শায়লা জাহান
২০১১ সালে মুক্তি পায় গুণী পরিচালক সুমন ঘোষ নির্মিত “নোবেল চোর” ছবিটি। নোবেল চুরির পটভূমিতে একজন দরিদ্র কৃষক ভানুর কল্পিত বিবরন রয়েছে এই ছবিতে। যিনি ঘটনাক্রমে চুরির সাথে জড়িয়ে যান। মেডেল ফেরত অথবা বিক্রির মাধ্যমে নিজের জীবন সাথে গ্রামের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শেষের দিকে তিনি এমন লোকদের সাথে সাক্ষাত করে শেষ করেছেন যারা তাঁর নিরীহতা কাজে লাগানোর আশা করেছেন। পরবর্তীতে দরিদ্র ভানুর বোধোদয় হয় এবং তাঁর স্বগতোক্তি হয় এমন, “এটা বিক্রি করার জিনিস নয়, মাথায় করে রাখার জিনিস।” ছবির এই ভানুর মত বাস্তবের নোবেল চোরের আদৌ কোন অনুতাপ হয়েছিলো কিনা কিংবা নোবেল পদকটির কি পরিণতি হয়েছিলো বিশ্ববাসীর কাছে তা আজো অজানাই রয়ে গেল।
ঘটনাটি হয়েছিল ২৫ মার্চ, ২০০৪ সালে। সময় সকাল ১০টা ১৫ মিনিট। প্রতিদিনকার মত এক দিনের বিরতির পর বৃহস্পতিবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। মিউজিয়ামের প্রদর্শনী হলটি যখন খোলা হয় চুরির ঘটনাটি তখনিই ধরা পড়ে। ধারনা করা হয় চুরিটি তার আগেরদিন রাতে অর্থাৎ বুধবারে করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরায়ণ কমপ্লেক্সে বিচিত্রা ভবনের রবীন্দ্র স্মৃতি জাদুঘরে চুরির ঘটনায় নোবেল পুরস্কার, প্রশংসাপত্র ছাড়াও কবিগুরু ও তাঁর স্ত্রীর ব্যক্তিগত অনেক মুল্যবান জিনিসপত্র সহ প্রায় অর্ধ- শতাধিক আইটেম খোয়া যায়। সুরক্ষা কর্মীদের দায়িত্বের অবহেলার কারনে গার্ড সহ ৮জন কে আটক করা হয়েছিল। তবে বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছিলেন যে, চুরির কাজটি খুব সুপরিকল্পিত ছিল এবং যারা এই কাজটির সাথে জড়িত ছিল তারা কোথায় কি আছে তার ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। কারন দুর্বৃত্তরা শুধুমাত্র সেই আলমারিগুলো ভেঙ্গে খুলেছে যার মধ্যে মুল্যবান জিনিসপত্রগুলো ছিল। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল থেকে ২৬টি আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যের সব কটি শাখাই প্রস্ফুটিত হয়েছিল রবিঠাকুরের অসামান্য লেখনীতে। তাঁর রচিত গল্প, উপন্যাস, গান আমাদের যেমন আবেগে ভাসায় তেমন ভালোবাসতে শেখায়। প্রথম এশিয়ান নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ এখনও পুরো বাংলায় আইকন হিসেবে শ্রদ্ধাশীল। তাই তাঁর নোবেল চুরির ঘটনায় পরবর্তীকালে দেশব্যাপী এক উত্তেজনা শুরু হয়েছিল এবং দোষীদের খুঁজে বের করার জন্য ব্যাপক তল্লাশী অভিযান চালানো হয়েছিল। রাজ্য সরকার, প্রতিবেশী রাজ্য এবং দেশগুলোর সাথে সীমানা সিল করে দিয়েছিল এবং চুরির সম্ভাব্য পলায়নের পথ রোধ করতে রেলস্টেশন এবং বিমানবন্দরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। ঘটনার ছয়দিনের মাথায় এর তদন্তের ভার চলে যায় সিবিআই এর হাতে। কিন্তু সিবিআইও এটা পুন্রুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় এবং ২০০৭ সালে মামলাটি বন্ধ করে দেয়। রাজনৈতিক চাপে ২০০৮ সালে আবার তদন্ত শুরু হলেও পরের বছরে তারা ইস্তফা দেয়।
মেডেল উদ্ধারের জন্য তদন্ত ব্যর্থ হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রেপ্লিকা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার জন্য সুইডিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে স্টকহোম তাতে সম্মত হয়েছিল। রবিঠাকুরের চুরি যাওয়া নোবেল পদকটির স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রতিলিপিগুলো কবির ১৪৪তম জন্মদিনের দুদিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে, সিআইডি তদন্তে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করেছিল। নোবেল চুরির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বীরভূম জেলার রুপপুর গ্রাম থেকে প্রদীপ বাউরি নামে এক বাউল গায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। একসময়ের গ্রাম্য পঞ্চায়েতের প্রধান বাউরিকে জিজ্ঞাসাবাদে পদক চুরিতে জড়িত অপরাধীদের আশ্রয় এবং রাষ্ট্র থেকে তাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার সাথে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জানা যায় যে, মোহাম্মদ হোসেন শিপুল নামে এক বাংলাদেশী ছিল এই ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারী এবং এতে দুই ইউরোপীয়ও জড়িত ছিল। কিন্তু এত কিছুর পরেও ১৬টি বছর পার হয়ে গেল, কবিগুরুর নোবেলের খোঁজ অধরাই রয়ে গেল।