শায়লা জাহানঃ
পরিবারে একটি নতুন শিশুর আগমন অনেক আনন্দ ও খুশির বার্তা নিয়ে আসে। শিশুটির পিতা-মাতা থেকে শুরু করে পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ্য সকলেরই চোখের মণি হয়ে উঠে সে। কিন্তু প্রায়শই যে একটা ব্যাপার নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাঝে কিছুটা মতানৈক্য শুরু হয় তা হল শিশুকে ম্যাসেজ বা মালিশ করা নিয়ে। এটি ভালো না খারাপ তা নিয়ে চলে বিতর্কের। আজ আমরা এই সব কিছু নিয়েই জানবো।
নবজাতক শিশুকে ম্যাসেজ করা বিশ্বব্যাপী একটি প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আমাদের দেশে তো তা আরও ব্যাপক। বাচ্চার গোসলের ঠিক আগে তাদের রোদে শুইয়ে পুরো শরীরে তেল মালিশ করে নেয়া হয়। মৃদু স্ট্রোকে করা এই মালিশে জড়িয়ে থাকে আদর এবং ভালোবাসার ছোঁয়া। নিয়মিতভাবে শিশুকে ম্যাসেজ করা তাদের আরও অনেক কিছু দেওয়ার একটি উপায়। আরও বন্ধন সময়, আরও সংবেদনশীল উদ্দীপনা, আরও স্বাস্থ্যকর বিকাশ। গবেষণা প্রকাশ করে যে, নিয়মিত স্পর্শ এবং ম্যাসেজ উন্নত শারীরবৃত্তিয়, জ্ঞানীয়, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের দিকে পরিচালিত করতে পারে। শিশুর প্রথম মানসিক বন্ধন দৈহিক যোগাযোগ থেকে তৈরি হয় এবং এগুলো পরবর্তী জীবনে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। নবজাতকের সাথে স্পর্শই হলো আমাদের প্রথম ভাষা আর এই প্রেমময় স্পর্শ তাদের শক্তিশালী হতে এবং কম উদ্বেগ অনুভব করতে সাহায্য করতে পারে।
শিশুর ম্যাসেজের স্বাস্থ্য উপকারিতা
-ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইনফ্যান্ট ম্যাসেজ (আইএআইএম) অনুসারে, শিশুর ম্যাসেজ রক্ত সঞ্চালন এবং পাচনতন্ত্রকে উদ্দীপিত করতে সাহায্য করতে পারে
-হজমে সাহায্য করে এবং গ্যাস, ক্র্যাম্প, কোলিক, কোষ্ঠকাঠিন্য এর মতো পরিস্থিতি দূর করতে সাহায্য করে
-নিয়মিত মালিশ করা তাদের মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করে
-এর মাধ্যমে কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) কমিয়ে হ্যাপি হরমোন যেমন সেরোটোনিন এবং ডোপামিন বৃদ্ধি করে, যা শিশুকে আরও ভাল ঘুমাতে সাহায্য করতে পারে
-নাক বন্ধ এবং দাঁতের অস্বস্তি দূর করে
-ভালো পেশীর সমন্বয় ও নমনীয়তা বিকাশে সহায়তা করে
-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
-ত্বকের গঠন উন্নত করে
এইতো গেল ম্যাসেজের উপকারী দিক।
তবে কিছু কিছু জিনিস বাচ্চার ভালোর জন্য সবসময় মনে রাখতে হবে। যেমনঃ
-বাড়িতে বাচ্চাকে ম্যাসেজ করার জন্য অনেক সময় অনেকেই এক্সট্রা লোক নিয়োগ করে থাকে। যিনি ম্যাসেজ করতে আসে তাদের প্যাটার্ন প্রায়ই রুক্ষ হয়, বাচ্চার বাহু এবং পা অতিরিক্ত প্রসারিত করার চেষ্টা করা হয়। এতে জয়েন্টগুলোর স্থানচ্যুতি বা এমনকি ফ্রাকচার হতে পারে। ফলস্বরুপ, ম্যাসেজ প্রায়ই একটি প্রশান্তিদায়ক অভিজ্ঞতার পরিবর্তে একটি চাপযুক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে উঠে। এগুলো পরিহার করতে হবে।
-কখনও কখনও শিশুর ম্যাসেজ করার জন্য ব্যবহৃত তেলগুলো ত্বকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। শিশুর ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এতে শক্তিশালী/ কঠোর পদার্থ সহ্য করার ক্ষমতা থাকেনা।
-শিশুর কানে তেল দেওয়ার অভ্যাস তার কানে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে।
-ম্যাসেজ করার সময় যদি মনে হয় যে তার কোন ধরনের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে বা তার মাঝে তেমন আরামের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছেনা তবে তৎক্ষণাৎ তা থামিয়ে দেয়াই ভালো।
-খাবার খাওয়ার পর পরই কখন ম্যাসেজ করবেনা।
তেল ব্যবহার কি অপরিহার্য?
শিশুর শরীর ম্যাসেজের মতোই তেল ব্যবহারের বিষয় নিয়েও চলে অনেক মতানৈক্যের। আগেরকার সময়ে দাদি-নানিরা খাঁটি সরিষা তেল দিয়ে নবজাতকের পুরো শরীর মালিশ করে দিতো, যা এখনকার সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিষেধ করা হয়ে থাকে। তাহলে উপায়?
-তেল ম্যাসেজ শিশুর নরম, সূক্ষ্ম ত্বককে রক্ষা করতে এবং একই সাথে এটিকে ময়েশ্চারাইজ করতে সাহায্য করে। কিন্তু তাই বলে সমস্ত তেল সমান নয় এবং সেগুলো শিশুর ত্বকের জন্য ভাল নয়। শিশুর ম্যাসেজের জন্য সঠিক তেলের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
-নির্বাচিত তেল প্রথমেই শিশুর ত্বকের একটি প্যাচে ছোট ড্যাব করে প্রয়োগ করে দেখতে হবে তাতে কোন প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। অ্যালার্জি বা সংবেদনশীল ত্বকের শিশুদের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
-সরিষা তেল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয় কারণ এটি ত্বকের উপর বিষাক্ত প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে শিশুর সূক্ষ্ম ত্বকে জ্বালা এবং সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে।
-পরিচিত তেলের মধ্যে অনেকেই অলিভ অয়েল ব্যবহার করলেও এর উচ্চ অলিক অ্যাসিডের কারণে শিশুর মালিশের জন্য একেও সুপারিশ করা হয়না। এটি বাচ্চার ত্বকের শুষ্কতার কিছু স্তর তৈরি করতে পারে।
-২০২০ সালে এক গবেষণায় বলা হয় যে, নবজাতকের উপর ভার্জিন নারকেল তেল প্রয়োগ করা তাদের ত্বকের উন্নতি এবং শক্তিশালী করতে সহায়তা করতে পারে। এটি নবজাতক এবং বয়স্ক শিশুদের জন্য একটি ম্যাসেজ তেল এবং ময়েশ্চারাইজার হিসেবে একই কাজ করতে পারে।
-বাদাম তেল ভিটামিন ই সমৃদ্ধ এবং ২০২০ থেকে ক্লিনিক্যাল গবেষণায় দেখায় যে এটি শিশুর উপর প্রয়োগ করা নিরাপদ।
-এছাড়াও, বিভিন্ন বেবি অয়েল যা আসলে একটি খনিজ তেল এগুলোও ব্যবহার করা নিরাপদ। পেট্রোলিয়াম জেলির মতো খনিজ তেলগুলো শিশুর ত্বকে কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনা।
শিশুর ম্যাসেজ একটি চমৎকার, প্রশান্তিদায়ক থেরাপি যা শিশুকে শান্ত করতে এবং বন্ধনের দৃঢ়তা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সঠিকভাবে ম্যাসেজ করার আগে কয়েকবার অনুশীলন করে নাও। প্রতিটি অনুশীলনের সাথে তুমি তোমার শিশুর সাথে একটি গভীর ও প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
-ছবি সংগৃহীত