চার অক্ষরের একটি মিষ্টি শব্দ ‘ভালোবাসা’। ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক ব্যাপার। বিশেষ কোনো মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করা যায় না।
ব্যক্তিগত অনুভূতি
‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী/ ভালোবাসা হলো নিঃশ্বাস এ দেহের/ নিঃশ্বাস বিনা মানুষ কখনো বাঁচে কি…’ কিশোর কুমারের বিখ্যাত এ গানটিই বলে দেয় ব্যক্তিজীবনে ভালোবাসার প্রয়োজন কতটুকু। ভালোবাসার সংজ্ঞাটি বিতর্ক, অনুমান এবং অন্তর্দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাধারণভাবে ভালোবাসাকে একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেটা একজন মানুষ অপর আরেকজন মানুষের প্রতি অনুভব করে। কারও প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীলতা কিংবা প্রতি ক্ষেত্রে কারও উপস্থিতি অনুভব করা ভালোবাসার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত।
প্রচলিত ধারণায় ভালোবাসা নিঃস্বার্থতা, স্বার্থপরতা, বন্ধুত্ব, মিলন, পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ভালোবাসাকে নিয়ে রচিত হয়েছে হাজার হাজার গান, কবিতা ও গল্প। এই ভালোবাসা সামনে রেখে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে পালিত হয় ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’। যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার সম্পর্ক পৃথিবীতে ছিল, আছে এবং থাকবেও অনন্তকাল।
ভালোবাসা এবং ভালো লাগা
ভালোবাসা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন- নিষ্কাম ভালোবাসা, ধর্মীয় ভালোবাসা, আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি। অনেকেই ভালোবাসার মতো একটি সর্বজনীন ধারণাকে আবেগপ্রবণ ভালোবাসা, কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা কিংবা প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভালোজন এসব ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী নন। তবে এসব ভালোবাসাকে শারীরিক আকর্ষণের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস করা যেতে পারে। ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। আবেগধর্মী ভালোবাসা সাধারণত গভীর হয়, বিশেষ কারও সঙ্গে নিজের সব মানবীয় অনুভূতি ভাগ করে নেওয়া, এমনকি শরীরের ব্যাপারটাও এ ধরনের ভালোবাসা থেকে পৃথক করা যায় না। ‘ভালোবাসা’ এবং ‘ভালো লাগা’ শব্দ দুটি একই রকম মনে হলেও অনেকটা গোলমেলে বা বিভ্রান্তিকর। ভালো লাগা ছাড়া ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা ছাড়া প্রেম হয় না কিন্তু প্রেম না হলেও ভালোবাসা হতে পারে। ভালো লাগাটা প্রাথমিক পর্যায়, প্রেমের পর্যায়টা চূড়ান্ত। অন্যভাবে বলা যায়, ভালোবাসার ব্যাপারটা হলো কারণ, আর প্রেমটা ফল।
ভালোবাসার জৈবিক ভিত্তি
প্রেম বিশেষজ্ঞ হেলেন ফিশার প্রেম বা ভালোবাসার অভিজ্ঞতাকে তিনটি আংশিক ওভারল্যাপিং পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। কামনা, আকর্ষণ এবং সংযুক্তি। কামনা হলো যৌন বাসনার প্রাথমিক ধাপ যা টেস্টোস্টাইন এবং অ্যাস্ট্রোজেনের মতো রাসায়নিক পদার্থ বেশি মাত্রায় ত্যাগ করে। এর প্রভাব কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর্যন্ত পর্যন্ত হয়। আকর্ষণ আরও স্বতন্ত্র এবং রোমান্টিক হয় একটি নির্দিষ্ট সঙ্গীর জন্য, যার মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র লালসা বিকশিত হয়। স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন তার মস্তিষ্ক নিয়মিত নিউরোট্রান্সমিটার হরমোন, ডোপামিন, নোরপাইনফ্রাইন এবং সেরোটোনিন রাসায়নিক পদার্থ ত্যাগ করে। এর ফলে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে, হার্টের কম্পন বৃদ্ধি পায়, ক্ষুধা এবং ঘুম হ্রাস পায় এবং উত্তেজনা বেড়ে যায়। এই পর্যায় সাধারণত দেড় থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যেহেতু কামনা এবং আকর্ষণের পর্যায়গুলোকে অস্থায়ী বলে মনে করা হয়, তাই দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য একটি তৃতীয় পর্যায় প্রয়োজন।
আর তা হলো সংযুক্তি। সংযুক্তি হলো একধরনের বন্ধন, যার কারণে সম্পর্ক অনেক বছর এমনকি কয়েক দশক পর্যন্ত দীর্ঘ¯ স্থায়ী হতে পারে। সংযুক্তি সাধারণভাবে বিবাহ বা শিশু জন্মদান করার মতো অঙ্গীকারগুলোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পারস্পরিক বন্ধুত্ব বা পছন্দের বিষয়গুলো ভাগ করে নেওয়ার কারণেও সম্পর্ক দীর্ঘ¯স্থায়ী হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্বল্পমেয়াদি সম্পর্কের চেয়ে দীর্ঘ স্থায়ী সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক অক্সিটসিন এবং ভাসপ্রেসিন নির্গত হয়। প্রোস্টেট অণুটি স্নায়ু বৃদ্ধিকারক ফ্যাক্টর (এনজিএফ) নামে পরিচিত। যখন কেউ প্রথম প্রেমে পড়ে তখন এর মাত্রা অনেক বেশি থাকে, কিন্তু এক বছর পর তা আবার পূর্ববর্তী স্তরে ফিরে আসে।
ভালোবাসাকে প্রকাশ করো
ভালোবাসা হলো এক অর্থে দুই স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ভালোবাসা কোনোভাবেই মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে নেই। এর ফলে তুমি একসময় তোমার মনের মানুষটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারো। ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সবাই ভালোবাসে, সবাই প্রেমে পড়ে। কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি সবার একরকম হয় না। ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে তুমি সহজেই কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারো।
ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে প্রথম উপায় হলো ভয় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা প্রকাশ করা। মনের মানুষটি কী পছন্দ করে, তা শিগগিরই খুঁজে বের করো। সেটা কোনো জিনিস হতে পারে, কোনো বিষয় হতে পারে, এমনকি খাবারও হতে পারে। পছন্দের জিনিসটি উপস্থাপন করে কিংবা উপহার দিয়ে তোমার ভালোবাসাকে প্রকাশ করো এবং বুঝিয়ে দাও তোমার ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি নেই। মানুষের ভালোবাসা প্রকাশ করার অন্যতম উপায় উপহার। মনের মানুষটির কাছে এই উপহার তোমার অনুভূতিকে বারবার প্রকাশ করতে সাহায্য করবে।
ভালোবাসার মানুষটিকে প্রতিটি কাজে উৎসাহ দাও, যাতে সে সাহস পায়। সব বিষয়ে তোমার উৎসাহ পেলে সে তোমার কাছে অন্য রকম স্বস্তি অনুভব করবে। আর তোমার ভালোবাসাও তার কাছে ধরা পড়বে। মনের মানুষটির চাহিদা অনুযায়ী কিছু একটা করার চেষ্টা করো, এতে তোমার ভালোবাসাটা প্রকাশ পাবে।
মনের মানুষটির কাছে নিজেকে প্রকাশ করো। সত্যিকারের তোমাকে যখন সে খুঁজে পাবে, তখন তোমার ভালোবাসাও সে অনুভব করতে পারবে। মনে রাখবে, মানুষ তখনই নিজেকে একজন মানুষের কাছে পুরোপুরি প্রকাশ করে, যখন সে তাকে সত্যি ভালোবাসে। সামনাসামনি কথা বলার অনুভূতিটাই অন্য রকম। তাই একবারের জন্য হলেও তাকে সামনাসামনি বলার চেষ্টা করো তুমি তাকে ভালোবাসো।
ভালোবাসার আলিঙ্গনে হৃদরোগ নিরাময়
বিজ্ঞানীদের গবেষণায় হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের ব্যাপারে এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়েছিল ২০০৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্বিদ্যালয়ের ড. ক্যারেল গ্রেন কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে গবেষণা করে জানিয়েছিলেন, প্রেম বা ভালোবাসার আলিঙ্গন হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা শতগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদযন্ত্রের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে আসে। ভালোবাসার আলিঙ্গন নারী-পুরুষ উভয়ের হৃদযন্ত্রের জন্যই নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর এ প্রক্রিয়া পুরুষের চেয়ে নারীর হৃদয়ের জন্য বেশি কার্যকর। গবেষণার শুরুতে ৩৮ নারী ও পুরুষকে বেছে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে অর্ধেক হচ্ছে দম্পতি এবং অর্ধেক অবিবাহিত। পরে নারী ও পুরুষদের আলাদা করে রক্তচাপ ও স্নায়বিক অবস্থার রেকর্ড নেওয়া হয়। পরে দম্পতিদের একটি রুমে রেখে সুখকর কোনো রোমান্টিক মুহূর্ত চিন্তা করে আলিঙ্গন করতে বলা হয়। গবেষকেরা দেখেছেন, এ অবস্থায় আলিঙ্গনের ফলে তাদের রক্তচাপ কমে গেছে এবং অক্সিটসিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়েছে।
হৃদযন্ত্রের সুস্থ ও সবল রাখতে অক্সিটসিন হরমোন অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি। ড. ক্যারেল গ্রেনের সঙ্গে একই মতামত পোষণ করেন ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. গ্রিফিথ। তিনি বলেন, ভালোবাসা বা প্রেমের আলিঙ্গন মানবদেহের কার্ডিও প্রোটেকটিভ ব্যবহার অত্যন্ত দৃঢ় করে।
সম্পর্কটাকে ঠিক রাখো
‘সম্পর্ক’ ও ‘ভালোবাসা’ শব্দ দুটি একসঙ্গে জড়িত। ভালোবাসে সবাই। কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে কজন? ভারসাম্যপূর্ণ রোমান্টিক জীবন গড়ে তোলা ও সম্পর্ক গভীরতর করা কঠিন কিছু নয়। অনেক সময় সামান্য ভুল-বোঝাবুঝির কারণে সহজেই ভালোবাসার সম্পর্কে ফাটল ধরে যায়। ভালোবাসার সম্পর্ককে ঠিক রাখার জন্য কিংবা ধরে রাখার জন্য তোমাকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।
নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন থাকো এবং খুব কাছের বন্ধু হিসেবে ওকে সবকিছু জানতে দাও। দেখবে সেও তার নিজের দুর্বলতাগুলো তোমার কাছে তুলে ধরছে। এতে সম্পর্ক গাঢ় হবে। জীবনে নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত থাকে। সেই সংকটের মুহূর্তে দৃঢ়তা নিয়ে তোমার সঙ্গীর পাশে দাঁড়াও। তোমার সরলতা তোমার সঙ্গীকে আরও কাছে টানবে। তুমি যা, তা তোমার বন্ধুকে জানতে দাও। নিজের মতো করে তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করো না। এতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, প্রত্যেক মানুষেরই থাকে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব। তুমি যদি সব সময় তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকো তা তোমার সঙ্গীকে দূরে সরিয়ে দেবে। কাজেই কোনো কিছু না বুঝে কিংবা না জেনে ভালোবাসার মানুষটিকে সন্দেহ করা কোনোভাবেই উচিত নয়।
ভালোবাসার সম্পর্ক যেমন গভীর, তেমনি ঠুনকো। সামান্য সন্দেহ কিংবা সামান্য কোনো কারণে ভালোবাসার সম্পর্কটা যেন ফাটল না ধরে, সে ব্যাপারে অবশ্যই তোমাকে সচেতন থাকতে হবে। খুব ভালো করে জানতে হবে, বুঝতে হবে তোমার কাছের মানুষটিকেÑ তবেই না তোমাদের দুজনের ভালোবাসার সম্পর্কটা গভীর থেকে গভীরতর হবে।
লেখা : প্রদীপ সাহা