখ, নিয়ে যাবি কি না বল?
-সকাল সকাল তোর যদি মরার পাখনা গজায়, তবে ঠেকায় কে? পিপীলিকার পাখা ওড়ে মরিবার তরে, কাহার ষোড়শী কন্যা তুমি আনিয়াছ ঘরে? চল, রেলে তোর মরিবার সাধ পুরা করি, আমার কী? চল, তোকে মরতে সাহায্য করি।
ফ্যাকাল্টি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে এসে রিকশা নেয় ওরা। জল উঠে বসে সিটে।
-এই পাশে বসলি কেন? কত দিন বলেছি আমার সাথে রিকশায় বসলে তুই ডান পাশে আর আমি বাঁ দিকে বসব? এক কথা কত দিন আর বলব? সামান্য এইটুকু মনে রাখতে পারিস না? এই মেমোরি নিয়ে তুই কী করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? আমার না ডাউট হয়!
-এত ডাউট করা লাগবে না, এই তো সরেছি বাঁ দিকে, এবার ওঠ।
ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে ভিসির বাংলো হয়ে রিকশা আসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে।
-এই মামা দাঁড়াও, দাঁড়াও।
-রিকশা থামালি কেন?
-বল, যা চাইব দিবি?
-কী চাই তোর?
-আগে বল দিবি?
-ন্যাকামি করিস না, কী চাই বল।
-ওই যে আমড়া মামা। বেশি করে কাসুন্দি দিয়ে আমড়ামাখা খাব।
-শোন, নেকু নেকু করবি না। আমড়া খাবি তো এত ঢং করছিলি কেন? একি এমন মহামূল্যবান জিনিস যে তার জন্য তোকে কথা দিতে হবে?
-তুই তো দেখি পুরাই পাগলি, মাথায় ছিট আছে? জুতা থুইয়া পা কালি করে?
-হুম, আমার মাথায় ছিট আছে আর সেই ছিট খালিও আছে, তুই বসবি ছিটে? যা পাগলু আমড়া মাখা নিয়ে আয়। এই শোন, সকালে না নাশতাও করিনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে; ওই দোকানে বানরুটি আছে। মাসকা করে মাখন লাগিয়ে একটা নিয়ে আসিস, প্লিজ। মাখন লাগানো রুটি আন, তোকে একটা দারুণ জিনিস শেখাব?
রিকশা থেকে জলকে ঠেলে নামিয়ে দেয় রিমি। ধাক্কাতে পড়ে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। পড়ে যেতে দেখে হো হো করে হাসে রিমি।
-সামান্য এটুকু ধাক্কাতেই নিজেকে সামলাতে পারিস না। এর চেয়ে বড় ধাক্কা আসলে কী করবি? এই শক্তি নিয়ে কী করে তুই বড় বড় বিল্ডিং বানাবি, শুনি? তোর বানানো বাড়ি তো তোর মতোই নড়বড়ে তালপাতার সেপাই হবে। সামান্য হাওয়াতেই পড়ে যাবে।
-হ্যাঁ, আমার বানানো বাড়ি নড়বড়ে হবে। আর সেই বাড়ি ভেঙে পড়বে তোর ওপর আর তার তলে চাপা পড়ে মরবি তুই।
-আমি মরলে তুই তো বেঁচে যাবি।
-আরে তুই মরলে আমি বেঁচে যাব কেন? তুই মরলে তো বড়জোর বেঁচে যাবে ওই বেটা, যার সাথে আল্লা তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আর তা না হলে তোকে বিয়ে করে ওই বেটাকেই তো নির্ঘাত সারা জীবন কাঁদতে হবে।
-আচ্ছা, যা আপাতত এখন ওই লোকের জায়গায় প্রক্সি দিয়ে তুই মর। আমার জন্য মাখন লাগানো রুটি আর আমড়া মাখা নিয়ে আয়।
রিকশায় বসে রিমি। কাসুন্দিমাখা আমড়া আনতে ছোটে জল। ছোট্ট পলিব্যাগে চারটা আমড়া, একটা দেড় লিটার মামের বোতল, কয়েকটা বেনসন, একটা ম্যাচ, দুই প্যাকেট চিপস আর দুইটা বড় বড় ছানার মিষ্টি সঙ্গে মাখন রুটিও নিয়ে নেয় জল।
রিকশা চলে লাইব্রেরির দিকে। সকালের নাশতা রিকশায়। মাখন লাগানো রুটি।
-কী নাকি শেখাবি আমাকে?
-হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করে দিলি তো! তোকে মজার একটিা জিনিস শেখাব। একটা প্রশ্ন, উত্তর দিবি?
-কী প্রশ্ন?
-এই যে আমি মাখন-রুটি খাচ্ছি। এই মাখন নিয়ে, তোকে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে।
-কী প্রশ্ন?
-মাখন লাল সরকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মামা ছিলেন- এর ইংরেজি কী?
-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। কোনো রকম ভনিতা ছাড়া একদমে উত্তর দেয় জল।
ভড়কে যায় রিমি। খাওয়া বন্ধ। থ হয়ে তাকিয়ে জলের দিকে-তুই পারলি কী করে?
-হাঁস পাড়ে, মুরগি পাড়ে। আমি কেন পারব না?
হো-হো-হো-হো-হো-দুজন হাসতে হাসতে একসঙ্গে বলে-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস।
জল থামে। রিমি এবার একা-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। হো-হো- হো-হো-হো-রিমির হাসি থামে না; বারবার বলে আর হাসে। জানিস, কালকে না প্রথম আমি এটা নেটে পড়েছি, তারপর সারারাত হেসেছি-হো-হো-হো-হো-হো-আবারও হাসে, রিমির এত হাসি দেখে এবার হাসে জলও।
ইলেকট্রিক্যাল ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে লেডিস হলের দিকে রিকশা যায়, পলিব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমড়া খায় রিমি। টকের স্বাদে চোখ বন্ধ করে আঙুল চেটে কাসুন্দি খেতে থাকে; আচ্ছা জল, আজকে তোর ব্যাপারটা কী বল তো। তুই এত কিছু আনলি কেন? আমি আনতে বললাম শুধু আমড়া-কাসুন্দি আর রুটি, তুই আনলি মিষ্টি, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, সিগারেট-এত কিছু, ব্যাপার কী তোর? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি আবার? আমাকে তো আবার লাইন মারার চক্করে নেই তুই?
-তার আগে তুই বল। সকাল সকাল আজ আমাকে রেললাইনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? লাইন মারার চক্করে যে থাকে সেই কিন্তু রেললাইনে যায়? আগে তোর মতলবটা শুনি?
-তোর মতো নড়বড়ে ইঞ্জিনিয়ারকে লাইন মারব আমি? শোন, আমিও তো ইঞ্জিনিয়ার। আমি লাইন মারলে মারব আমার চেয়ে বড় কারও সাথে?
-তো কে সে শুনি?
-আমার বিয়ে হবে কোনো পাইলট টাইলটের সাথে? তেমন কারও সাথেই লাইন মারব।
-পাইলট? মানে আমাদের ভার্সিটির বাসের ড্রাইভার মামা? হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তোর জন্য পারফেক্ট ম্যাচিং? ঠিকঠাক মানাবে।
-এই একদম ইয়ারকি মারবি না।
-ইয়ারকি কই? আমাদের ক্যাম্পাসের বাসের ড্রাইভার মামাদের আমরা তো পাইলটই বলি? কেন তুইও তো বলিস।
-হ্যাঁ, ওটা তো আমরা মজা করে বলি।
-আমি মনে করলাম ভার্সিটির বাসে চড়তে চড়তে হয়তো তুই কোনো পাইলট মামার প্রেমে পড়ে গেছিস? তা তো হতেই পারে, তাই না?
-না, পারে না? আরে গাধা, আমি প্লেনের পাইলটের কথা বলেছি।
-ও আচ্ছা বুঝলাম, বিমানচালক, তাহলে বাসচালক না? তো দুজনে কিন্তু একই-চালক। একজন চালায় আকাশে আর একজন মাটিতে, পার্থক্য এই যা। এয়ারবাসও তো বাস, তাই না? বাসচালক আর বিমানচালকের জাত আলাদা হলেও ক্লাস কিন্তু একই, বল ঠিক না? সেই হিসেবে তোর পছন্দ ঠিকই আছে; ঠিক আছে কি না বল।
-তুই একটা হারামি, শয়তান।
কাসুন্দিমাখা হাতে জলের বাঁ হাত ধরে কিল মারতে থাকে রিমি, -তুই একটা বানর, গাধা, বলদা।
-এই আমার হাত ছাড় রিমি। একদম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না-হাত ছাড় দূরে সরে বয়; কাছে ঘেঁষবি না-নো, নো, নো, নো-অ্যাডভান্টেজ; হাত ছাড় বলছি রিমি।
-ছাড়ব না, দেখি তুই কী করিস? জলের হাত আরও শক্ত করে এবার বুকের সাথে ধরে রিমি
-তুই কি পাগল হলি? আমার হাত তোর কোথায়, দেখ তো?
বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাত ছাড়ে রিমি। লজ্জায় তাকায় না জলের দিকে; মাথা নিচু করে বসে আছে। মুখে কথা নেই। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি পেরিয়ে যায় রিকশা।
-এই রিমি কি হলো? নির্বাক চলচ্চিত্র হয়ে গেলি? কথা বল কী হলো?
-তোর আমড়া খুব টেস্টি ছিল রে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
-আরে, আমড়া আমার হতে যাবে কেন? আমি কি আমড়া বেচি? ও তো আমড়া মামার আমড়া।
-তুই নিজেই তো একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি। তাই ভাবলাম আমড়াটাও তাই তোরই হবে?
হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি, না হেসে পারে না জলও। হাসে দুজনে। হেসে হেসে এবার জলের কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে রিমি।
-হাসতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হাসির ছুতোয় কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়া চলবে না। নো অ্যাডভান্টেজ; দূরে যা রিমি দূরে। ব্যাপার কী তোর আজ? তুই আমার শরীরের কাছে ঘেঁষছিস? ব্যাপার কী?
-তোর শরীর কি সুইমিংপুল যে ওখানে ঘেঁষতে হবে? ওটা তো একটা পচা ডোবা?
-কীভাবে টের পেলি? ডোবাতে নেমেছিস কোনো দিন?
-কোনটা সুইমিংপুল আর কোনটা পচা ডোবা তা বোঝার জন্য নেমে দেখার দরকার হয় না। পাড়ে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। বুঝলি কিছু বুদ্ধুরাম? আবারও একসঙ্গে হাসে দুজনে।
লেডিস হলের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। বাঁ দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের একবারে পাড় ঘেঁষে ছোট্ট পিচঢালা রাস্তা সোজা বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরিয়ে চলে গেছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির দিকে। ওই ফ্যাকাল্টির পাশেই রেললাইন।
-ওই দেখ, পুকুরের জলে আমাদের ছায়া।
তাকিয়ে দেখে পুকুরের জলে রিকশা মামা রিমি আর ও সাঁতার কাটে; পানির জলে রিকশা চলে, জলেতে রিকশায় বসে চলে দুজন। হলের পুকুরের একেবারে পাড় ঘেঁষে যায়;
-আচ্ছা, তুই কি এই পুকুরের জল? নাকি তুই নদী সাগর কুয়ো বৃষ্টি খাল বিল ডোবা নালা চোখের জল নাকি তুই নর্দমার? কিসের জল তুই, বল? কষ্টের নাকি সুখের? নাকি তুই নাকের জল?
হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি উত্তর দেয় না জল; উদাস তাকিয়ে রিমির হাসা দেখে।
-আচ্ছা, যেভাবে আমড়া খাওয়ালি, সারা জীবন আমাকে এইভাবে খাওয়াবি তো?
-তোকে সারা জীবন আমড়া খাওয়াতে যাব কোন দুঃখে? কী হয়েছে? আজ মন যে খুব উরু উরু তোর! এত রোমান্টিক কথা বলছিস? অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার মতলব? সামথিং সামথিং?
-আরে, নাথিং নাথিং।
-বল, এভাবে সারা জীবন আমড়া খাওয়াবি?
-দয়াল বাবা আমড়া খাবা, গাছ লাগায়ে খাও। আমি পারব না। এসব কথা আর বলবি না-নো অ্যাডভান্টেজ।
-আরে, তুই তো আমড়া কাঠের ঢেঁকি। আমড়া খাওয়ানোর তাই দায়িত্ব তোকেই দিতে চাই। তোর মতো আমড়ার ঢেঁকি আমি আর কই পাব?
এবার পুকুরের জলের ছায়াতে রিকশা মামা খিলখিল করে হাসে-রিকশা মামার হাসিতে যোগ দেয় ওরাও। ডাঙায় তিনজন, পানিতে তিনজন মোট হাসে ছয়জন। কিন্তু মানুষ তো তিনজন।
পুকুরের পাড় পেছনে ফেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। গা ছমছমে নীরবতা এই রাস্তায় সব সময়। অসম্ভব সুন্দর রোড। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা- রাস্তার দুই পাশে বড় বড় মেহগনিগাছ। জীবনানন্দের কবিতার মতো মেহগনির ছায়াঘন পল্লবে মোড়া। গাছের গভীর ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ও হাওয়ার খেলা আর এখানে ওখানে-দু এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া তেমন কেউ সাধারণত থাকে না এখানে -এই তুই নাকি সব কি কবিতা জানিস? একটা কবিতা আবৃত্তি কর না প্লিজ?
জলের হাত ধরে রিমি। এই হাত ছাড় বলছি। কোন অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, সেন্টিমেন্টাল কোনো ডায়ালগবাজি করবি না। যদি কাছে ঘেঁষার পাঁয়তারা করিস আমি কিন্তু তোকে ফেলে চলে যাব।
-তুই এত পার্সোনালিটি দেখাস কেন? তোর তো কোনো পার্সোনালিটি থাকার কথা না। তুই হলি জল, দ্য ওয়াটার হ্যাজ নো কালার। জলের নিজস্ব কোনো রং নেই; যখন যেখানে যে পাত্রে রাখা হয় জল সেই পাত্রের রং ধারণ করে। সুতরাং তোকে যেভাবে ইচ্ছা যেখানে সেখানে রাখব যা তা বলব তুই ঠিকঠিক সে রকম হবি? পার্সোনালিটি জলের মানায় না? তুই তো নামেই জল? জলের মতো সহজ সরল হ। খালি ত্যাড়াব্যাঁকা কথা?
জল চুপ হয়ে আছে।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সামনে এসে রিকশা দাঁড়ায়। রাস্তা শেষ। একটু হেঁটে গেট পেরিয়েই রেললাইন। রিকশা মামাকে টাকা দিয়ে সিগারেট ধরায় জল, আজ আমি সিগারেট খাব?
তা তো খাবিই মনে তো রং? কত কিছুই করবি আজ?
গেট পেরিয়ে রেললাইনে এসে দাঁড়ায় দুজন। পুব দিকে হাঁটে জল; এই আমাকে ফেলে আগে আগে যাচ্ছিস কেন? আমার কাছে আয়? আমি তোর হাত ধরে রেললাইনের ওপরে দিয়ে হাঁটব?
-আমাকে যত কাছে টানবি, আমি তত দূরে চলে যাব। সো নো অ্যাডভান্টেজ।
-আর যদি দূরে চলে যেতে বলি তখন কি কাছে চলে আসবি?
-নো, ইমোশনাল ডায়ালগবাজি? দূরত্ব বজায় রেখে হাঁট?
-আচ্ছা, তোর হাত ধরে হাঁটতে চেয়েছি, তোকে তো আমি হাগ করতে বলিনি। তুই এত ভিতু, ইঞ্জিনিয়ার হবি কীভাবে?
-তোর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে সাহসী হওয়ার প্রমাণ দিতে চাই না।
-হাত তোকে দিতেই হবে?
-শোন, হিমুরা কখনো কারও হাতে হাত রাখে না; আমি হলাম হিমু বুঝলি? সো ডোন্ট ট্রাই টু টেক এনি অ্যাডভান্টেজ।
-তুই হিমু আর আমি রুপা
-হিমু রুপার হাতেও হাত রাখে না। হিমুদের কোনো বন্ধন থাকতে নেই।
সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় জল। কী এক অজানা আবেগ এসে জড়ো হয় চোখে। সমান্তরাল এই রেললাইন যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি দূরে চলে। সারি সারি উঁচু উঁচু নাম না জানা গাছের মিতালি। রোদ-ছায়ার খেলা সত্যিই অপূর্ব জীবন আর বেঁচে থাকা। মনের অজান্তে কবিতা চলে আসে মুখে। পেছনে হাঁটা রিমিকে শোনানোর জন্যই হয়তো গলা জোরে ছাড়ে জল;
-আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভেতর এক নিরালা নীড়ে। তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালি শস্যের ভেতর গা ভাসিয়ে দিতাম- তোমার পাখনায় আমার পালক-আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-নীল আকাশে খইখেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে।
সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ। হয়তো গুলির শব্দ: আমাদের তির্যক গতিস্রোত, আমাদের পাখনায় পিষ্টনের উল্লাস, আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান। হয়তো গুলির শব্দ আবার: আমাদের স্তব্ধতা আমাদের শান্তি। আমাদের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না থাকত না আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার। আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে।
কখন যে রিমি এসে হাত ধরেছে টের পায়নি জল, হাতে হাত রেখে কবিতার ঘোরে অনেকটা পথ এসেছে দুজন।
-এই চল ওই দেবদারুগাছের নিচে একটু বসি। তোর আবৃত্তি কিন্তু জোশ, মাইন্ড ব্লোয়িং রিয়েলি।
-রিমি একদম ফ্ল্যাট করবি না। আর অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, তুই আমার হাত ধরেছিলি কেন?
-ওরে নেকা ষষ্ঠী দুধে-ভাতে মনে হয় কিচ্ছু বোঝো না? আমি হাত ধরেছি। তুই তো সরিয়ে দিতে পারতি? আরে বুঝি বুঝি সবই বুঝি। তোর যত বাহানা ওপরে ওপরে। সামনে এ রকম সুন্দরী থাকলে সবার মনই না উরু উরু করে? আর তোর করবে না? তোর মনও যে আঁকুপাঁকু করে আমি বুঝি?
-মোটেও না। আমি কবিতার ঘোরে ছিলাম। টেরই পাইনি কখন এসে তুই হাত ধরেছিস? নইলে আমি তোকে পাত্তা দেব? কোন চান্সই নেই ইয়ার।
-এই তুই এত ভালো আবৃত্তি করিস, কবিতা লিখিস, তোর তো সাহিত্যে পড়া দরকার ছিল?
-সাহিত্যে পড়তে কপালটা চওড়া হতে হয়। সে কপাল আমার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখব। সাহিত্যে পড়ব অথচ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সাহিত্যে চান্স পেলাম না। চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টসে শুধু সাহিত্যের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু একটাতেও টিকিনি, শেষমেশ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলাম। এখানে আমার কপালটা দেখ, ভালো লাগে যে বিষয় তা নিয়ে পড়তে পারলাম না। আসলে মা-বাবা চায়নি আমি সাহিত্যে পড়ি। তারা চেয়েছে ইঞ্জিনিয়ার হই। তাই হয়তো হয়নি? কী আর করা। এখন আর আফসোস করে লাভ কী বল? সবই কপাল। আর এখানে পড়তে এসে কপালে জুটেছে তোর মতো এক পিস। আফসোস করে কী লাভ, সবই কপাল?
-এই কী বললি? জলের গায়ে কিল মারতে থাকে রিমি। কিছুক্ষণ কিলিয়ে হাঁপিয়ে গলা টিপে ধরে, মেরেই ফেলব তোকে। আজ মেরেই ফেলব।
কোনো রকমে রিমির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দূরে গিয়ে বসে জল। এই পালালি কেন? কাছে আয়; আজ তোকে মেরেই ফেলব। রেললাইনের পাথর হাতে নিয়ে ভয় দেখায় রিমি, কাছে আয়, নইলে কিন্তু সত্যি সত্যি এই পাথর ছুড়ব। বলা যায় না মেরেও দিতে পারে। কোনো গ্যারান্টি নেই। এর আগে একদিন ঝগড়া করতে করতে রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল জলকে। এই মেয়েকে একটু বিশ্বাস নেই, রাগলে মাথা ঠিক থাকে না ওর।
-ঠিক আছে কাছে আসব কিন্তু আর কোনো ঝামেলা করবি না তো?
-কাছে আয়, আর কিছুই করব না।
-সত্যি তো?
-হ্যাঁ, সত্যি।
হাত থেকে পাথর ফেলে দেয় রিমি। জল এসে ওর কাছে বসে; পাশাপাশি দুটো স্লিপারের ওপর দুজন।
-খুব খিদে পেয়েছে রে।
-জানি তো তোর খিদে পাবে।
-এই নে খা।
মিষ্টি চিপস, পানির বোতল এগিয়ে দেয় জল,
-প্যাকেট ছিঁড়ে দে।
-সামান্য একটা চিপসের প্যাকেট ছিঁড়তে পারিস না। তুই কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? ডাউট হচ্ছে বুঝলি?
প্যাকেট ছিঁড়ে জল। মিষ্টি চিপস খেতে থাকে দুজন। হাত উঁচিয়ে দূরে দেখায় রিমি;
-ওই দেখ কেন্নো আসে;
-সেকি কিরে গাড়ি আসছে? তাড়াতাড়ি খা।
ওরা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। পানি খেয়ে দাঁড়ায় দেবদারুগাছের নিচে। সামনে-পেছনে সারি সারি দেবদারুগাছ। তার ভেতর দিয়ে ছুটে আসে ট্রেন। রিমিকে দূরে দেখায় জল-
-কী যে মনোহারি, দেবদারু সারি সারি দেদার দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতার।
-বাহ্ বাহ্, তুই তো দেখি চারণ কবিও?
গাড়ি আরও কাছে চলে আসে। ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ওরা যাত্রী নয়, কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে দুজন কিন্তু গাড়ি দাঁড়াবে না ওদের জন্য। পথের কোনো যাত্রীর প্রতি ট্রেনের মায়া থাকে না। মাঝপথে থেমে রাস্তা থেকে ট্রেন কাউকে তুলে নেয় না। ট্রেনের মায়া শুধু স্টেশনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীর ওপর। ঠিক সময়ে যাত্রীকে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে গাড়ি রোজ সকালে বাড়ি ছাড়ে। গাড়ি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে দুজনে। কখনো সখনো কারও চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যাওয়ার সময়ে কারও মুখে যেমন কথা থাকে না তেমনি মুখ বুজে দাঁড়িয়ে ওরা। হু..হু..হু..শ..শ..শ.. শব্দে ধুলো বাতাসের ঝড়ে ওদের ছেড়ে গাড়ি ছোটে অন্য কোনো পথিকের দিকে। যে আছে সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরই মতো ট্রেন যাওয়ার অপেক্ষায়। পেছন থেকে কেন্নোর চলে যাওয়া উদাস তাকিয়ে দেখে রিমি-এই কী হোলো তোর? আয়?
রিমির চোখ গাড়িতে আটকে আছে। ডাকের শব্দে ফিরে তাকায়-
এসে বসে জলের পাশে গা ঘেঁষে; বলেছি না আজ বিড়ি খাব; দে বিড়ি? একটা বেনসন হাতে দেয় জল, ম্যাচের কাঠি ঠুকে জ্বালায়।
খুক, খুক, খুক, খুক কাশি। থামে না আরও জোরে টানে খুক। খুক, খুক, খুক আবারও কাশে যত টান তত কাশ।
টানের চেয়ে কাশিই বেশি-
কাশি আর ধোঁয়াতে রিমির চোখে জল। তবু টান থামে না।
-এই সব ছাইপাঁশ তোরা যে কী করে গিলিস, মাথায় আসে না? রাবিশ, ফেলে দেয় সিগারেট। পার্স থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে জলের বা হাত টেনে নেয়; তোর হাতের কনুই থেকে নখ পর্যন্ত খুব সুন্দর। দুই হাতের মধ্যে জলের হাত চেপে ধরে আছে রিমি, তোর মুখের কালার হাতের মতো এত সুন্দর না? হাতের মতো হলে আরও ভালো হতো। সপাটে হাত টেনে নিয়ে আলতো চুমু খায় রিমি-
-হাত নেওয়া পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায় কিন্তু তুই এ কী করলি? হাউ ননসেন্স ইউ আর?
আরও শক্ত করে এবার জলের হাত ধরে একের পর এক চুমু দেয় হাতে।
-যত বাধা দিবি, তত বাড়বে।
জল দমে যায়। জানে বাধা দিয়ে লাভ নেই। তাতে রিমির পাগলামি আরও বাড়বে। ঝমঝম বৃষ্টি। শোঁ শোঁ শব্দ। দমকা বাতাসে হঠাৎ অন্ধকার চারদিকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাকভেজা দুজন। রেললাইনের ওপর হাত ধরে বসে থাকে। মুষলধারে জলের ঢল। ভারী ভারী ফোঁটার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। কেউ নেই চোখের সীমায়। অন্ধকারে ঝাপসা একটু দূরেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির তোড়ে উঠে দাঁড়ায় ওরা। জলের হাত ধরে টেনে নিয়ে ঝাঁকড়া দেবদারুগাছের নিচে দাঁড়ায় রিমি। অন্য হাতও টেনে নেয়। গাছের নিচে সামনাসামনি দাঁড় করায় জলকে দুই হাত দিয়ে বুকে জাপটে ধরে। তুমুল বাতাস। দমাদম বাজ পড়ার তীব্র শব্দে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রিমি।
দুই প্রকৃতির কাছে অসহায় জল। মেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আসল প্রকৃতি মিলেমিশে টালমাটাল করে দেয় ওকে। রক্ত-মাংস শিউরে ওঠে জলের। ভারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে ৪৪০ ভোল্ট কারেন্টের তেজ। জলের ভেজা বারুদের স্তূপে দাউদাউ আগুন জ্বলে। হেরে যায় দিশেহারা। ধরে রাখতে পারে না নিজেকে। জেগে ওঠে শরীর। দুই হাতে শক্ত করে জাপটে বাহুতে পেষে রিমিকে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে একজনকে পিষে চলে বুকে। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালের এই বৃষ্টি জলের জন্য শুভ কি না? তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে বারো বছর?
ছবিসূত্র: সংগ্রহীত