মন্থন – রুখসানা কাজল

করেছে Wazedur Rahman

কাটা পেঁয়াজের খোসার ভেতর আঙুল চালিয়ে কী যেন খুঁজছেন আমার শাশুড়িমা।
কী খুঁজছেন মা?
অমলিন হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, কুঁচোনো কিছু পেঁয়াজ পড়ে গেছে, তাই তুলছি মা।
এহে, ময়লা লেগে গেছে তো। ওগুলো ফেলে দিলেই তো হয়। অকৃত্রিম ঘৃণায় সিঁটিয়ে উঠি আমি।
খুঁজে পাওয়া পেঁয়াজের টুকরোগুলো পরম যত্নে টিউবওয়েলের পানিতে ধুয়ে মিশিয়ে দিলেন বাটিতে উঁচু হয়ে থাকা কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে, খাওয়ার যোগ্য জিনিস হেলাফেলায় ফেলতে নেই গো মেয়ে। ওরাও অভিশাপ দেয়।

উপচে পড়া চিনিগুলো অন্য বয়ামে তুলে রাখতে রাখতে আমি ভাবি, জীবনভর কী তুলছি আমি? স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা নাকি অবিশ্বাসের সুতোনলি সাপ? জয়ঢাক পেট নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াই। কখনো পড়তে বসি। কখনো পুরোনো বাড়ির বালু খসে পড়া দেয়াল, ছাদের কড়িকাঠ দেখি। মাঝে মাঝে কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়ালের ক্ষতগুলো থেকে আরও বালু-সিমেন্ট ঝরিয়ে দিই। শাশুড়িমা হাসেন। স্নেহ ছলকে ওঠে তার চোখেমুখে। যদিও তার মনের ভেতরে শতেক অশান্তি। এই তো বয়েস মেয়েটার। সামনে পড়ে আছে অসীম সময়। জীবনের অসংখ্য ঘাট, ঘুলঘুলি, আলোছায়ার নানা বাঁক কী করে এতটা পথ একা একা পেরোবে এই মেয়ে?

বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই স্বামী মরে গেল। তার আদরের সর্বশেষ সন্তান। মৃত্যু কী অপরিমেয় অবিবেচক। তিনিও তো ছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দ্বিধাহীন আলিঙ্গনে তিনিও পারতেন মৃত্যুকে তার জীবন দিয়ে দিতে। হাসির সঙ্গে কান্না মিশে যায়। আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চান, শিশুটিকে কি রাখবে মা? তোমার তো অধিকার আছে দ্বিতীয় জীবন বেছে নেওয়ার! নিজেকে নিয়ে ভাববার! জীবন যে মস্ত বড়, ভেবে দেখো আরেকবার।

সাঁঝসন্ধ্যায় সবাই ব্যস্ত ঘরে ঘরে সন্ধ্যাকে আলো দেখাতে, ধূপধুনো, নামাজ পড়ে নাশতা বানাতে। শাশুড়িমা আমার পাশে জায়নামাজে বসে আছেন পশ্চিম দিক মুখ করে। আমার রায় শোনার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছেন এক সন্তানহারা মা।
আমি পেটের ওপর হাত রেখে বলি, এই আছিস?

দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। আমার হাত কাঁপে। মেরুদণ্ডে স্রোত ভাঙে টেনশনের। আর ঠিক তক্ষুনি চিনচিনে এক নাড়াচাড়া মাতৃবন্ধি নাড়িতে টান দেয়। আমি মাথা শক্ত করে বলি, থাকুক মা। একা লড়াইয়ে ও না হয় আমার বন্ধু হবে।

শাশুড়িমার কালো মুখে মুক্তো গড়ায়। তিনি নদীতে বইঠা ফেলার মতো হাত দুলিয়ে বলে ওঠেন, আসুক, আসুক। আসুক তবে তোমার রাজাধিরাজ। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো মা। জোরসে পড়ো। লড়তে গেলে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে যে! একা একা সন্তান পালন! সে বড় কঠিন কাজ। তুমিই মা, আবার তোমাকেই বাবা হতে হবে।

 

হাসপাতালের কেবিনে চোখ খুলে দেখি অনেকগুলো মুখ। ঝাপসা। কে যেন খুশি খুশি গলায় বলে ওঠে, শুনছ ডক্টরকে জানাও ওর সেন্স এসেছে। ব্যথার সাগরে ছেঁড়া পাতার মতো দুলছি আমি। একেকটি ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর আমি কুঁকড়ে কেঁদে ফেলছি। কেউ একজন জেতা ট্রফির মতো একটি শিশুকে তুলে ধরল খানিক উঁচুতে। প্রচণ্ড রাগে কাঁদছে শিশুটি। কে এই শিশু? ওর হাতে নম্বর লেখা সাদা কাগজটি প্রতিটি কান্নার সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত ক্রোধ কেন শিশুটির! ও কি ভুল কোলে এসে পড়েছে! এরা কারা? পরাজিতের উঠোনে এ কোন বিজয় উৎসব?

একটি শীর্ণ বয়স্ক নারী তার হাতে আমার কপাল ছুঁয়ে দিয়ে হাসছে, ও মেয়ে শুনতে পাচ্ছ, তোমার সেনাপতি এসে গেছে। তুমি আর একা নও। আমার শাশুড়িমাও উদ্ভাসিত চাঁদমুখে হেসে গলে পড়ছে। তার পাশে আরও কিছু উজ্জ্বল মায়ামুখ। চেনা চেনা অথচ হারিয়ে যাচ্ছে অচেনার অলিগলিতে। আমি প্রাণপণে সেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি, আমিই জন্ম দিয়েছি শিশুটিকে। তীব্র আলোর সেই ওটি, ডাক্তার-নার্সদের সেই গাঢ় নীল মুখোশ মুখ! আমার মনে পড়ে যায় সবকিছু।

জুতায় খটাখট শব্দ তুলে সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন ডাক্তার দ্রুত এসে আঁতকে ওঠেন। কাকে যেন ধমকে ডেকে পাঠান, এখন তো সেন্স আসার কথা নয়! নার্স সিস্টার সিরিঞ্জ উঠে আসে ডাক্তারের হাতে। অচেতনার গোলাপি ঘরে চলে যেতে যেতে আমি দেখি আপন রক্তের নয় মানুষগুলো সজল ব্যাকুলতায় চেয়ে আছে। ভালোবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট ঘর থাকে? গোত্র? ভালোবাসার পিতা কে? কে মাতা? কতজন ভাইবোন আছে ভালোবাসার? কাছের-দূরের লতায়-পাতায় জড়ানো ছড়ানো আত্মীয়রা কী করে কোন মায়ায় বেঁধে রাখে ভালোবাসাকে? ভালোবাসায় এত জল! আনন্দের! প্রাপ্তির! হারানো! মৃত্যুতে!

শিশুটির কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল পরাতে না পেরে আমার শাশুড়িমা ওর পায়ের নিচে কাজলের টিপ পরিয়ে দিলেন। ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। কাজল পরাতে দেখলেই ডাক্তার আন্টি আমার শাশুড়িমাকে বকে দিয়ে বলবেন, বড় আপা, এসব কুসংস্কার। তারপর নিজেই দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া লিস্ট দেখিয়ে বলে যাবেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে নবজাতকের যত্ন-আত্তি, লালনপালনের নির্দেশনামা। শাশুড়িমার মুখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি খেলে মিলিয়ে যায়। চকিতে শালিকের মতো মাথা নেড়ে মেনে নেয় ডাক্তার বোনের সব কথা। তারপর নির্জন দুপুরে সবাই চলে গেলে খালি বাসায় শিশুটিকে গোসল করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে চুলের ফাঁকে কাজলের টিপ পরিয়ে তিনি গুনগুন করে সুর তোলেন, পরথমে বরননা করি আল্লাহ রসুলের নাম॥ তারপরেতে শোনো পুত্র তোমার মাতার নাম॥ পুবদিকে সূর্যি ওঠে পশ্চিমেতে ডোবেএ এ এ-

কী বোঝে কে জানে! সুর থামলেই শিশুটি চেঁচিয়ে কাঁদে। পায়ের ধাক্কায় জানিয়ে দেয় প্রতিবাদ। ঘুম তাড়িয়ে আবার সুরে ফিরে আসেন মা। ক্লান্তিহীন অবিরাম সুরের সুতায় বাঁধা পড়ে যায় দুটি অসম প্রাণ। দুজনেই একসঙ্গে জাগে। একসঙ্গে ঘুমোয়। আমি বয়সী মানুষটির গায়ে এক পাত্তার নরম কাঁথা ছড়িয়ে দিই। শিশুটিও জড়িয়ে আছে নানা রঙের সুতায় গাঁথা কাঁথায়। আড়াই দিন বয়সী শিশুটির গায়ে হাস্নাহেনার সুগন্ধ। ওর মুঠো করা লাল হাতের ভেতর একটি আঙুল রাখতেই আশ্চর্য আন্দাজে আমার দিকে ওর মাথা ঘুরে আসে। এক অস্ফুট অভিমানের শব্দ করে আদরে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে দেয় আমার আঙুল। চোখের দীর্ঘ পাপড়িতে মেঘজমা ভেজা রং। পাপড়ি ছুঁতেই হঠাৎ তাকিয়ে দুটি হাতই পুরে দেয় মুখের ভেতর।

পায়ের আঘাতে সরে যায় গায়ের কাপড়। নাভিবাঁধা ব্যান্ডেজ দুলছে। ছোট্ট আদুরে পেট। পেটের নিচে পুরুষ পরিচয়ের দিকচিহ্ন খয়েরি লিঙ্গটি নমিত কোমল সুন্দর। আমি আরেকটু ছুঁয়ে দিই। পায়ের পাতায় পদ্ম রং। তাতে শাশুড়িমায়ের আঁকা বিপদ তাড়ানো স্বস্তিশেল। আমার বিস্মৃতির খাম থেকে মুছে যায় অচেনা সব স্বাক্ষর। কী অসহায় ছোট্ট মিষ্টি মানুষ। শরীর কাঁপিয়ে ধেয়ে আসে রক্তকণা। দুটি বুকে দোল খায় আসমুদ্র বাঁচার রসদ। এই প্রথম শিশুটিকে দুহাতে তুলে নিই। কী করে যেন বুঝতে পারি, ক্ষুধা লেগেছে বাবুটার। খাওয়ার যোগ্য অমিত সুধা ঝরে যাচ্ছে যুগল স্তন থেকে। সভ্যতায় অভিশাপ ছোঁয়ার আগে আমি স্তন তুলে দিই ওর মুখে।

পড়তে পড়তে মেকিয়াভ্যালি রেখে দিই। লম্বা শিকের জানালার বাইরে কলাগাছের ঝাড়। মা কলাগাছের আশপাশে অসংখ্য ছোট-বড় শিশু কলাগাছ। হাতে হাতে ছুঁয়ে আছে সবাই সবাইকে, আমিও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি আমার সুনির্মিত শিল্প। হাত, পা, কান, একমাথা কালো চুল, চোখ, দৃষ্টির গভীরতা। ও দেখে আমাকে। ওর চোখে চিরচেনার সাদা আলো।

শাশুড়িমা দুকাপ চা এনে ঘন হয়ে কাছে বসেন, শিশুরাই ঈশ্বর। ওরাই পথ। ঘর। মাঠ। আকাশ। সমুদ্র। ওরাই পৃথিবী। বেঁচে থাকার অপাপ শক্তি। স্বপ্ন। সাহস। ওদের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছে করে। বাঁচতে হয়। ওরাই বাঁচিয়ে রাখে। এই যে আমার বেঁচে থাকা, সে তো তোমাদের জন্য মা।

আশ্বিনের ঝোরা বৃষ্টিতে নেয়ে গেছে কলাঝোপ। বড় গাছগুলো থেকে পানি ঝরে পড়ছে ছোটদের মাথায়। হাতে-পায়ে। মানুষের ঝোপে শাশুড়িমাকে ছুঁয়ে থাকি আমি। আমার কোলে এক নতুন শিশু। দুদিন পরেই পরীক্ষা। পলিটিক্যাল থট। শিশুটির নরম ঠোঁটে, গালে, কপালে, লাল পায়ের তালুতে চুমু খাই। গুনগুন করছে মা, এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…আমি দোল দিই। ঝুলনের দোল। মা আমিনার কোলে। যশোদা মাঈয়ের কোলে, আমার কোলে…দোলে পৃথিবী দোলে।

 

ছবি: সংগ্রহীত 

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

thirteen − 9 =