ভালোবাসা আর ভালো বাসা দুটোই বেশ দুর্লভ! অন্তত আজকের এই দুনিয়ায় কথাটা একশ ভাগ খাঁটি। ভালোবাসা বলতে যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপের ইমোজিতে বন্দী এক সম্পর্কের নাম; ঠিক তেমনি অভিজাত এলাকার খুপরিঘরে কোনোমতে ঠাঁই নেওয়াটাই ভালো বাসার শিরোনাম। হ্যাঁ, আজকের যুগে ভালোবাসা আর ভালো বাসা তাই দুর্লভ একটা ব্যাপারই বটে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অজানা আতঙ্কে প্রাচীন যুগের মানুষ প্রথম গুহার অভ্যন্তরে নিজেদের আশ্রয়স্থল বানিয়েছিল। কিংবা হয়তো অন্ধকারে অশুভর উপদ্রব থেকে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে বাঁচাতে গড়েছিল গুহা বা জঙ্গলের মধ্যে বাসা। এরপর আগুন জ্বালানোর মধ্য দিয়ে সভ্যতার উন্নতি হয় ধীরে ধীরে। গুহা বা জঙ্গল ছেড়ে সুউচ্চ অট্টালিকা কিংবা দৃষ্টিনন্দন আর আভিজাত্যময় বাড়ি বানানোর পেছনে সময়, শ্রম আর অর্থ সবই ব্যয় করতে রাজি হয় মানুষ। এভাবেই কালের প্রেক্ষাপটে বদলে যায় বাসার সংজ্ঞা।
আবার ভালোবাসার সংজ্ঞাটাও কিন্তু একইভাবে সময়ের আবর্তে বদলে গেছে। নবী ইউসুফ আর জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, লাইলী-মজনু কিংবা আধুনিক কালের রোমিও-জুলিয়েটের উপাখ্যান যা-ই বলা হোক না কেন, বদলে গেছে অনেক রীতি আর কৌশল। সবচেয়ে বড় কথা, এখনকার সময়ে অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে সামাজিকতা কিংবা পারিপার্শ্বিকতা। কিন্তু ইন্টারনেটের এই যুগে এসে যেখানে ভালোবাসা বিশ্বব্যাপী নিজের বিস্তার লাভ করার কথা ছিল, সেখানে ইন্টারনেটের সংকোচনের মতোই যেন কুঞ্চিত হয়ে এল ভালোবাসারও পরিধি।
প্রিয়জনের সঙ্গে থাকা অবস্থায়ও এখন চোখ থাকে মোবাইল ফোনে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দায়বদ্ধতায়ও মা-বাবার সঙ্গে অনেক সময় কথাবার্তার সুযোগ হয় না। এ ছাড়া বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সবার সঙ্গেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ সেরে নেওয়ায় কমছে বন্ধনের স্থায়িত্ব।
অথচ প্রবাদ আছে, মানুষ নাকি ভালোবাসার কাঙাল।
যদি এখন কেউ জিজ্ঞেস করো আমায় কেন বললাম এ কথা? তাহলে হয়তো আমার বিশাল পরিসরের উত্তর শোনার ধৈর্য তোমাকে রাখতে হবে। কেননা, ভালোবাসা মানেই যে প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমনটা কিন্তু নয়; বরং পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানসন্ততির, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব এমনকি আত্মীয়তার সম্পর্কগুলোও এখানে যুক্ত। আবার একইভাবে বৃহৎ পরিসরের একটা খোলামেলা বাসায়ই যে কেবল ভালো বাসার সংজ্ঞা, এমনটা ভাবাও নেহাত বোকামি।
ভালো বাসার মধ্যে ভালো পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতার একটা ব্যাপার থাকে; থাকে নির্ভরশীলতা আর আস্থার ব্যাপারগুলো। সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, সুসম্পর্ক থেকে শুরু করে সুনাগরিকতার ব্যাপারটা যুক্ত থাকে এই ভালো বাসা ব্যাপারটিতে। ভালোবাসা কিংবা ভালো বাসা দুর্লভ কেন, সেটা জানতে হলে বুঝতে হবে ভালোবাসা আর ভালো বাসার জন্য কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর আবশ্যক।

ভালো বাসার মধ্যে ভালো পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতার একটা ব্যাপার থাকে; থাকে নির্ভরশীলতা আর আস্থার ব্যাপারগুলো।
ভালোবাসা আর ভালো বাসা
ভালোবাসা মানেই যে শুধু মনের মানুষ তা কিন্তু নয়; প্রথমেই এই ধারণা থেকে মুক্তি দিতে হবে নিজের মস্তিষ্ককে। মনের মানুষ বলতে যে আমি প্রিয়জন কিংবা সঙ্গী বুঝিয়েছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব হলেও এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বলাটা একপ্রকারের অসম্ভবই বটে।
কেননা, ভালোবাসা হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, যা ঠিক যতটা মানবিক, ততটাই জাগতিক আর ঐশ্বরিক। ভালোবাসাটা অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতি যেমন হতে পারে, তেমনি প্রকৃতির প্রতিও হতে পারে; অবলা জীবদের প্রতিও হতে পারে। আবার একইভাবে বাড়িঘর নামক এক জড়বস্তুর ওপরও ভালোবাসাটা আটকে যেতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা; আর ভালোবাসা থেকে মায়া। তবে শুধু ভালোবাসি বললেই যে ভালোবাসা হয়ে যায়, এমনটা কিন্তু নয়! এর জন্য চাই মনের গভীর অনুভূতি। তাহলে এটা স্পষ্ট যে ভালোবাসা কেবল দুটি মনের বন্ধনই নয়, বরং পরিবর্তিত দুটি মনের বাঁধন। যুক্তিতর্কের বিচারে অনেকেই ভালোবাসা নামক এই অবোধ্য শব্দটিকে বুঝতে না পেরে হেসে উড়িয়ে দেয়। তাদের জন্য আছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পাঁচ মিনিটের মতো সময় লাগে বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি আকৃষ্ট হতে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা ৪ মিনিট বা ৪ মিনিট ৩০-৪০ সেকেন্ড মধ্যেই ঘটে থাকে। এই আকৃষ্টতার ক্ষেত্রে মানবমস্তিষ্ক কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। অঙ্গভঙ্গি কিংবা বাহ্যিক রূপ ৫৫ শতাংশ, কণ্ঠস্বর থেকে শুরু করে মার্জিত কথা বলার ভঙ্গিমায় থাকে ৩৮ শতাংশ এবং এরপর মূল বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে শেষ ৭ শতাংশ।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় ভালোবাসাবিষয়ক গবেষণার ফল হিসেবে জানিয়েছে, প্রেমের মূলত তিনটি স্তর আছে। প্রতিটি স্তরেই আলাদা রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে থাকে মস্তিষ্কে এবং স্তরভেদে রাসায়নিক পদার্থ আর হরমোন নিঃসৃত হয়।
প্রথম স্তর ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা
বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ভালো লাগলে সেই ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার ইচ্ছা বা আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টেরন আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন নামক এক হরমোন নিঃসৃত হয়।
দ্বিতীয় স্তর আকর্ষণ
কারও সঙ্গে দীর্ঘদিন মেশার ফলে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে কাউকে ভালোবাসার ফলে তার প্রতি একধরনের আকর্ষণবোধ তৈরি হয়। এই স্তরে তিনটি নিউরোট্রান্সমিটার জড়িত : এড্রিনালিন, ডোপামিন এবং সেরোটানিন। নিউরোট্রান্সমিটার আসলে একধরনের এন্ড্রোজেন রাসায়নিক। এটি এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য স্নায়ুকোষে সংকেত পাঠায়।
তৃতীয় স্তর সংযুক্তি
এই স্তরে এসেও দুটি আলাদা হরমোনের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় : অক্সিটোসিন এবং ভ্যাসোপ্রেসিন। দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকার পর পরস্পরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে ঘর বাঁধতে রাজি হয় দুজনই।
ওই আলোচনাটিকে শুধু মনের মানুষের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখাটা মোটেও সমীচীন হবে না। কেননা, মা-বাবার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটা যেমন নাড়ির বা অস্তিত্বগত, ঠিক তেমনি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটা আবার আত্মিক। এখন অনেক পরিবারই আছে, যাদের সব সদস্যই দিন শেষে রাতে এসে কিছু সময়ের জন্য মিলিত হয় জীবনযাপনের তাগিদে। নাহ্্, এটা শুধু যে দিন আনে দিন খায় মানুষের চিত্র; এমনটা কিন্তু নয়।
বরং নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারেও একই চিত্র বিরাজমান। এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তাদের ভালোবাসার বন্ধন কি ঠুনকো? নাহ্! মোটেই নয়! যদিনা তারা রাতের একটা নির্দিষ্ট প্রহর সবাই একসঙ্গে কাটায়। সারা দিনের ক্লান্তিও যেন হার মানে তাদের সেই ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে।
তবে এই যে পরিবারের সবার একত্র হওয়া, এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার পাশাপাশি ভালো বাসাটাও জরুরি। কেননা, একটু খোলামেলা পরিবেশ, একটু প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, যথেষ্ট আলো-বাতাসের উপস্থিতির সঙ্গে হাঁটাচলা কিংবা নড়াচড়ার জন্যও চাই পর্যাপ্ত জায়গা। শুধু কি তাই? এর পাশাপাশি দরকার ঘরের দেয়ালের রং থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, বারান্দায় টবের গাছ ইত্যাদির কথাও চলে আসে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সাজানো-গোছানো একটা ঘর মনে বইয়ে দিতে পারে প্রশান্তির বাতাস। আর একটা ঘিঞ্জি ঘর করতে পারে বিরক্তির উদ্রেক, মনের অশান্তি এবং সাংসারিক কলহের সূত্রপাত। আর সাংসারিক কলহ কিন্তু আবার ঘুরেফিরে সেই ভালোবাসার ওপরই আঘাত হানে।
তাহলে এখন কী বলবে? যে লাউ সেই কদু? হ্যাঁ, যেই ভালোবাসা সেই ভালো বাসাও বলা যায়। তাহলে চলো ভালো বাসা সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
সকালের প্রথম সূর্য কিরণ আর স্নিগ্ধ পরিবেশ করতে পারে একটা শুভদিনের সূচনা। কেননা, ভোরের সেই কোমল আলোয় মন হয়ে ওঠে প্রশান্তিময়। আর একই কথা যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে যাই, তাহলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানীদের গবেষণার সাহায্য নিতে হয়। তাদের মতে, যাদের ঘরে দিনের আলো বেশি সময় ধরে স্থায়িত্ব হয়, তাদের শরীর আর মন দুটোই সুস্থ থাকে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস না থাকলে গুমোট পরিবেশে মনমেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং ভালো বাসার এই প্রাদুর্ভাবটা ভালোবাসার সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে।
চাই সাজানো-গোছানো ছিমছাম বাসা! বাংলায় একটা বাক্য আছে না, ‘সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ’। ঠিক তেমনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ীই ঘরটাকে সাজাও। লোকদেখানো ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে দেখা গেল তোমার ঘরের তুলনায় আসবাব বড় হয়ে গেছে কিংবা বেমানান লাগছে; তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। তাই সাধ্যের পাশাপাশি নান্দনিকতার ব্যাপারটাকেও প্রাধান্য দিতে হবে। দরকারে সময় নিয়ে ঘরের আসবাব বাছাই করো; কেননা ঘরের আসবাবের ওপরই অতিথিদের ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব বিরাজ করে। আবার, একই সঙ্গে এত নান্দনিক উপস্থাপনায় ঘর সাজিয়ে অগোছালো রেখে দিলে কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হবে না। যে তো সেই হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর গোছানো ভাবটা সদা কাম্য।
আচ্ছা বলো তো, প্রকৃতির রং সবুজ কেন? আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা এর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা চালিয়েছেন। আর তাতে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে সতেজ সবুজ রং মানুষের অনুভূতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সৃজনশীলতা ও কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে উদ্যমী করে তোলে। যার জন্য শত স্ট্রেস কিংবা মন খারাপের সময়গুলোতেও সবুজ মাঠ অথবা প্রান্তরের দিকে তাকালে কিংবা সবুজের মাঝে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর মনে একধরনের প্রশান্তি অনুভূত হয়।
আরেক গবেষণালব্ধ জ্ঞানে এ-ও জানা গেছে, সবুজের মাঝে গেলে ৯০ মিনিটের মধ্যেই মানুষের সব মানসিক চাপ কমে আসে ধীরে ধীরে।
তাহলে এবার চিন্তা করে দেখো তো, যদি সারা দিনের ক্লান্তি আর জ্যামের বিরক্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে একপশলা সবুজ দেখতে পাও, তাহলে কি তোমার মন খানিকটা হলেও শান্ত হবে না? অবশ্যই হবে। সে জন্য ঘরে প্রবেশের করিডরগুলো সবুজ রঙে সাজলে নিজের পাশাপাশি অতিথিদের কাছেও ব্যাপারটা ইতিবাচক বলেই গণ্য হবে। কিন্তু অনেকেই ভাড়া বাসায় থাকে। ফলে চাইলেও সবুজ রং করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না অনেক সময়ই।
তবে কি জানো তো, সবুজ মানেই প্রকৃতি। তাই চাইলেই একগাদা প্রকৃতি ঘরের দুয়ারে কিংবা অভ্যন্তরে রেখেও এই প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভব। এতে করে সিমেন্টের জঞ্জালে থেকেও থাকা যাবে প্রকৃতির আরও কাছে। নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ভেসে আসবে ফুলের সুবাস। একই সঙ্গে বাড়বে ধৈর্য। আবার একই সঙ্গে বারান্দা কিংবা ছাদে গড়ে তোলা সম্ভব ছোটখাটো কৃষিবাগান। মনে রেখো, মানুষ যতই যান্ত্রিক হোক না কেন আদতে সে প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির কাছেই ফিরতে হবে তাকে। তাই প্রকৃতির প্রতি সূক্ষ্ম টানটা মানুষের আদি আর উৎসের প্রবৃত্তি।
তবে ভালো অনুভূতি জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে সবুজের পরেই নীল আর হলুদ রঙের জুড়ি মেলা ভার। যদিও সাহিত্যের বিচারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের এটা জ্ঞাত যে নীল হচ্ছে বেদনার রং। তবে একই সঙ্গে কবি-সাহিত্যিকেরা কিন্তু এটাও বলে যে নীল হচ্ছে প্রশান্তির এক রং। নীল রং মনকে করে প্রশান্ত। যেমনটা সমুদ্রের বিশাল নীলের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। তাই হালকা নীল বা আকাশি নীল রঙের বিছানার চাদর, পর্দা মনকে রাখতে পারে প্রফুল্ল। আর হ্যাঁ, সাদা হচ্ছে শুভ্রতা আর পবিত্রতার প্রতীক। তাই সাদা রং ব্যবহার করাটাও অনিবার্য। তবে কি, সাদায় দাগ পড়লে বিরক্তির মাত্রা দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই সাদা রং ব্যবহারে চাই অতিরিক্ত সতর্কতা।
আবার অনেকে হলুদ রঙের কথাও ভাবতে পারে তারুণ্যের প্রতীক ভেবে। কিন্তু হলুদ আদতে বাসাবাড়ির সবকিছুর জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন তোয়ালে, ফুলদানি, টব বা শোপিস হলে মানানসই বলা যায়। একই সঙ্গে লালকে ভালোবাসার রং বলা হলেও লাল রং বাড়িঘরের ক্ষেত্রে অনেক কটকটে লাগে। ঠিক যেমনটা কালো এবং অন্যান্য কটকটে রঙের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ওপরের আলোচনায় ব্যাপারগুলো আসলে ভালো বাসার জন্য জরুরি বা আবশ্যকই বলা চলে। পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম আর আলো ঝলমলে বাসা মনকে রাখে প্রফুল্ল আর সতেজ। বাসার আকৃতিটা খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না, যদি সুন্দর, নান্দনিক, ঝকঝকে, আরামদায়ক, গোছানো, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের উপস্থিতি থাকে। এমন মনোরম পরিবেশের ভালো বাসায় ভালোবাসার অভাব হওয়ার কথা নয়; হোক না সেটা স্বামী-স্ত্রী বা মা-বাবা অথবা ভাই-বোন কিংবা পরিবার-পরিজনের সম্পর্ক।
ভালোবাসায় ভালো বাসার প্রভাব কতটুকু?
ভালোবাসা মানেই একটা সম্পর্কের সূচনা। আর এই সম্পর্কের আদতে কোনো নাম নেই। যদিও প্রচলিত ভাষায় তা ভালোবাসা বলেই খ্যাত তবে এই শব্দটা নিজের শব্দের মাঝেই বিশাল আর পরিপূর্ণ। সম্পর্ক এমন একটা ব্যাপার যে এই নামের সঙ্গে যেটাই জুড়ে দেওয়া হোক না কেন, সেটাকেই সে পূর্ণতা দেবে। তবে যে কোনো ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রেই গভীরতা, আস্থা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মান এবং একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
ধরো, তোমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই জব করো। তো সারা দিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি ফিরে যদি দেখো ঘরবাড়ি অগাছালো; তাহলে কি মেজাজ ঠিক রাখা সম্ভব? নাহ্্ একদমই নয়। আবার, ধরো দিন শেষে তোমার একটু একা সময় কাটাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু বাসাটা এতটা কনজাস্টেড যে এক মুহূর্তের জন্যও খানিকটা একা সময় কাটানোর ফুরসত নেই। তাতে করে এই বিরক্তিভাবটা মনকে প্রবোধ দিবে আর রাগের উৎপত্তিটাও এখান থেকেই ঘটবে।

ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রেই গভীরতা, আস্থা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মান এবং একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।
আবার এই অগোছালো বাসার কারণে সৃষ্ট বিরক্তির ভারটা গিয়ে পড়তে পারে সন্তানসন্ততির ওপর রাগে পরিণত হয়ে। হ্যাঁ, এটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। অথচ খোলামেলা, আলো ঝলমলে এক বাস্তুসংস্থান কিন্তু রাগান্বিত একটা মনকে মুহূর্তেই শীতল করে তুলতে পারে। আর এটা যে মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার ফল, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তাই ভালোবাসার সম্পর্ক অটুট রাখতে চাই ভালো বাসা।
আবার অনেকে বাসাবাড়িতেই পোষা প্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে চায়। জীবের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এমনটা করে থাকে অনেকে। এর মধ্যে বিড়াল, কুকুর, কবুতর, টিয়া পাখি, ময়না, খরগোশ বা অ্যাকুরিয়ামে হরেক প্রজাতির মাছ উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে যে বাসায় পোষা প্রাণী থাকলে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থাকে কম। কেননা, তুমি যখনই একটু দুশ্চিন্তায় ডুবে যেতে শুরু করবে তখনই হয়তো তোমার পোষা প্রাণীটা উষ্ণতার খোঁজে তোমার কোলে আশ্রয় নেবে। এতে করে তোমার মস্তিষ্ক আর শরীর ব্যস্ত হয়ে পড়বে পোষা প্রাণীটিকে নিয়ে আর দুশ্চিন্তা নিমেষেই বিদায় নেবে। তবে পোষা প্রাণী যেটাই হোক না কেন, চাই বাড়তি যত্ন আর সতর্কতা। ভ্যাকসিন দেওয়া থেকে শুরু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটাও তোমাকে করতেই হবে।

তুমি যখনই একটু দুশ্চিন্তায় ডুবে যেতে শুরু করবে তখনই হয়তো তোমার পোষা প্রাণীটা উষ্ণতার খোঁজে তোমার কোলে আশ্রয় নেবে।
আগের আলোচনা শেষে নিশ্চয়ই তুমি আমার সঙ্গে একমত পোষণ করবে যে ভালোবাসার পরিপূর্ণতায় ভালো বাসাটাও আবশ্যক। যে ধরনের সম্পর্কই হোক না কেন, সম্পর্কে যেমন একে অপরকে বোঝার কিংবা বোঝানোর ক্ষমতা থাকা লাগে, তেমনি ভালো বাসার ক্ষেত্রেও ঘরের মাপজোখ বুঝে সে অনুযায়ী ঘরকে সাজিয়ে তোলার মানসিকতাও থাকা লাগবে। তাহলে হয়তো তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারবে, ভালোবাসা আর ভালো বাসা এতটা দুর্লভ নয় বরং চাইলেই এটাকে সহজলভ্য করে তোলা সম্ভব।
লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবিসূত্র: ওমর ফারুক টিটু , রোদসী এবং সংগ্রহীত