মনিকা পারভীন প্রীতি:
আচ্ছা কখনো কি ভেবেছ? তোমার যাবতীয় সম্পদের পাসওয়ার্ড বা চাবি তুমি কি তোমার বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে যাও? অথচ নির্দ্বিধায় তোমার কথা না বলতে পারা ছোট্ট একটা বাচ্চাকে তুলে দিচ্ছ যে কারও কাছে। যার জীবনপদ্ধতির সঙ্গে তোমার জীবনপদ্ধতির কোনো মিল নেই। তার সামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা, অর্থনৈতিক, মানসিক, শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে কোনো মিল নেই। তাদের কাছে বাচ্চা বড় করা মানে এক ধরনের শিক্ষা। আর তুমি হয়তো বাচ্চাকে বড় করতে চাও অন্য এক উপায়ে।
কেয়ার করার মতো দায়িত্ব নিতে পারো কিন্তু তার কাছেও অনেক সময়ই মায়েরা তাদের বাচ্চাকে রেখে নিশ্চিন্ত মনে কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে অফিস থেকে ফিরে যখন কোনো মা দেখে যে তার বাচ্চা সেই সকালে পরানো ডায়াপারটা বিকেল বেলা পর্যন্ত আছে। স্বাভাবিক কোনো মায়েরই মেজাজ ঠিক থাকবে না।
কিংবা তুমি বাড়িতে ফিরে তোমার ছোট্ট কথা না বলতে পারা শিশুর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দেখছ লাল লাল দাগ হয়ে আছে। তুমি কি বলতে পারবে যে এই দাগগুলো কোথা থেকে আসে? তুমি কি নিশ্চিত যে তোমার অগোচরে তোমার এই অবলা শিশুটি কাজের মানুষের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে না?
এই সব সমস্যার সমাধান আমার কাছে মনে হয় যে একজন কর্মজীবী মা যদি একটা ভালো ডে কেয়ার সেন্টার পায়, যেখানে তার বাচ্চাকে সে নিশ্চিন্ত মনে রেখে কাজে যেতে পারবে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ডে কেয়ার সেন্টার এখনো অপ্রতুল। আবার বাংলাদেশে এখনো কর্মজীবী নারীদের ভেতর বাচ্চাদের ডে কেয়ার সেন্টারে রাখার ব্যাপারে একদম অনীহা দেখা যায়। তাদের ভেতর দেখা যায় ডে কেয়ার ব্যবহারের ব্যাপারে অনাস্থা এবং কাজের লোকের কাছে বাচ্চাকে রাখার ব্যাপারে তারা বেশি স্বস্তিবোধ করে। যেটা বাচ্চার মানসিক এবং শারীরিকভাবে গড়ে উঠতে সত্যি অনেক বেশি সমস্যা তৈরি করে।
ইদানীং ঢাকা শহরে বেশ কিছু এলাকায় বেশ কিছু ভালো ভালো ডে কেয়ার তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে দেখা যায় কিছু সস্তা মানের ডে কেয়ার সেন্টার যেখানে হয়তো বাচ্চার সে রকম দেখাশোনা হয় না। যেগুলো শুধু ব্যবসায়িক চিন্তাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়। এ কারণে যখনই তুমি সিদ্ধান্ত নেবে যে তুমি তোমার বাচ্চাকে দেখে আরে রাখবে সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু দিক তোমাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
# একটি ভালো মানের ডে কেয়ার অবশ্যই সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত হয়।
# ডে কেয়ারে যারা বাচ্চাদের কেয়ারগিভার হবে, তাদের সবাইকে প্রপার ট্রেনিংপ্রাপ্ত হতে হবে।
# সারা দিন বাচ্চা কী কী খাবে এবং কী কী খেলবে এবং কী কী অ্যাকটিভিটিজ তার হবে, সেগুলোর একটা লিস্ট প্যারেন্টসকে দেওয়া হবে।
#সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
#ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেকোনো সময় বাচ্চা কিংবা যেন উভয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে পারে অথবা দেখা করতে পারে।
#একজন ডাক্তারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে যদি বাচ্চার কোনো ধরনের সমস্যা হয় তাহলে তাৎক্ষণিক সেই সমস্যার সমাধান দিতে পারো।
# বাচ্চার শতভাগ সিকিউরিটির গ্যারান্টি দিতে হবে ডে কেয়ার সেন্টারকেই।
এ ছাড়া একটা ডে কেয়ার সেন্টার এনসিওর করতে হবে একজন বাচ্চার মা-বাবার কী কী চাহিদা আছে এবং তা পূরণ করার ক্ষমতা তাদের আছে কি না। শুরুতেই সব ধরনের কথা খোলাখুলি আলোচনা করে নিতে হবে। যেহেতু একটা ডে কেয়ার সেন্টার একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের পরিবর্তে তারা সার্ভিস দিয়ে থাকে তাই তাদের উচিত সবকিছু খোলামেলাভাবে আলোচনা করে নেওয়া। প্যারেন্টসের উচিত বাচ্চার সম্পর্কে প্রতিটি ইনফর্মেশন ডে কেয়ার সেন্টারকে প্রোভাইড করা। যেমন তোমার বাচ্চা কী পছন্দ করে, কী কী খায়, কোনটা তার প্রিয় খেলনা, বাচ্চার কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি না। এ রকম বাচ্চাবিষয়ক সব ধরনের ইনফরমেশন ডেকে দিতে হবে। যাতে তারা তোমাকে সঠিক সার্ভিসটি দিতে পারে। এবং যদি কখনো ভুল হয় তাহলে তুমিও তাদের ধরতে পারবে যে আমি তো তোমাদের প্রপার ইনফরমেশন দিয়েছিলাম তাহলে আমি কেন সার্ভিসটি পাইনি? প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিতে পারো।
তুমি একজন কাজের লোকের কাছ থেকে কখনোই পাবে না এ ধরনের সার্ভিস। পাবে না তোমার পরিবারের কোনো গুরুজনের কাছে তোমার বাচ্চাকে রেখে। যা পাবে তা হচ্ছে দিন শেষে মানসিক ও পারিবারিক অশান্তি। যা তোমার কাজের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং অবশেষে একজন মায়ের ক্যারিয়ার ছেড়ে তাকে সময় দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। একসময় এই মা বাচ্চা বড় হয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে তাকে কথা শোনাবে, তোমার জন্য আমি আমার ক্যারিয়ার দেখিনি আর তুমি এমন আচার-আচরণ করো? এসব আবার সন্তান ও মায়ের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। আরও বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার তৈরি হতেও দেখা যায়।
আজকের যে মা, তারও কিছু স্বপ্ন থাকে জীবনে কোনো কিছু করার। কিন্তু তার মা সত্তার কিছু ভুল ডিসিশন তার এবং বাচ্চার দুজনের জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই বাচ্চাকে তোমার ক্যারিয়ারের অন্তরায় না ভেবে নিজের শক্তি ভাবা উচিত। তাকেও সঠিকভাবে বড় করতে কোনো ভুল মানুষের হাতে তার শৈশব তুলে না দিয়ে, ভালো ডে কেয়ারে দাও।
আমাদের দেশে এখন বেশ কিছু অর্গানাইজেশন অফিসের সঙ্গে ডে কেয়ারের ব্যবস্থা রাখছে। তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সরকারি-বেসরকারি সব সংস্থায় এ ব্যবস্থা করা উচিত। তাহলে মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজে মনোযোগ দিতে পারবে।
আবার অনেক গৃহিণী মা সারা দিন কাজ শেষে বাসায় থাকে, তারাও চাইলে প্রতিবেশীদের বেবি সিটিং করে অর্থ উপার্জন করতে পারো, যা বিদেশে হরহামেশাই হয়। এ ক্ষেত্রে নিজেদের ভেতর একটি সমঝোতানামা লিখিয়ে নিয়েই কাজ শুরু করা যেতে পারে। একে বলে মাদার টু মাদার হেল্প। কোনো কাজ ছোট নয়, যতক্ষণ তুমি তাতে চুরি না করো। এটিও অনেক সম্মানজনক কাজ। বিদেশে হাই ডিমান্ড বেবি সিটিং মায়েদের।
বেবি সিটিং বা ডে কেয়ারে বাচ্চা বড় হতে হতে শিখে ফেলে অনেক রাইমস, ম্যানারস। বাচ্চা আরও পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে বড় হয়, হয় সামাজিক। কথা বলা শেখে তাড়াতাড়ি। ইনডিপেনডেন্ট হয়। আত্মবিশ্বাসী হয়। বন্ধুত্ব ও শেয়ারিং শেখে। অপরদিকে কাজের মানুষের কাছে কী কী শেখে? প্রথমে শেখে তার ভাষা, গালি, রুডনেস, ভিতু হয়ে বড় হয় আরও অনেক খারাপ অভ্যাসই বেশি আয়ত্ত করে।
মনিকা পারভীন প্রীতি
প্যারেন্ট এডুকেটর
ওমেন উইদাউট বর্ডারস