রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
লেখক

Wazedur Rahman

Wazedur Rahman

এই সংখ্যায়বিশেষ রচনারোদসীর পছন্দসংগ্রাম

তারা অনন্য – একাই একশো!

করেছে Wazedur Rahman জুন ৮, ২০২০

যেভাবে শুরু করতে চাই, সেভাবে হয়তো হয়না। আবার অনেকটা পথ এসে মনে হয়- আরে আমি তো ভুল পথে! গোলমেলে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা নেই এমন মানুষ মেলা দুষ্কর। ক্যারিয়ারে পথ ভোলা হলে প্রথমে হতাশা আসে। সেখান থেকে চিড় ধরে আত্মবিশ্বাসে। পরিণাম-কর্মক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য না পাওয়া।

তোমাদের সাথে এমন কয়েকজনকে আমরা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি যাদের নিজস্ব একটা পড়াশোনা কিংবা কর্মের জগৎ আছে অথচ সমাজ তাদের চেনে অন্য পরিচয়ে! তারা নিজেদের ভালোলাগার কাজটি কখনোই উপেক্ষা করেননি। অবহেলা করেননি আত্মার চাহিদাকে। সে কারণেই আজ তারা সফল মানুষ। সবার থেকে অনন্য।

রাবা খান, ইউটিউবার, রেডিও জক

জনপ্রিয় ইউটিউবার রাবা খান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফানি ভিডিও দিয়ে হয়েছেন আলোচিত। এসব ভিডিওতে মানুষের নানা রকম স্বভাবকে সাবলীলভাবে দেখিয়ে যাচ্ছেন। এক রাবা খান ধারণ করছেন শত মানুষের বৈশিষ্ট্য।

সম্প্রতি ইউনিসেফ-এর ইয়ুথ এডভোকেট হিসেবে কাজ করছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন নিজে ইউটিউবার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি একাধারে রেডিও জকি আবার বেশ কিছু কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর। দূরদৃষ্টি আর একাগ্রতা দিয়ে হয়েছেন সফল একজন।

শুরুটা কিভাবে?
আমি টিভি দেখা খুব একটা পছন্দ করতাম না। টিভি সিরিজগুলো ডাউনলোড করে কম্পিউটারে দেখা হতো। আমি সিনেমা এবং ইউটিউবের অনেক বড় ফ্যান। ইন্ট্যারন্যাশনাল ইউটিউবারদের দেখেই ইন্সপিরেশন পাওয়া। বাংলাদেশে তখন হাতে গোনা কয়েকজন ইউটিউবার ছিল। তাদের ভিডিও কন্টেন্ট দেখতাম। আমার হাতে তখন ক্যামেরা ছিল, কম্পিউটার ছিল। পরে মনে হলো ‘আমি কেন কন্টেন্ট বানাব না’। এরপরই শুরু করে দেওয়া।

তখনই মনে হয়েছিল এটি ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ে উঠবে?
শুরু থেকেই আমি এটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলাম। কারণ, তখনই ইন্টারন্যাশনাল ইউটিউবারদের দেখতাম, তারা বই লিখছে। আরও অনেক কাজ করছে। তো ইউটিউবার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব এ কথা আমি আরও আগে থেকেই জানতাম। প্রথম কন্টেন্ট বানানোর দেড় বছর পর আমি আর একটি ভিডিও কন্টেট বানিয়েছি। ইউটিউবের তরফে আর্ন করা শুরু করেছি, ভিডিও কন্টেট তৈরি করার এক মাস পর থেকেই।

কি রকম ভিডিও?
আমি ব্র্যান্ড ফ্যামিলি কন্টেন্ট বানিয়ে থাকি। আমার কন্টেন্টে কোনো গালি দিচ্ছি না, পলিটিকস বা রিলিজিয়ন বিষয়ে কোনো কথা বলছি না। ব্র্যান্ড ফ্যামিলি কাজ করার ফলে ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করা সহজ হয়ে যায়। সেভাবে করেই তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।

অনুপ্রেরণার গল্প!
আমি যে কারও কাছ থেকে ইন্সপিরেশন নেব- এই রকম সুযোগ তেমন একটা নেই। আমি অনেক ইন্ডিয়ান ভিডিও দেখি, আমেরিকানস ভিডিও দেখি, যেগুলো থেকে ইন্সপিরেশন নেওয়া সম্ভব হয়। সবচেয়ে বেশি যে কাজটি করতে হয়, তা হলো রিসার্চ। আমি হয়তো কারও সঙ্গে কথা বলছি, তার সঙ্গে এক-দুইটা লাইন যোগ করে একটা ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে ফেলি। আমি সব সময় কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই কিছু না কিছু ভাবতে থাকি।

অবসর?

আমার অবসর বলতে কোনো কিছু নেই। একই সঙ্গে কাজ ও পড়াশোনা দুই-ই করতে হয়। কাজের জন্য অনেক সময় দিই। রাতে ঘুমানো কখনো কখনো কঠিন হয়ে পড়ে। আবার খুব মজা লাগে, যখন দেখি খুবই ডিফরেন্ট লাইফটা। একটা দিনের সঙ্গে আর একটি দিন কখনো মেলে না। এই বিষয়টা খুব এক্সাইটিং লাগে। কোনো ধরাবাধা জব নেই। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করছে। ইটস আ ফান।

পড়াশোনা?
‘এ লেভেল’ শেষ করেছি। কিছু বছর আগে ‘ও লেভেল’ শেষ করেছি। এরপর কিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ রেখেছিলাম। কাজের জন্য এটা করতে হয়েছিলো। আবার পড়াশোনা শুরু করেছি।

ক্যারিয়ার ফোকাস নিয়ে ভাবনা
সবকিছুরই ডিমান্ড অনেক বেশি। যেহেতু সবকিছুুরই একটু কমতি আছে। আমার মনে হয়, যে কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেই কাজটিই ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। তাহলে কাজকে কখনো কাজ বলে মনে হবে না।

কাজ, কাজ আর কাজ
কাজকে কাজ না মনে হয়ে প্যাশন মনে হলে তবেই এনজয় করা সম্ভব। কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো- টাইম মেইনটেইন, কন্ফিডেন্ট। ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্সটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এক, দেড় বা দুই বছরের এক্সপেরিন্সও অনেক কাজে লাগে। এক্সপেরিয়েন্স গেদার করা থামিয়ে দেওয়া চলবে না।

প্রতিদিনের কাজের পরিকল্পনা
আমি এতো বেশি কাজ করি, গত তিন বছর ধরে প্রপার ভ্যাকেশনে যেতে পারিনি। দেশের বাইরে গেলে দুই দিনের বেশি থাকা আমার জন্য কঠিন হয়ে যায়। যেহেতু আমার দুইটা রেডিও শো আছে, আমি একটা শো-স্পন্সর। এখানে সময় দিতে হয়। মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য কলকাতায় গিয়ে বলিউডের সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। আমি বলিউডের খুব বড় ফ্যান। বড় কোন রিলিজ হলে, আমি কলকাতায় চলে যাই। ছুটির দিন আমার পছন্দ না। কারণ আমার কাজ করতে অসম্ভব ভালো লাগে। যদিও ছুটিতে থাকার দরকার আছে।

ভালোলাগা-ভালোবাসা
ভালোলাগে ব্রান্ডন জনসনকে। তিনি দুই মিনিটের একটি মিটিংয়েও যোগ দেন। তিনি তার কাজের সময়টাকে, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, পনেরো মিনিট, বিশ মিনিটের জন্যও ভাগ ভাগ করে রাখেন। এই রকম মানুষ আমরা খুব কম দেখি। একটি সুন্দর ক্যারিয়ার জন্য পরিকল্পিত কাজ করার দরকার আছে।

ইয়ারলি প্ল্যান
এই বছরটা ইউনিসেফ-এর সঙ্গে কাজ করবো। কয়েকটা কোম্পানীর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আছি। এগুলো ঠিকঠাক মতো করবো। নিজস্ব কন্টেন্টতো অবশ্যই বানাবো। এই বছর গান ফোকাস করার চেষ্টা থাকবে।

নিজের কাজ সম্পর্কে মন্তব্য
আমার কাজ আমার কাছে ফান।

নতুন কাজের ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সূত্র
আমি আমার ক্ষেত্র নিয়ে বলি, ছেলেরা ইউটিউবের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করছে। অনেক ছেলে ইউটিবিউব কেন্দ্রিক অর্থ-উপার্জন করছে। কিন্তু মেয়ে কই? পেছনের গল্প হলো-ফ্যামিলির প্রেসার আছে, ফ্যামিলি থেকে চায় না, ফ্যামিলি করতে দেয় না ইত্যাদি, ইত্যাদি। এই সবকিছু থাকবে। প্রয়োজন হলো- কন্ফিডেন্ট।

নিজে বুঝতে হবে, আমাকে দিয়ে কি হবে, আমি কি করতে পারবো। কাজের পরিকল্পনা থাকতে হবে। তিন বছর আগে আমি যে প্ল্যান করেছিলাম, তা পুরোপুরি করতে পেরেছি। প্ল্যান হতে হবে রিয়েলিস্টিক। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে প্ল্যান সফল করতে হবে। একটা রিয়েলিস্টিক প্ল্যান মানুষকে হতাশ করে না।

লেখা: স্বরলিপি
ছবি: সংগ্রহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
পাঠকের রান্নাহেঁসেল

স্পাইসি চিকেন সালাদ

করেছে Wazedur Rahman জুন ৭, ২০২০

যা লাগবে:

মুরগির মাংস জুলিয়ান কাট ১ কাপ, গোলমরিচ ১/৪ চা চামচ, পাপরিকা আধা চা চামচ, লেবুর রস ১ চা চামচ, কর্নফ্লাওয়ার ১ চা চামচ, ধনেপাতা কুচি পরিমাণ মতো, আদাবাটা আধা চা চামচ, রসুন বাটা আধা চা চামচ, মাস্টার্ড পেস্ট ১ চা চামচ, সয়াসস ১ টেবিল চামচ, চিলি সস ১ চা চামচ, লবণ স্বাদমতো, চিলি ফ্লেক্স ১ চা চামচ, তেল পরিমাণ মতো, সবজি (শসা, গাজর, টেমেটো) ১ কাপ।

যেভাবে করবে:

প্রথমে মুরগির মাংসে লবণ, গোলমরিচ, লেবুর রস, কর্নফ্লাওয়ার, ডিমের সাদা অংশ, ধনেপাতা কুচি, আদাবাটা, রসুনবাটা, মাস্টার্ড পেস্ট, সয়াসস, চিলি সস দিয়ে ভালো করে মেখে মেরিনেট করে নিতে হবে। কড়াইতে তেল গরম করে মেরিনেট করা মাংস দিয়ে ভেজে উঠিয়ে নিতে হবে। এবার আলাদা একটা বাটিতে ভাজা মাংস ঢেলে টমেটো, গাজর, শসা, বাঁধাকপি,কাঁচামরিচ, চিলি ফ্লেক্স, লবণ, গোলমরিচ গুঁড়া, লেবুর রস ও চিলি সস দিয়ে টস করে নিতে হবে। ব্যাস হয়ে গেলো স্পাইসি চিকেন সালাদ।

রেসিপি ও ছবি: আফরোজা নাজনীন সুমি 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
পাঠকের রান্নাহেঁসেল

স্টাফড জুকিনি

করেছে Wazedur Rahman জুন ৪, ২০২০

উপকরণ:

স্পাইচ জুকিনি : ১০ পিস, গোলমরিচ গুঁড়া: আধা চা চামচ, পাপরিকা গুঁড়া: আধা চা চামচ, আদা গুঁড়া: ১/৪ চা চামচ, রসুন গুঁড়া: ১/৪ চা চামচ, ময়দা: প্রয়োজনমত, সিদ্ধ ডিম :১টা, টুথপিক: প্রোয়জন মত, মজেরেলা চিজ: ১০ পিস, মরিচ গুঁড়া:১/৪ চা চামচ, ব্রেডক্রাম:১ কাপ, সস: পরিবেশনের জন্য, লবণ: স্বাদমত

প্রনালী:

প্রথমে ময়দার মধ্যে সাদা গোলমরিচ গুঁড়া, পাপরিকা পাউডার,লবণ,আদা গুঁড়া, রসুন গুঁড়া দিয়ে ভাল করে ময়দার সাথে মিশিয়ে আলাদা করে রাখুন। এবার সিদ্ধ ডিমে লবণ গোলমরিচ গুঁড়া দিয়ে মিশিয়ে নিন। এখন জুকিনি স্পাইসে মজেরেলা চিজ দিয়ে জুকিনী স্পাইচ মুরিয়ে টুথ পিক দিয়ে আটকিয়ে প্রথমে ময়দায় মাখিয়ে তারপর ডিমে চুবিয়ে ও ব্রেডক্রামে গড়িয়ে ডুবো তেলে ভেজে নাও। ভাজা হয়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।

রেসিপি ও ছবি: আফরোজা নাজনীন সুমি 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
কবিতাশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ – কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের কাব্যগ্রন্থ

করেছে Wazedur Rahman জুন ৩, ২০২০

প্রেমহীন এই নিথর ধরা যেন অসার
পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করে আবার।

কবিতা হচ্ছে ছন্দ, দোলা এবং স্পন্দন নিয়ে রচিত একগুচ্ছ শব্দমালা। অথবা, কবিতা বা পদ্য হচ্ছে শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস; যা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে আর তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে।

কবিতা। তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ অথচ এর বিশালতা আর গভীরতা অকল্পনীয়। হ্যাঁ সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয়। জীবনের প্রত্যেকটি উপাদান আর উপাত্ত নিয়েই কবিতা। একটি জীবনের আলোকে সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয় কবিতা। কবিতা হাসায়, কবিতা কাদায়। কবিতা আনন্দ দেয়, কবিতা বেদনা শেখায়। তাই একজন কবির কাছে তার কবিতা নিজের সন্তানের মতো, নিজের সহধর্মিণীর মতো যে তাকে ভালোবেসে পাশে থাকে দুঃখের সময়েও।

২০২০ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নৈঋতা ক্যাফে থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ শিরোনামে। বইটির প্রচ্ছদ করেছে চারু পিন্টু। প্রচ্ছদ বেশ মানানসই হয়েছে কাব্যগ্রন্থের কাব্যগুলো অনুসারে।

ছবি: সংগ্রহীত

খুবই সাদামাটা না আবার খুব বেশি ঝমকালো নয়; যতটুকু অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার ততটুকুই যেন। বইটির পেইজ, বাইন্ডিং বেশ স্ট্যান্ডার্ড মানের। আর যেহেতু কাব্যগ্রন্থ তাই গাউন পেপারের ব্যবহার যেন বইটির আউটলুককে আরও পরিপূর্ণ করেছে।  

শ্রাবণ জুড়ে মেঘ থাক, আশা রাখি  
কেটে যাক দাবদাহ জ্বর, প্রসন্ন হাসি;  
ফিরে আয় মেঘমালা- বিষণ্ণ ঢাকি  
পোড়া চোখে বৃষ্টি ঝরুক, তোমায় ভালোবাসি।

কবিতা এমন একটা ব্যাপার যেটা আসলে পড়ে, অনুভব করে অন্যকে ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানোর নয়। তবুও কিছু কথা জড়ো হয় যে কোন কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষেই। এই বইটি পাঠ শেষেও তেমন কিছু কথাই জড়ো হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে অর্ধশতেকের বেশি কবিতা স্থান পেয়েছে। সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলে এই পর্যোলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আর পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তাই যেসব কবিতা ভাবনার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো নিয়েই বরং আলোচনা করা যাক।

কবিতা লিখেন কে? একজন কবি। পাঠকের মনের অজানা কথাগুলোই যেন ভেসে উঠে পঙক্তি হয়ে কবির কবিতার। পাঠক নিজের না বলা কথাগুলো গুচ্ছ আকারে লিপিবদ্ধ দেখে আনন্দে হয় আত্মহারা; কিন্তু কখনো কি ভাবে কবির কথা! সেই আক্ষেপটাই যেন কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে তিনি বলেন –

কে শুনবে কার কথা?  
এই ধরো আমার কথা-  
নিদারুণ দুঃখ বোধ,  
ভিতরে-ভিতরে ক্ষয়রোগ;

কবির আক্ষেপটাই যেন প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভটাই যেন কবিকে প্ররোচিত করে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান দেয়ার। তখন কবি বলেন –

এই অন্ধকার থেকে আলোর মুখ কবে বের হয়ে আসবে?  
সেদিন কোথায় যেদিন সম্মিলিত প্রতিরোধ হবে… আর কত দিন…???

কবি মানেই রোমান্টিক আর কবিতা মানেই রোমান্টিকতা। হোক না তা দ্রোহের কবিতাগুচ্ছ সেখানেও চুপিসারে রয়ে যায় কবির অজানার প্রেমের কথা। কবির অজানায় হারিয়ে যাবার কথা। এমনই হারিয়ে যাবার উপাখ্যানে কবি বলেন –

দাঁড়াও, আমিও আসছি, হাওয়ার তরী –  
বেয়ে-বেয়ে তোমার অজানা দ্বীপে।

ছবি: সংগ্রহীত

হাজার মানুষের ভীড়ে ছুটে চলা মানুষটার একাকীত্ব আর ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো পাখিটার শূন্যতায় কবি যেন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন খুঁজে পান। সেই মানুষটা কিংবা সেই পাখিটার যে ভালোবাসার মানুষটাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাই ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। কবির ভাষ্যে-

অসহ্য যন্ত্রণায় ওড়ে পাখি –  
নিয়ে ডানায় শ্বাসহীন রাখী।

তথাকথিত সমাজের ভালোবাসা মানেই যেন জৈবিক চাহিদার এক আঁতুড়ঘর। আসলেই কি তাই? ভালোবাসা তো মনের সঙ্গে মন বুনার এক কাজ। ভালোবাসা সে তো অশরীরী – না ধরা যায় না ছোঁয়া যায়। ভালোবাসার সেই অকথিত কোমলতার কথাই কবি বলেছেন ভালোবাসা এত কোমল কবিতাটিতে। কবি বলেন –

নশ্বর শরীর পাবে না এর নিগূঢ় ভেদ-  
তাইতো ভালোবাসা আজ অভাবনীয় নিঃশেষ!

স্বপ্ন আর মিছিল যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। স্বপ্ন যেন কবিতার মতো। প্রতিবার পড়ার সময় তা নিজেকে আরো মেলে ধরে, নিজের আরো বিস্তৃতি বাড়ায়। আর মিছিল!! স্বপ্ন হোক কিংবা মিছিল সে তো শুরু করে একজনই। কিন্তু তার কি কোনো শেষ আছে? স্বপ্ন আর মিছিলের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায় কোনো না কোনো এক সুবোধ। তাই কবি বলেন –  

স্বপ্নটা পৃথিবীর তাবৎ সুবোধ-  
প্রাণের আকুতি নিয়ে জনাকীর্ণ এক মিছিল।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে কত শিল্পী আর মনীষী এই দেশের প্রেমে পড়েছেন তার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু আধুনিকতার কবলে পড়ে ক্রমশ নদী হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। কিন্তু সেই নদীর এমন দগ্ধতা আর ক্ষতের কথা কতজনে মনে রাখে? কতজন সেই নদীর হাহাকার শোনে? কবি সেই হাহাকারের খানিকটা তুলে ধরেন এভাবে –  

আমি এখন খরায় পোড়া ক্ষত-
আমাকে নিয়ে ভাবছে সবাই কত?

ছবি: সংগ্রহীত

প্রেম। প্রকৃতির অদ্ভুত এক সৃষ্টি। প্রেমের বন্ধন যে কতটা গাঢ় তা তো যুগে যুগে ইতিহাসই প্রচার করে এসেছে। কিন্তু সেই গাঢ়তা কি খানিকটা ম্লান হয়নি? হয়েছে বটে আর তাই তো বেড়েছে প্রেমের ব্যর্থতা আর বিচ্ছিন্নতা। সেই বিচ্ছিন্নতার জ্বালা সইতে পারে এমন কজনাই বা আছেন? তাই কবি নিজের ভাষায় বলেন –  

নিঃস্ব জীবন- প্রেমহীন প্রেমিকা- 
এক দৌড়ে হচ্ছে সভ্যতার গণিকা!

কথার কোনো ক্ষয় আছে কিংবা শেষ আছে? কথা স্রোতস্বিনী নদীর মতো; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে, যুগ থেকে যুগান্তরে। কথার কোনো ক্ষয় নেই কিংবা শেষ নেই তবে কথা থাকে অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষায় পালা শেষ হয় কিন্তু কথা তবু ফুরোয় না। গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে কথাগুলো জমতে জমতে একদা হারিয়ে যায় কোনো অতলে, কোনো এক অজানার দেশে। তাই কবি বলেন –

অবশেষে, অপেক্ষমাণ কথাসমূহের দল- 
ফিরে যায় অজানার দেশে!

এই আমরা প্রতদিন সমাজ বদলের কথা বলি। নিত্যনতুন নিয়ম গড়ি। সমাজকে নিয়ে চলি আগামীর তলে। কিন্তু আসলেই কি সমাজ বদলায়? যদি তাই হয় তাহলে দিনমজুর এখনো দিন এনে দিন খায় কেন? নাকি কেবল আমরা মুখেই বলি শুধু সমাজ বদলাই। কবি তার নিজের ভাষায় এভাবে বলেন-

এখনো দিনমজুর দিন আনে দিন খায়- 
আমরা সবাই অহরহ সমাজ বদলাই।

কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের জন্ম কুষ্টিয়াতে। তবে বর্তমানে ঢাকার বাসিন্দা। স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই কবিতার প্রতি মায়া, মমতা, ভালোবাসা এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ২০১২ সালের প্রথম কবিতার বই ‘একজন মোনালিসা চাঁদের গহবরে মুচকি হাসে।’ এরপর সময় যেন থমকে গেল দীর্ঘ আটটি বছরের জন্য। কিংবা হয়তো বলা যায় কবি আটটি বছরের জন্য কবিতায় সিদ্ধহস্ত হতে সময় নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ’।

কবিতার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো সুবিধা হলো একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। অবাধ্য শৈশবকে যেমন অনুভব করা যায় তেমনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়। এভাবেই কবি নিজের গান গেয়ে অন্যকে করে প্রভাবিত। আর কবিতার বই একরাশ মুগ্ধতায় রয়ে যায় পাঠকের মনে হয়তোবা ক্ষণিকের জন্যে কিংবা হয়তো আজীবনের জন্যে। যেমনটা কবিও যেতে যেতে বলে যান –

মনুষ্যত্বের বাহক খাক হয়ে যায়
কিছুমানুষ আমৃত্যু স্বপ্নহীন থেকে যায়।

বই: পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ
লেখক: সোহাগ ওবায়দুজ্জামান
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
প্রকাশনী: নৈঋতা ক্যাফে
মূল্য: ২৫০ টাকা মাত্র

লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবি: সংগ্রহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
পাঠকের রান্নাহেঁসেল

মোরগ পোলাও

করেছে Wazedur Rahman জুন ২, ২০২০

উপকরণ

দেশি মোরগ ৭০০ গ্রাম, চিনিগুঁড়া চাল ৫০০ গ্রাম, টক দই ১ কাপ, আদাবাটা ১/২ চা-চামচ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, কাঁচামরিচ ফালি ৭/৮টা, গাজর মিহিকুচি ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজকুচি ১/২ কাপ, কাঁচামরিচবাটা ১ চা-চামচ, গুঁড়া মরিচ ১ চা-চামচ, গরম মসলাগুঁড়া ১/২ চা-চামচ, লবণ ২ চা-চামচ, চিনি ১ চা-চামচ, কিশমিশ ১ চা-চামচ, আলু বোখারা ৪/৫টা, তরল দুধ ১ কাপ, সেদ্ধ ডিম ৪টা, ঘি ৬/৭ টেবিল চামচ।

প্রণালি

প্রথমে মোরগের মাংস ৪ টুকরো করে ছুরি দিয়ে আঁচড় কেটে নিতে হবে। এবার টক দইয়ের পানি ঝরিয়ে নিয়ে দইটুকু ফেটে নিয়ে সেটার সঙ্গে মরিচের গুঁড়া, লবণ মাখিয়ে মেরিনেট করে রাখো ২ ঘণ্টার জন্য। এবার প্যানে ৪ টেবিল চামচ ঘি গরম করে তাতে পেঁয়াজকুচি দিয়ে বাদামি করে ভাজতে হবে। হয়ে এলে এতে আদাবাটা, রসুনবাটা দিয়ে কিছুটা কষিয়ে নিতে হবে। এবার এতে মোরগের মেরিনেট করে রাখা মাংসগুলো দিয়ে এপিঠ-ওপিঠ করে কষাতে হবে। দইয়ের পানিতে খুব অল্প দমে মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে।

এবার অন্য একটি প্যানে বাকি ঘি গরম করে তাতে ধুয়ে রাখা চাল, কিশমিশ, আলু বোখারা, কাঁচামরিচ ফালি, চিনি এবং লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে চাল ভেজে নিয়ে, তাতে ৭০০ গ্রাম পানি এবং ১ কাপ তরল দুধ দিয়ে বলক আসতে দাও। পানি শুকিয়ে দমে দিয়ে পোলাও করে নাও। এবারা আধা পোলাও সরিয়ে তার মাঝে মোরগের মাংসের টুকরো এবং মসলাগুলো দিয়ে তার ওপর বাকি পোলাও দিয়ে আরও ১০ মিনিট দমে দিয়ে গরম গরম পরিবেশন করো।

রেসিপি ও ছবি: ফাহা হোসাইন 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
ফটো ফিচার

ছবিতে করোনার লকডাউনে বিশ্বব্যাপী ঈদুল ফিতর

করেছে Wazedur Rahman জুন ১, ২০২০

করোনার কারণে লকডাউনে বিশ্ব স্থবির হয়ে আছে, তাও মাস তিনেকের বেশী তো হবেই। মুসলিম বিশ্বের তীর্থস্থান পবিত্র মক্কা শরীফও বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি মুসলিম দেশে মসজিদগুলোতে কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাত্র গুটিকয়েক মুসল্লিকে নিয়েই নামাজ আদায় করার অনুরোধ করা হয় সরকার প্রধানের তরফ থেকে। এর মধ্যেই চলে আসে মুসলমানদের কাছে বছরের সেরা আর পবিত্রতম মাস রমজান। তাই রমজানের আগেই জানিয়ে দেয়া হয় তারাবীহসহ সকল নামাজে লোক সমাগম না করতে। 

এমনকি একমাসের সিয়াম সাধনা শেষে ঈদের নামাজেও দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। ঈদগাহ মাঠ বাদ দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মসজিদেই স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের জামাত আদায় করেন। যেহেতু লকডাউনে কড়াকড়ি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল প্রশাসন সেহেতু এবারের ঈদটা বিশ্বব্যাপী খানিকটা ভিন্নরকম হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর রোদসীর পাঠকদের জন্য আজকের আয়োজনে থাকছে করোনার লকডাউনে বিশ্ববাসীর ঈদুল ফিতর উদযাপনের সচিত্র প্রতিবেদন।  

Mohammad Ponir Hossain/Reuters 

ঢাকা, বাংলাদেশ। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদে সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের নামাজ জামাতে আদায়ের একটি দৃশ্য।

Ajit Solanki/AP

আহমেদাবাদ, ভারত। ঈদের দিন গৃহহীন আর দুস্থ মানুষদের মধ্যে ঈদের খুশি বাটতে ক্ষীর বিলাচ্ছে এক ধর্মপ্রাণ মুসল্লি।

GETTY IMAGES

চেচনিয়া, রাশিয়া। ঈদের জামাত শুরুর আগে একজন স্বেচ্ছাসেবীকে দেখা যাচ্ছে মুসল্লিদের মধ্যে হাত গ্লাভস বিতরণ করতে।  

GETTY IMAGES 

তিরানা, আলবেনিয়া। তিরানার একটি মসজিদে ঈদের নামাজ জামাতে আদায় করার দৃশ্য।

Bakr ALKASEM/AFP

ইদলিব, সিরিয়া। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইদলিব প্রদেশের মারেত মিসরিন শহরের কাছে একটি ক্যাম্পে বাস্তুহারা শিশুরা, রমজানের শেষে ঈদের ছুটিটা নিজেদের মতো করে খেলাধুলা করে উদযাপন করছে।  

VASSIL DONEV/EPA 

সোফিয়া, বুলগেরিয়া। লকডাউন থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্ব মেনে সোফিয়ার লোকোমোটিভ স্টেডিয়ামে ঈদের নামাজের জন্য অপেক্ষায়রত মুসল্লিদের একাংশ।

VAHID SALEMI/AP PHOTO 

তেহরান, ইরান। তেহরানের এক মসজিদে নামাজ শেষে দোয়ায়রত সকল মুসল্লিদের মুখেই ফেসমাস্ক আর সামাজিক দূরত্ব মানার রীতি দেখা যায়।

 VISAR KRYEZIU/AP PHOTO

প্রিস্টিনা, কসোভো। প্রিস্টিনা জাতীয় জামে মসজিদে ঈদের দিনে ইমামের কাছ থেকে সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে তেলাওয়াত শোনার একটি দৃশ্য।

MUHAMMAD SAJJAD/AP PHOTO 

পেশোয়ার, পাকিস্তান। লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে খোলা ময়দানেই আদায় করা হয় ঈদের জামাত, তারই একটি দৃশ্য।

MOHAMMAD ISMAIL/REUTERS

কাবুল, আফগানিস্তান। কাবুলের এক মসজিদের বাইরে বাচ্চাদের খেলাধুলা আর আনন্দ উদযাপনের একাংশ। 

SAEED KHAN/AFP

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। সিডনির লাকেম্বা মসজিদ থেকে লোক সমাগম করে ঈদের জামাতে নিষেধাজ্ঞা করা হলেও, অনলাইনের মাধ্যমে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে ঈদের জামাত এবং খুতবার আয়োজন করা হয়; যাতে করে মুসল্লিরা নিজেদের ঘরে বসেই নামাজ আদায় করতে পারে এই লকডাউনে।  

MADAREE TOHLALA/AFP

নারাথিওয়াট, থাইল্যান্ড। ফেসমাস্ক পড়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইয়াকানিয়াহ মসজিদের মাঠে নামাজের জন্য অপেক্ষায়রত মুসল্লিদের একাংশ।  

MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

মুন্সীগঞ্জ, বাংলাদেশ। ঈদের ছুটিতে অভিবাসী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছে; যার জন্য এই করোনার সময়ে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফেরীতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।

THIERRY GOUEGNON/REUTERS

আবিদজান, আইভরি কোস্ট। আবিদজানের অন্তর্গত আদজামির মুসল্লিরা এভাবেই মসজিদের বাইরে রাস্তায় জায়নামাজ বিছিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করে। 

MOHAMED ABD EL GHANY/REUTERS

কায়রো, মিশর। লকডাউনে মসজিদগুলোতে জামাতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ফলে কায়রোর বেশীরভাগ বাসার ছাদেই উক্ত ভবনের বাসিন্দারা নামাজের ব্যবস্থা করে। তেমনি একটি বাসার ছাদে ঈদুল ফিতর আদায় করার দৃশ্য।  

DANISH ISMAIL/REUTERS

কাশ্মির, ভারত। শ্রীনগরের এক মসজিদের বাগানে সামাজিক দূরত্ব মেনে এভাবেই ঈদের জামাত আদায় করা হয়।

ZIK MAULANA/AP PHOTO 

আচেহ, ইন্দোনেশিয়া। লোকসুমাওয়াত মসজিদে ঈদের জামাতের একাংশ।

KHALIL HAMRA/AP PHOTO 

গাজা, ফিলিস্তিন। গাজার এক মসজিদের বাইরের উঠানে ঈদের নামাজের জন্য অপেক্ষায়রত মুসল্লিদের একাংশ।

লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ফিচার ইমেজ: GETTY IMAGES 
সূত্র: আল জাজিরা এবং বিবিসি।

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
পাঠকের রান্নাহেঁসেল

বিফ টেরিয়াকি সালাদ

করেছে Wazedur Rahman মে ৩১, ২০২০

যা লাগবে:

জুলিয়ান কাট গরুর মাংস ১ কাপ, ডিমের সাদা অংশ ১ টেবিল চামচ, আদাবাটা ১/২ চা চামচ, রসুনবাটা ১/৪ চা চামচ, সাদা গোলমরিচ গুঁড়া ১/৪ চা চামচ, লেবুর রস ১ টেবিল চামচ, মাস্টার্ড পেস্ট ১ চা চামচ, আধা ভাঙা গোলমরিচ ১/৪ চা চামচ, কর্নফ্লাওয়ার ১ টেবিল চামচ, সিসেমি অয়েল ১ টেবিল চামচ, চিলি সস ১ টেবিল চামচ, পাপরিকা ১ চা চামচ, তেল প্রয়োজনমতো, কাঁচামরিচ ১ টেবিল চামচ, ধনেপাতা ১ টেবিল চামচ, মধু ১ চা চামচ, তিল ১ চা চামচ, লবণ স্বাদমতো, তেল পরিমাণ মতো, সবজি (শসা,গাজর, টমেটো) ১ কাপ।

প্রণালী:

প্রথমেই গরুর মাংসে ডিমের সাদা অংশ, আদাবাটা, রসুন, সাদা গোলমরিচ গুঁড়া, লেবুর রস, মাস্টার্ড পেস্ট, কর্নফ্লাওয়ার, সিসেমি অয়েল, পাপরিকা দিয়ে ভালো করে মেখে মেরিনেট করে নাও। এবার একটি কড়াইতে তেল গরম করে মেখে রাখা মাংস ভাজতে থাকো। ভাজা হয়ে এলে ওপরে মধু আর তিল দিয়ে উঠিয়ে রাখো। এখন অন্য একটি পাত্রে কেটে রাখা সবজিগুলো দিয়ে তার মধ্যে কাঁচামরিচ, চিলি সস, ধনেপাতা, গোলমরিচ গুঁড়া ও লবণ দিয়ে ভালো করে টস করে নাও। ব্যাস হয়ে গেল বিফ টেরিয়াকি সালাদ।

রেসিপি ও ছবি: আফরোজা নাজনীন সুমি 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
কর্মক্ষেত্র

সহজ কথায় ইন্টারভিউ

করেছে Wazedur Rahman মে ৩১, ২০২০

জীবনের চ্যালেঞ্জ প্রতিটি মানুষকেই নিতে হয়। নিজের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে। তেমনি একটা অন্তিম সময় হলো চাকরিতে যোগদানের আগের মুহূর্তগুলো।

প্রথমে চলে আসে ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস। ইন্টারভিউ বোর্ড ফেস তো অনেকেই করে বা করে চলেছে, কিন্তু সবাই কি টিকতে পারে? না। টিকতে হলে কিছু গুণ থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। এ বিষয়ে কথা হলো স্টেপ ওয়ান গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর নাজমা মাসুদের সঙ্গে। তিনি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়েছেন যা আজ থাকছে পাঠকদের জন্য।

ইন্টারভিউ বোর্ডে যাওয়ার আগে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে মাথা থেকে। কোনো প্রশ্ন করলে ইনিয়ে-বিনিয়ে উত্তর কিংবা ‘অ্যা’ ‘উ’ এগুলো করা যাবে না। যতটুকু জানো, স্মার্টলি উত্তর দিতে হবে। আর নির্দিষ্ট কোন পোস্টের জন্য অ্যাপ্লাই করা হচ্ছে তার প্রাথমিক জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে। তা ছাড়া নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগে কিছু জেনে যাওয়া ভালো।

নাজমা মাসুদের বলেন,

বাচনভঙ্গি খুব জরুরি বিষয়। চাকরিপ্রার্থীকে ভদ্র, বিনয়ী হতে হবে। কাজ করতে পারার সদিচ্ছা, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে হবে। প্রশ্ন করলে উত্তরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হবে। তবে আঞ্চলিকতা পরিহার করাই ভালো। উচ্চারণ সুন্দর হলে কথা বলার ধরনই পাল্টে যায়। উচ্চারণে সমস্যা থাকলে কিছুদিন নিজে চর্চা করলেই এটা ঠিক হয়ে যায়।

ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় পোশাক অনেকাংশেই গুরুত্ব বহন করে। পোশাক রুচিবোধের প্রকাশ ঘটায়। ছেলেদের কোনো রকম জুয়েলারি ব্যবহার এখানে দৃষ্টিকটু দেখায়।

মেয়েদেরও মার্জিত পোশাক পরতে হবে। ঝাঁজালো গন্ধের বডি স্প্রে বা পারফিউম ব্যবহার না করাই ভালো। সব ক্ষেত্রে রুচিশীল হলে ইন্টারভিউ বোর্ডও তা মার্ক করবে। অনেকে আছে যারা ফ্রেশার, তারা অনেক সময় ছাত্রদের মতো পোশাক পরেই ইন্টারভিউ দিতে চলে যায়। এগুলো পরিবর্তন করতে হবে।

সঙ্গে রেখো

ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় অবশ্যই সিভি, কভার লেটারের একটি কপি প্রিন্ট করে নিয়ে যাবে। সঙ্গে কলম রাখতে হবে। সময়জ্ঞান প্রতিটি মানুষের জন্যই জরুরি। আর ইন্টারভিউ বোর্ডে এই ব্যাপারটা আরও খেয়াল রাখতে হবে। ফোন সাইলেন্ট রাখবে। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে মিথ্যা বলবে না। ইন্টারভিউ দিতে ঢোকার আগে সিগারেট খাওয়া ঠিক নয়।

আত্মবিশ্বাস বাড়াও

ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ইন্টারভিউ বোর্ডের সম্মুখীন হওয়ার আগে একবার নতুন করে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতাগুলো যাচাই করে নিতে হবে। তুমি এই পদে কেন প্রার্থিতা করছ এবং এর জন্য তুমি কতটা যোগ্য, সেটা ভালোভাবে বুঝে নিও।

এর ফলে তোমার নিজের ওপর আস্থা বাড়বে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে যাওয়াটা খুবই সাধারণ ঘটনা। অনেকেই নার্ভাস হয়ে জানা প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না। অনেকে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। তাই এ-জাতীয় সমস্যা এড়াতে তুমি বাসায় বসে ইন্টারভিউর প্র্যাকটিস করে নিতে পারো। তাহলে ইন্টারভিউ বোর্ডে গিয়ে অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। আর ম্যানারস ঠিক রাখতে হবে।

ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় তোমাকে হতে হবে ভদ্র, বিনয়ী ও বন্ধুসুলভ। সঙ্গে সঙ্গে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত। তারা যেন তোমার আচরণে সন্তুষ্ট হন তার চেষ্টা করো। তাহলে ইন্টারভিউ দেওয়াটা সহজ হয়ে যাবে।

নো নার্ভাসনেস

নার্ভাস হওয়া যাবে না। তাহলেই সব গুলিয়ে যাবে। বিভিন্নমুখী প্রশ্ন এলে ধৈর্য ধরে শান্তভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিলে সেটা ঠিক না-ও হতে পারে। বোর্ডের মধ্যে পানি খেতে চাওয়া, ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেওয়া নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে বক্তব্য বুঝিয়ে বলার জন্য যে সময়টুকু নেওয়া প্রয়োজন, নেওয়া যেতে পারে। এতে চিন্তাগুলোও সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে বেশি সময় নয়।

ভাষার ব্যাপারে

ইন্টারভিউ গ্রহীতা বাংলায় প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দেওয়া যাবে না। এটা ওভার স্মার্টনেসের পরিচয়। আবার ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করতে হবে। তবে ইংরেজিতে গুছিয়ে বলতে না পারলে তাদের কাছে অনুমতি নিয়ে বাংলায় উত্তর দিতে হবে। আর ভাবা যাবে না এটাই আমার সবচেয়ে ভালো চাকরি কিংবা শেষ সুযোগ, এমনটা ভাবলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যাবে।

ইন্টারভিউ যদি খারাপও হয়, তাহলেও আস্থা রাখতে হবে, সামনে হয়তো এর চেয়েও ভালো সুযোগ আসতে পারে।

লেখা: সুরাইয়া নাজনীন
ছবি: সংগ্রহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
পাঠকের রান্নাহেঁসেল

কোয়েলের ডিমে বাসমতী

করেছে Wazedur Rahman মে ২০, ২০২০

ঈদ উৎসবে বাড়িতে চাঁদের হাট জমবে এ তো স্বাভাবিক। এ সময় মেহমানদারিতে পোলাও না হলে ঠিক জমে না। গড়পড়তা চিন্তার বাইরে একটু বুদ্ধি খাটালেই পোলাও প্রেজেন্টেশনে ভিন্নতা আনা খুব কঠিন কিছু নয়।

উপকরণ

কোয়েলের ডিম ২ ডজন, বাসমতী চাল ২৫০ গ্রাম, পেঁয়াজকুচি ১/২ কাপ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, আদাবাটা ১/২ চা-চামচ, ক্যাপসিকাম ১ টেবিল চামচ, কাঁচামরিচ ফালি ৬/৭টা, হলুদের গুঁড়া ১/২ চা-চামচ, মরিচের গুঁড়া ১ চা-চামচ, তেল ৬ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কলি ১ টেবিল চামচ, লবণ ১ চা-চামচ।

প্রণালি

প্রথমে কোয়েলের ডিম সেদ্ধ করে তা খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এবার প্যানে তেল গরম করে তাতে কোয়েলের সেদ্ধ ডিমগুলো দিয়ে তা ভালোমতো নেড়েচেড়ে তাতে একে একে পেঁয়াজকুচি, হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, আদাবাটা, রসুনবাটা, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ ফালি, লবণ দিয়ে ভালোমতো কষিয়ে নাও। এর পাশাপাশি হাঁড়িতে ফোটানো পানিতে বাসমতী চালের সঙ্গে লবণ দিয়ে চাল ৮০% সেদ্ধ করে পানি ঝরিয়ে নাও। এবার কষানো ডিমের হাঁড়িতে পানি ঝরানো ভাত দিয়ে খুব ভালোভাবে উল্টেপাল্টে মিশিয়ে নিতে হবে। ৫-১০ মিনিট অল্প আঁচে দমে রেখে গরম গরম পরিবেশন করো।

রেসিপি ও ছবি: ফাহা হোসাইন  

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্য

কোথায় চলেছি আমরা – ইসহাক খান

করেছে Wazedur Rahman মে ২০, ২০২০

আমরা যখন বাঁশের সাঁকো পার হয়ে গ্রামের কাদামাখা মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন একটি কিশোরী মেয়ে আমাদের পাশ দিয়ে দৌড়ে উঁচু ভিটের ওপর আমবাগানে গিয়ে অকারণ খিল খিল করে হাসতে থাকে। তার আলুথালু বেশ। মাথার চুলে জট ধরা। তাতে তেল পড়ে না বহুদিন। সে নৃত্যের ভঙ্গিতে শরীর দোলাচ্ছে আর একা একা খিল খিল করে হাসছে। আমরা অবাক। নিশ্চিত হতে পারছিলাম না মেয়েটি কী কারণে এমন করে হাসছে? সে কি মানসিক প্রতিবন্ধী, নাকি অতি উচ্ছ্বাসে এমন উদ্ভট কাণ্ড করে চলেছে! আমাদের সঙ্গে থাকা ফটোসাংবাদিক অমিতাভ ছবি তুলতে চাইলে আমি বাধা দিলাম। অমিতাভ শুনল না। ক্যামেরা তাক করামাত্র মেয়েটি এবার গম্ভীর হয়ে তারপর ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে তেড়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে।

আশ্বিনের মেঘমুক্ত আকাশ। বাতাস শুকনো খরখরে। গা ঘেমে ওঠে রোদে দাঁড়ালে। শহুরে মানুষ বলে রোদের তেজ আমাদের শরীরে বেশি করে খামচে ধরছে যেন। আমরা তিনজন সাংবাদিক যাচ্ছিলাম শহর থেকে দূরে নন্দীপুর নামের একটি অজ গ্রামে। অজ বলতে যা বোঝায় নন্দীপুর যথার্থ অর্থে তাই। পাকা রাস্তা দূরের কথা, তেমন কোনো চওড়া রাস্তা নেই। আল আর ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। পথঘাটের যে অবস্থা, শিক্ষার প্রসঙ্গটি বোধকরি না তোলাই ভালো। অশিক্ষার অন্ধকার এখানে আষ্টেপৃষ্ঠে কামড়ে আছে। তাই তো গ্রাম্য সালিসে প্রভাবশালীরা একজন মেয়েকে দোররা মেরে ক্ষতবিক্ষত করেছে। মেয়েটির অপরাধ সে ধনী জোতদারের ছেলে আবুলকে ভালোবাসে। আবুলের অতিমাত্রায় ভালোবাসার ফলে সে সামাজিক নিয়মবহির্ভূত সন্তানের মা হতে চলেছে। গ্রামীণ জীবনে এ ঘটনা বিশাল এবং মুড়মুড়ে চিবানোর মতো মুখরোচক চানাচুর। মানুষের নাওয়াখাওয়া থেমে যায় এই রসাল আলোচনায়। বিচারের ব্যাপারটিও এসব ক্ষেত্রে ভীষণ কৌতুকপ্রদ। শোনা গেছে, আশপাশের দশ গাঁয়ের মানুষ এসেছিল সেই সালিসে। শুধু কি কৌতূহল? না। তারা এসেছিল শরিয়তের বিধান দেখতে। অনেক আগে থেকেই এই গ্রাম শরিয়তের কড়া নিয়ম মেনে চলে। ব্যাপারটি এই বলে প্রচার হয়েছিল যে অপরাধী ছেলেমেয়ে উভয়কেই মাটির নিচে অর্ধেক পুঁতে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে। যতক্ষণ অপরাধীর দেহ থেকে প্রাণ ত্যাগ না হয় ততক্ষণ ঢিল ছোড়া হবে। এটাই নাকি শরিয়তের বিধান। সেই বিধান কীভাবে প্রয়োগ হয় তাই দেখতে মানুষের ঢল নেমেছিল।

অজ গ্রাম বলে খবরটি প্রশাসনের নজরে আসেনি। আমাদের কাছে যখন খবর আসে, ততক্ষণে আহত মেয়েটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে চিকিৎসাধীন। সে তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এই কথাটি সাধারণত সংবাদ রচনায় আমরা লিখে থাকি ‘মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।’ সংবাদপত্রে ব্যবহৃত কমন কিছু ভাষা আছে, যা সহজ অর্থে পাঠককে বোঝানোর জন্য লেখা হয়। গিয়ে দেখলাম, ক্ষতবিক্ষত মেয়েটি পাঞ্জা লড়বে কী, নেতানো শরীর নিয়ে নিস্তেজ পড়ে আছে। এতটাই দুর্বল যে তার কথা বলার অবস্থা নেই। ঘটনা সরেজমিনে জানার জন্য আমরা যাচ্ছি নন্দীপুর। আমরা মানে অমিতাভ, শফিক এবং আমি। শফিক স্থানীয় একটি সাপ্তাহিকের সাংবাদিক। ফটোসাংবাদিক অমিতাভ এবং আমি ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার। এ বছর আমার প্রমোশন হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার থেকে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। বার্তা সম্পাদক আলী ভাই আমাকে পাঠালেন সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরি করতে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলী ভাই সরাসরি বললেন, ‘পাবনা প্রেসক্লাবে গিয়া তুমি শফিককে খুঁইজা বার করবা। ওরে আমার কথা বলবা। দেখবা ওই তোমারে পথ চিনায়া নিয়া যাবে। তোমার কিছু ভাবতে হবে না।’
আলী ভাই বলেছেন- কিছু ভাবতে হবে না। কিন্তু তেড়ে আসা মেয়েটির কথা বা এমন ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা তিনি বলেননি। এমন পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে-তা তিনি বলে দেননি। হয়তো তিনি জানেন সাংবাদিকদের এমনতর অনেক উদ্ভূত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি প্রাণ যাওয়ার জোগাড়ও হয়।

তেড়ে আসা মেয়েটি আমাদের কাছাকাছি আসতে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের একটি ডাল হাতে তুলে নেয়। এরই ফাঁকে অমিতাভ ক্রমাগত ক্যামেরার শাটার টিপে চলেছে। আমরা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। শফিকও তেমন কোনো পরামর্শ দিচ্ছে না। কিংবা দিতে পারছে না। মেয়েটি কাছে এসে কী ভেবে থমকে দাঁড়াল। গোটা ব্যাপারটি অভিনব মনে হলো আমার। এই অভিনব দৃশ্য অবিকল এমন করে অভিনয় করতে বললে আমার বিশ্বাস, বাংলা ফিল্মের বাঘা বাঘা অভিনেত্রী পেরেশান হয়ে যাবে। কম করেও দশবার ক্যামেরা কাট করতে হবে। মেয়েটি কাছাকাছি এলে বোঝা গেল ওকে অষ্টাদশী বলা যায় না। আবার কমও নয়। মুখটা মায়াময়। পরনের তাঁতের শাড়িখানা ত্যারতেরে ধরনের। শরীরে ব্লাউজ যেটা আছে সেটা ঠিক ব্ল¬াউজ বলা মুশকিল। কবে কে তৈরি করেছিল বোধ করি সেটা এখন গবেষণার বিষয়। মেয়েটি যেভাবে তেড়ে এসেছিল, তাতে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কী ভেবে ও থমকে দাঁড়াল তা বোঝা না গেলেও দেখে মনে হলো ও আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।
আমি হেসে বললাম, তোমার নাম কী?
মেয়েটি ধমক দেওয়ার মতো করে জবাব দিল, ‘পুটি।’ আমরা তিনজনই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। পুটি আবার কারও নাম হয় নাকি? মেয়েটিও হাসল এবার। হাসলে ওকে অন্য রকম দেখায়। তখন ওর দুখী-দুখী চেহারা হঠাৎ করে উদ্ভাসিত হয়।
হাসি আড়াল করে বলে, ‘জন্মের সময় আমি খুব ছোট আছিলাম। তাই নানি আমারে পুটি কয়া ডাকে।’
এতক্ষণে একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয় যে ওর জীবন কাটে বড় কষ্টে। ও আসলে অসুস্থ বা অস্বাভাবিক নয়। বরং সারল্য ভর করে আছে কথায় এবং সমস্ত অবয়বে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কোন বাড়ি?
আগের মতো ধমকে বলল, ‘ক্যা? বাড়ি দিয়া কী কাম?’ আমার হঠাৎ মনে হলো এই মেয়েটি হতে পারে আমাদের সংবাদ সংগ্রহের বাড়তি উৎস। ওকে হাতছাড়া করা যাবে না। বললাম, তোমাকে কিন্তু আমরা চিনি। আমরা শহর থেকে তোমার কাছেই এসেছি। মেয়েটি আবারও ধমকে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা? কী কামে আমার কাছে আইছেন?’ বললাম, ‘যারা ঠিকমতো খেতে পায় না, তাদের আমরা টাকা দিয়ে সাহায্য করব। শুনেছি তোমরা নাকি ভীষণ কষ্টে আছো।’
মেয়েটি এবার মন খারাপ করল। আমি ভাবলাম ওকে গরিব বলায় হয়তো ওর আত্মসম্মানে লেগেছে। মাথা নামিয়ে বলল, ‘আমাগোরে সাহায্য করলে গাঁয়ের লোক আপনাদের মাইরা খেদায়া দিব।’
বিস্ময়ে আমাদের কথা হারিয়ে যায়। পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই আমরা। পুটি আবার বলে, ‘জানেন না, আমাগো একঘরে কইরা রাখছে? কেউ আমাগো সাথে কথা কয় না। কাম দেয় না।’
‘কেন?’ শফিক তাৎক্ষণিক প্রশ্নটি ছুড়লে পুটি জবাব না দিয়ে আবার ভিটের দিকে হাঁটতে থাকে। আমি সামান্য গলা তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি তখন একা একা খিল-খিল করে হাসছিলে কেন?’ পুটি জবাব না দিয়ে আবার খিল-খিল করে হেসে দৌড়ে ভিটের দিকে যায়। সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলে, ‘পুলিশের ভয়ে ছোট মিয়া বোরখা পইরা পালাইছে’। বলেই আবার পুটি খিল খিল করে হাসে। আমরা তার কথাটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই। ফটোসাংবাদিক অমিতাভ ততক্ষণে অস্থির হয়ে পড়েছে। বলে, ‘পাগল-ছাগলের ব্যাপার বাদ দেন বস। চলেন, আসল কাজে যাই।’ চটপটে স্বভাবের অমিতাভ সাংবাদিকতায় শুধু থ্রিল আর রোমাঞ্চ খোঁজে। ও বোঝে না, সহজ সত্যের মধ্যেই প্রকৃত থ্রিল আর রোমাঞ্চ।
অমিতাভ আবার অস্থিরতা প্রকাশ করে বলে, ‘বস, খামাখা দেরি কইরেন না। যে কাজে আছি সেই কাজে চলেন।’ আমি আমার ভাবনার কথাটা ওদের বুঝতে না দিয়ে বললাম, ‘চলো।’
ততক্ষণে আমার ভেতরে সংবাদের নেপথ্যে আরও গভীর সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎসের জন্ম হতে চলেছে। এই জন্য পুটির সাহায্য দরকার। ওকে অবশ্যই আবার খুঁজে নিতে হবে।
আমরা হাঁটছিলাম গাঁয়ের ভাঙাচোরা পথে। ছন্নছাড়া ধরনের গ্রাম নন্দীপুর। গ্রামীণ সৌন্দর্যের পুরোটা না হলেও অনেকখানি এখানে অনুপস্থিত। এলোমেলো ধরনের বাড়িঘর। ঘরদোরের চেহারা দেখেই অনুমান করা যায় গরিব মানুষের সংখ্যা এখানে বেশি। কথাটা বলেই ফেলল অমিতাভ। মুচকি হেসে শফিক বলল, ‘বিটিভির উন্নয়নের জোয়ার এখানে এসে পৌঁছায়নি।’
আমি অবাক হলাম শফিকের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রসের পরিচয় পেয়ে। আমি হেসে তাকালে শফিক লাজুক হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকায়। পরিচয়ের পর তার সাদামাটা কথাবার্তা আমার ভালো লাগেনি। সাংবাদিকেরা এমন মেনিমুখো হবে কেন? ভেবেছিলাম ঢাকায় ফিরে আলী ভাইকে আচ্ছা করে একটা ঝাড়ি দেব। ‘ধ্যত্তরি আলী ভাই, কী এক আবদুলের ঠিকানা দিছিলেন, সব সময় মুখ চুকা কইরা রাখে। স্থানীয় বলে ও আমাদের পথ দেখাবে। সব বলে দেবে, কোথায়Ñকাকে ধরলে আমরা আসল তথ্য পাব, সব ধরনের সাহায্য করবে সে। তা নয়। কেমন ভ্যাদা মাছের মতো উদাস হয়ে থাকে। কিন্তু সরকারকে দেওয়া তার এই খোঁচা আমি বেশ উপভোগ করলাম এবং মজা পেলাম। অমিতাভ একমনে বাড়িঘর দেখছে আর সুযোগমতো ক্যামেরার শাটার টিপছে। একটি পুরোনো বটগাছ দেখা গেল গ্রামের পশ্চিম পাশে। আশপাশে জঙ্গলা ধরনের গাছ। যত্নের অভাব। হাঁটতে হাঁটতে একটা জিনিস খেয়াল হলোÑ গ্রামে জনমানবশূন্য। হয়তো সালিসি ব্যাপারটি জানাজানি হওয়ার পর ভয়ে সবাই আত্মগোপন করেছে। তবে বাড়িঘরের আড়ালে বউঝিরা আমাদের ঠিকই খেয়াল করছে। অমিতাভের কাঁধে ক্যামেরা দেখে তাদের হয়তো ধারণা হচ্ছে আমরা কারা, কেন এসেছি।

একটি বড়সড় বাড়ি চোখে পড়ল। বড় অনেকগুলো ঘর। বাড়ির সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা। এক পাশে বড় খড়ের পালা আর ঝাঁকড়া দুটো আমগাছ বাড়িটির আকর্ষণ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একজন বৃদ্ধলোক আমাদের দেখে কৌতূহলে এগিয়ে এলে আমরা তার কাছে জানতে পারি, এ বাড়ির মালিক গাঁয়ের অবস্থাশালী জোতদার ফুলজার তালুকদার। তিনি গাঁয়ের মাতবরও। বিচার-সালিস তিনিই করেন। আমরা আরও জানতে পারি তার বাড়ির ওই ঝাঁকড়া আমগাছের নিচে বসেই সালিসি কার্যক্রম চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ফুলজার তালুকদার বাড়ি নেই। সদরে গেছেন। সদর মানে উপজেলায়। প্রায়ই যান। সেখানে তার রড-সিমেন্টের ব্যবসা। আমরা আসার আগে সেই দোকানে ঢুঁ মেরেছি। ওখানে তিনি নেই। পেলে ওখানেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করতাম।
আমরা ধরে নিয়েছি তিনি আত্মগোপন করেছেন। চারদিকে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভয়ে-আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন। কারণ, তার নির্দেশেই মেয়েটিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে দোররা মারা হয়েছে।
তালুকদারবাড়ির উঠোনে কথা হচ্ছিল জনা কয়েক নিরীহ গ্রামবাসীর সঙ্গে। তারা মুখ ফুটে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছিল না। তারা আমাদের ভয় আর কৌতূহল মিশেলে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল।
স্থানীয় সাংবাদিক শফিক তাড়া দিয়ে বলল, ‘চলেন, ভিকটিমের বাড়ি যাই। এখানে থাইকা কোনো লাভ হবে না।’ আমি বলতে চাইলাম লাভ হবে কি হবে নাÑসেটা বুঝতে আপনার অনেক সময় লাগবে। কিন্তু বলা হলো না। সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। বলা ঠিকও না। আমার কথায় মনঃক্ষুণ্ন হয়ে শফিক যদি অসহযোগিতা করে, তাহলে?
আমরা নির্যাতিত মেয়েটির বাড়ি যাব বলে পা বাড়ালাম। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি বালক, নাম জিন্নত আলী। পড়ালেখা করে না। মাঠে গরু চরায়। জিন্নতের কাছে জানলাম নির্যাতিতের নাম সবুরা। সে আরও বলল সবুরার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আবুলের। আবুল অর্থাৎ সেই প্রেমিকপ্রবর। যার জন্য সবুরাকে সব হারাতে হয়েছে।
আমি খুব সরলভাবে সহজ কথায় জিন্নতের কাছে জানতে চাইলাম, সবুরা যদি দোষ না করে থাকে তাহলে তাকে মারল কেন? আর মারল যখন তখন কেউ প্রতিবাদ করল না কেন?
জিন্নত সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘কেডা পরতিবাদ করবে? তালুকদারের বিরুদ্ধে কথা কইলে তার খবর আছে। এক্কেবারে ছেইচা ফালাইবো।’
‘আবুল কে?’ আমি জিজ্ঞেস করলে জিন্নত বলে, ‘তালুকদারের ভাইস্তা। বদের হাড্ডি।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘বদের হাড্ডি কেন?’
জিন্নত বলে, ‘কামকাজ করে না। সারা দিন খালি বদগিরি করে। তারে কী কমু? আপনে কন, ও বদের হাড্ডি না?’
বললাম, ‘তা ঠিক। কিন্তু তুমি যে এত কথা বলছ, ও যদি জানতে পারে, তোমার অসুবিধে হবে না?’
কথায় জোর দিল জিন্নত। বলল, ‘কেমনে জানব? ও কি গাঁয়ে আছে? পলাইছে। জানেন, পুলিশের ভয়ে বোরখা পইরা পলাইছে।’ বলেই জোরে হাসতে লাগল জিন্নত। এতক্ষণে ভিটের ওপর পুটির খিলখিল হাসির মাজেজা বুঝলাম। ক্ষমতাশালীরা যখন বোরখা পরে চোরের মতো পালায়, দুর্বলেরা তা দেখে হাসতেই পারে। যাদের অঙ্গুলি হেলনে সবাই ওঠে-বসে, তারাও ভয়ে মেচি বিড়াল হয়। এটাই বুঝি দুর্বলদের আনন্দের বাড়তি খোরাক।
হঠাৎ জিন্নতের সারল্যভরা আবদার, ‘আমার একটা ফটোক তুলবেন?’ কোমলমতি বালকের মায়াময় আকুতি আমাদেরও স্পর্শ করে। অমিতাভকে কিছু বলতে হলো না। ক্যামেরা রেডি করে বলল, ‘তুমি ঠিক হয়ে দাঁড়াও।’ বলেই অমিতাভ পকেট থেকে চিরুনি বের করে দিল, বলল, ‘সিঁথি করে নাও।’
বালক জিন্নত লাজুকভাবে হেসে এলোমেলো লালচে চুল সে নিজের মতো সিঁথি করতে লাগল। আমি বালকের আনন্দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে চিরুনি নিয়ে ওকে বোম্বে ফিল্মের নায়ক শাহরুখ খান স্টাইলে সিঁথি করিয়ে দিলে ও গালভরে হেসে ওঠে। সে হাসি নির্মল। জীবনের না পাওয়ার হতাশা সেখানে নেই। অনেক পেয়েছে যেন। ভালোবাসা বুঝি এমনই। না চাইতে অনেক কিছু পাওয়া যায়। তারপরও একটু ভালোবাসা দিতে মানুষের কত যে অনীহা। অমিতাভ পরপর তিনটি ছবি তুলল। বাকি কয়টা শুধু ফ্লাশ জ্বালিয়ে জিন্নতকে ভিলেনের ঢঙে পোজ দিতে বললে বালক জিন্নত অবলীলায় তাই করতে থাকে। স্রেফ মজা। এর মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। অমিতাভের চালাকি বিষয়ে কোনো কথা বলা ঠিক হবে না। তাহলে মজাটা বিষাদে ভরে যাবে।

ছবি তোলার পর জিন্নত আগের মতো গাল ভরে হেসে উঠলে সে হাসি যেন ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে পড়া সমুদ্রের সফেদ ফেনার মতো ঝলমলিয়ে ওঠে। তামাশা দেখতে ওর বয়সী কিছু বালক আমাদের পিছু পিছু আসছিল। ঝোপের আড়ালে অনেকগুলো রমণীর কৌতূহলী চোখ আমাদের গিলছিল। অমিতাভ এ রকম একজন লুকানো মহিলাকে আকস্মিক দেখতে পেয়ে তার ছবি তুলতে চাইলে মহিলা ছুটে পালায়। কৌতূহলী বালকেরা আমাদের কাছাকাছি এলে আমি ইশারা করতে অমিতাভ ধমকে সবাইকে সরিয়ে দেয়। শুধু জিন্নত থাকে আমাদের সফরসঙ্গী। জিন্নতের চোখে-মুখে বিজয়ের প্রশান্তি।
পথের পাশে একটি নির্মাণাধীন পাকা ভবনের ওপর দৃষ্টি যায় আমাদের। জিন্নত বলে, ‘তালুকদার সাহেব জুম্মাঘর বানাইতেছে। সে কইছে এবার কুরবানির হৃদে জুম্মাঘর পুরাপুরি কমপ্লি¬ট অইয়া যাইবো।’
আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। সারা গ্রামে একটিমাত্র পাকা ঘর। সেটা মসজিদ। গাঁয়ে কোনো পাঠশালা নেই। ছেলেরা এখানে সকাল-বিকেল আমপারা পড়ে। নামাজের জন্য দোয়া-দরুদ শেখে। ওই পর্যন্ত। যেন আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। কদিনের দুনিয়া, পরকাল হলো অনন্তকাল। ইহকাল নিয়ে কাফেররা মাথা ঘামায়। দ্বীন ইসলামের জন্য এর বেশি জানা ফরজ না। অথচ তালুকদারের ছেলেমেয়েরা ঠিকই কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে। তারা শহরে থাকে। এসব গল্প আমাদের জিন্নত বলে যেতে যেতে।
মসজিদের পাশে একটি জীর্ণ বাড়ি। মানুষজনের সাড়া নেই। দাঁড়িয়ে পড়ি আমরা। অমিতাভ মসজিদের ছবি তোলে। এই সময় হুজুর কিসিমের একজন বয়স্ক ব্যক্তি বেরিয়ে আসে। খালি গা। তার ওপর মাথায় টুপি। ভীষণ বেখাপ্পা লাগছিল। আমাদের দেখে ভয়ার্ত মুখে আবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে। জিন্নত বলে, ‘উনি হুজুর। উনি তো হাদিস ঘাঁইটা সালিসের রায় দিছে।’
আমরা তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যাই। এই ফতোয়াবাজকেই আমরা খুঁজছি। এই লোকগুলো ধর্মের নামে দুর্বলকে অত্যাচারের ফতোয়া দেয়। এরাই ইসলামের প্রকৃত দুশমন। আসল লোকটির কথা আমরা যেন ভুলেই বসেছিলাম। জিন্নতকে পাঠানো হলো হুজুরকে ডাকতে। আমরা অপেক্ষা করছি।
শফিক বলল, ‘মনে হইতাছে হুজুর ব্যাটা আসবে না। টের পাইছে আমরা কারা। যাই কন, ব্যাটাকে কিন্তু ছাড়া ঠিক হবে না। ওকে চাপ দিলেই সব গিট্টু খুইলা যাবে। দেইখাই কিন্তু মনে হইছে ব্যাটা মেনকা শয়তান। আমাগো দেইখা এমনভাবে লেজ তুইলা দৌড় মারল, মনে অইলো বাঘে তাড়া করছে। কারবারটা খেয়াল করছেন?’
জিন্নত এলো অনেক পরে। আমাদের ধৈর্য ভেঙে যায় যায় অবস্থা। আমরা নানা কিছু ভাবছিলাম হুজুরকে নিয়ে। জিন্নত এসে জানাল, ‘আইবো না। কইলো জোহরের নামাজের টাইম অইছে। এহন গোসল করবো। সময় নাই।’
অমিতাভ ঘড়ি দেখে বলল, ‘সবে বাজে বারোটা। এখনই কিসের নামাজ? ব্যাটা আসলে আমাদের সামনে আসবে না।’ জিন্নত এ কথায় সায় দিল। বলল, ‘আমারে জিগায় আপনেরা কারা? আমি বলছি, আপনেরা সামবাদিক। উনি শুইনা আমারে হাত দিয়া না কইরা দিল। আমি বললাম, হ্যারা খুব ভালো মানুষ। আমারে ধমক দিয়া কয়, ভালোর তুই কী বোঝস? ওরা সব শয়তানের চ্যালা। নামাজ-কালামের ধার ধারে না, আইছে আল্লাহর কালাম নিয়া বেহুদা কথা জিগাইতে। ওরা দোজখের খড়ি। তুই কি ওদের ডাইকা আনছোস আমার কাছে?’
অমিতাভ বলল, ‘চলেন, আমরাই যাব বাড়ির ভেতর। আপনারা কথা বলতে থাকবেন আর আমি এই ফাঁকে-’ অমিতাভ কথা শেষ করল না। ইঙ্গিতে বোঝাল ক্যামেরার শাটার টিপবে। আমরা পায়ে-পায়ে আঙিনার একেবারে কাছে গিয়ে বেড়ার পাশে গিয়ে ডাকলাম, ‘হুজুর, একটু বাইরে আসেন, আমরা আপনাকে বিরক্ত করব না। জাস্ট দুটো কথা বলব।’
হুজুরের সাড়াশব্দ নেই। বুঝলাম হুজুর ঘরে লুকিয়ে আছে। আমরা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে বোঝালাম, আমরা চলে গেছি। কায়দাটা বের করল শফিক। সে দরাজ গলায় বলে উঠল, ‘ঠিক আছে হুজুর, আপনার কাছে জরুরি দরকারে আসছিলাম। আপনি যখন সাক্ষাৎ দিবেন নাÑতখন কী আর করা, আমরা গেলাম। দোয়া কইরেন।’
অথচ আমরা গেলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শফিকের এই কৌশলটা আমার ভীষণ মজা লাগল। সাংবাদিকদের কত রকম ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। ‘ছলনা’ শব্দটা না বলে বলা যায় সংবাদ আহরণের কায়দাকৌশল। ছলনা শব্দের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক আবহ আছে। আমরা কি নেতিবাচক কোনো কিছু করতে এসেছি?
আমি অবাক হয়েছি শফিকের আকস্মিক কৌশলটা প্রয়োগে। এতক্ষণ যাকে মেনি মাছ বলে মনে মনে তিরস্কার করছিলাম, এক্ষণে তার দরাজ গলার আওয়াজে আমাকে আরেক দফা অবাক করে। ধীরৈ ধীরে প্রতিভার পোর খুলছে। ব্যাপারটা ভাবতে একা একা হাসি পায় আমার।
আমাদের অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হুজুর ভেবেছে আমরা চলে গেছি। সে বাইরে এসে দাঁড়াতে শফিক তাকে তমিজের সঙ্গে মিষ্টি গলায় সালাম দিলে হুজুর অভ্যাসবশত মুখস্থ জবাব ওলায়কুম পর্যন্ত এসে আমাদের দেখামাত্র বাকি অংশ তার কণ্ঠের ভেতরে আটকে গেল। কোনোরকমে ঢোঁক চিপে জবাব শেষ করে। তারপরই সে গর্জে ওঠে। ‘আপনারা এখনো যান নাই? ক্যান আমারে তকলিব দিতাছেন? জানেন, আমি কে?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘হুজুর রাগ করছেন কেন? আপনাকে আমরা চিনি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আপনাকে চিনতেই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।’ আমাদের কথার মাঝে অমিতাভ তার কাজ করে যাচ্ছে। ক্রমাগত সে শাটার টিপছে। হুজুর কথায় ব্যস্ত। হঠাৎ বুঝতে পেরে খেঁকিয়ে তেড়ে গেল অমিতাভের দিকে। ‘ফটো তোলেন ক্যা? জানেন না ফটো তোলা নাজায়েজ?’
আমি অমিতাভকে মৃদু ধমক দিলাম। বললাম, ছবি তোলার দরকার নেই।
হুজুর রেগেমেগে বললেন, ‘ছবি বাইর করেন। না অইলে আমি ক্যামেরা ভাইঙ্গা ফালামু।’
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘হুজুর, আপনার ছবি আমরা ছাপব না। নষ্ট করে ফেলব।’
বললেন, ‘না, এখনই ছবি বাইর করতে অইবো।’
শফিক বলল, ‘কেন, ভয় পাচ্ছেন?’
হুজুরের কণ্ঠে এবার ব্যঙ্গ ঝরল, ‘ভয়! মুসলমান এক আল্ল¬াহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না।’
বুঝলাম গোখরো সাপের লেজে পা পড়েছে। হুজুরকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

শফিক বলল, ‘তাহলে এত অস্থির হচ্ছেন ক্যা? আপনাদের বড়-বড় মৌলানা সাহেবরা হরহামেশা ছবি তুলছে। পত্রিকায় সেসব ছবি ছাপা হচ্ছে। টেলিভিশনে টক শো করছে। এমনকি আপনাদের মৌলানা সাহেবরা বেপর্দা মহিলাদের সঙ্গে গ্রুপ ছবিও তুলছে।’
‘বাজে কথা মাত করেন। কোথায় মৌলানা সাহেবরা বেপর্দা নারীদের সঙ্গে ছবি তুলছে?’
অমিতাভ বলল, ‘কোথায় আবার, টেলিভিশনে দেখেন না?’
হুজুর বলেন, ‘ওই গুনার বাক্স আমি কী কামে দেখমু? সব নাজায়েজ।’
আমি থামিয়ে বললাম, ‘ওদের কথায় মাইন্ড করবেন না হুজুর। ওরা নাদান। ওরা না বুঝে আপনার সঙ্গে তর্ক করছে। আমরা আপনার কাছে একটি কথা জানতে এসেছি। সবুরাকে দোররা মারা হয়েছে। আর তার ফতোয়া নাকি আপনি দিয়েছেন?’
হুজুর থেমে বললেন, ‘তাতে অন্যায়টা কী অইছে? ওই ছেমরি জেনা করছে। শরিয়তমতে ওর বিচার অইছে। আমি জানি আপনারা কারা? আপনারাও ওই জেনাকারীদের দলে। তাই তো খবরের কাগজে মুসলমানদের গিবত করতে আপনারা আইছেন। আমি কিছু বুঝি না মনে করছেন?’
আমি বললাম, ‘হুজুর, একই অপরাধে শুধু সবুরা শাস্তি পাবে কেন? একই শাস্তি আবুলেরও পাওয়ার কথা।’ কিন্তু-
হুজুর বললেন, ‘ওরে কই পামু। ও তো পলাইছে।’
অমিতাভ বলল, ‘তাই বলে গরিব মেয়েটাকে আপনারা নির্মমভাবে পিটাইবেন? এই কি আপনাদের
শরিয়তের বিধান?’
হুজুর যুক্তি খুঁজে না পেয়ে ক্ষেপে গেলেন, ‘চুপ বেয়াদব। তুমি আমাকে শরিয়ত শিখাও? শরিয়তের তুমি কী বোঝ? তুমি জানো, সম্পূর্ণ কোরআন আমার মুখস্থ? আমি হাফেজ?’
শফিক এবার মিন মিন করে বলে, মুখস্থ বিদ্যা দিয়া আর কত চালাইবেন? পুলিশ আইলে মুখস্থ বাইর করব। শফিকের কথা পরিষ্কার শুনতে পাননি হুজুর। তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কুট কুট কইরা কী কইতাছ? সাহস থাকে গলা বাড়ায়া কও।’
আমি বললাম, ‘পেলাপানের কথা বাদ দেন। ওরা সেদিনের পোলাপান। ওরা আপনাদের মাজেজা বুঝবে কী? হুজুর, আমি বলছিলাম কী, এই নিয়ে যদি মামলা-মোকদ্দমা হয় তখন আপনি কিন্তু আগে ফাঁসবেন।’
এবার হুজুরের চোখজোড়া সামান্য কাঁপল যেন। বোঝা গেল মামলার কথা শুনে হুজুর কিঞ্চিত ভয় পেয়েছেন। আমি এবার জোর দিলাম কথায়, বললাম, ‘যতদূর জানি মানবাধিকার সংস্থা থেকে মামলা করা হচ্ছে। সেখানে আপনি প্রধান আসামি।’
‘ক্যা, আমি প্রধান আসামি অমু ক্যা? আমি কী করছি?’
বললাম, ‘আপনি ফতোয়া দিয়েছেন। সেই ফতোয়ায় মেয়েটির ওপর অত্যাচার করা হয়েছে।’
হুজুর বললেন, ‘আমি ফতোয়া না দিলেও ওরা মেয়েটাকে রেহাই দিত না।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে? কে রেহাই দিত না?’
‘কে আবার? যার হুকুমে সব অইছে?’
‘তার নাম বলেন।’
‘নাম বইলা কি আমারে বেকায়দায় পড়তে কন?’
কথাটা চেপে ধরল শফিক। ‘একটু আগে বললেন আপনি এক আল্ল¬াহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পান না? এখন আবার এ কথা বলছেন ক্যা? তার মানে আপনি তালুকদারের ভয়ে ফতোয়া দিয়েছেন, ঠিক না?’
হুজুর এবার থমকে গেলেন। ধর্মের আদর্শের চেয়ে এদের কাছে সমাজপতির নির্দেশ অনেক বেশি মূল্যবান। ধর্ম প্রচারকেরা মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর ধর্মের এই ধ্বজাধারীরা অর্থ আর ক্ষমতার কাছে সবকিছু বন্ধক দিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনেও একই চিত্র সর্বত্র। যারা একসময় গলাবাজি করে বলেছেন, নারী নেতৃত্ব হারাম। এখন তারাই নারী নেতৃত্বের কাছে ইহলৌকিক স্বার্থে ধর্মের সব বিধান অন্ধের মতো বির্সজন দিয়েছেন।
সে হিসেবে হুজুরের দোষ সামান্য। নিজের ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তায় সমাজপতিকে মান্য না করে তার উপায় নেই। সেইমতো হাদিস বয়ান করেছেন। কিন্তু তিনি তো ইমাম। অনেক মানুষের দায় তাকে নিতে হবে। না হলে তাকে হাশরের ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে। কথাটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি ভাবনাক্রাস্ত হয়ে ভেতরে যেতে থাকলেন।
আমরা হুজুরের আঙিনা পার হয়ে হঠাৎ খেয়াল করি বালক জিন্নত আমাদের সঙ্গে নেই। কখন কোন ফাঁকে ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আমরা খেয়াল করিনি। খানিক যাওয়ার পর কোথেকে ভুস করে বের হয়ে আসে জিন্নত। শফিক বলে, ‘শৈল মাছের মতো কেদো কাইটা কই গেছিলা মি. জিন্নত মিয়া?’
জিন্নত জবাব দেয় না। শফিকের কথাটা খুব রসাল শোনায়। জিন্নত হয়তো শফিকের সূক্ষ্ম রস অনুধাবন করতে পারেনি। রস করাটা যেমনÑ তেমনি রস আস্বাদন করাটাও শক্ত কাজ, মেধা লাগে। শফিকের রসাল সংলাপে আমি ক্রমে মুগ্ধ হচ্ছি। বার্তা সম্পাদক আলী ভাই যথার্থ লোকের ঠিকানা দিয়েছেন আমাকে। জায়গামতো ওষুধ দিতে সে যথেষ্ট পারদর্শী।
আমি জিন্নতকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি পুটিকে চেনো?’
জিন্নত অবাক। ‘কন কী! চিনমু না ক্যা?’ ওর অবাক হওয়ার ভঙ্গিটি দেখার মতো। এমন ভঙ্গি আর মজার একটি সংলাপ আমাকে শুনিয়েছিল বছর দুই আগে উত্তরবঙ্গের একজন মধ্যবয়সী কৃষক। সেও এমন ভঙ্গি করে অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আপনি কী কইলেন! কথা কইলেন না চাল চাবাইলেন!’
কথার সঙ্গে চালের কী সম্পর্ক তাৎক্ষণিক বুঝতে না পারলেও মজা পেয়েছিলাম বেশ। আজও শক্তভাবে মনে গেঁথে আছে। মনে হলে এখনো একা একা হাসি।
আমি জিন্নতকে বললাম, ‘আমাকে একটু পুটিদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারো?’
জিন্নত মাথা নামিয়ে থাকে। কুঁত-কুঁতে চোখ একবার ওপরে তুলে আবার নামিয়ে নেয়। বোঝা যায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। অমিতাভ বলে, ‘এত চোটপাট এখনই থাইমা গেছে? বোঝা গেছে তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি সিওর, তুমি কখনো জায়গীর থাকতে পারবে না।’
এই মজার কথাটা অমিতাভ শুনেছে আমার মুখে। অফিসে ক্যানটিন বয়কে কথাটা মজা করে বলেছিলাম একদিন। তাকে একটা বললে করে আরেকটা। তাকেই বলেছিলাম কথাটা। সেখানে অমিতাভসহ আরও কজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিল। সবাই খুব মজা পেয়েছিল। কিন্তু জিন্নত বিষয়টি মজা পেল বলে মনে হলো না। শফিক খুব এনজয় করল। সে হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। এবং গভীরভাবে জিন্নতের দিকে তাকিয়ে রইল। শফিকের এমন করে হেসে ওঠায় অমিতাভও মজা পেয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে হাসতে লাগল।
একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখা গেল লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে আসছে। তার পাকা চুলগুলো দূর থেকে শন ফুলের দেখাচ্ছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল দারিদ্র্য তাকে পিষে রেখেছে। সে কাছে এসে চোখ ওপরে তুলে তাকায়, খন-খনে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কেডা?’
জিন্নত কিছু বলে না। জিন্নতের নীরবতা আমাদের অবাক না করলেও কারণটা জানার কৌতূহল ভেতরে প্রচণ্ড উসখুস শুরু হয়। একটু পর বৃদ্ধ মহিলা সামনে হাত মেলে ধরে। যে কাজটি আমরা খুব সহজে করতে পারি। এই হাত পাতা নিয়ে আমাদের যেন কোনো গ্লানিবোধ নেই।
আমরা বৃদ্ধ মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দারিদ্র্যের কর্কশ আঁচড় তার সারা মুখে দগদগে। সে ঘাড় নেড়ে কাতর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে।
জিন্নত হঠাৎ খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ওই বুড়ি যাস না! যার-তার সামনে হাত পাতোস। তোর লজ্জা-শরম নাই? জানোস তারা কারা? তারা সামবাদিক। সামবাদিকরা কাউরে ভিক্ষা দেয় না।’
বৃদ্ধ মহিলা অবাক গলায় অ্যাঁ শব্দ উচ্চারণ করে। সে বুঝতে পারেনি জিন্নত কী বলছে। সে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করে, ‘তারা ভিক্ষা দেয় না ক্যা?’
জিন্নত এবার জোর দিয়ে বলে, ‘তারা সামবাদিক।’
‘সামবাদিক! হে আবার কী জিনিস?’
‘তোমার বোঝার কাম নাই। তুমি যাও।’ বৃদ্ধ মহিলা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। আমি দশ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে ধরলে তার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে। সে খপ করে টাকাটা নিয়ে দুহাত তুলে দোয়া করে। অমিতাভের দোয়ায় বিশ্বাস নেই। ও বৃদ্ধ মহিলার দোয়া করার ভঙ্গি ক্যামেরাবন্দী করে।
আমি তখন ভাবছিলাম জিন্নতের মন্তব্য নিয়ে। ও বলেছে, ‘সাংবাদিকেরা ভিক্ষে দেয় না’। এ কথার মানে কী? আমরা কি আজব প্রাণী? সাংবাদিকেরা কি তাহলে মানুষ না? ও কী করে বলল, সাংবাদিকেরা কাউকে ভিক্ষা দেয় না!

বৃদ্ধ মহিলা চলে গেলে জিন্নতকে কথাটা জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলাম না। জিন্নত বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। শফিক বলল, ‘তাই তো, তখন কথাটা খেয়াল করি নাই। তুই সাংবাদিকদের পানিতে ডুবাইছোস। এটা কী বললি তুই?’
অমিতাভও অবাক। এবং সে এবার হা হা করে হেসে উঠল। বলল, ‘বস মনে রাখার মতো একটা কথা শুনলাম। নন্দীপুর আসা সার্থক। থ্যাংকস মাই ডিয়ার জিন্নত। তোর কারণে আমার এই বিরল অভিজ্ঞতা।’ হাসতে থাকে অমিতাভ। কিছুতেই ওর হাসি বন্ধ হচ্ছে না।
জিন্নত অসহায় বোধ করে। আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে বলি, ‘তুমি খুব ভালো কথা বলেছ। হ্যাঁ তাই তো, ও তো অপ্রিয় সত্যটি বলেছে। বন্যায় বানভাসি মানুষের দুরবস্থার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বুঝেছি, জিন্নতের কথা কতটা খাঁটি। সাংবাদিক শুনলে দুর্গতরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা সাহায্য চায়। পত্রিকায় ছবি ছাপা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তারা ত্রাণ চায়। সাহায্য চায়। তখন আমরা ভীষণ অসহায় বোধ করি। আমরা তাদের বেঁচে থাকার উপকরণ দিতে পারি না। বিষণ্ন মুখে আমরা কেবল ছোটাছুটি করিÑকী ঘটেছে জানতে। জিন্নত বলেছে নিজের মতো। কিন্তু সে যে কথাটা বলেছে, সেটা অপ্রিয় সত্যÑতা কি জিন্নত জেনেবুঝে বলেছে?
আমি জিন্নতকে ওই বৃদ্ধ মহিলার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে জিন্নত তড়বড় করে বলে, ‘ওই বুড়ি তো পুটির নানি।’
‘হায়! সে কথা আগে বলবে না?’
জিন্নত বলে, ‘খেয়াল আছিল না। বললাম, ‘যাও। ডেকে নিয়ে এসো।’ অমিতাভ বলল, ‘দরকার নাই। কী হবে তাকে দিয়া?’
বললাম, ‘কাজ আছে।’
জিন্নত হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘বুড়ির ফটো তুলবেন? আচ্ছা, ফটো ছাপলে কি টেকা পাওয়া যায়?’
বললাম, ‘সে কথা পরে শোনো। তুমি আগে মহিলাকে ডেকে নিয়ে এসো।’
জিন্নত বলল, ‘তারে ডাকা যাইব না।’
‘কেন?’
জিন্নত বলে, ‘ওরা সমাজের বাইরে। তার সাথে কথা বললে খবর আছে। তালুকদার পিটায়া পিঠের চামড়া তুইলা ফালাইবো।’
‘কিন্তু কেন?’ আমার জোরালো প্রশ্নে জিন্নত আর কিছু বলে না। আমি অমিতাভকে বললাম, ‘তুমি এসো। শফিক ভাই, আপনি যান, জিন্নতের সঙ্গে সবুরাদের বাড়িটা চিনে আসুন।’
আমি আর অমিতাভ দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে বৃদ্ধাকে ধরে ফেলি। তাকে দাঁড় করিয়ে কয়েকটি ছবি নেওয়া হয়। বৃদ্ধার বিস্ময় যেন ধরে না। সে পান খাওয়া দন্তহীন ফোকলা মুখে হাসে। সে হাসি কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টি করে না। কিন্তু ভালো লাগার আবেশ তৈরি করে।
আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের একঘরে করেছে কেন?’
বৃদ্ধ মহিলা বোধকরি আমার এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। হাঁ মুখে আমার দিকে তাকায়। তারপরই ঝরঝরে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে সে যা বলে তা শোনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তালুকদারবাড়িতে বৃদ্ধ মহিলার মেয়ে বেলি ঝিয়ের কাজ করত। শারীরিক সৌন্দযের্র কারণে তার প্রতি নজর ছিল অনেকেরই। তালুকদার তাকে বেশি বেশি আদর করত। বেলি এসে মাকে এ কথা বললে মা শঙ্কিত বোধ করে। তার সেই শঙ্কা একদিন ছায়ার মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে। মেয়ে গর্ভবতী হয়। তালুকদারের শেখানো মতো বাড়ির কামলার নাম না বলায় সালিসে তাকে দোররা মারা হয়। তিন দিন অচেতন থাকার পর পুটিকে জন্ম দিয়ে বেলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পুটির পিতৃপরিচয় নেই। ভবিষ্যতে ওর কী হবে? এই আশঙ্কায় বৃদ্ধার রাতে ঘুম হয় না। একদিন পুটিকেও ওর মায়ের মতো দোররা খেয়ে মরতে হবে।
বৃদ্ধার কান্নার মধ্যে বারবার এই আক্ষেপ ঘূর্ণিবায়ুর মতো ঘুরতে থাকে। আমরা তাকে কী বলব?
সান্ত্বনার কোনো আশ্বাস আমাদের কণ্ঠনালি ছুঁয়ে বাইরে আসে না।
আমার পুটিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। এই জীবনে তার কোনো অবলম্বন নেই। বোধকরি ওর চেয়ে অসহায় পৃথিবীতে আর কেউ নেই। যে কোনো দিন নিজের পিতৃপরিচয় বলতে পারবে না। সমাজ তাকে কোনো দিন ঠাঁই দেবে না। ও তাহলে যাবে কোথায়?
পুটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি যেন কথা হারিয়ে ফেলি। গভীর পর্যবেক্ষণে ওকে আমার শুদ্ধতম মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু সমাজের অগ্নিচক্ষু সেই স্বীকৃতি ওকে দিতে চাচ্ছে না। তিলকের মতো কলঙ্কের মোটা দাগ লেপ্টে গেছে সিঁথিতে। এ দাগ কি মুছবে কোনো দিন?
আমরা পুটির অসহায় অবস্থার জন্য নিজেদের ভেতর হাহাকার ধ্বনি শুনলেও প্রতিকারের কথা বলতে পারলাম না। জিন্নতের কথাটা যেন চূড়ান্ত সত্য। ‘তারা সামবাদিক। তারা কাউরে ভিক্ষা দেয় না।’
জিন্নত তুমি জানো না, আমাদের দেওয়ার মতো কিছু নেই। আমরা শুধু তোমাদের ওপর অন্যায়-অত্যাচারের কথা দেশের মানুষকে জানাতে পারি। এর বাইরে আমরাও যে তোমাদের মতো অসহায়, নিরাপত্তাহীন। তবু আমরা অবিচল-সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে। আমাদের কলম চিরকাল নির্যাতিতদের পক্ষে থাকবে, কেবল এই অঙ্গীকারটুকু দৃঢ়ভাবে তোমাদের কাছে আমানত রাখতে পারি। যার কখনো ব্যত্যয় হবে না।
আমার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিল ছুটতে ছুটতে আসা আমাদের স্থানীয় সঙ্গী সাংবাদিক শফিক।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘সবুরা নেই। খবর এসেছে মারা গেছে সে।’
‘সবুরা মারা গেছে!’ বাতাসের ধাক্কায় কথাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নন্দীপুরের আকাশে। চারদিক থেকে যেন প্রকৃতি একসঙ্গে মাতম করছে-সবুরা নেই। তাকে দোররা মেরে হত্যা করা হয়েছে। সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য তার জীবন স্পর্শ করার আগে ফুটন্ত ফুলটি ঝরে গেল। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কোনো কিছু তাকে নিরাপত্তা দিতে পারল না। নির্মমতা আর কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে সবুরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল। এ-ও একধরনের নীরব প্রতিবাদ। সমাজকে নিঃশব্দ চাবুক মেরে বুঝিয়ে দিয়ে গেল-ধর্মের জন্য মানুষ, মানুষের জন্য ধর্ম নয়। শফিক আবার তাড়া দিল, কী করবেন এখন? বললাম, ওখানে যেতে হবে। আমাদের অনেক কাজ। চলো।
বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পথে বেরিয়ে ধান্ধায় পড়ি আমরা। কোন পথে পুটিদের বাড়ি এসেছিলাম মনে করতে পারছি না। ছুটতে গিয়ে অমিতাভ থমকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে, আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি?

অলংকরণ: শাহরিন 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
নতুন লেখা
আগের লেখা

পোর্টফোলিও

প্রকাশিত সংখ্যা

রোদসীর পছন্দ

  • ঘরেই বানিয়ে নাও মেকআপ সেটিং স্প্রে

তুমিই রোদসী

  • আলোয় ভুবন ভরা







rodoshee logo

© স্বত্ব রোদসী ২০১৪ - ২০২১
সম্পাদক ও প্রকাশক:   সাবিনা ইয়াসমীন
৯১/এ, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা, ব্লক-এফ, রোড-৩, চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮০-২-৫৫০৪১০৪৬-৪৮, ই-মেইল: info@rodoshee.com

রোদসী

রোদসী

ক্যাটাগরি

আর্কাইভ

@2014-2018 -রোদসী. All Right Reserved.

রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
Facebook