আজকাল অনেকেই জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে পছন্দ করে। কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতির কারণে তাদের অনেককেই কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তারপরও ভালোবাসার মানুষ বলে কথা! তাই কঠিন বাস্তবতাও প্রেমিক যুগলের কাছে হয়ে ওঠে লঙ্ঘনীয় ব্যাপার। ভিন্ন ধর্মের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিয়ের ঘটনা তাই বাড়ছে। তবে এই বিশেষ বিয়ে সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নয়। চলো জেনে নেওয়া যাক বিশেষ বিয়ের নানা দিক।
প্রচলিত রীতি
পৃথিবীতে অনেক ধর্ম থাকলেও কেবল মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্ম সম্পর্কেই আমরা বিশেষভাবে অবগত। এর মধ্যে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে নিজের ধর্মের কাউকে বিয়ে করার প্রচলন রয়েছে। তবে ইসলাম ধর্মে পুরুষদের জন্য এর পরিধিটা কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মুসলমান পুরুষেরা চাইলে অমুসলিম কিন্তু কিতাবিয়া (খ্রিষ্টান ও ইহুদি) নারীকে বিয়ে করতে পারবে। তবে মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম কিতাবিয়া পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না। এ ছাড়া সব ধর্মের ক্ষেত্রে তারা কেবল নিজ নিজ ধর্মের মানুষকেই বিয়ে করে আসছে। বর্তমানে খ্রিষ্টধর্মে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে বিয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলেই মূলত ‘বিশেষ বিবাহ’ আইন প্রণয়ন হয়। কিন্তু এত দিন ধরে এই আইনের ব্যবহার হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে যেকোনো ধর্মের লোকই বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে বিশেষ বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ে করতে পারবে।বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর ২ ধারা অনুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠানের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে।
প্রথমত : বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারও কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না। অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউ বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিশেষ বিবাহ করতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, বিবাহ করতে ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়স ২১ বছর এবং নারীর বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হতে হবে।
তৃতীয়ত, পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবে না। যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে নোটিশ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর ৪ ধারায় বলা আছে, বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষ রেজিস্ট্রারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবে। যদি এই সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি না করে, তবে বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর অধীন বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। সুতরাং সম্মতি অত্যন্ত জরুরি। এর ১১ ধারায় বলা আছে, বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। বিয়ের দুই পক্ষ রেজিস্ট্রার ও তিনজন সাক্ষীর সামনে, ‘আমি “ক”-কে আইনত স্ত্রী/স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছি’Ñ এই রকম ঘোষণা দেওয়ার সময়, ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে নারী সাক্ষী হলে হবে না। এমনকি দুজন নারী সাক্ষীও গ্রহণযোগ্য নয়। সাক্ষী ঠিকঠাক থাকলে এই আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এ জন্য নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রির বই আছে।
উত্তরাধিকার
তবে এ ধরনের বিয়ের ফলে বেড়ে উঠছে নতুন একটি প্রজন্ম। যারা উত্তরাধিকারসূত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় বহন করছে না। এই উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আবার কেউ কেউ একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের জন্য কোনো আইন নেই।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২-এর ২২ নং ধারা অনুসারে বিয়ে হলে নিজ নিজ পরিবার থেকে নারী ও পুরুষের বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ, যেহেতু বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ মানেই হচ্ছে তুমি নিজেকে কোনো ধর্মের অনুসারী নয় বলে ঘোষণা দিচ্ছ। তাই বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিবাহ হলে, ওই ব্যক্তির যৌথ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ বিবাহ
সরকারিভাবে এমন বিয়ে হওয়ার একমাত্র স্থান পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে। সরকার নিযুক্ত প্রাণেশ সমাদ্দার নামের একজন এ ধরনের বিয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন এত দিন। তার অবর্তমানে এখন অন্য একজন একই জায়গায় এই কাজ করছেন। প্রাণেশ সমাদ্দার ছিলেন শরৎচন্দ্র ব্রাহ্ম প্রচারক নিবাসের আচার্য ও ট্রাস্ট। তিনি সেখানেই থাকতেন।
শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও ছেলেমেয়েরা আসে বিয়ে করতে। বিশেষ করে যারা দেশের বাইরে যেতে চায়, তাদের আসতেই হয়। কারণ, কোর্টে বিয়ে করলে বিয়ে রেজিস্ট্রির কোনো প্রমাণপত্র পাওয়া যায় না। অবশ্য কোর্টে দুই ধর্মের দুজন বিয়ে করতে পারে না। অনেক সময় যারা জানে না তারা প্রথমে কোর্টে যায়। আর তখন আইনজীবীরা এখানে নিয়ে আসেন। এখানে বিয়ে হলেও ডিভোর্স করানো যায় না। ওটা করতে হয় কোর্টে।
নিয়মানুযায়ী বিয়ের ১৪ দিন আগে রেজিস্ট্রারের কাছে নোটিশ দিতে হয়। এর মধ্যে কারও কোনো আপত্তি থাকলে সে তা জানাবে। তারপর তিনজন সাক্ষী আর পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে হাজির হতে হবে। নির্দিষ্ট ছকে ছেলেমেয়ে দুজন স্বাক্ষর করবে আর স্বাক্ষর করবে তিনজন সাক্ষী। আর দুই কপি ছবি সঙ্গে পরিচয়পত্রের ফটোকপি। তারপর এতেই হয়ে যাবে দুজনের বিয়ে।
লেখা : রোদসী ডেস্ক
ছবি : সংগৃহীত