নারীর জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশাগুলোর মধ্যে সাংবাদিকতা অন্যতম হলেও বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয়। মাত্র কয়েক বছর আগেও পরিবার নিরাপত্তার অভাবের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিরুৎসাহিত করত। এখন নারী প্রথা ভেঙে হয়ে উঠেছেন দক্ষ সাংবাদিক।
বর্তমানে রিপোর্টিংয়ের তুলনায় এবং সাহসী সাংবাদিকতার জায়গাগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। সংবাদপাঠ কিংবা উপস্থাপনায় যে পরিমাণ নারী দেখা যায়, মূলধারার সাংবাদিকতায় তা হাতে গোনামাত্র। ভিশন ৫০-৫০ অর্জন কিংবা সমতার বাংলাদেশ সবার কাম্য। তাই গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ ও নারীকে উপস্থাপনের দিকে মনোযোগ দেওয়া সময়ের দাবি।
মানুষের জীবনে যোগাযোগের চাহিদার কারণে বর্তমানে যোগাযোগ শিল্প রূপ নিয়েছে। তথ্য বিনোদনের পাশাপাশি একেকটি জাতির ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন সবকিছুই তুলে ধরছে গণমাধ্যম এতটা শক্তিশালী যে, যে তথ্য দিচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে সভ্যতা।
সমাজের প্রতিফলক হয়ে নির্মাণ করছে জেন্ডার সংস্কৃতি।গণমাধ্যমে জেন্ডার উপস্থাপন বিষয়ে বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন ১৯৯৫-এর সুপারিশগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নানা পদক্ষেপ নিলেও গত ২৭ বছরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং বিজ্ঞাপনে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন আশানুরূপ নয়।
সংবাদপত্র হলো সমাজের দর্পণ।
১৯৯৫-২০২২-এ বাংলাদেশের সংবাদপত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। নারী নির্যাতনকে একপ্রকার বিনোদন হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্রে নারী নির্যাতনের চিত্র: যৌতুক, ধর্ষণ ও অ্যাসিড নিক্ষেপ’ গবেষণায় দেখা যায়, সংবাদপত্রে ধর্ষণসংক্রান্ত খবর বেশি।
আগে ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে থাকলেও বর্তমানে বিষয়টি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
সপ্তাহে একদিন বিশেষ নারী পাতা ছাপিয়ে সংবাদপত্র যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে নারী আলাদা কিছু। নারীর অর্জন এসব পাতায় যাওয়ার অজুহাতে মূল খবরেও থাকছে না নারী।বিনোদন পাতায় শোবিজের নায়িকাদের অশ্লীল ছবিকে পুঁজি করতে প্রথম পাতার এক কোণে দেওয়া হয় সেই ছবি। বেগম পত্রিকা, অনন্যা এসব পত্রিকার সম্পাদক নারী হওয়ার কারণেই হয়তো নারীর ক্ষমতায়নভিত্তিক প্রচার বেশি। তবে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে পাঠকের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে প্রিন্ট কমিয়ে পত্রিকাগুলো অনলাইনেই খবর দিচ্ছে। রয়েছে প্রচুর অনলাইন পত্রিকা কিন্তু নিউজ পড়লেই বোঝা যায় ঘাটতি আছে জার্নালিজম এথিকসের।
ইলেকট্রনিক মাধ্যম
টেলিভিশন :
চ্যানেল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই টেলিভিশনের সংবাদে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দেশে নারী সংবাদ উপস্থাপিকাদের অতিরিক্ত মেকআপ ও সাজসজ্জায় উপস্থাপন করা হয়। নারীরা সংবাদ পড়লেও নারীকে নিয়ে সংবাদ খুব কম থাকে।
টিভিতে প্রচারিত নাটক, সিরিয়াল ডেইলি সোপে ভালো নারী মন্দ নারীর অবয়ব তৈরি করে দিচ্ছে মিডিয়া। বাস্তব ক্রাইমভিত্তিক নাটক জনপ্রিয়তা শীর্ষে থেকে মানুষের অজান্তে ক্রাইমের দিকেই আকৃষ্ট করছে। পরকীয়া, পারিবারিক কলহের পেছনে টিভিতে দেখা বিষয়গুলো ভূমিকা রাখে।
চলচ্চিত্র : ১৯৯৫-২০২১-এর মধ্যে ২০১০ সাল পর্যন্তই রাজত্ব করেছে অশ্লীলতা। নায়িকাকে ধর্ষণের চেষ্টা আর নায়কের বোনকে ধর্ষণ করার দৃশ্য না থাকলে যেন সিনেমা হয় না। এসব সিনেমা পুরুষকে ধর্ষণে উৎসাহ দেয়। মেয়েরা রান্নাবান্না করলেই ভালো মেয়ে, মন্দরা ক্লাবে যায়, মদ খায় অথচ নায়ককে বিরহে মদ খেতে দেখা যায়। গোটা কয়েক সিনেমা ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমাই সমাজে নারীর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে দর্শকের মনে নেগেটিভ বীজ বোনে।
৩. অনলাইন প্লাটফর্ম : অনলাইনে কোনো আইন না থাকায় সংবাদসহ যার যে রকম খুশি ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরি করছে। সম্প্রতি অনলাইন সংবাদের পুরোটাজুড়ে ছিল পরীমনি। এ ছাড়া এরা বিভিন্ন অভিনয়শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মনগড়া তথ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক জগৎকে নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করে। নুসরাত মা হলেন কিন্তু তার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করেই প্রচারিত হয় মুখরোচক সংবাদ। সব সমস্যার সমাধান ফ্রিতে ইউটিউবে পেয়ে ডায়েট করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার খবরও পাওয়া যায়।
টিকটকের নেশায় ঘর ছাড়ছে কিশোরীরা। ওয়েব সিরিজের নামে অবাধে প্রাপ্তবয়স্কদের দৃশ্য দেখে ফেলছে শিশু-কিশোরেরাও। এ ক্ষেত্রে সরকার যথাযথ উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠবে নারীকে ভোগ্যপণ্য ও দাসী মনে করার মানসিকতা নিয়ে। অতি সম্প্রতি ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদগুলো পর্নোগ্রাফি ও বিকৃত রুচির প্র্যাকটিসই প্রকাশ করে।
লেখক: সায়মা রহমান তুলি, গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী