শায়লা জাহানঃ
১৯৮৫ সালে ‘এইসব দিনরাত্রি’, ’৮৮ তে ‘বহুব্রীহি’, ’৯০ এ ‘কোথাও কেউ নেই’; কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকা এই সময় গুলো নির্মানের কারিগর হুমায়ূন আহমেদ। তাঁকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য সাহিত্যের কোন শাখার বাঁধনে বাঁধা যাবেনা। তার বিচরন ঘটেছিল উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে। আজ এই গুনী ব্যক্তির জন্মদিন। কোন নির্দিষ্ট শ্রেনীর দর্শকের জন্য নয়, সকল শ্রেনীর, সকল বয়সের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়।
পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজের ৬ সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আইনের লোক হলেও তিনি ছিলেন বেশ সাহিত্যনুরাগী। তখনকার সময়ের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিতে তাঁর বিচরন ছিলো। মা আয়েশ ফয়েজের লেখালেখির অভ্যাস না থাকলেও শেষ জীবনে রচনা করেছেন একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ। ছোটবেলায় হুমায়ুন আহমেদের নাম তাঁর বাবার নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। ডাকনাম কাজল। তাঁর বাবার ছেলে মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে খুবই পছন্দ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে শামসুর রহমান হয়ে যায় হুমায়ূন আহমেদ এবং বাবুল হয়ে যায় মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। লেখালেখিতে শুরুটা করেছিলেন উপন্যাস লিখার মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ নামে ১ম স্বল্প দৈর্ঘ্য উপন্যাস রচনা করেন। সীমিত পরিসরেই উপন্যাসের আবহ তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’।
নাটক নির্মানের ক্ষেত্রেও দেখিয়েছিলেন সুনিপুন দক্ষতা। বাংলা নাটকের ব্যাকরনই পাল্টে দিলেন তিনি। ‘এইসব দিনরাত্রি’ ছিল ১ম ধারাবাহিক নাটক। এটা এতই জনপ্রিয় ছিল যে প্রচারের সময় ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলো ফাঁকা থাকত। সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, টানাপোড়েন, মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে কাহিনীটি আবর্ত ছিল। এরপর প্রচারিত হয় নাটক ‘বহুব্রীহি’। এটি ছিল মূলত একটি হাস্যরসাত্মক নাটক। এই নাটকের মাধ্যমে সেসময় মুক্তিযুদ্ধকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুললেন তিনি। ‘তুই রাজাকার’ এই একটি সংলাপেই স্বাধীনতা বিরোধীর প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন। এর পরের বছরই তৈরি করেন ‘কোথাও কেউ নেই’। এই নাটকের বাকের ভাইয়ের চরিত্র এতটাই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, নাটকে তার সম্ভাব্য ফাঁসি রুখতে দলে দলে লোক শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে, হুমায়ূন আহমেদের বাসায় আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে তিনি থানায় জিডিও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহু এক পর্বের নাটক নির্মান করেন। খেলা, অচিনবৃক্ষ, খাদক উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৪ সালে ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্র দিয়ে পরিচালনায় অভিষেক ঘটে। সাহিত্য যার রক্তে মিশে আছে তাঁকে কি ধরাবাঁধা নিয়মে বাঁধা যাবে? তাইতো চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষকতার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক এই ছবিতে ছিল অসাধারন গল্প ও দূর্দান্ত নির্মানশৈলীর মিশেল। পরবর্তীতে নিজস্ব উপন্যাস অবলম্বনে মোট ৮টি ছবি নির্মিত হয়। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সর্বোমোট ৬টি চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জিত হয়েছিল আগেনের পরশমনি, দারুচিনি দ্বীপ ও ঘেটুপুত্র কমলা ছবির জন্য।
লিখেছিলেন প্রায় ৩শতাধিক গ্রন্থ। একুশে বইমেলায় ১৯৯০ ও ২০০০ সালে তাঁর বই ছিল বেস্ট সেলার। তাঁর জাদুকরী লেখাতে কিছু কিছু চরিত্র হয়ে উঠে জীবন্ত। রহস্যময় এক চরিত্র ছিল মিসির আলি, যার ১ম উপস্থিত ঘটে দেবী উপন্যাসে। মিসির আলির কাহিনীগুলো ক্রাইম-ফিকশন মত নয়; বরং তা মনস্তাত্ত্বিক ও যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে ঠাসা। আবার হিমু চরিত্র ছিল মিসির আলির একদম বিপরীত। স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী উদাসীন হিমু একবিংশ শতাব্দীর ১ম দশকের তরুন্দের ব্যাপক অনুপ্রাণিত করেছিল। এত গুনী ও বড় মাপের মানুষ কিন্তু তাঁর মধ্যে সবসময় বাস করত এক উচ্ছল শিশু, যে সময় পেলেই নুহাশ পল্লীতে মেতে উঠত আড্ডায় কখনোবা গানের আসরে। গানের অনুরাগী ছিলেন প্রচন্ড। নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে গানও রচনা করেছিলেন। ভালোবাসতেন বৃষ্টির শব্দ এবং জোছনার বাঁধভাঙ্গা হাসি; যা তাঁর রচিত গানেও প্রকাশ পায়-
যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো
চলে এসো এক বরষায়।।
অথবা,
ও কারিগর, দয়ার সাগর
ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরন হয়।।
যে মানুষটি বাংলা সাহিত্যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, সকল বয়সি মানুষকে আবার বইমুখি করেছিল, সহজ সাধারন কাহিনী ও চরিত্রসমূহকে তাঁর জাদুকরী লেখনির মাধ্যমে জীবন্ত করে রেখেছিল সেই মানুষটি সকল মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে ২০১২ সালে মারা যান। আজো রাত ফুরিয়ে দিন হয়, সময়ের পর সময় চলে যায়, কিন্তু এক হুমায়ূন আহমেদ আজো বেঁচে আছেন আমাদের সকলের অন্তরে।
-ছবি সংগৃহীত