পেশা হিসেবে ব্যাংকিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত থাকার সময়েই নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। কাজ করে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। স্বপ্ন দেখেন ব্যাংকিং পেশায় নারীদের পথ আরও সুগম করার। তিনি মধুমতি ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ইন্টারন্যাশনাল ডিভিশনের ফাহমিদা সাকি। বিশ্ব দিবসে রোদসীর আয়োজনে তার মুখোমুখি হয়েছেন তানিয়া আক্তার
পেশাগত জীবন নিয়ে ইচ্ছার শুরুটা জানতে চাই
ফাহমিদা সাকি : কর্মজীবী দম্পতির সন্তান আমি। মা অবসর নিয়েছেন কাস্টমসের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম সুন্দর করে সেজে অফিসে যাচ্ছে। খুব স্মার্ট দেখাত। সেই দৃশ্যটাই আমার পেশাগত জীবনের অনুপ্রেরণা। পারিবারিক আবহ এমন হওয়ায় আমারও স্বপ্ন ছিল পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে উপযোগী করে গড়ে তোলা।
পেশা হিসেবে ব্যাংকিংকেই কেন বেছে নেওয়া?
ফাহমিদা সাকি : ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষের দিকে একটি ব্যাংক থেকে অফার আসে। তখন প্রতিটি ব্যাংকেই কমপক্ষে ৩০ ভাগ নারী থাকতে হবে, এমন পদ্ধতি ছিল। পাকিস্তানের একটি জাতীয় ব্যাংকে যোগদান করি। সেই ব্যাংকে যোগদানকারী প্রথম নারীটিই ছিলাম আমি। ইংরেজি নিয়ে পড়াশোনা করা এমন একজন নারীকেই খুঁজছিল সেই ব্যাংকটি। কাজের ধরনও এমন ছিল যে দেশের বাইরের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা। যেহেতু আমার তখনো স্নাতকোত্তরের ফলাফল আসেনি। সেই সময়টায় খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করতাম। তখন এমন একটি অফার পেয়ে চেষ্টা করতে বলেছে অনেকেই। কারণ, শিক্ষকতা পেশা আমাকে এতটা আকর্ষণ করত না। তাই সিভি নিয়ে গেলাম ব্যাংকে। যেহেতু ব্যাংকিং পেশায় কোনো অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না, তাই গল্পের ছলে অনেকক্ষণ কথা হলো। সপ্তাহখানেক কাজ করতে বলল। তারপর সিদ্ধান্ত জানাবে এমনটাই জানাল। তিন দিনের শেষে সিইও এসে আমায় দেখতে চাইলেন। কাজ দেখে তার এতটাই ভালো লেগেছে যে সেদিনই নিয়োগপত্র দিয়ে দিলেন। সেই থেকেই শুরু কর্মজীবনের পথচলা।
নারী হওয়ায় পেশাগত কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন?
ফাহমিদা সাকি : অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পেশাগত জীবনে প্রবেশের আগেই একজন সন্তান ছিল আমার। সেই সময়টায় ধরে নেওয়া হতো বিবাহিত বা সন্তান থাকার পর কর্মজীবন সামলাতে পারবে না নারীরা। যদিও এখনো আছে এ ধারণা। তারপরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অথচ নারীরা সব সামলে নিয়ে সব পারে। আর সন্তানধারণ করা তো প্রাকৃতিক বিষয়। সেটাকে অসুস্থতা ভাবা ঠিক নয়। নারীদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তখনো ছিল, এখনো আছে। ‘মেয়েমানুষ’ এমন একগুচ্ছ শব্দ সমাজের এমন নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আগে বেশি ছিল, তারপর দীর্ঘদিনের চর্চায় নারীরা সব সামলে নিতে অভ্যস্ত হওয়ায় এখন কিছুটা কমেছে কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
নারীর অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে একজন নারীর মধ্যে কী কী বিষয় থাকা উচিত?
ফাহমিদা সাকি : প্রথমে তো শিক্ষা। এটি থাকতেই হবে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। তারপর নিজেকে দাঁড় করানো। একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। এ ছাড়া এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ ভালোভাবে রপ্ত করা। কারণ, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলেই হবে না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব ধরনের গুণাবলি রপ্ত করার চেষ্টাই একজনকে তার অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।
নির্দিষ্ট কোন বাধাটির মুখোমুখি হন নারীরা?
ফাহমিদা সাকি : নারীদের জীবনসঙ্গী সাপোর্টিভ না হলে সবচেয়ে বড় সমস্যাটির মুখোমুখি হতে হয়। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে আর নির্দিষ্ট কোনো বাধা সাধারণত থাকে না। কর্মক্ষেত্র চায় কাজ। আর কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাই সমান।
ছবি: ফাহমিদা সাকির অফিস
কর্মক্ষেত্রে নারীরা বড় অবস্থানে গেলে অনেক নেতিবাচক কথা শোনায়। এ ক্ষেত্রে আপনার মতামতটা শুনতে চাই।
ফাহমিদা সাকি : নারীরা বড় অবস্থানে গেলে তার সহকর্মীরা নেতিবাচক কথা শোনায়, এমনটা অনেক আগে হতো। এখন তেমনটা হয় না বলা চলে। আমি নিজেও আমার অধীনে কাজ করা নারীদের এমনভাবেই যোগ্য করে গড়ে তুলি। তাদের এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকি। নারীরা নারীদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না অনেক সময়। কিন্তু আমি ওদের এ বিষয়গুলো এড়িয়ে আগে কাজের জায়গায় যোগ্য হওয়ার জন্য বলে থাকি।
কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনে ভারসাম্য নিয়ে আসেন কীভাবে?
ফাহমিদা সাকি : আমি যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি, তখন বিবাহিত ছিলাম। সন্তানও ছিল। তাই আমার ওপরও নানা ধরনের পারিবারিক চাপ ছিল। আমার অফিস টাইম ছিল ৯টা ৫টার ছকে বাঁধা। তারপর পরিবারে ফেরা। সেখানে সবাই কী খাবে, সেটা নির্ধারণ করে রান্না করা। এমন অনেক ধরনের কাজ পরিবারে থাকে, সেগুলো করেছি। তবে এটাকে আমি উপভোগ করেছি। কখনোই অভিশাপ হিসেবে ভাবিনি। কারণ, সংসারজীবনটাও উপভোগ্য করে তোলা যায়। তারপরে যখন কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ আরও বাড়ল, তখন আমি একজন হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে একজনকে নিলাম। কারণ, তখন অফিসে সময়টা বেশি দিতে হবে। এভাবে কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবন আলাদাভাবে উপভোগ করেছি। তাই জীবনে ভারসাম্য এসেছে।
ছবি: পারিবারিক পরিমন্ডলে ফাহমিদা সাকি
সমাজের পিছিয়ে থাকা নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
ফাহমিদা সাকি : নারীদের এখন অনেক সুযোগ। প্রযুক্তি আরও সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীরা যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো জায়গা থেকেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারে । এখন উচ্চশিক্ষিত নারীদের আক্ষেপও কমে গেছে। তারা তাদের অর্জিত শিক্ষা দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারছে। অনেক নারী উদ্যোক্তা হচ্ছে। এভাবে সব পেশাতেই নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তাই সমাজে পিছিয়ে আছে, এমন নারীরা প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে চাইলেই নিজের সুবিধামতো কাজ করে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম খুঁজে নিতে পারে। শুধু ইচ্ছা থাকাটাই জরুরি। আত্মবিশ্বাস আর আগ্রহ থাকলেই একজন নারী এগিয়ে যেতে পারে।
পারিবারিক সহযোগিতা কেমন পেয়ে থাকেন?
ফাহমিদা সাকি : আমি পরিবারের বেশ সহযোগিতা পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি। আমার সন্তানেরা বোঝে যে মায়ের কাজ আছে। সেভাবেই তারা মেনে নিয়েছে। সন্তানেরাও নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে আনন্দ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। ফলে দিনের বেলায় মায়ের অভাবটা কিছুটা পূরণ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে মানসিকভাবে শক্ত হওয়ার চর্চার মাধ্যমে তারাও স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠে। যারা কর্মজীবী নারী, তাদেরও সন্তানের বিষয়ে এত আবেগপ্রবণ না হয়ে মানসিকভাবে পরিপক্ব হতে হবে।
ছবি: বিজয় দিবসে ফাহমিদা সাকি
কারণ, এখন কিছুটা কষ্ট হলেও যখন সন্তানেরা বড় হয়ে যাবে, তখন সুখটা পাওয়া যাবে। সন্তান নাকি কাজ, এমন দ্বিধায় থেকে অনেকেই সন্তানের পাশেই থেকে যান। কিন্তু সন্তান একসময় বড় হয়ে যায়, তখন মায়েরা একাকী হয়ে পড়ে। তাই আবেগ সামলে নিয়ে কাজ করতে থাকলে একসময় সন্তানরো সময়ের প্রয়োজনে পাশে না থাকলেও নিজের একটা সামাজিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই সামাজিক পরিচিতিটা সব বয়সী নারীর জন্য খুব দরকার। আমিও মানসিকভাবে শক্ত ছিলাম বলেই আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছি। আর আমি অবশ্যই ভাগ্যবান যে এমন সাপোর্টিভ পরিবার পেয়েছি, যারা প্রতিমুহূর্তে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
রোদসীর পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন
ফাহমিদা সাকি : নারী-পুরুষের বিভেদ ভাঙতে হবে। যদিও এখন অনেকটা এগিয়ে গেছে দেশ। নারীরা পাইলট হচ্ছে, স্পিকার হচ্ছে, এমনকি বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি গণতান্ত্রিক দেশও চালাচ্ছেন একজন নারী! অথচ ব্যাংকিং সেক্টরেও কোনো নারী ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিল না। গত বছর সেই ঘাটতিও পূরণ হয়ে গেছে। সুতরাং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে এ বিভেদের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে।
রোদসীকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ফাহমিদা সাকি : আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।