শায়লা জাহানঃ
এমন কখনো খেয়াল করে দেখেছো কি বাসার যে ছোট্ট সদস্যটি রয়েছে, যে সদ্য কথা বলতে শিখেছে, আধো আধো বোলে ঘরকে মাতিয়ে রেখেছে সেই বাচ্চার রাগ, জেদে সবার অবস্থা নাজেহাল। একদিকে সে চায় তার সব কাজ সে নিজে নিজেই করতে আবার অন্যদিকে সেই প্রচেষ্টার বিফল ঘটলে হয়ে যায় হতাশ, পরবর্তীতে যা রুপ নেয় বদমেজাজে। শিশুর জীবনের এই টার্মকে বলে টেরিবল টু। অনেকেই এই শব্দটির সাথে পরিচিত না থাকলেও বাচ্চার এই আচরণগত পরিবর্তনের সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত।
টেরিবল টু বা ভয়ংকর দুই শব্দটি দীর্ঘকাল ধরে ২ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বাবা মায়েরা যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে তা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সন্তানের মেজাজ এবং আচরণের দ্রুত পরিবর্তন এবং তাদের সাথে মোকাবেলা করার অসুবিধার কারণে একজন পিতামাতা এই বয়সটিকে ভয়ানক বলে মনে করতে পারে। এটি একটি শিশুর বিকাশের স্বাভাবিক পর্যায়কে বোঝায় যেখানে একটি শিশু নিয়মিতভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের উপর নির্ভরতা এবং স্বাধীনতার জন্য নতুনভাবে বেড়ে উঠার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বাউন্স করতে পারে। লক্ষণগুলো শিশুর মধ্যে ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন এবং মেজাজ ক্ষুব্ধ হতে পারে। এক মিনিটে দেখা যাবে বাচ্চাটি পরম মমতায় তোমাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে আবার পরের মিনিটেই দেখা যাবে সে বিপরীত দিকে দৌড়াচ্ছে। টেরিবল টু বলা হলেও এই ধরনের আচরণ প্রায়শই ১৮ মাস থেকে শুরু হয় এবং তা ৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
এটি কেন হয়?
২ বছর বয়সের আশেপাশে শিশুরা সাধারণত অনেক ধরনের বড় উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই সময় তাদের মধ্যে নতুন সব ধরনের দক্ষতার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। যেমন জাম্পিং, ক্লাইম্বিং, ব্লক স্ট্যাক করা, ক্রেয়ন বা মার্কার দিয়ে আঁকিবুঁকি করা ইত্যাদি। এই পর্যায়ে সে চাইবে স্বাভাবিকভাবেই নিজের একটা পরিবেশ অন্বেষণ করতে এবং নিজের মতো করে সব কিছু করতে। এটা সবই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত আচরণ। কিন্তু এই সময় তাদের মৌখিক, শারীরিক এবং মানসিক দক্ষতা ভালোভাবে বিকশিত না হওয়ায়, সন্তান পর্যাপ্তভাবে যোগাযোগ করতে বা কোনো কাজ করতে ব্যর্থ হয়। তাদের চাহিদা এবং তা প্রকাশের অক্ষমতার জন্য তারা তখন এই ধরনের আচরণ করে থাকে।
লক্ষণ
সকল বাচ্চাই সমান নয় এবং সমভাবে তারা আচরণও করেনা। তাই এই টেরিবল টু’র লক্ষণগুলো বাচ্চা থেকে বাচ্চাদের মধ্যে আলাদা। তবে কিছু আচরণগত নিদর্শন রয়েছে যা পিতামাতাকে সংকেত দিতে পারে যে তাদের সন্তান এই জটিল বিকাশের পর্যায়ে থাকতে পারে। যেমনঃ
-ভাইবোন বা খেলার সাথীদের সাথে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঝগড়া করা
-রাগ হলে লাথি, থুতু বা কামড় দেয়া
-ঘন ঘন মেজাজের পরিবর্তন যেমন এই হাসি তো এই কান্না
-মনোযোগ আকর্ষনের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করা, হাতের কাছে জিনিস ছুঁড়ে ফেলা
টেরিবল টু-এর সাথে আসা উত্তেজনা এবং অবাধ্যতা স্বাভাবিক যা সময়ের সাথে সাথে চলে যেতে পারে। কিন্তু তুমি যদি মনে করো যে আচরণগুলো বেশ দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং তা বাচ্চার খাওয়া, ঘুম বা ডে কেয়ারে যোগদান করাকে প্রভাবিত করছে, তখন একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে নিলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে তারা সন্তানের আচরণ সংশোধন করার জন্য টিপস দিতে পারেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নের প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন।
টেরিবল টু ম্যানেজের টিপস
সন্তান এবং নিজেকে এই ভয়াবহ টার্মটি পরিচালনার জন্য কিছু টিপস ফলো করতে পারোঃ
-বাচ্চার ঘুমের সময়সূচী রাখো। সন্তান যখন ক্লান্ত থাকে তখন এই ধরনের আচরণ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তার ঘুমের সময় যতটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার চেষ্টা করো। ভালো ঘুম ও বিশ্রাম তাদের মেজাজ স্থির রাখতে সাহায্য করবে।
-একই কথা খাবারের বেলায়ও প্রযোজ্য। বাচ্চারা যখন ক্ষুদার্ত অনুভব করে তখন বাইরে যাওয়া এড়াতে চেষ্টা করো। আর যদি খাবারের সময় সন্তানের সাথে বাইরে থাকতেই হয় তবে খাবার প্যাক করে সাথে নিয়ে রাখতে পারো।
-তুমি যে আচরণগুলো অনুমোদন করবে সেগুলোর প্রশংসা করো এবং যেগুলো থেকে বিরত রাখতে চাও সেগুলোকে উপেক্ষা করো।
-সন্তানের সামনে অহিংস আচরণ উপস্থাপন করতে চাইলে তাদের আঘাত করবেনা এবং তাদের উপর চেঁচামেচি করা এড়াতে হবে।
-তাদের কোন কিছু করতে পুননির্দেশ বা বিভ্রান্ত করো। বাচ্চা যখন উত্তেজিত হয়ে চেঁচামেচি করা শুরু করতে থাকে তখন তাদের মনোযোগ অন্য দিকে ডাইভার্ট করার জন্য মজার বা আকর্ষনীয় কিছু দেখানো বা করার নির্দেশ করো।
-বাচ্চার জন্য একটি নিরাপদ, শিশুরোধী পরিবেশ নিশ্চিত করো। ভঙ্গুর বা মূল্যবান বস্তু তার হাতের নাগালে থাকতে পারে এমন জায়গায় রাখবেনা।
-বাচ্চাকে সীমিত পছন্দ করার ব্যাপারে অফার করো। উদাহণস্বরুপ, সে কি খেতে চায় তা জিজ্ঞাসা না করে তাদের আপেল বা কমলা থেকে একটি বেছে নিতে বলতে পারো। এটি শিশুকে অনেক পছন্দের সাথে যোগ না করে নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি দেয়।
-সর্বোপরি নিজেকে শান্ত রাখো। এমন পরিস্থিতিতে যে কারোরই মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু নিজেও ধৈর্য্য হারা হয়ে গেলে এতে আরও বিপত্তি বাড়ে। তাই যখনই পরিস্থিতি তোমাকে রাগের প্রান্তে নিয়ে আসে, তখন কিছুক্ষন বসে থেকে গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য সময় নাও। এটি তোমাকে শান্ত করতে এবং সহানুভুতির সাথে সন্তানের সাথে যোগাযোগ করতে সহায়তা করবে।
সন্তান যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা গ্রহণ করে এবং তাকে বা তার ভালোবাসা এবং সম্মান দেখানোর মাধ্যমে, তুমি তোমার সন্তানকে এই কঠিন পর্যায়ে সাহায্য করতে পারবে এবং তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে সহায়তা করতে পারবে।
-ছবি সংগৃহীত