পারস্পরিক সম্পর্ক এমনকি উঠতি বয়সীদের সম্পর্কের ভেতরে নির্যাতন ঘটতে পারে, আর ছেলেরাও তার শিকার হতে পারে। তবে নারী ও কন্যাসন্তানদের বেলায় তা ঘটার আশঙ্কা থাকে অনেক বেশি। এ ছাড়া একই লিঙ্গের সম্পর্কেও নির্যাতন ঘটতে পারে।
নির্যাতন ঘটলে কী কী সমস্যা হতে পারে
শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন তোমার সন্তানের দেহ ও মনে যে প্রভাব বিস্তার করে, তা হয় দীর্ঘমেয়াদি। এর ফলে হতাশা, মদ ও অন্যান্য মাদকাসক্তি, খাবারে অনিয়ম ইত্যাদি হতে পারে। আর যৌন নির্যাতন থেকে গর্ভধারণ এবং যৌনবাহিত সংক্রমণের (STIs) আশঙ্কাও থাকে।শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে আঘাত করা, লাথি, ঘুষি বা চড় মারা, ধাক্কা দেওয়া এবং জোর করে যৌন ক্রিয়াকলাপে বাধ্য করা। আর অন্যদিকে মানসিক বা ভাষাগত নির্যাতনের বেলায় নিচের বিষয়গুলো ঘটে :
* এমন কিছু বলা, যাতে করে নিজেকে তুচ্ছ ও নির্বোধ মনে হয়।
* ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা, যার মধ্যে যৌন ক্রিয়াকলাপও থাকতে পারে।
* সঙ্গিনী কোথায়, কার সঙ্গে আছে জানার জন্য সব সময় নজরদারি করা।
* সঙ্গিনীকে বা তার কাছের কাউকে এমনকি তার কোনো পোষা প্রাণীকে আঘাত করার হুমকি দেওয়া।
সমাজকর্মী টিংক পামার নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি জানান, অত্যাচারের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘মুঠোফোন এবং ইন্টারনেটকেও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মেয়েটি যখন তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, ছেলেবন্ধুটি হয়তো প্রতি দশ মিনিট পরপর তার মুঠোফোনে মেসেজ পাঠাতে থাকে, যাতে মেয়েটি সেখানে মন দিতে না পারে এবং এভাবে ছেলেবন্ধুটি সব সময় মেয়েটিকে তার উপস্থিতি মনে করিয়ে দিতে থাকে।’
তুমি কী করতে পারো?
সম্পর্কের বেলায় কোন আচরণ ঠিক আর কোনটি বেঠিক, তা নিয়ে তোমার সন্তানের সঙ্গে আলাপ করো। অনেক উঠতি বাচ্চা ধরেই নেয় সম্পর্কে নির্যাতন ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’ অথবা ভাবে ‘ও তো কেবল ফাজলামি করছে’। তোমার সন্তান বা তার বন্ধুদের মধ্যে এ ধরনের ধারণা তৈরি হওয়া অসম্ভব নয়। আক্রমণাত্মক বা জবরদস্তিমূলক ব্যবহার যে স্বাভাবিক নয় এবং এ ধরনের ব্যবহার যেকোনো মানুষেরই মেনে নেওয়া উচিত নয় সেটা তাদের স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও।
সন্তানের ছেলেবন্ধুর যেসব আচরণ দেখে সতর্ক হবে
নিচের সংকেতগুলোর ব্যাপারে নিজে যেমন সতর্ক হবে, তোমার সন্তানও যেন সতর্ক হতে পারে, তা নিশ্চিত করো। যদি তোমার সন্তানের ছেলেবন্ধুদের মধ্যে নিচের আচরণগুলো দেখতে পাও, বুঝবে সতর্ক হওয়ার সময় হয়েছে।
ছেলেটি খুব হিংসাপ্রবণ
তোমার মেয়ের ফোন, ই-মেইল এগুলোর ওপর নিয়মিত নজরদারি করে এবং তাৎক্ষণিক সাড়া না পেলে রেগে যায়।
* আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, বিশেষ করে রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
* তোমার সন্তানকে তার ইচ্ছামতো বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করতে দেয় না।
* কথা-কাটাকাটির সময় বলপ্রয়োগ করে।
* তার সমস্যা বা কষ্টের জন্য অন্যদের দোষারোপ করে।
* আচরণগতভাবে অত্যাচারী।
* ওর আচরণ অন্যদের মধ্যে ভীতির উদ্রেক করে।
বন্ধুটির হিংসা এবং নজরদারিমূলক আচরণ দেখে অনেক মেয়ে মনে করে যে ভালোবাসে বলে হয়তো ছেলেটি এগুলো করে। কিন্তু এটা সত্যি নয়। এ ধরনের আচরণ প্রেম বা ভালোবাসার প্রকাশ নয়। তোমার সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তার ইচ্ছামতো চালানোর জন্যই সে এমনটা করে। অনেক ছেলে মনে করে, মেয়েবন্ধুর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করাটা বেশ পুরুষসুলভ। তোমার সন্তানকে বুঝিয়ে দিও যে আক্রমণাত্মক আচরণ কাউকে পুরুষ করে তোলে না।
সন্তানকে আশ্বস্ত করো যে তুমি সব সময় তার পাশে আছো
যাই ঘটুক তুমি যে তোমার সন্তানের পাশে থাকবে, সে বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করো। যারা নির্যাতনের শিকার হয়, তারা নিজেদের নিয়ে গ্লানি বোধ করে এবং ভাবে যে নিজের ত্রুটির কারণেই সে নির্যাতনের শিকার হয়েছে (যদিও এই ভাবনা ভুল)। নির্যাতনের শিকার হওয়া যে তোমার সন্তানের ভুল নয় এবং সে যদি তোমার কাছে আসে তাহলে যে তুমি তাকে সাহায্য করবে, এটা তার কাছে পরিষ্কার করো।
কীভাবে বুঝবে তোমার সন্তানের ছেলেবন্ধুটি নির্যাতন করছে কি না
পামার বলেন, ‘উঠতি কিশোরীরা চাপা স্বভাবের হতে পারে। কিন্তু তুমি বোঝার চেষ্টা করবে তার গোপনীয়তার কারণ কী? এটা কি আত্মনির্ভরতার লক্ষণ নাকি সে ভয় পেয়ে তোমার কাছে সত্য গোপন করছে?’
তোমার সন্তান নির্যাতিত হলে তার মধ্যে নিচের লক্ষণগুলো আছে কি না মিলিয়ে দেখো :
১. সে তার বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতো আর মিশছে না,
২. স্কুলে তার ফলাফল খারাপের দিকে অথবা সে স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে,
৩. সব সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত আছে,
৪. আগের তুলনায় একা থাকতে চাইছে ও চুপচাপ হয়ে পড়েছে,
৫. কেমন আছে জানতে চাইলে রেগে যাচ্ছে অথবা খিটখিটে ব্যবহার করছে,
৬. ছেলে বা মেয়েবন্ধুর হয়ে অজুহাত তৈরি করছে
৭. গায়ে আঁচড় বা ক্ষত দেখছ, কিন্তু তা কীভাবে হলো তা জানতে পারছ না,
৮. মনোভাব বা ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন, অথবা মদ বা অন্য মাদকদ্রব্যে আসক্তি
এর মধ্যে কিছু কিছু বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। কিন্তু যদি তোমার সন্তানের ব্যাপারে উদ্বেগের কারণ আছে বলে ভাবো তাহলে যা করতে পারো :
শান্ত থাকো : পামার বলেন, ‘তোমার সন্তানের সঙ্গে আলাপ করো, কিন্তু তাকে দোষারোপ করবে না। তাদের সঙ্গে আলাপ শুরুর আগে তাদের উদ্বেগের কারণ ভালোভাবে বুঝে নিও এবং তা নিয়ে তোমার চিকিৎসক অথবা বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে নিও। এভাবে তুমি তোমার নিজের অনুভূতি ও চিন্তা সম্পর্কে আগাম ধারণা পাবে এবং তোমার সন্তানের সঙ্গে আলাপের সময় তোমার আবেগ ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’
তাদের সঙ্গে কখন আলাপ করবে সেটাও ভেবে নাও : পামারের উপদেশ হচ্ছে ‘তারা ঘরে ঢোকার সাথে সাথে অথবা কোনো কথা-কাটাকাটির মাঝামাঝি তাদের সাথে এ নিয়ে আলাপে বসবে না। শান্ত পরিস্থিতিতে এই আলাপ শুরু করবে, যাতে তার দেরি করে বা নেশা করে বাড়ি ফেরার বিষয়ের সাথে সেটি সম্পর্কিত হয়ে না যায়।’
কী বলবে ভেবে নাও : বলো যে, তুমি আলাপ করতে চাও। বলো তুমি তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন এবং জানতে চাও যে, সব ঠিকঠাক আছে কি না। এ বিষয়ে পামার বলেন, ‘এতে করে তার মনে হবে তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় এবং তুমি হয়তো তার আবেগ বুঝতে পারবে। ঠিক তখনই আলাপ না করলেও হয়তো সেখান থেকে চলে গিয়ে সে বিষয়টি নিয়ে ভাববে এবং পরে তোমার সঙ্গে আলাপ করবে।’