শায়লা জাহান
একাধারে বাংলাদেশের টেলিভিশন, থিয়েটার এবং চলচ্চিত্রের আইকন হিসেবে খ্যাত, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বর্তমানে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন; আসাদুজ্জামান নূরের জন্মদিন আজ। বিনোদন জগতে সফলতার সাথে দীর্ঘ পথচলা যাকে এই শিল্পে কিংবদন্তি করে তুলেছে।
কারাগার করিডোর; একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মুনা, অপর প্রান্তে বাকের ভাই। সকল সঙ্কোচ, দ্বিধা-দ্বন্দ কাটিয়ে জেলের গ্রীলের উপর দিয়ে দুজন দুজনের হাত আঁকড়ে ধরে আছেন। কি এক শূন্যতা, ভয়াবহ হাহাকার দুজনকে ঘিরে রেখেছে। পরের দৃশ্যে এক ভোরে, আধো-অন্ধকারে, চারদিকে ফযরের আজান হচ্ছিলো। জেলগেট দিয়ে বাকের ভাইয়ের লাশ বের করে দেয়া হয়। সৎকারের পর শোকে স্তব্দ একাকি মুনা ভোরের আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। গুণী নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের এই শেষ দৃশ্য দেখে কারো চোখ পানিতে ভাসেনি এমন পাওয়া দুষ্কর। নাটক এবং বাস্তবতার মাঝে যখন চমৎকার মেলবন্ধন হয়ে যায় তখন তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া আসলেই কঠিন হয়ে পড়ে। আর তাই তো এই ধারাবাহিকটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, বাকের ভাইয়ের সম্ভাব্য ফাঁসি ঠেকাতে প্রতিবাদমুখর দর্শকদের রাস্তায় ঢল নেমেছিল। বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয়ের এটাই সার্থকতা যে আজ এত বছর পর এসেও তিনি জনমনে আজো বাকের ভাই হিসেবে বেঁচে আছেন।
১৯৪৬ সালে আজকের এই দিনে (৩১ অক্টোবর) নীলফামারী জেলায় জন্ম নেয়া আসাদুজ্জামান নূরের কর্মজীবন শুরু হয় বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক চিত্রালীতে কাজের মাধ্যমে। চিত্রালীর অভ্যর্থনাকারী হিসেবে বিখ্যাত অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার নিতে যেতেন। সেভাবেই পরিচয় হয় অভিনেতা আলী জাকেরের সাথে,যিনি সেসময় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ছিলেন। প্রথমে দলটির নেপথ্যে কন্ঠদান দিয়ে শুরু করেন। পরবর্তীতে ‘তৈল সংকট’ নামে একটি নাটক মঞ্চায়স্থ হওয়ার দুদিন আগে এর প্রধান অভিনেতা আবুল হায়েত হঠাৎ আহত হওয়াতে তাঁর পরিবর্তে আসাদুজ্জামানকে নেয়া হয়। এভাবেই তাঁর অভিনয়ের শুরু। এই দলের হয়ে ১৫টি নাটকে ৬০০ বারের বেশি অভিনয় করেছেন। দিয়েছেন নির্দেশনাও, যার মধ্যে ‘দেওয়ান গাজির কিসসা’ প্রায় তিন শতাধিকবার মঞ্চায়িত হয়ে রেকর্ড গড়েছে।
শুধু থিয়েটারের মঞ্চে নয়, টেলিভিশন পর্দায়েও তিনি রেখেছিলেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। ১১০টিরও বেশি টেলিভিশন চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিকে কাজ করেছেন। প্রথম টেলিভিশন অভিনীত নাটক ছিল রঙ এর ফানুশ, যার পরিচালক ছিলেন গুনী নির্মাতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘আজ রবিবার’, ও ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’। নব্বইয়ের দশকে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের রচিত কথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে দেশব্যাপী তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ও ‘আগুনের পরশমণি’। এছাড়াও দেশটিভিতে প্রচারিত ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন।
হাওয়া মে উড়তা যায়ে, প্রিয় গান শুনতে শুনতে চাবির রিং হাতে নিয়ে ঘোরা মহল্লার বখাটে যুবক বাকের চরিত্র থেকে শুরু করে জীবনের সকল স্তরেই তিনি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থেকে হয়েছেন চারবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি সদস্য, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। স্বাধীনতা পুরষ্কার সহ পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরষ্কার।
-ছবি সংগৃহীত