শায়লা জাহানঃ
“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী, পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়লক্ষ্মী নারী”।
প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরেই নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সভ্যতার উন্মেষ। নারীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাদের অবদান সব কিছু নিয়েই সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য রচনার। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সমাজের মানদণ্ডে প্রাপ্য স্বীকৃতির ক্ষেত্রে নারীরা কী আসলেই মূল্যায়িত না এগুলো সবই ফাঁকা বুলি সেটাই মূখ্য বিষয়।
নারীর পরিচয় কি? বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে ছাড়া কি আসলেই তার আর কোন পরিচয় নেই? ভূললে চলবেনা এই নারীর মাঝেই বাস করে এক স্নেহময়ী মায়ের জাত, একটি জাতির ভবিষ্যৎ সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে লালন-পালনের মাধ্যমে তাঁকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে মায়ের অবদান কোন অংশে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শুধু তাই নয় দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক এমন অনেক পিতার অবর্তমানেও নিজের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তানের একক অভিভাবক হিসেবে যোগ্যতার সাথে মায়ের ভূমিকা পালনের অনেক নিদর্শনও রয়েছে। মায়ের অভিভাবকত্বের এই যাত্রা শুরু হয় মূলত সন্তানকে গর্ভ ধারণের পর থেকেই। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের পিতা-মাতার উভয়ের সম-মর্যাদা থাকলেও কিন্তু এতো কিছুর পরেও শিক্ষা ও চাকরি জীবনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাবার পরিচয়ই যেন মূখ্য হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা হয় উপেক্ষিত। কিন্তু আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবকের নামের জায়গায় বাবার নাম ছাড়াও আইনগতভাবে শুধুমাত্র মায়ের নাম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত মঙ্গলবার ( ২৪ জানুয়ারি) বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মোঃ খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ যুগান্তকারী রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার লিপি ও অ্যাডভোকেট আয়েশা আক্তার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিত দাশগুপ্ত।
ঐতিহাসিক এই রায়ের পথ কিন্তু এতো সুগম ছিলোনা। এর পেছনের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের যেতে হবে পনের বছর পিছনে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০০৭ সালে এপ্রিল মাসে বিভিন্ন সংবাদপত্রে “বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের পড়ালেখা” শীর্ষক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে। প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরমে তথ্য পূরণের ক্ষেত্রে বাবার নাম পূরণ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের এক তরুনী। এর ফলশ্রুতিতে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড সে তরুনীকে প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্লেখ্য যে, মা ও সন্তানকে কোনরুপ স্বীকৃতি না দিয়ে দায়িত্বহীন বাবার চলে যাওয়ার পর ওই তরুনী তার মায়ের একক ছত্রচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠে। পরবর্তিতে এই ঘটনার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করে মায়ের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার দাবীতে, শুধু মায়ের নাম ব্যবহার করলে পরীক্ষার ফরম অপূর্ণ বিবেচিত হবে কেন; তা জানতে চেয়ে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট রিট দায়ের করে। ওই রিটের প্রেক্ষিতে আদালত তখন রুল জারি করেছিলেন। একই সঙ্গে বর্তমানে কোন কোন শিক্ষাবোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বাবা-মা উভয়ের নাম সম্পর্কিত তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করতে হয়, তার একটি তালিকা এবং যেসব যোগ্য শিক্ষার্থী তাদের বাবার পরিচয় উল্লেখ করতে অপরাগ তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে সম্পর্কে প্রতিবেদিন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। ২০২১ সালের ৬ জুন মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্ট আবেদনকারীদের পক্ষে একটি সম্পূরক হলফনামা আবেদন আকারে দাখিল করে। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সকালে হাইকোর্ট রায় ঘোষনার জন্য এইদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি ধার্য করেন।
কালজয়ী এই রায়ের ফলে এখন থেকে বাবার নামের পাশাপাশি আরও দুটি অপশন যুক্ত হলো। এতে করে কেউ চাইলে বাবার পরিচয় ব্যবহার না করেও ফরম পূরনের সময় মা কিংবা আইনগতভাবে বৈধ অভিভাবকের নাম লিখতে পারবেন। এ যেন মায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা লাভে এক বড় ধরনের সাফল্য সংযোজিত হলো।
-ছবি সংগৃহীত