নিজেকে নিয়ে মানুষের ভুল ধারণার শেষ নেই। এমন ধারণা থেকে শেষ পর্যন্ত জন্ম নিতে পারে মানসিক রোগ। লোকে কী ভাবছে নয়, যেমন আছি ভালো আছি এই বিশ্বাস না থাকলে সমস্যা থেকে উত্তরণ সত্যিই কষ্টকর।
ছেলেটি কলেজে পড়ে। এসএসসিতে রেজাল্ট খুব ভালো। কিন্তু এখন তার বিশ্বাস, নাকটা ভীষণ কুৎসিত, মুখের সঙ্গে একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ, যদিও আজ পর্যন্ত এ কথা তাকে কেউ বলেনি। সে এ-ও বিশ্বাস করে, সে যখন বাইরে যায়, তখন মানুষ অবাক হয়ে তার নাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। লজ্জায় তাই সে একটা রুমাল দিয়ে নাক ঢেকে রাখে সব সময়। ছেলেটি মনোচিকিৎসককে নাক দেখাতে মোটেও রাজি নয়। ফলে প্রচণ্ড হতাশায় ভোগে। রোগীকে আত্মীয়স্বজন জোর করে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় রোগটির নাম বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার। এ রোগে আক্রান্তদের বিশ্বাস, তাদের শরীরের কোনো এক অংশ কুৎসিত, অসামঞ্জস্য, ত্রুটিপূর্ণ ; যদিও বাস্তবে এদের শরীরে কোনো ত্রুটি নেই বা থাকলেও তা অতি নগণ্য। এই কাল্পনিক ত্রুতির কারণে রোগী প্রচণ্ড টেনশন ও হতাশায় ভুগে থাকে। এ সমস্যা দূর করতে রোগী পাগল হয়ে ওঠে। রোগীর পরিবার এ কাজে বাধা দিলে রোগীর হিংস্র হয়, আত্মহত্যার হুমকি দেয়।
এ ত্রুটি দূর করতে তারা সাধারণত কসমেটিক সার্জনের কাছে যায়। সাধারণত মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে চায় না। রোগীরা বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে। অন্যদের সঙ্গে নিজের ত্রুটি যুক্ত (কাল্পনিক) অংশের তুলনা করে। শরীরের কোনো কোনো অংশের ত্রুটি রোগী শনাক্ত করে। রোগীর নাক, ঠোঁট, চোখ, ব্রেস্ট (নারীদের ক্ষেত্রে) নিতম্ব, পুরুষাঙ্গ (পুরুষের ক্ষেত্রে) আগে বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এখন এটি অবসেশিভ ডিসঅর্ডারের মধ্যে ধরা হয়। কারণ, রোগীর মধ্যে এ চিন্তা বারবার মাথায় আসে। এ চিন্তা দূর করতে রোগীরা কিছু কমপালসিভ কাজ করে। যেমন আয়নায় বারবার নিজের শরীর বা শরীরের অংশ দেখা, বারবার নিজেকে দেখে বা অন্যকে দিয়ে পরীক্ষা করায়। রোগী অন্য ব্যক্তির মুখ থেকে সান্ত্বনা ও আশ্বাস শুনতে চায়। তাকে সাপোর্ট করার জন্য উদগ্রীব থাকে।
অন্যরা যদি তাকে বলে, তোমার কিছুই হয়নি বা তোমার শরীরে তেমন দৃষ্টিকটু কিছু নেই, তাতে রোগীর চিন্তা একই থাকে। বরং ফল হয় উল্টো। রোগী নিজ উদ্যোগে কসমেটিক সার্জনের শরণাপন্ন হয় এবং সার্জারি করতে চাপ দেয়। অপারেশনের পরও রোগীর মানসিক তৃপ্তি আসে না। বরং মানসিক কষ্ট বাড়ে। তাই কসমেটিক সার্জারি এ রোগ নিরাময়ে কোনো সমাধান নয়। অসফল সার্জারি বা বারবার সার্জারিতে কারও কারও মুখ, ব্রেস্ট বা শরীরের অন্য অংশ ভয়াবহ বিকৃত হয়ে পড়ে।
বিশ্বখ্যাত পপ গায়ক মাইকেল জ্যাকসন বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি মুখসহ অন্যান্য স্থানে ১১ বার কসমেটিক সার্জারি করান। চিকিৎসকদের নিষেধ সত্তে¡ও তিনি তা করান। তবু তার মনে কোনো তৃপ্তি আসেনি। বরং ভয়াবহ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত।
আমাদের দেশে এ ধরনের রোগী কত, সে সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য নেই। তাই বলে দেশে এ ধরনের রোগী নেই, এমন নয়। এ ধরনের রোগীর স্বাভাবিক ও পারিবারিক জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগী লজ্জা ও সংকোচে সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে চায় না। মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে না। ক্রমে রোগী গৃহবন্দী হয়ে পড়ে।
রোগের লক্ষণ
- দেহকাঠামো নিয়ে মনে মনে বারবার অহেতুক চিন্তার উদয় হয়।
- নিজের চেহারার গঠন নিয়ে মনে অলীক বা অস্বাভাবিক ধারণার জন্ম হয়।
- মাঝেমধ্যেই আয়নায় নিজেকে দেখার একপ্রকার প্রবণতা দেখা যায়।
- কাছের মানুষের কাছ থেকে নিজের এমন বদ্ধমূল ধারণা যাচাই করার মানসিকতার জন্ম হয়।
- নিজের সম্পর্কে হীনমন্যতার বোধ জাগ্রত হয়।
- চিন্তাভাবনায় অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে।
- রাগ এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
- স্কুল, কলেজ বা কাজের জায়গায় সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ, মনের অস্থিরতার জন্য কাজের দক্ষতা হ্রাস পায়।
- নিজের চেহারার গড়নের জন্য মনের মধ্যে এমন অস্বস্তি এবং ভয়ের জন্ম হয় যে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আর যোগাযোগের কোনো ইচ্ছা থাকে না।
- সর্বোপরি, সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করলে রোগীর আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়।
এ সমস্যার সঙ্গে কো-মরবিডিটি হিসেবে বিষণ্নতা , আত্মহত্যার প্রবণতা, শুচিবাই, সোশ্যাল ফোবিয়া দেখা দিতে পারে।
রোগের কারণ
অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যার মতো এ ক্ষেত্রে কোনো একটি কারণকে চিহ্নিত করা মোটেই সহজ বিষয় নয়। এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ কারণ।
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ
আমাদের সমাজ, পরিবার বা বন্ধুদের মধ্যে কারও চেহারার গড়ন নিয়ে হাসাহাসি বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন লম্বা লোককে হিন্দিতে ‘লম্বু’ বা মোটা মানুষকে ‘ডুম্মি’ বলে ডাকা হয়। পরিবার বা বন্ধুদের কাছ থেকে এ ধরনের ব্যঙ্গ শুনে মানুষের মনে তার নিজের সম্পর্কে একধরনের অসন্তোষ, হীনমন্যতা বা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
নেতিবাচক আত্মকল্পনা
আত্মবিশ্বাসহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে একজনের অতিরিক্ত অস্বাভাবিক চালচলনে, অত্যধিক শরীরচর্চা, বেশি খাওয়াদাওয়া করা বা কম পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
উদ্বেগ
চরিত্রগত বা ব্যক্তিত্বের সমস্যা, যেমন কেউ অতিরিক্ত নিখুঁত হতে চেষ্টা করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় মানসিক উদ্বেগজনিত বিকার।
চিকিৎসা
বিডিডির চিকিৎসায় অনেক পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যদিও সমস্যা গুরুতর আকার নিয়ে মানুষকে অবসাদ বা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে যথাযথ ওষুধ প্রয়োগ একান্ত জরুরি। আরেকটি কার্যকরী পদ্ধতি হলো কগনিটিভ বিহেভিয়ারেবল থেরাপি বা সিবিটি।
এই কৌশলের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ শারীরিক গঠনের বদ্ধমূল বিশ্বাসকে লঘু, ভাঙার বা বদল করার চেষ্টা করা হয়। এই দুটি কৌশলেরই লক্ষ্য হলো আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক এবং সর্বাঙ্গীণ কার্যকলাপকে উন্নত করা। এ ধরনের রোগ নিরাময়ে রয়েছে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং আমাদের দেশেই তা দেওয়া সম্ভব।
সিবিটি (কগনিটিভ বিহেভিয়ারেবল থেরাপি)
রোগীর চিন্তার ত্রুটি বের করে তা ঠিক করতে দীর্ঘমেয়াদি সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়।
সাইকো এডুকেশন
রোগী ও তার পরিবারকে বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান দেওয়া। সাইকোথেরাপি ও ওষুধের ভূমিকা এবং উপকারিতা ও পরিণতি বোঝানো হয়।
ফ্যামিলি থেরাপি
সাপোর্টিভ সাইকোথেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়। এ ছাড়া রয়েছে শিথিলায়ন বা রিলাক্সেশন ট্রেনিং। তবে ওষুধ ও সাইকোথেরাপি দুটো চিকিৎসা একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব হলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
লেখা : রোদসী ডেস্ক