আজমেরী হক বাঁধন বিডিএস পাস করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ থেকে। ক্যারিয়ার গড়েছেন মিডিয়ায়। তিনি ২০০৬ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় রানারআপ হওয়ার মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন। ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’ কথাগুলো যেন তার বেলায়ই খাটে। মিডিয়ায় ক্যারিয়ার শুরু করতে না করতেই মিডিয়াকে বলেছিলেন ‘বাই বাই’। আবার ফিরেছেন তিনি। নিজের অবস্থান করেছেন পাকাপোক্ত। সম্প্রতি তিনি রোদসীকে জানালেন জীবন জার্নির কথা। কথপোকথনে স্বরলিপি।
পড়াশোনা বনাম মিডিয়ায় পদচারণ
আমি যখন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন লাক্স সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় এসেছি। তখন আমার ডাক্তারি পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য মিডিয়ায় খুব বেশি কাজ করতে পারতাম না। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে একটু-আধটু কাজ যা করতাম, শুধু হুমায়ূন আহমেদ স্যারের নাটকে কাজ করা হতো। আমার পড়াশোনায় কোনো গ্যাপ তৈরি হতে দিইনি। ২০০৯ সালে ডাক্তারি পড়া শেষ হলো। এরপর এক বছর মিডিয়ায় মোটামুটি কাজ করা হয়েছে। ক্যারিয়ারের একেবারে দারুণ সময় পার করছিলাম। লাক্স সুন্দরী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই অনেক ভালো ভালো কাজের অফার পাচ্ছিলাম। সেগুলোর বেশির ভাগ ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। প্রথম কারণ পড়াশোনা।
ক্যারিয়ারের অন্য পথ
ডাক্তারি পাসের এক বছর পর আমি বিয়ে করলাম। এরপর ঘোষণা দিলাম মিডিয়ার কাজ আর করব না। বিয়ের দুই মাস পার না হতেই আমি কনসিভ করলাম। খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলাম, একটা ভুল লোককে বিয়ে করে; ভুল একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি। তখন জানি, একটা ভয়াবহ অবস্থার মুখে এসে পড়েছি। কী করব, কোনো কিছু বুঝে ওঠা সহজ হচ্ছিল না। আমি কখনো ভাবতে পারিনি মিডিয়ায় আবার কাজ করতে পারব। আমার তখন ওজন হয়ে গিয়েছিল সাড়ে ৮৬ কেজি।
আত্মবিশ্বাস হারানো, আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প
আমি যাকে বিয়ে করেছিলাম, সে বলেছিল ‘আমরা একটা চেম্বার দেব’। সন্তান জন্মদানের পর চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করব বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু সে কথা রাখেনি। অনেক ঘটনাই ঘটতে থাকল ব্যক্তিজীবনে। ডিপ্রেসড হয়ে গেলাম। ঘটনাগুলো কাউকে তেমন বলতেও পারছিলাম না। এর মধ্যে আমি মা হলাম। আমার সন্তানের বয়স যখন আট মাস, তখন নিজের ওজন কমানোর প্রতি মনোযোগী হলাম। কিন্তু তখনো বুঝতে পারছিলাম না ক্যারিয়ার কোন দিকে নেব। একবার সিদ্ধান্ত নিলাম মিডিয়ায় ফেরার। চিন্তা হলো সন্তানকে নিয়ে, সে তো তখনো বুকের দুধ খায়। তাকে রেখে আমি কীভাবে শুটিংয়ে যাব। যাদের কাজ মোটামুটি পায়ে ঠেলে মিডিয়া থেকে চলে গিয়েছিলাম, তাদেরই আবার নিজ থেকে নক করলাম। কেননা, আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম আমাকে কাজে ফিরতেই হবে। কথা হলো চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি আমাকে সেটে এসে কথা বলতে বললেন। আমি গেলাম। প্রায় দুই বছরের ব্যবধানে বউদির (চয়নিকা চৌধুরী) সঙ্গে দেখা হলো। বউদি আমাকে বললেন, ‘বাঁধন, তুমি কাজ করতে পারবে। কোনো অসুবিধা নাই।’ সেটে ছিলেন মাহফুজ ভাই আর তারিন আপু। মাহফুজ ভাইয়ের সামনে মানসিকভাবে অপদস্থ আর বিপর্যস্ত বোধ করছিলাম। তার কারণ হলো মাহফুজ ভাইয়ের ‘চৈতা পাগল’ নাটকের কাজ আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাহফুজ ভাই, আমাকে দেখে সে বিষয়ে কোনো কথা তুললেন না। তিনি আমাকে কটু কথা শোনাতেই পারতেন। কারণ তখনো তো কেউ জানে না, কেন আবার মিডিয়ায় ফিরতে চাইছি। উল্টো মাহফুজ ভাই আমাকে উৎসাহ দিলেন। তো, দেখা করার দশ-বারো দিন পরেই বউদি আমাকে ফোন করলেন। একটি কাজের অফার দিলেন। আমি তাকে বললাম, আমি তো কাজটা অবশ্যই করতে চাই। কিন্তু একটাই সমস্যা, আমাকে তো সেটে বাচ্চাকে নিয়ে আসতে হবে। সে তিনি বললেন, ‘বাচ্চা নিয়ে আসবা, অসুবিধা নাই’। ওই মুহূর্তের ওই কথাটা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এই জন্য আমি সারা জীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
কাজের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে
চয়নিকা চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করার পরে আমি জুয়েল মাহমুদের একটি সিরিয়ালে এবং মাঈনুল হাসান খোকনের একটি সিরিয়ালে কাজ শুরু করি। দুটি সিরিয়ালেরই কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলাম। আমি আমার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে শুটিংয়ে যেতাম। আমার সঙ্গে আরও দুজন মানুষ এক্সট্রা থাকত। তাদের সঙ্গে নিতে হতো সন্তানকে দেখে রাখার জন্য। তখন জুয়েল মাহমুদের সেটে একটি রুম ছেড়ে দিতে হতো। সম্প্রতি আমজাদ হোসেন স্যার মারা গেছেন। ওনাকে নিয়ে একটা স্মৃতির কথা বলি, আমজাদ স্যার ‘আকাশ মেঘে ঢাকা’ নাটকে আমার বাবা ছিলেন। তখন গরমের দিন। সবাই মিলে ডিসিশন নিল আমাকে আমার বাচ্চার জন্য মেকআপ রুমটা ছেড়ে দেবে। একমাত্র মেকআপ রুমেই এসি ছিল। আমজাদ স্যারের মতো এত বড়মাপের মানুষ, তিনিও কিন্তু সেই স্যাক্রিফাইসটা করেছিলেন। বাকি সবাই একটি রুমে ছিলেন। নিজের ইচ্ছা আর এই সাপোর্টগুলোর জন্য আমি মিডিয়াকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে পেরেছি।
নেগেটিভ মন্তব্য নিয়ে মন্তব্য
আমি মনে করি, মানুষ আমাদের মানুষ মনে করে না। এটা আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমাদের নিয়ে যারা বাজে কথা বলে তারা যদি একটু মনে করত আমরাও রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, তাহলে হয়তো বলত না। কারণ, এগুলো কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ করে হিংসার বশবর্তী হয়ে। যেহেতু তার কাছে নেই, সেটা যখন আমার কাছে আছে, সে হয়তো ওই জিনিসটাকে মানসিকভাবে মেনে নিতে পারে না। এটা কিন্তু আমাদের সোসাইটির প্রবলেম। আমরা সব সময় খারাপ জিনিসগুলোকে বেশি ফোকাস করে ফেলি। যদিও যারা খারাপ বলছে, তাদের সংখ্যা খুবই কম। আমি দেখেছি সেটি দুই শতাংশের কম। কিন্তু খারাপ কথা মানুষকে এত আঘাত করে যে সে কথা যদি একটাও হয় সেটা সে ভুলতে পারে না।
অন্যদের নিয়ে আপনার মন্তব্য
যার যার জীবন তার তার। যার যার ক্যারিয়ারও তার তার পছন্দের।
নিজের কাছে নিজে
মানুষ যা কিছুতে উৎসাহ দিয়েছে, সেগুলো মনে রাখতে চাই। কে কী বলল, মনে রাখতে চাই না। কারণ, একেকজন একেক কারণে খারাপ বলে। আমি তো তার ভাবনা ঠিক করতে পারব না। সে কেন খারাপ বলল, সেটা কিন্তু তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি বলতে পারি যে কখনো কারও খারাপ চাইনি।
তবে কি আর ডাক্তারি পেশায় ফেরা হবে না?
ফিরব। আমি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে পেরেছি। চেম্বার দেব। মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে চাই। অভিনয়টাও ছাড়ব না। এখান থেকে আমি অনেক পেয়েছি, এই সেক্টরের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসা সবই আছে। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার মনে হয় আমি এই দুই-ই হতে চেয়েছি। সুযোগ যেহেতু আছে, তাহলে কেন নয়!
রোদসী/আরএস