শিশুদের স্ক্রীন আসক্তি কমানোর উপায়

করেছে Shaila Hasan

শায়লা জাহান:

পাঠ্যবইয়ে পড়া সুফিয়া কামালের “আজিকার শিশু” ছড়াটির কথা মনে আছে? তাতে তিনি বলেছেন-

“আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/ তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা/ আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগণ জুড়ি।“ আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেশ ও জাতির উন্নতির কল্পে তাদের মাঝেই লুকায়িত হয়ে আছে হাজারো সম্ভাবনার জীয়নকাঠি। যে বয়সে তাদের মাঝে সৃজনশীল প্রতিভা বিকশিত হওয়ার কথা, সে বয়সেই এসে তারা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের উপর চরমভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে; যা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতোই বটে।

কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন এবং দূরত্ব শিক্ষার মডেলগুলোর কারণে, অনেক শিশুর মাঝেই দিনে আরও বেশি স্ক্রীন টাইম অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এই কারণেই দিনের বাকি সময়ে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবহার কমানো আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আপডেট থাকার জন্য এগুলো সংস্কৃতির একটি অংশ হলেও, শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, স্থূলতা হ্রাস সহ আরও অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা সম্পর্ক রয়েছে এই স্ক্রীন সময় কমানোর সাথে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, করোনার সময় আমরা সবাই বাইরের কাজ, হোম স্কুলিং, বাড়ির কাজ এবং শিশু যত্নের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করার সময় বেবিসিটার হিসেবে এইসব ডিভাইসের উপর নির্ভর করেছি। মহামারী চলাকালীন এগুলো অপরিহার্য ছিল, কিন্তু এখন আমাদের বাচ্চাদের স্ক্রীন ব্যবহার ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে কিনা তা দেখার সময় এসেছে। আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের একটি গ্রহণযোগ্য স্ক্রীন সময়ের জন্য সুপারিশগুলো হলঃ

-২ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য স্ক্রীন টাইম নেই

-২ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য প্রতিদিন এক ঘন্টা

-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন দুই ঘন্টা

কিন্তু বাস্তবতা হলো ৮৫% শিশু এই পরিমানকে ছাড়িয়ে যায় যা তাদের সুস্থতা এবং বিকাশকে প্রভাবিত করছে।

স্ক্রীন আসক্তির প্রভাব

বাচ্চাদের জন্য, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য স্ক্রীন টাইমের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এর মাঝে তারা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেঃ

-অন্যান্য কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

-মনোযোগ দিতে অক্ষমতা

-সামাজিকীকরণে সমস্যা

-ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা

-মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া

-স্থূলতা বৃদ্ধি পাওয়া

-মানসিক ও অন্যান্য শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া

মুক্তির উপায়

নিজের স্ক্রীন টাইম সীমিতকরণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্দার আসক্তিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের সাহায্য করার প্রথম ধাপ হল নিজেদের দিকে তাকানো। কারো আচরণকে প্রভাবিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হল সেই আচরণগুলোকে মডেল করা। আমরা বড়রাই অনেক সময় কাজ থেকে ফিরে মোবাইল নিয়ে বসে পড়ি। সন্তানকে হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত রেখে বা খেলতে দিয়ে নিজেরাই ঘন্টার পর ঘন্টা ডিভাইস নিয়ে পরে থাকি। তাই প্রথমেই আমাদের এই বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

শিশুর হাতে ফোন না দেয়া

আমরা বড়রা প্রায়শই যা করি তা হলো বাচ্চা যখন কান্না করে তাদের শান্ত হতে অথবা খাওয়ানোর সময় স্মার্টফোনটি তাদের হাতে তুলে দিই। এতে কাজ হলেও, পারতপক্ষে আমরাই কিন্তু বিপদ ডেকে আনছি। শিশুর হাতে ডিভাইস তুলে দেয়া মানে তাদের ভেতর এটার অভ্যাস গড়ে তোলা, যা মোটেই ঠিক নয়। তাই এইসময়গুলোতে তাকে এসব না দিয়ে গল্প শুনিয়ে কিংবা তার পছন্দের ছড়া বা গান শুনিয়ে তার মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যেতে হবে।

স্ক্রীন এবং স্ক্রীন-মুক্ত সময় সেট করা

বর্তমানে বাচ্চাদেরকে পুরোপুরিভাবে এর থেকে দূরে রাখা সম্ভবপর হয়ে উঠেনা। তাই প্রতিদিন একটি সময় ঠিক করে নাও, যখন যাবতীয় সব ধরনের স্ক্রীন টাইমের জন্য বিরাট নো থাকবে। এই সময়টিতে বাচ্চাদের যে কোন ধরনের এক্টিভিটিসে উৎসাহ দিতে হবে। এছাড়াও সে সময়টিতে স্কুলের পড়া, হোম ওয়ার্ক, ঘরের রুটিন ওয়ার্কগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভারাসাম্য আনয়নের জন্য সবকিছুর মাঝেই একটি সীমা থাকা নিশ্চিত করো।

সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দেয়া

বাচ্চারা মাত্রই কল্পনাবিলাসী। এই ইমাজিনেশন পাওয়ারের মাধ্যমে তারা অনেক কিছুই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। কিন্তু অত্যাধিক স্ক্রীন টাইম তাদের এই সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে বাঁধা দেয়। তাই তাদের সৃজনশীল কাজের প্রতি বেশি বেশি উৎসাহ দিতে হবে। সে যা করতে ভালোবাসে- এই যেমন ছবি আঁকা, ক্রাফটিংয়ের কাজ করা বা বিশেষ কোন খেলা, সবকিছুতে তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে হবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে বা সেই সংক্রান্ত বিশেষ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে অংশ করিয়ে দিতে হবে।

বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা

যে কোন বয়সী মানুষের জন্য বই হতে পারে সর্বোত্তম বন্ধু। বাচ্চাদের হাতে গ্যাজেট তুলে না দিয়ে বই তুলে দাও। তাদের মাঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলো। প্রয়োজনে তাদের লাইব্রেরিতে নিয়ে যাও, যেখানে অনেক বইয়ের মাঝে সে নিজেকে খুঁজে পাবে। ঘরেও পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সেই সহায়ক পরিবেশ করে তোলো।

সময় দেয়া

ব্যস্ত এই জীবনে আমরা সবাই ছুটে চলেছি। কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও বাচ্চাদের সময় দেয়া একেবারেই ভুললে চলবেনা। কারণ তোমার এই শূন্যতা তাদের মাঝে এই স্ক্রীনে আসক্তি করে দিতে যথেষ্ট। কর্মজীবী হলে, ঘরে ফিরে নিজে ডিভাইসে বুঁদ না হয়ে সন্তানদের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটাও। উইকেন্ডে তাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরী। এছাড়াও ঘরোয়া কাজেও তাদের সহযোগিতা নিতে পারো। ছোট-খাটো কাজ সমাধা করতে পারলে তাতে প্রশংসা করো। এতে দেখবে মোবাইলের প্রতি আসক্তি তাদের অনেকটুকুই কমে যাবে।

প্রতিটি শিশুই অনুকরণপ্রিয়। ছোট থেকেই তারা থাকে দলা পাকানো মাটির মতো। তাদের তুমি যেভাবে গড়বে, সেভাবেই কিন্তু সে বেড়ে উঠবে। তাই প্রথম থেকেই তাদের প্রতি বিশেষ কেয়ার করা খুবই জরুরী। কবি সুফিয়া কামাল যথার্থই বলেছেন, “তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর/ জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর’’।

-ছবি সংগৃহীত

০ মন্তব্য করো
0

You may also like

তোমার মন্তব্য লেখো

three × four =