নাজমুল হুদা খান
রমজানে শরীরের রক্তকণিকাসহ বিবিধ ধাতব পদার্থে পরিবর্তন ঘটে, যা পরবর্তী সময়ে শরীরের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রোজার সময় রক্তের সুগার, চর্বি, রেচনক্রিয়ায় নিঃসৃত ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইলেকট্রোলাইটসমূহেও প্রভাবিত করে। এ ছাড়া শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে রক্তচাপ, মস্তিষ্ক ও হার্টের বিভিন্ন অসুখও নিয়ন্ত্রণে রাখে-
রমজান সংযম, সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে মুসলিম সম্প্রদায় আল্লাহর নির্দেশনা পালন, নৈকট্য লাভ ও আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য মাসব্যাপী রোজা পালন করে থাকে। এর মাধ্যমে আত্মা ও মানসিক পরিশুদ্ধতা লাভ, ত্যাগের মহিমায় গড়ে ওঠার প্রত্যয়ী অনুশীলন যেমন সাধিত হয়; ঠিক তেমনি মানবদেহের বিভিন্ন তন্ত্রে বহুবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয় বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে। রোজার সময় শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে অভিযোজন ঘটে। শরীরের তরল অংশের ভারসাম্য রক্ষার্থে রেচনতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র এবং খাদ্য, পরিপাকতন্ত্র প্রভৃতিসহ সংশ্লিষ্ট হরমোন, এনজাইমসমূহে পরিবর্তন সাধিত হয়, যা মানবদেহকে পরিশুদ্ধ করতে সহায়তা করে। রমজানে শরীরের রক্তকণিকাসহ বিবিধ ধাতব পদার্থে পরিবর্তন ঘটে, যা পরে শরীরের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রোজার সময় রক্তের সুগার, চর্বি, রেচনক্রিয়ায় নিঃসৃত ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, ইলেকট্রোলাইটসসমূহেও প্রভাবিত করে। এ ছাড়া শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের কারণে রক্তচাপ, মস্তিষ্ক ও হার্টের বিভিন্ন অসুখও নিয়ন্ত্রণে রাখে। তবে যেসব শারীরিক অসুস্থতা রোজা রাখার কারণে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এসব ক্ষেত্রে রোজা না রাখার বিধান রয়েছে।
আমাদের দেশে রমজানের শুরুতেই নানা রকম খাবারদাবারের ধুম পড়ে যায়। রোজার সময়ের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল এবং চিরায়ত খাদ্যাভ্যাস আমাদের দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা খাদ্য পরিস্থিতি, বাজার, এমনকি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা যায়।
রোজার সময় ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া থেকে নিবৃত থাকতে হয় সত্যি; তবে ইফতার, রাতের খাবার, সেহিরসহ তিনবেলাই খাবার আমরা গ্রহণ করে থাকি। সুতরাং শারীরিক সুস্থতার দিকে নজর রেখে খাবার ও মেনু নির্বাচন করলে একদিকে দৈহিক ও মানসিক কষ্ট ছাড়াই যেমন রোজা রাখা যায়, তেমনি পুরো মাসই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব।
ইফতার : সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারে একসঙ্গে অনেক খাবার গ্রহণের প্রবণতা থাকে আমাদের। ইফতারিতে আমাদের মূলত নজর থাকে মুখরোচক খাবার : পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, শিঙাড়া, সমুচা, মোগলাই, ফুচকা, চটপটিসহ নানা ধরনের ভাজাপোড়া, টক ও ঝাল খাবারের দিকে; যা সহজেই পেটফাঁপা, বদহজম, বমি বমি ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। তাই ইফতারের সময় খেজুর, নানা ধরনের দেশীয় ফল, নাশপাতি, আঙুর, সফেদা, ডালিম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রাখা উচিত। এ ছাড়া কাঁচা ছোলা, দই, চিড়া, গুড়, মধু ইত্যাদিও থাকতে পারে ইফতারের মেনুতে। শরীরের সহজাত পানির ঘাটতি পূরণেও বাজারে নানা রকম পানীয় সহজলভ্য। এদের বেশির ভাগই নানা ধরনের রং, ঘ্রাণজাত সামগ্রীর মিশ্রণে তৈরি; যা শরীরে বিভিন্ন জটিল রোগ তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করে। তাই পানির ঘাটতি পূরণে সাধারণ পানি, লেবুর শরবত, বেলের শরবত, ডাবের পানি, তরমুজ, বাঙ্গি, মাল্টা, আনারস, খেজুর, আনারের জুস ইত্যাদি শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর। মোটকথা আমাদের মনে রাখতে হবে, ইফতারের খাবার হতে হবে নরম, সহজে হজমযোগ্য, পুষ্টিকর, অতিরিক্ত তেল ও নানা ধরনের মসলাবর্জিত।
রমজানে রাতের খাবার : ইফতারের পর এশা ও তারাবিহর পরপরই আমাদের রাতের খাবার গ্রহণের প্রস্তুিত শুরু। খাবারের বিরতিটা স্বল্প হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ ক্ষুধা না-ও পেতে পারে। তাই রাতের খাবারটা হালকা হওয়া বাঞ্ছনীয়। খাবারের পর থেকে সেহ্রির সময়ের ব্যবধানটিও খুব একটা বেশি নয় এবং বেশির ভাগ সময়টা ঘুমেই কেটে যায়। তাই রাতের খাবারে অল্প পরিমাণ ভাত, ভর্তা, শাকসবজি, মাছ ও পাতলা ডালই হতে পারে উৎকৃষ্ট মেনু। মাছের পরিবর্তে মাংসও থাকতে পারে। ভাতের পরিবর্তে রুটি বা খিচুড়িও খাওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, রাতের খাবার পরিমাণে বেশি হলে বদহজম, পেট ফেঁপে থাকা, অ্যাসিডিটি ও ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সেহরি : সারা দিন অর্থাৎ ১২ থেকে প্রায় ১৬ ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে এই ভেবে আমাদের সেহরি কিছুটা সেহরি খাওয়ার প্রবণতা থাকে; আবার অনেকে সেহরিতে কিছু খান না; কেউ কেউ হালকা পানীয়, ডিম বা ফল খেয়ে সেহরি সেরে ফেলেন। এসব ক্ষেত্রে অনেকের ঘুম থেকে ওঠার বিষয়টিই কাজ করে থাকে। সেহরি অতিরিক্ত কিংবা কিছু না খাওয়া দুটিই সঠিক পন্থা নয়। সেহরিতে সুস্বাস্থ্য, পুষ্টিকর এবং পরিমাণমতো খাওয়া উচিত। সেহরিতে মেনুতে ভাত, সবজি, সালাদ, ডিম বা মুরগির মাংস ইত্যাদির সঙ্গে এক গ্লাস দুধ কিংবা খেজুর খাওয়া যেতে পারে। এ সময়ও ঝাল, তৈল চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। তা না হলে সারা দিন বদহজম, পেট ফেঁপে থাকাজাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রোজায় বর্জনীয় : রোজার ইফতারের তালিকায় আমাদের ঘরে ঘরে ভাজা পোড়া, ফাস্ট ফুড, হালিম, ফুচকা, চটপটিসহ নানা ধরনের ঝাল, অতিরিক্ত তেল ও মসলাজাতীয় খাবার থাকে। রোজা রাখার ফলে আমাদের শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়া বিশেষভাবে খাদ্য ও পরিপাকতন্ত্র এবং রেচনতন্ত্রের কার্যক্রমে যে পরিশুদ্ধতার সুযোগ থাকে এসব খাবারে তা ব্যাহত হয় এবং রোজাকে কষ্টকর করে তোলে। রোজায় চিনি, চিনিজাতীয় খাবার, কোল্ড ড্রিংকস, চা কিংবা কফি না খাওয়া শরীরের পক্ষে ইতিবাচক। কারণ, চিনিজাতীয় খাবার কোষে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়; কফি শরীর থেকে আরও পানি শুষে নেয়। ফলে রেচনতন্ত্রের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যতা বিনষ্ট করে।
শরীরকে সুস্থ রাখার প্রচেষ্টা ইবাদতেরই একটা অংশ। আত্মসংযমের এই রমজান মাসে শরীরকে সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর, উপাদেয়, সহজে হজমযোগ্য খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় পান করার বিষয়ে সবার সচেতনতা প্রয়োজন।
লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, এমফিল, এমপিএইচ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল
কুর্মিটোলা, ঢাকা।