ইংরেজি সাহিত্যের শক্তিশালী কবি জন কিটসের জন্ম এ মাসের ৩১ তারিখে। রোমান্টিক কবি কিটস ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন একজন প্রবল প্রেমিক। অথচ প্রেমিকা ফ্যানির সঙ্গে হৃদয় লেনদেন নিয়ে আছে অনেক কানাঘুষা। তাহলে কেমন ছিল সেই প্রেম? লিখেছেন মিলন আশরাফ।
নভেম্বর মাস। সালটা ১৮১৮। হাম্পস্টেডের এক বাড়ি। ১৮ বছরের এক সুন্দরী তরুণী। আয়তচোখের ২২ বছরের টগবগে যুবক। তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে উল্লিখিত বাড়িটিতে। শুরুর দিকে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলেও দু-এক দিন পরে আড়মোড়া ভেঙে সম্পর্ক হয় বন্ধুত্বের। যুবকটি শেক্সপিয়ার, স্পেনসার, মলিয়ের পড়ে শোনায় তরুণীটিকে। নিমগ্ন চিত্তে তরুণীটি সেই সব অমৃত হৃদয়ে পুরে নেয় ভাবুক বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে। ছেলেটির শরীর ছিল একটু শুকনা। ইংরেজ পুরুষদের তুলনায় উচ্চতা ছিল একটু কম। কোনো পার্টিতে সে মেয়েদের সঙ্গে নাচত না। কারণটা ওই উচ্চতা। তবে কোঁকড়ানো লাল-খয়েরি চুল ও আয়তচোখে তাকে দেখাত ভীষণ মায়াময়। এই মায়াময় ছেলেটিই সারা বিশ্বের সৌন্দর্যের কবি জন কিটস। ‘এ থিং অব বিউটি ইজ এ জয় ফরএভার’ এই লাইনটি শোনেনি এমন পাঠক মেলা ভার। লাইনটি কিটসের গ্রিক পুরাণের এক চরিত্রকে নিয়ে লেখা ‘এন্ডিমিয়ন’ পান্ডুলিপির। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, চার হাজার লাইনের ‘এন্ডিমিয়ন’ সেই সময়ের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘ব্ল্যাকউডস এডিনবরা’ কোনো পাত্তাই দেয়নি। উল্টো সমালোচক বলেছিলেন, ‘কিটস এর উচিত কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়া।’ কড়া সমালোচক জন গিবসন লকহার্ট কিটসকে আক্রমণ করে বলেন, ‘কিটসের ভাষা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট, শব্দচয়ন অতি নিম্নমানের।’ সঙ্গে একটি উপদেশনামাও দেয় কিটসের জন্য। সেটি হলো, ‘সে যেন চিকিৎসাশাস্ত্রে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করে।’
সমালোচকদের এসব কথাবার্তার কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার পরিবার তাকে শল্যচিকিৎসকের সহকারী হিসেবে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কবিতা তাকে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে যে, চিকিৎসাশাস্ত্র ছেড়ে আবার মনোনিবেশ করেন কবিতায়। সেই সময় তার পাশে ছিলেন পরম বন্ধু আরেক বিশ্বখ্যাত কবি পিবি শেলি। পরবর্তী সময়ে শেলি জানান, ‘সমালোচকদের কড়া মন্তব্য কিটসকে ভেতর থেকে এতটাই দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল যে, তার হৃদয়রোগও এতটা দেয়নি হয়তো।’
কিন্তু সবকিছু বদলে যেতে থাকে তরুণী ফ্যানি ব্রাউনের সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর থেকেই। একে একে লিখে ফেলেন বিশ্বখ্যাত সব কবিতা। ‘ব্রাইট স্টার’ নামের কবিতা ও পত্রাবলি সংকলন পড়লে যে কেউ ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারবেন। তাদের প্রেমকাহিনি নিয়ে হলিউডে ‘ব্রাইট স্টার’ নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। তিনি যে শুধু সৌন্দর্যের কবি তা নয়, প্রেমেরও। তার কথায়, ‘প্রেম আমার ধর্ম, এটার জন্য আমি মরতেও পারি।’
কিটসের প্রেমিকা ফ্যানি ব্রাউন জন্মগ্রহণ করেন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট। কিটসের কাব্য সাধনায় এই মেয়েটির গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু ভিক্টোরীয় যুগের সমালোচকেরা ফ্যানির ওপর অবিচার করেছেন। কিটসের অকালমৃত্যুর পেছনে অন্যান্য কারণ ছাড়াও ফ্যানির হৃদয়হীনতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেই সময়ের সমালোচকেরা। সেই হৃদয়হীনতার ভার কিছুটা লাঘব হয়ে আসে ১৯৩৭ সালে কিটসের বোনের কাছে লেখা ফ্যানির চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর। চিঠিগুলো কিটস ইতালি যাওয়ার পর লিখে পাঠিয়েছিলেন ফ্যানি ব্রাউন। এক চিঠিতে ফ্যানি লিখেন, ‘অন্য সকলে তোমার দাদার কথা ভুলে যাক, শুধু আমার বেদনাটা বেঁচে থাক।’ জোয়ানা রিচার্ডসন কর্তৃক লিখিত ফ্যানি ব্রাউনের জীবনী পাঠে আমরা বুঝতে পারি, কিটসকে সত্যিই ভালোবাসত ফ্যানি এবং কোনো অন্যায় আচারণও করেনি সে কবির প্রতি।
ফ্যানির সঙ্গে পরিচয়ের দেড় মাসের মাথায় বিয়ের প্রস্তাব দেন জন কিটস। সে প্রস্তাবে রাজিও হয় ফ্যানি। কিটসের বৈষয়িক অবস্থা জেনেবুঝেও এ রকম সিদ্ধান্ত বোকামির নামান্তর বটে! অল্প বয়সে বাবাকে হারান কবি। স্কুলে পড়াকালীন মা মারা যান। ছোট ভাই টমের মৃত্যুও ঘটে ওই একই রোগে। সেই সময়ে কবির নিজের স্বাস্থ্যও ভালো যাচ্ছিল না। তার ওপর আবার লাভের ব্যবসা ডাক্তারি ছেড়ে আরম্ভ করেছেন কবিতা লেখা। নিজের খরচ সে নিজেই চালাতে পারেন না। ফ্যানি যদি সত্যিই ভালো না বাসবে তাহলে এমন বোকামি কেন করবে? তাঁদের বাগদানের কথা জানল দু-একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। তারাই ঠিক করলেন উপার্জনের একটা পথ বের করে তারপর বিয়ে হবে। কিন্তু ভাগ্যদেবতা মুখ তুলে তাকালেন না। হৃদয়রোগ প্রকাশ পেল কিটসের। তার সব আশা লন্ডভন্ড হয়ে গেল। শরীর ভেঙে পড়ল। ফ্যানি রোজ দেখতে আসতেন তাকে। কিন্তু কিটসের প্রেম ছিল সর্বগ্রাসী। তিনি চাইতেন, ফ্যানি সারাক্ষণই তার পাশে পাশে থাকুক। কিটসকে অসুস্থ অবস্থায় ফেলে সে অন্য কারও সঙ্গে নাচবে, গল্প করবে, হাসবে এসব সহ্য করা তার জন্য কঠিন ছিল। এসব সন্দেহে ফ্যানিকে অনেক অপমানও করেছেন কবি। কিন্তু ফ্যানি সব মুখ বুজে সহ্য করেছেন কবিকে ভালোবাসতেন তাই। ওই সময়টাতে কিটসের সব কবিতাতেই ফুটে উঠেছে ব্যর্থ প্রেমের হাহাকার। চিঠিগুলোতেও তাই। চরম এক হতাশায় পেয়ে বসে তাকে। ফ্যানির চরিত্রের ওপর সন্দেহের তির নিক্ষেপ করেন তিনি। এসব অভিযোগের পরেও হতাশাগ্রস্ত কবিকে ছেড়ে চলে যাননি প্রেমিকা ফ্যানি ব্রাউন।
এমন করে করে বাগদানের প্রায় এক বছর দশ মাস পার হল। সুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, শীতের আগেই তাকে ইতালি নিয়ে যেতে হবে। ফ্যানির ইচ্ছা ছিল কিটস ইতালি যাওয়ার আগেই বিয়েটা হোক। আপত্তিটা আসল কিটসের কাছ থেকে। এই শরীরে তার মন সায় দিল না। তা ছাড়া ফ্যানি তখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। বিয়েতে তার মায়ের মতো লাগবে, তিনি মত দিলেন না। অবশেষে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ১৩ সেপ্টেম্বর কিটস বিদায় নিল ফ্যানির কাছ থেকে। রওনা হলো ইতালির পথে। যাওয়ার আগে ফ্যানি কবির কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাক্সে ভরে সঙ্গে কিছু উপহারও দিয়েছিলেন। কিটস দিয়ে গিয়েছিলেন সেভার্নের আঁকা তার নিজের ছবি ও প্রিয় বইগুলো। ইতালি যাওয়ার আগে ফ্যানিদের বাড়িতে কয়েক দিন ছিলেন কিটস। এই কয়েকটি দিন ও ফ্যানির অশ্রুসিক্ত বিদায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত বারবার মনে পড়ত তার। ফ্যানির নাম শুনলেই দেহ টালমাতাল হয়ে যেত কিটসের। ইতালি এসে তিনি আর চিঠি লিখতেন না ফ্যানির কাছে। বন্ধুরা কিটসের চিঠি পেত নিয়মিত। তাদের কাছ থেকে কিটসের খবর নিতেন ফ্যানি। একবার ফ্যানির লেখা চিঠি এলে বন্ধু সেভার্নকে ডেকে বললেন, ‘এ চিঠি আমি পড়তে পারব না। আমি মারা গেলে বুকের ওপর রেখে কবর দিও আমাকে।’ কিটসের এই নির্দেশ পালন করা হয়েছিল। এই নির্দেশ পালন করার ফলে ফ্যানির শেষ চিঠিতে কী লেখাছিল, তা অজানাই থেকে যায় চিরদিনের মতো।
১৮২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৫ বছর ৪ মাস বয়সে রোমে মারা যান কিটস। তার মৃত্যুসংবাদ খুব শান্তভাবেই গ্রহণ করেন ফ্যানি। ধারণা করা হয়, ফ্যানি চাপা স্বভাবের মেয়ে হওয়ায় কোনোরকম উচ্চবাচ্য করেননি। তার প্রেম অন্য কেউ বুঝতে পারত না। প্রকাশ ক্ষমতা কম ছিল। জীবনীকার রিচার্ডসন জানান, ‘কিটসের মৃত্যুর ৬ বছর পর্যন্ত ফ্যানি বিধবার কালো পোশাক পরেছিল, চুল ছেটেছিল ছোট করে।’ ফ্যানি খুব রূপবতী ছিলেন। কিটস তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ’The richness, the bloom, the full form, the enchantment of love after my own heart.’
কিটস মারা যাওয়ার পর ফ্যানিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে অনেকে। সুন্দরী তরুণীর জন্য এটাই স্বাভাবিক। তাদের ফেরাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে তার। বেশির ভাগ সময়ই তিনি থেকেছেন শীতল। অবশেষে জন কিটসের মৃত্যুর বারো বছর পর বিয়েতে বসেন ফ্যানি ব্রাউন। বিয়ে করেন লুই লিন্ডোকে। ধারণা করা হয়, লুই লিন্ডোর ভেতর হয়তো তিনি কিটসের ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন ফ্যানি। কিটসের দেওয়া উপহার ও চিঠিগুলো সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন আমরণ। তা না হলে বিশ্বসাহিত্য থেকে এই অমূল্য সম্পদগুলো হারিয়ে যেত চিরতরে। কিটসকে আজীবন ভুলতে পারেননি ফ্যানি। একবার কবি ফ্যানিকে বলেছিলেন, ‘তোমার যদি ছেলে হয়, তবে তার নাম জন রেখো না। এই নামটি বড়ই অপয়া। আমার নাম জন দেখেই সেটা অনুমান করতে পারছ নিশ্চয়। তার চেয়ে বরং তোমার ছেলের নাম রেখো এডমন্ড। এটা বেশ ভালো নাম।’ ফ্যানি কবিকে আজীবন মনে রাখার আরেকটি প্রমাণ দিলেন। নিজ ছেলের নাম রেখেছিলেন কিটসের দেওয়া এডমন্ড (অর্থ-ঐশ্বর্যের সুরক্ষা)
কিটসের প্রায় সব বন্ধুই তখন মারা গেছে। ইতালিতে কিটসের কবরের কাছাকাছি থাকত সেভার্ন। ফ্যানি শেষ বয়সে হাম্পস্টেডে ফিরে আসেন। অর্থাৎ যেখানে তাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দারিদ্র্য ফ্যানিকে আঁকড়ে ধরে। অভাবে পড়েন। শেষ সম্বল বলতে কিটসের দেওয়া বন্ধু সেভার্নের আঁকা ছবি। বাঁচার শেষ অবলম্বন হিসেবে ছবিটি বিক্রির জন্য স্বামীর হাতে দিয়ে এক বন্ধুর কাছে পাঠালেন। ছবির সঙ্গে লিখে দিলেন একটি চিরকুট : ‘It would not be a light motive that would make me part with it.’
ছবিটি বিক্রির পর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি। দারিদ্র্যের কাছে নিজের প্রেমের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ১৮৬৫ সালে ডিসেম্বর মাসে ৬৫ বছর বয়সে ফ্যানি ব্রাউন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পুনশ্চঃ জোয়ানা রিচার্ডসন লিখিত ‘ফ্যানি ব্রাউন’ বইটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।