শায়লা জাহানঃ
রাতে ঘুমাচ্ছো। হঠাৎ পায়ের ব্যথায় জেগে উঠা। পা টানা যাচ্ছেনা, আঙ্গুল যেন বেঁকিয়ে যাচ্ছে। ব্যথার পাশাপাশি ঘুমের দফারফা। অথবা, খানিকটা বিছানায় গড়িয়ে নিচ্ছো। মাঝে একটু হাত পা ছড়িয়ে নিলে, আর হঠাৎই পড়লো পায়ের পেশীতে প্রবল টান। বর্ণিত এই ঘটনাগুলোর মুখোমুখি যদি তুমি হয়ে থাকো, তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। তুমি শুধু একা নও। এই ধরনের পায়ের ক্র্যাম্প সাধারণ। তবে এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া কিছুটা কঠিন হতে পারে।
পায়ের ক্র্যাম্প- যা নাইট ক্র্যাম্প বা চার্লি হর্স নামেও পরিচিত, একটি তীক্ষ্ম পেশী সংকোচনের দ্বারা চিহ্নিত যা কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই বেদনাদায়ক খিঁচুনি যা সাধারণত পায়ের কালফ মাসলে ঘটে থাকে। শুধুমাত্র রাতেই যে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ এই ব্যথার আবির্ভাব ঘটে তা কিন্তু নয়। দৌড়ানো, সাইকেল চালানোর মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সময় দিনেও এটি আঘাত করতে পারে। ফিটনেস তোমার পায়ের পেশীতে চাপ দিতে পারে। কিছু পায়ের পেশীর ক্র্যাম্প সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত যে কোন জায়গায় স্থায়ী হতে পারে। যদিও আমরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই রগে টান পড়া অনুভব করেছি, কিন্তু ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় দেখায় এই ধরনের ক্র্যাম্প ৫০ বছর বয়সের পর সংঘটিত হওয়া আরও সাধারণ বলে মনে করা হয়।
কেন হয়?
এই ব্যাপারে তুমি প্রচুর ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাবে, তবে বাস্তব সত্য হলো যে এই ক্র্যাম্প কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। নিচের এক বা একাধিক কারণ এই হঠাৎ রগে টান পড়ার সাথে সম্বন্ধযুক্ত।
-কিছু গবেষক তত্ত্ব দিয়েছেন যে, আমাদের আধুনিক জীবনধারা এর জন্য দায়ী। আমাদের বেশিরভাগ সময়ই কম্পিউটার এবং স্ক্রিনের সামনে ব্যয় করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে পেশী এবং টেন্ডনের দৈর্ঘ্য এবং অস্থিরতা হ্রাস করে যাতে ক্র্যাম্পিং হতে পারে।
-শোয়ার পজিশনও এর সাথে জড়িত। আমরা অনেক সময় বিছানায় জুবুথুবু হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। যেখানে পা প্রায়শই প্লান্টার ফ্লেক্সিয়ন অবস্থানে থাকে- যার অর্থ হলো পায়ের কালফ মাসলকে ছোট করে আঙ্গুলগুলো তোমার থেকে দূরে অবস্থান করে। যখন পা দীর্ঘ সময়ের জন্য এই অবস্থানে থাকে, তখনই এই ধরনের টান পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
-কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ডিহাইড্রেশন নিশাচর রগে টান পড়াকে উৎসাহিত করে। তরল ভারসাম্য ক্রাম্পের বিকাশের উপর প্রভাব ফেলে। ডিহাইড্রেশন রক্তে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতাকে উন্নীত করতে পারে, যা একটি ক্র্যাম্প ট্রিগার হতে পারে।
-হার্ড ব্যায়াম দীর্ঘকাল ধরে এই ধরনের ব্যথার সাথে যুক্ত। কঙ্কালের পেশী ওভারলোড এবং ক্লান্তি অতিরিক্ত কাজ করা পেশী ফাইবারগুলোতে স্থানীয়ভাবে পেশী ক্র্যাম্পিংকে প্ররোচিত করতে পারে। এটি উচ্চ প্রশিক্ষিত পেশাদার ক্রীড়াবিদদের মধ্যেও ঘটে।
-ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়ামের ভারসাম্যহীনতা ক্র্যাম্পিংয়ে ভূমিকা পালন করে। এই ইলেক্ট্রোলাইটগুলোর প্রতিটি রক্ত এবং পেশীতে তরল ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে।
-একটানা দাঁড়িয়ে থাকাও এটি হওয়ার অন্যতম কারণ। যখন তুমি অনেক সময় ব্যয় করে টানা দাঁড়িয়ে থাকো, তখন শরীরের নিচের অংশে রক্ত এবং পানি জমা হয়। এটি তরল ভারসাম্যহীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেই সাথে পেশী এবং টেন্ডন ছোট হয়ে যেতে পারে- যা সবগুলোই ক্র্যাম্পিং এর দিকে নির্দেশ দেয়।
-গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি এবং সঞ্চালন ব্যাহত হওয়ার কারণে এই ঘন ঘন রগে টান পড়তে পারে। আমেরিকান প্রেগন্যান্সি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এটা সম্ভবত মায়ের রক্তনালী এবং স্নায়ুর উপর ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের চাপের কারণে এই ক্র্যাম্পিং হয়।
-ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস, বিষন্নতা সবই পায়ের ক্র্যাম্পিং এর সাথে যুক্ত। এই অবস্থাগুলোর মধ্যে কিছু- যেমন ডায়াবেটিস এবং স্নায়বিক রোগ, স্নায়ুকে ব্যাহত করতে পারে বা এমনকি মেরে ফেলতে পারে যা ক্র্যাম্পিং হতে পারে।
-বার্ধক্যও এক্ষেত্রে একটি বড় ফ্যাক্টর। এই সময় আমাদের মোটর নিউরন হারাতে শুরু করে। এই জন্য ৫০ এর পর থেকেই রগে টান পড়ার ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ
বহু বছর ধরে, কুইনাইন জাতীয় পিলগুলো পায়ের ক্র্যাম্পের জন্য সর্বোত্তম চিকিৎসা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটি অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের মতো কিছু বিপদজনক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। যেহেতু নিশাচর এই রগে টান পড়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই, তাই কোন নিশ্চিত নিরাময়ও নেই। তবে এক্ষেত্রে কিছু জিনিস বিবেচনা করা জরুরী। যেমনঃ
-রাতের বেলা হঠাৎ রগে টান পড়লে তা উপশম করার সর্বত্তম পদ্ধতি হলো নড়াচড়া করা, চারপাশে হাঁটা বা পা নাড়ানো। এছাড়াও গোড়ালিকে উপরে এবং নীচে পাম্প করা বা পেশী ঘষার মতো জিনিসগুলোও সাহায্য করতে পারে।
-সহজ জীবনধারা পরিবর্তন করে এটি প্রতিরোধ বা উপশম করতে সক্ষম হতে পারো। প্রচুর পানি পান করা অপরিহার্য, যেহেতু এই ধরনের রগে টান পড়া প্রায়ই ডিহাইড্রেশনের কারণেও হয়ে থাকে। শুষ্ক মুখ, মাথাব্যথা, ক্লান্তি এবং শুষ্ক ত্বক এই সমস্ত লক্ষণ জানান দেয় যে তুমি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করছো না। পস্রাবের রঙ খেয়াল করো। তা যদি ফ্যাকাশে হলুদ বা পরিষ্কার হয় তবে তুমি যথেষ্ট পানি করছো তা বুঝায় কিন্তু তার বর্ণ যদি গাঢ় হলুদ হয় তবে পানি পান করা মাস্ট।
-নির্দিষ্ট ভিটামিন এবং খনিজগুলো পেশীর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম। গবেষণায় দেখা গেছে ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা রাতের সময় পায়ের ক্র্যাম্পের ফ্রিকোয়েন্সি, বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের জন্য সাহায্য করতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০০ মিগ্রা ম্যাগনেসিয়াম পাওয়ার পরামর্শ দেন। বাদাম, মসুর ডাল, গোটা শস্য, শাকসবজী এর ভালো উৎস।
-যদি এই রগে টান পড়ার পেছনে কঠোর ব্যায়ামের ফলাফল বলে মনে হয় তবে স্ব-যত্নের জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখো। প্রচুর তরল পান করো এবং দীর্ঘ দৌড়ের জন্য বাইরে যাওয়ার আগে একটি সুষম খাবার গ্রহণ করো। অনেক ক্রীড়াবিদ ফিনিশ লাইনে পৌঁছে গেলে পটাসিয়াম সমৃদ্ধ কলা খাওয়ার পরামর্শ দেন।