রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
বিভাগ

বাতিঘর

.কান পেতে রইগ্রুমিংজীবনযাত্রাদিবস সবিশেষদেহ ও মনবাতিঘরবিশেষ রচনাসচেতনতাসমস্যাস্বাস্থ্য

ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়- লাইভ আলোচনা

করেছে Shaila Hasan মার্চ ৫, ২০২৩

সুরাইয়া নাজনীন:

প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালন করা হয়। ২০২২-২০২৪ সাল পর্যন্ত এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “close the care gap” অর্থাৎ‘ক্যান্সার সেবায় বৈষম্য দূর করি’। ‘ক্যান্সারমানেইমৃত্যু নয়’ এই বিষয় ধরে রোদসী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে  ফেসবুক লাইভ আলোচনা। রোদসীর সম্পাদক ও প্রকাশক সাবিনা ইয়াসমীনের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। দুজন চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম ও সহকারী অধ্যাপক ডা.তন্নিমা অধিকারী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ফার্মাসিস্ট স্বাগতা সরকার লোপা-

সাবিনা ইয়াসমীন: ক্যান্সার মানেই কি মৃত্যু? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধরে নেয়া হয় ক্যান্সার হলেই সব শেষ- এ  ধারণা নিয়ে কিছু বলুন?

রওশন আরা বেগম: ক্যান্সার হলেই যে মৃত্যু নিশ্চিত তেমনটি নয়।আর মৃত্যুর কথা তো আমরা কেউ বলতে পারিনা। দেখতে  হবে ক্যান্সারের স্টেজ কোন পর্যায়ে আছে। স্টেজ ১ হলে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে আবার ২ হলে ৭০ শতাংশ আবার স্টেজ ৩ হলে ৫০  শতাংশ। এটা আসলে নির্ভর করে রোগীর শারীরিক কন্ডিশনের ওপর। স্টেজ বেশি হলে সারভাইবাল কমে যায়।তবে মৃত্যু  অবধারিত এমনটি নয়।

সাবিনা ইয়াসমীন: ক্যান্সার হলে একজন মানুষ কীভাবে বুঝবে?

তন্নিমা অধিকারী: ক্যান্সারের কিছু লক্ষণ আছে সেগুলো দেখে আঁচ করা যেতেপারে।  যেমন কিছু কিছু ক্ষত হলে অনেক সময় সারতে চায়না, তিন-চারসপ্তাহ ধরে থাকে। আবার শরীরের কোনো কোনো জায়গায় চাকা কিংবা পিন্ডের মতো দেখা দিলে আবার তা যদি খুব দ্রুত  বেড়ে যায় তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া দরকার। অস্বাভাবিক রক্তপাতও চিন্তার বিষয় হতে পারে। যেমন প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে, মাসিকের সঙ্গে অস্বাভাবিক রক্ত গেলে, স্বামী-স্ত্রীর মেলামেশার পর রক্ত গেলে। আবার শরীরে আঁচিলের সংখ্যা বেড়ে  গেলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া দরকার। কিন্তু বলে রাখা ভালো এসব লক্ষণ দেখা দিলেই যে ক্যান্সার হয়েছে তেমনটি ভাবারও কারণ নেই। একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন কী কারণে এসব লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।

সাবিনা ইয়াসমীন: ক্যান্সারের ধরন অনুযায়ী কি এর ভয়াবহতা নির্ভর করে?

রওশন আরা বেগম: ক্যান্সারের স্টেজ ভেদে এর ভয়াবহতা নির্ভর করে। আবার চিকিৎসাও ভিন্ন হয়ে যায়। অনেক সময় শুরুর দিকে ধরা পড়েনা সেজন্য উচ্চতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। কিছু ক্যান্সার আছে কেমো সেনসিটিভ সেগুলো কেমোথেরাপি দিলে ভালো হয়ে যায়, আবার কিছু ক্যান্সারের জন্য রেডিওথেরাপি দরকার হয়।

সাবিনা ইয়াসমীন: ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কি নারী-পুরুষের কোনো প্রভাব আছে?

তন্নিমা অধিকারী:  হ্যাঁ, ব্রেস্ট, জরায়ু আর ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে নারীরা। ব্রেস্ট ক্যান্সারপুরুষেরও হয় তবে তা ১  শতাংশের মতো। প্রোস্টেড ক্যান্সার পুরুষের হয়। আমাদের দেশে অতিমাত্রায় পান-জর্দা খাওয়ার কারণে মুখের ক্যান্সার বেশি হয়। আবার ধূমপানের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার নারী-পুরুষ উভয়েরই হয়।

সাবিনা ইয়াসমীন: ক্যান্সার কিংবা বড় কোনো রোগ হলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই কিন্তু  এক্ষেত্রে একজন ফার্মাসিস্টও বড় ভুমিকা পালন করতে পারে সেটা কীভাবে?

স্বাগতা সরকার লোপা: রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যকার একটা ভুমিকা পালন করে ফার্মাসিস্টরা। অনেক সময় ক্যান্সারের  মেডিসিনে অনেক রকম পার্শ্ব ¦প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সেক্ষেত্রে ফার্মাসিস্টরা কাউন্সেলিং করে থাকেন। ওষুধের ডোজের ক্ষেত্রেও ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসকরাই প্রেসক্রাইব করে থাকেন, সেই মোতাবেক ফার্মাসিস্টরা রোগীর কাউন্সেলিংয়ের কাজটা করেন। যেমন কেমোথেরাপি বেশ ব্যয়বহুল আমরা সেক্ষেত্রে অ্যাড মিক্সিং করি।

সাবিনা ইয়াসমীন: নারীরা কোন বয়স থেকে সচেতন তার চিন্তাটা করবে?

রওশন আরা বেগম: আসলে সচেতনতার কোনো বয়স নেই। আমরা স্কুল-কলেজে গিয়েও সচেতন তার বিষয়টি নিশ্চিত করি। তারা  যেন জানতে পারে কীভাবে ব্রেস্ট চেক করতে হয়। কখনই বা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে রুটিন মাফিক নিয়ম করে ৩০ বছর  থেকেই সচেতন হওয়া খুব দরকার। বিশেষ করে মাসিক শেষ হওয়ার পর ব্রেস্ট চেক করতে হয়।তাছাড়া আর একটু নিশ্চিত হওয়ার ভায়া  টেস্ট করাটাও জরুরি।

সাবিনা ইয়াসমীন: আপনার দৃষ্টিতে আমাদের দেশের মানুষ কতটুকু সচেতন?

তন্নিমা অধিকারী: আগের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। তবে তা শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশ  তো আর শহরকেন্দ্রিক নয়। তবে একটা জিনিস জেনে রাখা ভালো দেশের প্রত্যেকটা উপজেলাতে ভায়া টেস্টের ব্যবস্থা রয়েছে।  সেটা সিস্টাররাই করতে পারেন। কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জানা এবং জানানো ভীষণ প্রয়োজন। এখানে সরকার এবং গণমাধ্যমের বেশ ভূমিকা রয়েছে।তবে আরও একটা জিনিস আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, আমাদের লাইফস্টাইলের পরিবর্তন করতে হবে।  এখন আমরা স্যানিটারি লাইফ লিড করি। যেমন – সারাদিন বসে কাজকর্ম করা,  হাঁটাচলা, ব্যায়াম খুব কম হয়,  এগুলো বাড়াতে হবে। খাওয়া-দাওয়ায় শাকসবজি সতেজ জিনিস বেশি খেতে হবে। ফাস্টফুড বাদ দিতেহবে।

সাবিনা ইয়াসমীন: অনেকেই ধারণা করেন কেমোথেরাপি দিলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়, রোগীর জন্য ধারণ করাও খুব কষ্টসাধ্য। এ বিষয়ে কিছু বলুন

স্বাগতা সরকার লোপা: আজকাল শুধু নয়, ক্যান্সারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি, সার্জারি, টার্গেটেড থেরাপিও দেয়া হয়। তবে কেমোথেরাপি দিলেই যে রোগীর খারাপ কিছু হবে তেমনটি নয়। কোন রোগীর জন্য কোন চিকিৎসা কার্যকর এটা চিকিৎসকরা সঠিকভাবেই প্রেসক্রাইব করেন। তবে ওই যে আমি আবার বলব, ক্যান্সার কোন স্টেজে ধরা পড়ল সেটার ওপরই চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে। শেষের দিকে ধরা পড়লে কেমোতেও কাজ হয় না তখন পেলিয়েটিভ ট্রিটমেন্ট দিতে হয়।

সাবিনা ইয়াসমীন:  রোদসী লাইভে ক্যান্সার বিষয়ক অনেক কথাই উঠে এসেছে। প্রত্যাশা রাখি শ্রোতা, পাঠক সবাই উপকৃত হবেন এই লাইভের মাধ্যমে। রোদসী লাইভে অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

অতিথি বৃন্দ: রোদসীকে ধন্যবাদ। সব শ্রোতা ও পাঠকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  • অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

         এমবিবিএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিএমইউ, এফসিপিএস (রেডিওথেরাপি)

         অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি বিভাগ।

          জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।

  • ডা তন্নিমা অধিকারী

         এফসিপিএস (রেডিওথেরাপি)

         সহকারী অধ্যাপক

         রেডিওথেরাপি বিভাগ

          ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

  • স্বাগতা সরকার লোপা

          ডেপুটি ম্যানেজার

          ফার্মেসি

          এভার কেয়ার হসপিটাল, ঢাকা।  

 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
আইনআমরা গড়িজীবনযাত্রাবাতিঘরবাংলাদেশ ও বিশ্ববিশেষ রচনাসাফল্য

স্বীকৃতি পেল মায়ের একক অভিভাবকত্ব

করেছে Shaila Hasan জানুয়ারী ২৫, ২০২৩

শায়লা জাহানঃ

“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী, পুরুষের তরবারি

প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়লক্ষ্মী নারী”।

প্রাগৈতিহাসিক কাল ধরেই নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সভ্যতার উন্মেষ। নারীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, তাদের অবদান সব কিছু নিয়েই সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য রচনার। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সমাজের মানদণ্ডে প্রাপ্য স্বীকৃতির ক্ষেত্রে নারীরা কী আসলেই মূল্যায়িত না এগুলো সবই ফাঁকা বুলি সেটাই মূখ্য বিষয়।

নারীর পরিচয় কি? বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে ছাড়া কি আসলেই তার আর কোন পরিচয় নেই? ভূললে চলবেনা এই নারীর মাঝেই বাস করে এক স্নেহময়ী মায়ের জাত, একটি জাতির ভবিষ্যৎ সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে লালন-পালনের মাধ্যমে তাঁকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে মায়ের অবদান কোন অংশে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শুধু তাই নয় দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক এমন অনেক পিতার অবর্তমানেও নিজের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তানের একক অভিভাবক হিসেবে যোগ্যতার সাথে মায়ের ভূমিকা পালনের অনেক নিদর্শনও রয়েছে। মায়ের অভিভাবকত্বের এই যাত্রা শুরু হয় মূলত সন্তানকে গর্ভ ধারণের পর থেকেই। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের পিতা-মাতার উভয়ের সম-মর্যাদা থাকলেও কিন্তু এতো কিছুর পরেও শিক্ষা ও চাকরি জীবনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাবার পরিচয়ই যেন মূখ্য হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা হয় উপেক্ষিত। কিন্তু আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সব ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবকের নামের জায়গায় বাবার নাম ছাড়াও আইনগতভাবে শুধুমাত্র মায়ের নাম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত মঙ্গলবার ( ২৪ জানুয়ারি) বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মোঃ খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ যুগান্তকারী রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম, অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার লিপি ও অ্যাডভোকেট আয়েশা আক্তার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিত দাশগুপ্ত।

ঐতিহাসিক এই রায়ের পথ কিন্তু এতো সুগম ছিলোনা। এর পেছনের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের যেতে হবে পনের বছর পিছনে। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০০৭ সালে এপ্রিল মাসে বিভিন্ন সংবাদপত্রে “বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের পড়ালেখা” শীর্ষক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে। প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফরমে তথ্য পূরণের ক্ষেত্রে বাবার নাম পূরণ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের এক তরুনী। এর ফলশ্রুতিতে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড সে তরুনীকে প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্লেখ্য যে, মা ও সন্তানকে কোনরুপ স্বীকৃতি না দিয়ে দায়িত্বহীন বাবার চলে যাওয়ার পর ওই তরুনী তার মায়ের একক ছত্রচ্ছায়ায় বড় হয়ে উঠে। পরবর্তিতে এই ঘটনার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করে মায়ের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার দাবীতে, শুধু মায়ের নাম ব্যবহার করলে পরীক্ষার ফরম অপূর্ণ বিবেচিত হবে কেন; তা জানতে চেয়ে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট রিট দায়ের করে। ওই রিটের প্রেক্ষিতে আদালত তখন রুল জারি করেছিলেন। একই সঙ্গে বর্তমানে কোন কোন শিক্ষাবোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বাবা-মা উভয়ের নাম সম্পর্কিত তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করতে হয়, তার একটি তালিকা এবং যেসব যোগ্য শিক্ষার্থী তাদের বাবার পরিচয় উল্লেখ করতে অপরাগ তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে সম্পর্কে প্রতিবেদিন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়। ২০২১ সালের ৬ জুন মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্ট আবেদনকারীদের পক্ষে একটি সম্পূরক হলফনামা আবেদন আকারে দাখিল করে। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সকালে হাইকোর্ট রায় ঘোষনার জন্য এইদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি ধার্য করেন।

কালজয়ী এই রায়ের ফলে এখন থেকে বাবার নামের পাশাপাশি আরও দুটি অপশন যুক্ত হলো। এতে করে কেউ চাইলে বাবার পরিচয় ব্যবহার না করেও ফরম পূরনের সময় মা কিংবা আইনগতভাবে বৈধ অভিভাবকের নাম লিখতে পারবেন। এ যেন মায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা লাভে এক বড় ধরনের সাফল্য সংযোজিত হলো।

-ছবি সংগৃহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
এই সংখ্যায়প্রধান রচনাবাতিঘরশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

ছোটবেলায় ঈদে সালামি ছিল না, আনন্দ ছিল

করেছে Suraiya Naznin এপ্রিল ১৮, ২০২২

আনিসুল হক:

আমার ছোটবেলা কেটেছে রংপুরে। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭১ সালে, বগুড়ার সোনাতলা পিটিআইতে। মার্চ মাসে মিছিলে যেতাম, স্লোগান দিতাম, ‘ভুট্টোর পেটে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ একটা বাঁশঝাড়ে গিয়ে বাঁশ কেটে এনে ছোট্ট লাঠি কতগুলো বানিয়েছিলাম আমরা, আমাদের ভাইবোনেরা। তারপর তো শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। আমরা এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। যুদ্ধের মধ্যেও ঈদ এসেছিল। সেই ঈদের কিছুই মনে নেই, শুধু একটা কথা ভাসা-ভাসা মনে পড়ছে, ঈদের চাঁদ দেখা না দেখা নিয়ে তর্ক উঠেছিল। গ্রামের মানুষ রেডিওর কথা বিশ্বাস না করে নিজের চোখে চাঁদ দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

১৯৭২ সালে আমরা রংপুরে চলে আসি। সেবারের ঈদের কথা আমার মনে পড়ে। স্কুলের দেয়ালে বোমার শেল আটকে ছিল। সেই অংশটা আমরা বের করে এনেছিলাম। তারপর মাঠের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে সেই গোলার অংশটা রাখা হলো। প্রচ- শব্দে বিস্ফোরণ হলো। আজ ভাবলেও আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী ভীষণ বিপদই না সেদিন হতে পারত।

আমাদের এক বন্ধু, রংপুর জিলা স্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়েছি, তার নাম দীপু। তিনি এ রকম একটা গোলাকার চাকা পেয়েছিলেন, সেটা দিয়ে গাড়ি বানানোর জন্য মাঝখানে পেরেক পুঁততে গেলে হাতুড়িতে বাড়ি দিয়েছিলেন। সেটা বিস্ফোরিত হয়, তার হাতের কটা আঙুল আর একটা চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ছিল আমাদের ছোটবেলার পরিস্থিতি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ। আরেকটা গল্প বলে ঈদের সালামির প্রসঙ্গে আসি।

১৯৭৯ সাল। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। আমি ফার্স্ট হলাম। সেদিন ছিল ছুটির দিন। আমার প্যান্টটা তাই ধুতে দেওয়া হয়েছে। আমি লুঙ্গি পরে পিটিআইয়ের মাঠে খেলছিলাম। রংপুর জিলা স্কুলের হেড স্যার একজন পিয়ন আংকেলকে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাকে ধরে আনার জন্য। সাইকেলে করে পিয়ন আংকেল এলেন। আমি তখনো মাঠে খেলছি। তিনি বললেন, ‘সাইকেলে ওঠেন। হেড স্যার ডাকে।’
আমি বললাম, আমি লুঙ্গি পরে আছি। আমার প্যান্ট ধুতে দেওয়া হয়েছে। লুঙ্গি পরে আমি স্কুলে যেতে পারব না।

পিয়ন আংকেল বললেন, ‘স্যারের অর্ডার, আনিসুলকে ধরে আনো। আমি আপনাকে ধরে নিয়ে যাবই।’

অগত্যা লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই আমি স্কুলে হেড স্যারের রুমে গেলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘তুমি বৃত্তিতে ফার্স্ট হয়েছ। তোমাকে আমি দোয়া করি। তোমাকে প্রেসিডেন্ট ডেকে পাঠিয়েছেন। দোয়া করি, আজ তোমাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডেকে পাঠিয়েছেন, একদিন যেন তোমাকে পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট ডেকে পাঠান।’

আমি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। প্যান্টটা পরে বঙ্গভবনে যেতে হবে। কাজেই আমি পায়জামার ওপরে শার্ট পরে ঢাকা শহরে এলাম।

মানে ক্লাস নাইনে আমার প্যান্ট ছিল মাত্র একটা। পরে বৃত্তির টাকা পেয়ে আরেকটা প্যান্ট আমি তৈরি করাতে পেরেছিলাম।

তার মানে এই নয় যে আমরা গরিব ছিলাম। তার মানে এই যে তখন সারা দেশের জেলা শহরগুলোর মধ্যবিত্তের সবারই এই রকমই ছিল জীবনযাপনের মান। আমাদের কোনো অভাববোধ ছিল না। কিš‘ প্রাচুর্য বলতে কিছুই ছিল না। একেবারে রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলার মতো। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন :

‘জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো। গাড়িঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই হয়। বাইরে কোণের দিকে তেঁতুলগাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পাল্কিগাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে। যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানের বরাদ্দ হল পাউরুটি আর কলাপাতামোড়া মাখন, মনে হল আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়োমানুষির ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল।’

রবীন্দ্রনাথ জমিদারের ছেলে ছিলেন। তাঁর ছোটবেলার জীবনেই বাহুল্য বলতে কিছু ছিল না। আমরা জমিদারের ছেলে ছিলাম না। আব্বা ছিলেন পিটিআইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট। সরকারি চাকরি। আমরা নিজেরা বাগান করতাম, কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি নিজেদের বাগানে হতো। বাড়িতে গরু ছিল। তিন সের দুধ দিত দুটো গরু। গোটা কুড়ি মুরগি, গোটা ছয়েক হাঁস ছিল। ডিম আসত দেদার। সেসব খেয়ে আমাদের দিন যেত ভালোমতোই। তবে একটা নাবিস্কো পাইন অ্যাপেল ক্রিমের বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে কোনো অতিথি বাসায় এলে সেই বিস্কুট খাওয়া ছিল মহাভোজ।

কাজেই আমাদের ছোটবেলায় ঈদে কেউ আমাদের সালামি দিত না। আমরাও কাউকে কদমবুসি করতাম না। মুন্সিপাড়ায় ছিল আমাদের মামাবাড়ি। ওখানে গিয়ে দেখি মামাতো ভাইবোনেরা বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে এবং বড়রা তাদের সিকিটা আধুলিটা দেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা সিকি আধুলি কী বুঝবে কি না, আমার সন্দেহ আছে। ১০ পয়সায় একটা লাল রঙের আইসক্রিম পাওয়া যেত। চার আনা বা সিকিতে পাওয়া যেত মালাই আইসক্রিম। ১০ পয়সা দিয়ে জোড়া পাপড় কিনে খেতে পারতাম। রাস্তার ফেরিওয়ালার কাছ থেকে তিলের খাজা বা শনপাপড়ি কিনে খেতে আট আনা বা আধুলির দরকার পড়ত।

প্রত্যেক ঈদে তাই নতুন জামা পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কোনো ঈদে হয়তো শার্ট পেলাম। পরের ঈদে আর কিছু না। তারপরের ঈদে বাটার স্যান্ডেল শু। তার পরের বছর একটা প্যান্ট।

তবে আমাদের পায়জামা-পাঞ্জাবি ছিল। ঈদের আগে সেসব বের করে ধুয়ে মাড় দেওয়া হতো। আমাদের কাজ ছিল সেসব ইস্ত্রি করে রাখা। ইস্ত্রি ছিল দুই ধরনের। একটা শক্ত লোহার ইস্ত্রি। সেটা চুলার আগুনে ধরে গরম করতে হতো। আরেকটা ইস্ত্রির ছিল গহ্বর ভরা পেট। সেই পেটে কাঠের কয়লা ভরতে হতো। এরপর আগুন উসকে দেওয়ার জন্য হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম। বাঁশের চোঙ দিয়ে ফুঁ দিতাম। এই পায়জামা-পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করাটা ছিল বিশাল আনন্দের কাজ। তারপর স্যান্ডেল বা জুতা কালি করা। নিজেদের জুতা স্যান্ডেল নিজেরাই বুরুশ করতাম। তারপর সেগুলো রোদে মেলে ধরতে হতো।

আমাদের বাসায় সেমাই বানানোর মেশিন ছিল। সেটা দেখতে ছোটখাটো টিউবওয়েলের মতো। এক দিক দিয়ে পানি মেশানো আটার ছোট ছোট গুলি ভরে ওপরের হাতল ঘোরাতে হতো। নিচে ছিল ফুটো ফুটো পাত। সেটা দিয়ে সেমাই বের হতো। সেই সেমাই আমরা শুকাতে দিতাম মাদুরে। ছাদের ওপরে সেমাই শুকাতে দিয়ে পাখি তাড়ানোর জন্য বিশাল পাটকাঠি নিয়ে আমি বসে থাকতাম। সময়টা উপভোগ্য করে তোলার জন্য একটা কাগজের চোঙ বাঁশের লাঠির ডগায় বেঁধে মাইক হিসেবে চালাতাম। একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স হতো আমার মাউথপিস। সেই মাউথপিস মুখের কাছে ধরে আমি নিজে নিজে রেডিওর অনুষ্ঠান প্রচার করতাম। কবিতা আবৃত্তিই ছিল প্রধান অনুষ্ঠান। কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি কবিতাগুলো বই দেখে পাতার পর পাতা আবৃত্তি করতাম। তাতে রোজা থাকার কষ্ট কমত। দিনটা পার হয়ে যেত দ্রুত।

ঈদ মানেই ছিল আনন্দ। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল তিনটা থেকে আমরা পিটিআইয়ের ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সূর্য ডোবার আগেই চাঁদ দেখা গেল। কী আনন্দ! ছেলেরা মিছিল বের করত, আজ আমাদের কিসের খুশি, ঈদের খুশি ঈদের খুশি। ১৯৭৮ সালের আগে রংপুরে টিভি ছিল না। সম্প্রচার কেন্দ্র হলো ১৯৭৮-এ। তারপর সাদাকালো টিভি রংপুরে আসতে লাগল। কাজেই তার আগে ঈদের আগের রাতে রেডিওতেই আমরা শুনতাম সেই গানটা, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ এমনকি আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত জব্বর আলীর ঈদের নাটক প্রথমে প্রচারিত হয়েছিল রেডিওতে। তার একটা সংলাপ আজও মনে আছে, জব্বর আলীর মেয়ে বলছে, ‘বাবা, ঈদে আমাকে ম্যাক্সি কিনে দিতে হবে।’ জব্বর আলী বলছে, ‘ট্যাক্সি, আমি তোকে ট্যাক্সি কিনে দিতে পারব না।’

আমরা অবশ্যই ঈদসংখ্যা কিনতাম। বিচিত্রা, রোববার, সন্ধানী। উপন্যাসগুলোর কোনো কোনোটাতে যৌনতা থাকত। এমনকি হাসান আজিজুল হকের লেখা ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পে ‘রাত্রে স্ত্রী সহবাসে সে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিল’ এই বাক্য পড়ে আমি নিষিদ্ধ জিনিস পড়ার আনন্দ লাভ করেছিলাম। যৌনতা থাকত আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীনের গল্পে। আমাদের শৈশবে ঈদের আরেকটা বিনোদন ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। প্রচন্ড ভিড় হতো। ওই সময় সৈনিকদের জন্য আলাদা কাউন্টার ছিল। আমি সেই কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কোনো সৈনিক আংকেল টিকিট কাটতে এলে আমি তাঁকে অনুরোধ করতাম, আমাকে একটা টিকিট কেটে দেবেন? আমার চেহারার মধ্যে একটা গো বেচারি ভাব তখনো ছিল। সহজেই তাঁরা রাজি হতেন। আমি নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ঈদের সিনেমা দেখতাম রংপুরের লক্ষ্মী টকিজে বা ওরিয়েন্টাল প্রেক্ষাগৃহে। আগের দুদিন মাইকিং করে সিনেমার গান আর নাম জানিয়ে যাওয়া হতো। কাজেই সিনেমা না দেখে পারা যায়?

এরপর এল টেলিভিশনের যুগ। ঈদ মানেই টেলিভিশনে ঈদের নাটক আর আনন্দমেলা। আনন্দমেলাগুলো খুব আনন্দময় হতো। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, জুয়েল আইচ, আফজাল হোসেন, আনিসুল হকÑ এঁরা সব আশ্চর্য আনন্দময় আনন্দমেলা করেছিলেন। পরে করেছিলেন হানিফ সংকেত। ঈদের নাটক ভালো করতেন হুমায়ূন আহমেদ। উফ। ঈদের নাটকগুলো দেখে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যেত।

তারপর বড় হয়ে গেলাম। আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমাকে ঈদে সালাম করতে লাগল। আমিও সাধ্যমতো তাদের বকশিশ দিতে শুরু করলাম। বিয়ের পরে খালু হলাম। ভাগনে-ভাগ্নিরা এলে আমি সালামি দিই। সে তারা সালাম করুক আর না করুক। ইদানীং তো অনেক নতুন নিয়মকানুন শোনা যাচ্ছে। কদমবুসি করতে হয় না। আমার আম্মা অবশ্য আমাকে শিখিয়েছিলেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার সময় মাথা উঁচু রাখতে হবে।

বড় হয়েই আমি আম্মাকে সালাম করতাম। শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করতাম। আম্মা মারা গেছেন। শ্বশুর সাহেবও মারা গেছেন বেশ ক’বছর আগে। এখন শাশুড়িকে সালাম করি। অফিসেও আমার জুনিয়র সহকর্মী মেয়েরা আগে আমার কাছ থেকে ঈদের সালামি আদায় করত। তার ছবিও ফেসবুকে দিত। এখন আমাদের অফিসও বড় হয়ে গেছে। আমরা এখন দূরে দূরে বসি। সালাম করে সালামি আদায় করবে, এমন মানুষেরা আর আমার ফ্লোরে বসেও না।

নিজের একমাত্র মেয়ে থাকে বিদেশে। ঈদে আসবে না। হয়তো ফোন করবে। ভিডিও কলে দেখা হবে। কথা হবে।

আমরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে যাচ্ছি। আগে আম্মা যখন বেঁচে ছিলেন এবং রংপুরে ছিলেন, আমরা পাঁচ ভাইবোন দারা পুত্র পরিবার নিয়ে রংপুর যেতাম। বাড়িতে চাঁদের হাট যেন লেগে যেত। সন্ধ্যার সময় বাচ্চারা নিজেরাই আনন্দমেলা করত। এখন আম্মাই নাই। রংপুরে কেউ থাকে না।

ঈদ আসলে ছোটবেলাতেই আনন্দের ছিল। এখন বড় হয়ে গেছি। এখন ঈদে আনন্দর চেয়ে দায়িত্বই বোধ করি বেশি। আর করোনার দুই বছরে তো ঈদেও আমরা বন্দী ছিলাম।
এবারের ঈদ হয়তো মুক্তি এনে দেবে।
করোনার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি।

মধ্যখানে কিছুদিন আমারও ঈদ মানে ছিল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য ঈদের নাটক লেখা। প্রথম দিকে সেই সব নাটক ভালো হলো নাকি মন্দ হলো, তাই নিয়ে টেনশন করতাম। তারপর এত চ্যানেল আর এত নাটক প্রচারিত হতে লাগল যে নিজের নাটকও নিজে দেখা হয়ে উঠত না। এখন আর ঈদের নাটক লেখার সময় পাই না। আগ্রহও পাই না।

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা দিয়ে এই লেখা শেষ করি, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ/ তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ।’
আমরা যদি ঠিকভাবে জাকাত দিই, দেশে কোনো দারিদ্র্য থাকার কথা নয়। বিলাসব্যসনের প্রতিযোগিতা না করে আমরা কি সুচিন্তিতভাবে গরিব-আত্মীয়স্বজনকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতা করতে পারি না?

 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
প্রযুক্তিবাতিঘরবাংলাদেশ ও বিশ্ববিশেষ রচনা

ডিজিটাল এডুকেশন : চাকরিই খুঁজবে তোমাকে

করেছে Suraiya Naznin জুলাই ১১, ২০২১

ড. মো. আকতারুজ্জামান

কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে কিছু সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত করেছে। পৃথিবীর প্রায় সব সেক্টরই কমবেশি এ মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত, শিক্ষাক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। সারা জীবন যে শিক্ষকেরা প্রচলিত টিচিং-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত, তাদের পক্ষে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া ব্লেন্ডেড, অনলাইন বা ডিজিটাল এডুকেশনে ক্লাস নেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করা সহজ নয়। বিগত এক বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তাকে জীবন-জীবিকার তাগিদে বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজতে হয়েছে, সেটা নার্সারি, প্রাথমিক বা উ”চশিক্ষা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অনেকে বিকল্প রোজগারের পথ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর দীর্ঘদিন ক্লাস ও পরীক্ষা না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হতাশা এবং বিপথে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমরা ডিজিটালি অনেক দূর এগিয়েছি সত্যি, কিন্তু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো ডিজিটাল এডুকেশনের প্রয়োগ যেমনটি হওয়া উচিত ছিল, তা দেখতে পাইনি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং মেথডের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে।

 

প্রথমেই আমরা ফেস-টু-ফেস, অনলাইন, ব্লেন্ডেড, ডিজিটাল এবং এই সম্পর্কিত বিষয়গুলো একটু পরিষ্কারভাবে জেনে নিই। প্রচলিত পদ্ধতিতে আমরা যেভাবে সরাসরি ক্লাসরুমে পাঠদান করায় সেটিকে ফেস-টু-ফেস এডুকেশন বলি, যেমন ক্লাসরুমে সরাসরি গিয়ে আমরা যে লেকচার দিই। ইন্টারনেটভিত্তিক যেকোনো পাঠদান পদ্ধতিকে অনলাইন এডুকেশন বলতে পারি, যেমন জুম বা গুগল মিটের মাধ্যমে আমরা যে ক্লাস নিয়ে থাকি।

আর ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন এডুকেশনের সংমিশ্রণকে আমরা ব্লেন্ডেড এডুকেশন বলতে পারি, যেমন সপ্তাহের পাঁচ দিনের ক্লাস শিডিউলের মধ্যে তিন দিন সরাসরি ক্লাসরুমে এবং দুই দিন অনলাইনে পাঠদান করলে সেটা ব্লেন্ডেড এডুকেশন। তবে যেকোনো ধরনের পাঠদান পদ্ধতিকে আমরা ডিজিটাল এডুকেশন বলতে পারি যদি সেটা ডিজিটাল প্রযুক্তি বা আইসিটির সাহায্যে পরিচালিত হয়, যেমন মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির মাধ্যমে সরাসরি কোনো ক্লাস নিলে সেটা ডিজিটাল এডুকেশন। আর ব্লেন্ডেড বা অনলাইন এডুকেশন যেহেতু ডিজিটাল টেকনোলজি ছাড়া সম্ভব নয়, তাই উভয় পদ্ধতিই ডিজিটাল এডুকেশনের মধ্যে পড়ে।

বর্তমানে নতুন একটি কনসেপ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে ফিজিটাল এডুকেশন যা ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল এডুকেশনের একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। এটি ব্লেন্ডেড এডুকেশন থেকে কিছুটা ভিন্ন, কারণ ব্লেন্ডেড পদ্ধতিতে ফেস-টু-ফেস এবং অনলাইন দুটিই পাশাপাশি চলে আর ফিজিটাল পদ্ধতিতে ফেস-টু-ফেস (ফিজিক্যাল) এবং অনলাইন (ডিজিটাল) দুটো পদ্ধতির সেরা প্র্যাকটিসগুলো ইন্টিগ্রেট করে পাঠদান করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রোবোটিকস ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের রোবটের সঙ্গে ইন্টারাকশন, একটি ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ ছাত্রছাত্রী সরাসরি এবং দুই-তৃতীয়াংশ অনলাইনে একই সময়ে ক্লাস করা এ ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট এনগেজমেন্ট এবং লার্নিং আউটকাম তুলনামূলক ভালো হয়। এডুকেশন ৪.০ এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ফিজিটাল এডুকেশনই হবে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা।

ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা ফিজিটাল লার্নিং অ্যাট এডুকেশন ৪.০
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল এডুকেশনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়াটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দেশ-বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অনলাইন এবং ব্লেন্ডেড এডুকেশন নিয়ে সর্বমোট এক যুগের বেশি সময় ধরে কাজ করছি আমি।

এই সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমার মনে হয়েছে, দুর্বল গতির ইন্টারনেট, আর্থসামাজিক অবস্থা নিরিখে ডিভাইস ও উচ্চ মূল্যের ইন্টারনেট ইস্যু, শিক্ষকদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধিতে অনীহা, ডিজিটাল এডুকেশন সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা এবং সর্বোপরি একটি সমষ্টিক ও গ্রহণযোগ্য ডিজিটাল এডুকেশন পলিসির অভাব এ দেশের সব স্তরে ডিজিটাল এডুকেশন বাস্তবায়ন ও প্রসারের সবচেয়ে বড় বাধা। রাতারাতি এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়, তবে কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে এবং আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারলে সহসাই এ পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে।

ব্লেন্ডেড, অনলাইন বা ডিজিটাল এডুকেশন নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি ইউনিভার্সিটিতে একটি করে কেন্দ্রীয়ভাবে ম্যানেজড এবং কাস্টমাইজড লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) যেমন মুডল, ক্যানভাস, ব্ল্যাকবোর্ড বা ন্যূনতম গুগল ক্লাসরুমের যেকোনো একটি অবশ্যই থাকা উচিত। এ ছাড়া সব একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্মার্ট-এডুকেশন টাইপের প্ল্যাটফর্ম খুবই জরুরি। শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যাতে নিয়মিতভাবে এ প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করতে হবে।

আধুনিক এলএমএসের সঙ্গে ওয়েব কনফারেন্সিং সিস্টেম, লার্নিং অ্যানালিটিকস, ভিডিও এনগেজমেন্ট, ইন্টার‌্যাক্টিভ কনটেন্ট এবং মোবাইল এপ্লিকেশন যুক্ত থাকে, ফলে শিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আসে। ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি প্র্যাকটিসের দূরত্ব নিরসনে এবং শিক্ষকদের নৈতিক মূল্যবোধ ও প্রফেশনালিজম তৈরিতে। এ ক্ষেত্রে ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্স (মুক) খুবই উপযোগী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।

বিখ্যাত মুক প্রভাইডারগুলো যেমন এডেক্স, কোর্সেরা, উডাসিটি, ইউডেমির আদলে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় কোর্স ডিজাইন করা যেতে পারে। এর ফলে টিচিং-লার্নিং আরও উন্নত এবং ইমপ্যাক্টফুল হয়।
ডিজিটাল এডুকেশনে কোলাবরেশন এবং স্টুডেন্টদের এনগেজমেন্টের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এ জন্য খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফ্লিপড ক্লাসরুম পেডাগজি অনুসরণ করে ক্লাস শুরুর আগেই লেকচার নোট, অডিও-ভিজ্যুয়াল ম্যাটেরিয়ালস কেন্দ্রীয় এলএমএসে সরবরাহ করে, ফলে ক্লাসের সময়টা ডিসকাশন, প্রশ্নোত্তরপর্ব, ড্রিল-প্র্যাকটিস, বিষয়ভিত্তিক অধিকতর আলোচনার জন্য ব্যবহার করা যায়। লাইভ ক্লাসে গুগল ওয়ার্কস্পেস ফর এডুকেশন ফ্রি প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সব ফিচার ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন অনলাইনে স্ক্রিন শেয়ারের মাধ্যমে রেগুলার ক্লাসের মতো জ্যামবোর্ডে লেখা, ড্রয়িং করা, প্রেজেন্টেশনের স্লাইডে হাইলাইট করা, ফলে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয়। প্রতিটি লেকচার রেকর্ড করে ক্লাস শেষে ভিডিও এনগেজমেন্ট কুইজের মাধ্যমে সেটি শিক্ষার্থীদের কাছে এলএমএসে সরবরাহ করা যেতে পারে, যা পরে ভিডিও অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে গ্রেডিং করা যায়।

এ ছাড়া অরিজিনালিটি চেকিং, স্মার্ট অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম, গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট, ডিসকাশন ফোরাম, কুইজ, ক্রিয়েটিভ রাইটিং ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের সঠিক মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক এবং শিক্ষকদের জবাবদিহি এই দুটি বিষয় সামনে রেখে ডিজিটাল এডুকেশন পরিচালনা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক পিরিয়ডিক্যালি অ্যানালাইসিস করে সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়মিত পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষকদের প্রতি মাসে ন্যূনতম কয়েকটি বিষয়ের ওপর রিপোর্টিং এবং একটি সামগ্রিক ভিডিও প্রেজেন্টেশন জমা নেওয়া যেতে পারে স্মার্ট-এডুকেশনের মতো প্ল্যাটফর্মে, যেগুলোর মধ্যে থাকবে স্টুডেন্ট ফিডব্যাক, রিসার্চ অ্যাক্টিভিটি, সেলফ ডেভেলপমেন্ট, কন্ট্রিবিউশন ও ভ্যালু এডিশন, অ্যাটেনডেন্স, টিচার ও স্টুডেন্ট অ্যাকটিভিটি কমপ্লিশন লগ, মাসিক টাইমশিট এবং প্রেজেন্টেশন। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের মাসিক মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। ইউনিভার্সিটিগুলো নিয়মিতভাবে এসব কাজ তদারক করলে কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করা সহজ হবে।

দেশের কয়েকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ডিজিটাল এডুকেশন সেক্টরে ভালো করছে যেমন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এর মধ্যে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিকে ব্লেন্ডেড, অনলাইন এবং ডিজিটাল এডুকেশনে বাংলাদেশের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ধরা হয়। ২০১৩ সালে ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল এডুকেশন শুরু করেছিল ড্যাফোডিল। বর্তমানে নিজস্ব এলএমএস, মূক প্ল্যাটফর্ম এবং স্মার্ট-এডু সিস্টেমসহ অসংখ্য সল্যুলশন নিয়ে টিচিং-লার্নিং পরিচালনা করছে শীর্ষ এ প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ কর্মসূচির অধীনে ৩০ হাজারের অধিক ল্যাপটপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি ক্যানভাস এলএমএস এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এডেক্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির মধ্যে বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, শাহজালাল ইউনিভার্সিটিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান করোনা মহামারির শুরু থেকে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম পরিচালনা করে আসছে।
অনলাইন এডুকেশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি। আমাদের দেশে মোট মার্কের বেশির ভাগ (৭০-৮০%) বরাদ্দ থাকে সেমিস্টার ফাইনাল/মিড টার্ম পরীক্ষায়, যা আধুনিক অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে মোটেও মানানসই নয়। অন্যদিকে অনলাইনে প্রক্টরড এক্সামের সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। এ ক্ষেত্রে মিক্সড পদ্ধতি কার্যকরী হতে পারে।

৬০-৭০ শতাংশ মার্ক অনলাইনে অথেনটিক এসেসমেন্টের মাধ্যমে হতে পারে, যেমন ধরো ক্রিয়েটিভ অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, কেস স্টাডিজ, প্রেজেন্টেশন, প্রজেক্ট ডেভলপমেন্ট ইত্যাদি। আর বাকি ৩০-৪০ শতাংশ মার্কের জন্য ট্রাডিশনাল এক্সাম পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওপেন ও ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নিয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার মান ভালো হবে, অন্যদিকে দেশব্যাপী তাদের বিশাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাজে লাগিয়ে সত্যিকারের ব্লেন্ডেড অনলাইন এডুকেশন, বিশেষ করে অ্যাসেসমেন্ট, কাউন্সেলিং, ভিডিও স্ট্রিমিং সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

অনলাইন এডুকেশনের নিজস্ব কোনো সমস্যা নেই, যে প্রতিষ্ঠান এটি পরিচালনা করবে তার গ্রহণযোগ্যতা এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাতারাতি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন এডুকেশন যাওয়া ঠিক নয়, ধীরে ধীরে ছাত্র-শিক্ষক-স্টাফদের এর জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থিতিশীল এলএমএস প্ল্যাটফর্ম এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল থাকা অত্যাবশ্যকীয়। দেশে প্রতিবছর যত শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পাস করে, তাদের সবার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন কার্যকরী শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে অনলাইন ডিজিটাল এডুকেশনের বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল এডুকেশন বাস্তবায়নে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালা নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন ডিজিটাল এডুকেশন প্ল্যাটফর্মগুলো অ্যাকসেস করতে নামমাত্র মূল্যে শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া, লাইব্রেরি থেকে ডিভাইস লোন হিসেবে দেওয়া, শিক্ষকদের প্রমোশনে অনলাইন ট্রেনিং সার্টিফিকেশন অন্তর্ভুক্ত করা, সক্ষমতা অনুসারে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাথমিকভাবে কিছু কোর্স অনলাইনে পরিচালনা করতে অনুমতি দেওয়া, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্সটাকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি।

বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র দুটি ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি এবং বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি-অনলাইন এডুকেশন দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন আছে। যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার কর্মসূচি, তাই ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির মতো যারা অনেক বছর ধরে ডিজিটাল এডুকেশনে সাফল্য দেখিয়ে আসছে, তাদের শর্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় অনুমতি দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। চলো সবার জন্য ডিজিটাল এবং কার্যকরী এডুকেশন নিশ্চিত করি, তখন তোমাকে আর চাকরি খুঁজতে হবে না, চাকরিই তোমাকে খুঁজবে।

 

ড. মো. আকতারুজ্জামান
ডিজিটাল এডুকেশন এক্সপার্ট এবং পরিচালক, ব্লেন্ডেড লার্নিং সেন্টার
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল স্মার্ট সিটি, আশুলিয়া, ঢাকা
প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান, আইসিটি ও শিক্ষা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
বাতিঘর

স্বর্ণকুমারী দেবী: বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী প্রতিনিধি

করেছে Rodoshee মে ৭, ২০১৭

স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক। তিনিই ছিলেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী সাহিত্যিক। ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তাঁর ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক। স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৫৫ সালের ২৮ আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতনি ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ মেয়ে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন স্বর্ণকুমারী।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তাঁদের শিক্ষয়ত্রী শ্লেটে কিছু লিখে দিতেন, সেই লেখাটিই তাঁরা টুকে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ এ কথা জানতে পেরেই এই যান্ত্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতিটি তুলে দেন। পরিবর্তে তিনি অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করেন। ১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিয়ে হয়। জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালী থাকভুক্ত ব্রাহ্মণ। পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিয়ে করার জন্য জানকীনাথকে পরিবারচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব এক জমিদারি গড়ে তুলে ‘রাজা’ উপাধি অর্জন করেন।
সঙ্গীত, নাটক ও সাহিত্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুরুষ সদস্যদের সৃষ্টিশীলতা স্বর্ণকুমারী দেবীকেও স্পর্শ করেছিল। এই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তিন ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। তাকে সাহায্য করছিলেন অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি থেকে জানা যায়, জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় এসে থাকতে শুরু করেন। এই সময় তিনিও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে ওঠেন।
১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস ‘ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত’ প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে স্বর্ণকুমারী ছিলেন প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক। ‘দীপনির্বাণ’ ছিল জাতীয়তাবাদী উপন্যাস। এর পর তিনি একাধিক উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) ‘বসন্ত উৎসব’ রচনা করেন। পরবর্তীকালে এ ধারা অনুসরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পারিবারিক পত্রিকা ‘ভারতী’ চালু করেন। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। এর পর ১১ বছর ওই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করতে কঠোর পরিশ্রম করেন। সমালোচকরা এই পত্রিকার উচ্চ প্রশংসা করেন। পরে বিভিন্ন মেয়াদে স্বর্ণকুমারী পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। ভারতী যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ষোলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। আসলে এই পত্রিকার চাহিদাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়মিত লিখতে বাধ্য করত এবং বহু বছর তিনি এক নাগাড়ে এই পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠিয়ে এসেছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে প-িত রামাবাই, রামাবাই রানাডে ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নেন। তিনিই ছিলেন প্রথম নারী যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৯৬ সালে ঠাকুরবাড়ির অন্য সদস্যদের নিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখীসমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের দেশজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করা। ওই মেলা কলকাতার সমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল। তারপর হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রয় এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি বিধবা আশ্রম চালু করেন। এই আশ্রমের নাম ছিল ‘মহিলা বিধবা আশ্রম’। হিরন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমটিরই নতুন নামকরণ হয় ‘হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম’। মহিলা বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যনির্বাহী সমিতিতে ছিলেন স্বর্ণকুমারী, ময়ূূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবী, কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী, লেডি হ্যামিলটন, প্রিয়ংবদা দেবী, শ্রীমতী চ্যাপম্যান ও শ্রীমতী সিংহ। হিরন্ময়ী দেবী ছিলেন আশ্রমের সচিব। হিরন্ময়ী দেবীর কন্যা তথা আশ্রমের পরিচালিকা কল্যাণী মল্লিকের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ সালেও এই আশ্রম সফলভাবে চালু ছিল। ‘সখীসমিতি’ নামটি রবীন্দ্রনাথের দেয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখীসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখনির মধ্যে রয়েছে- ( উপন্যাস ) : দীপনির্বাণ (১৮৭৬), মিবার-রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ি (১৮৮৭), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে (১৮৯৮), ফুলের মালা (১৮৯৫), বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১), মিলনরাতি (১৯২৫) ও সাব্বিরের দিন রাত (১৯১২)।
(নাটক): বিবাহ-উৎসব (১৮৯২), রাজকন্যা ও দিব্যকমল।
(কাব্যগ্রন্থ) : গাথা, বসন্ত উৎসব ও গীতিগুচ্ছ।
(বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ) : পৃথিবী।

১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে সম্মানিত করে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন।

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
বাতিঘর

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: বাংলার প্রথম বিপ্লবী কন্যা

করেছে Rodoshee মে ৪, ২০১৭

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী শহীদ। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

ডা. খাস্তগীর সরকারী বালিকা বিদ্যালয় ছিল তার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে তিনি এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। সেই শিক্ষকের একজন ছিলেন ইতিহাসের ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাই এর ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী তাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে তারা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করেন। ১৯২৮ সালে তিনি কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করে। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়তে যান। প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। দর্শনের পরীক্ষায় তিনি ক্লাসে সবার চাইতে ভাল ফলাফল লাভ করতেন। এই বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্লবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণে অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেয়া হয়নি।

প্রীতিলতা তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা তখন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন শেষে সক্রিয় হচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস মোড়ে সূর্য সেনের বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করে। এ ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় রেলওয়ে ডাকাতি মামলা। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ঊষাদির সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই মামলার ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অনেক কিছুই জানতে পারেন তিনি। ঊষাদির দেয়া ‘ঝাঁসীর রাণী’ বইটি পড়ার সময় ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ১৯২৪ সালে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের অনেক নেতা ও সদস্য এই আইনে আটক হয়েছিল। তখন বিপ্লবী সংগঠনের ছাত্র আর যুবকদেরকে অস্ত্রশস্ত্র, সাইকেল ও বইপত্র গোপনে রাখার ব্যবস্থা করতে হত। সরকার বিপ্লবীদের প্রকাশনা সমুহ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার তখন বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। লুকিয়ে লুকিয়ে তিনি পড়েন ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। এই সমস্ত গ্রন্থ প্রীতিলতাকে বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। প্রীতিলতা দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিলো।

ঢাকায় যখন প্রীতিলতা পড়তে যান তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠন ছিল। এই দলটি প্রকাশ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরি করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের ‘দীপালী সঙ্ঘ’ নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগ (বিয়ের পর লীলা রায়) এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করত। গোপনে তাঁরা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুুক্ত করার কাজও করত। ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা রায়ের সাথে প্রীতিলতার পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯২৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নারী সম্মেলন করবার কোন পরিকল্পনা তখনও ছিলো না কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন। মহিলা কংগ্রেস নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাঁদের দুজনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সূর্য সেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হয়।
১৯৩০ সালের ১৯ এপ্রিল আই এ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন প্রীতিলতা। আগের দিন রাতেই চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের দীর্ঘ পরিকল্পিত আক্রমণে ধ্বংস হয় অস্ত্রাগার, পুলিশ লাইন, টেলিফোন অফিস এবং রেললাইন। এটি ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচয় লাভ করে। চট্টগ্রামের মাটিতে বিপ্লবীদলের এই উত্থান সমগ্র বাংলার ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। প্রীতিলতা লিখেছিলেন ‘পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯ এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম’।
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত আসার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে টিজেক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য মাষ্টার’দা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে মনোনীত করলেন। পরিকল্পনা অনুাযায়ী ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তাঁরা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালায়। কিন্তু ভুল করে ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এসডিও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলবারসহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে। এই বোমাগুলোই কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদ- এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসনদ- দেয়া হয়। ব্যয়বহুল বলে আলিপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যু গ্রহণের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সাথে চট্টগ্রাম থেকে আত্নীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। মনোরঞ্জন রায়ের মা হিজলী জেলে ছেলের সাথে দেখা করতে গেলে গোপনে তিনি প্রীতিলতাকে লেখা চিঠিটা তাঁর হাতে দেন। গুনু পিসির উপদেশ অনুযায়ী প্রীতিলতা মৃত্যুপ্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে দেখা করার জন্য আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ‘অমিতা দাস’ ছদ্মনামে ‘কাজিন’ পরিচয় দিয়ে দরখাস্ত করেন। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে তিনি প্রায় চল্লিশবার রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করেন। এ সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন ‘তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুন বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সাথে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।’
রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসীর পর আরো প্রায় নয় মাসের মতো প্রীতিলতাকে কলকাতায় থেকে যেতে হয় বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে বাড়ি এসে দেখেন তাঁর পিতার চাকরি নাই। সংসারের অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য শিক্ষকতাকে তিনি পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে বিশিষ্ট দানশীল ব্যাক্তিত্ব অপর্ণাচরণ দে’র সহযোগিতায় তখন নন্দনকাননে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নন্দনকানন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (বর্তমানে অপর্ণাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়)। তিনি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। স্কুলে যাওয়া, প্রাইভেট পড়ানো, মাকে সাংসারিক কাজে সাহায্য করে তাঁর দিনগুলো কাটছিল। তিনি লিখেছেন ‘১৯৩২ সালে বিএ পরীক্ষার পর মাষ্টারদার সাথে দেখা করবই এই প্রত্যয় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম’। বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের কথা কল্পনা দত্তকে বলেন। প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার এক বছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলী হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন। সেজন্য প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সাথে মাষ্টারদার দেখা হয়। ১৯৩১ সালে এই গোপন সাক্ষাতের সময় আত্মগোপনে থাকা মাষ্টারদার সাথে ছিলেন বিপ্লবী নির্মল সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী এবং কালীকিংকর দে। মাষ্টারদা ঐ সাক্ষাতের সময় কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কিত খোঁজ খবর জানতে চান। এরমধ্যে একবার মাষ্টারদার সংগঠন চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দিল। প্রীতিলতার বাবা সংসারের খরচ চালানোর জন্য মাসিক বেতনের পুরো টাকাটা প্রীতিলতার হাতে দিতেন। তিনি ঐ টাকাটা সংগঠনের কাজে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তা নিতে কল্পনা দত্ত আপত্তি করায় প্রীতিলতা কেঁদে বলেন ‘গরিব দেখে আমাদের টাকা নিতে চান না। আমি যে নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পারব তার প্রমাণ করার সুযোগও কি আমায় দেবেন না?’
১৯৩২ সাল- চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দুই বছর অতিক্রম হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই বছরগুলোতে আক্রমণের নানা পরিকল্পনার পরেও শেষ পর্যন্ত নতুন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারে নাই। এসব পরিকল্পনার মূলে ছিলেন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেন। এই দুজন আত্মগোপণকারী তখনো গ্রাম থেকে গ্রামে বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই আশ্রয়স্থলগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর টিনের ছাউনি দেয়া মাটির দোতলা বাড়িটা। পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামটা ছিল বিপ্লবীদের অতি শক্তিশালী গোপন আস্তানা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে এই গ্রামে ছিলো মিলিটারি ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে সেনারা বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আত্মগোপনরত বিপ্লবীদের ধরার চেষ্টা করত। ১৩ জুন সন্ধ্যায় সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীদের সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা পটিয়া পুলিশ ক্যাম্প জানতে পারে। এর আগে মে মাসেই ইংরেজ প্রশাসন মাষ্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে ১০,০০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন।

জ্বরের কারণে নির্মল সেন এবং ভোলা রাতের খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে উপরের তলায় শুয়ে ছিলেন। মাষ্টারদার সাথে খেতে বসে অস্বস্তি বোধ করায় প্রীতিলতা দৌড়ে উপরে চলে যান। এমন সময় মাষ্টারদা ঘরের ভিতরের মই বেয়ে দোতলায় উঠে বলেন ‘নির্মলবাবু, পুলিশ এসেছে’। মাষ্টারদা প্রীতিলতাকে নিচে নেমে এসে মেয়েদের সাথে থাকার নির্দেশ দেন। ততক্ষণে সিপাহী এবং কনষ্টেবলরা ঘর ঘিরে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং সাব-ইন্সপেক্টর মনোরঞ্জন বোস ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঘরের একতলায় থাকা সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে মেয়েকে দেখতে পান। ‘ঘরে আর কে আছে?’ এ প্রশ্ন করে কোন উত্তর না পাওয়া অভিযান পরিচালনাকারীরা এ সময় ঘরের উপরের তলায় পায়ের আওয়াজের শব্দ শুনতে পান। ক্যাপ্টেন ক্যামেরন হাতে রিভলবার নিয়ে ঘরের বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই নির্মল সেনের করা দুইটা গুলিতে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন মৃত্যুবরণ করেন। গুলির শব্দ পাওয়ার পরেই ঘরের চারিদিকে থাকা সৈন্যরা চারিদিক থেকে প্রচ- গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা গুলি এসে নির্মল সেনের বুকে লাগে এবং প্রচুর রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়। মাষ্টারদা আর প্রীতিলতা সেই রাতে কচুরিপানা ভরা পুকুরে সাঁতার কেটে আর কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পটিয়ার কাশীয়াইশ গ্রামে দলের কর্মী সারোয়াতলী স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মনিলাল দত্তের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। মণিলাল দত্ত তাদেরকে ধলঘাট হতে ছয় কিলোমিটার দূরে পাহাড়, জঙ্গল এবং নদীর কাছাকাছি একটা গ্রাম জৈষ্ট্যপুরায় নিয়ে যেতে মনস্থির করেন। পুলিশ আসলে পাহাড় এবং জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা যাবে অথবা নদী পার হয়ে অন্য আশ্রয়ে যাওয়া যাবে। অনেক প্রতিকূল পথ অতিক্রমের পর তাঁরা জৈষ্ট্যপুরা গ্রামে আরেকটা গোপন আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছান। ঐ গুপ্ত আস্তানাটি ‘কুটির’ নামে পরিচিত ছিল।

১৯৩২ এর ১০ আগস্ট ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী প্রীতিলতার উপর। ২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন এর। ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তারা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘণ্টা পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারণে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাঁ-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা আহত হয়। পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্বান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করেন। তাঁর মৃতদেহ তল্লাশীর পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটা হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না। পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
বাতিঘর

মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা

করেছে Rodoshee মে ৩, ২০১৭

জাহানারা ইমাম। শহীদ জননী হিসেবে খ্যাত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে ১৯২৯ সালের ৩ মে জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবকালে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের আধুনিক শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না। তবে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতা আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। বিবাহিত জীবনে লেখাপড়ায় তিনি পুরপ্রকৌশলী স্বামী শরীফ ইমামের দিক থেকেও উৎসাহ পেয়েছিলেন।

বাবার চাকরিসূত্রে জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৬৫ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ফুলব্রাইট স্কলার জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৮-র দিকে সে চাকরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি মহলে সুপরিচিত ছিলেন।

ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম অল্প-বিস্তর পরিচিত ছিলেন শিশুকিশোর উপযোগী রচনার জন্য। কিন্তু তাঁর সর্বাধিক খ্যাতির কারণ দিনপঞ্জিরূপে লেখা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুত্র রুমী ও স্বামীকে হারান। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কেটেছে তাঁর একদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে; অন্যদিকে মনের মধ্যে ছিল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। সেই দুঃসহ দিনগুলিতে প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার বৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি নানা চিরকুটে, ছিন্ন পাতায়, গোপন ভঙ্গি ও সংকেতে। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থরূপ পাওয়ার পর তা জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শিহরণমূলক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাবৃত্তান্ত হলো একাত্তরের দিনগুলি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাহানারা ইমাম লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান এবং তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলি এ সময়ে প্রকাশ পায়। গল্প, উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুইমেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যানসারের সঙ্গে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাহানারা ইমামের নাম ছড়িয়ে পরে তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য। অতীতে তিনি রাজনীতিসচেতন হলেও রাজনীতিবিদ ছিলেন না, এবার ভবিতব্যই তাঁকে রাজনীতির অঙ্গণে নিয়ে আসে। একাত্তরে তাঁর প্রথম পুত্র রুমী ছাত্রত্ব ত্যাগ করে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে নিহত হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তখন থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মর্যাদায় ভূষিত।

মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জাহানারা ইমাম নিজেও সব সময় সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ ঘাতক-দালালদের পর্যায় ক্রমিক পুনর্বাসনে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করে এবং লিখে জনসচেতনতা গড়ে তোলেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের পরিচালিত ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’, ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ ইত্যাদি উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের একত্র করতে না পারলে বিরোধী দুষ্ট চক্রকে প্রতিরোধ করা যাবে না। এ সময় তিনি অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন মূলত সংস্কৃতি অঙ্গনের লোক, কিন্তু এ সময় থেকে তিনি রাজনীতির অঙ্গণেও সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৯২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’র আহবায়ক হন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক দল ও কর্মিবৃন্দ, দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ এবং প্রজন্ম ’৭১ তাঁর আহ্বানে এগিয়ে আসেন। তাঁদের সক্রিয় সমর্থনে জাহানারা ইমাম ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গড়ে তোলেন।

গণ-আদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। কিন্তু তৎকালীন সরকার জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪ জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করে এবং জাহানারা ইমাম মৃত্যুকালেও এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি।

১৯৮১-র দিকে জাহানারা ইমাম মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন; রোগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, কথা বলাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু কর্কট রোগ তাঁর কর্মস্পৃহা ও আদর্শকে বিন্দুমাত্র স্তিমিত করতে পারেনি। সকল ব্যথা-বেদনা উপেক্ষা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকা- সমান উৎসাহে চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। সেখান থেকে ঢাকায় এনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
এই সংখ্যায়বাতিঘর

দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রীর গল্প

করেছে Rodoshee মার্চ ২২, ২০১৭

 

লেখা : অহ নওরোজ

সাম্প্রতিক সময়ে নারী জাগরণের অগ্রদূত হয়ে যারা নতুন পথের সন্ধান করেছেন, তাদের মধ্যে সাইদা খানম অন্যতম। কারণ, তিনিই এ দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী। এ পর্যন্ত তিনি ছবি তুলেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সত্যজিৎ রায়, ইন্দিরা গান্ধী, রানি এলিজাবেথ, মাদার তেরেসা, মার্শাল টিটো, উত্তমকুমার, অড্রে হেপবার্ন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবীসহ আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির। তবে তিনি শুধু একজন আলোকচিত্রীই নন, একাধারে তিনি সমাজসেবী ও সুসাহিত্যিকও। সময়ের এই জীবন্ত কিংবদন্তিকে নিয়ে এই সংখ্যার বিশেষ ফিচার।

১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর নানার বাড়ি পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন সাইদা খানম। তার পৈতৃক ভিটা ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। বাবা আবদুস সামাদ খান এবং মা নাছিমা খাতুনের সুযোগ্য কন্যা সাইদা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে পুনরায় লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করেন। চার বোন, তিন ভাইয়ের মধ্যে সাইদা খানম ছিলেন সবার ছোট। তাদের মধ্যে তার ছবি তোলার ব্যাপারে সবচেয়ে সাহায্য করেছিলেন মেজ বোন হামিদা খানম। ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ দেখে আমেরিকা থেকে তিনি একটি রোলিকড ক্যামেরা এনে দিয়েছিলেন।

আলোকচিত্রী হিসেবে সাইদা খানমের যাত্রা শুরু হয় বেশ তরুণ বয়সেই। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই ছবি তোলার প্রতি তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সালটা ১৯৪৯, সে বছরই প্রথম ছবি তোলেন তিনি। তবে এর আগে থেকেই ছবি তোলার প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মে তার।

আলোকচিত্রী হিসেবে সাইদা খানমের মূল যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৬ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে। কাজ করার প্রথম দিকে তিনি তার কাজ দিয়ে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তাদের বাসায় কাজ করতেন একজন সুন্দরী বালিকা। সে সময় মেজ বোনের কিনে দেওয়া ক্যামেরাটা ছিল তার কাছে। একদিন তিনি কাজের মেয়েকে কাছে ডেকে তার মাথায় পানি ঢেলে তারপর তার একটি ছবি তুললেন। সদ্যস্নাত স বালিকার স্নিগ্ধ রূপ ফুটে উঠল ছবিতে। এরপর ‘বেগম’ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় ছবিটি ছাপা হয়। ছবিটি দেখে এলাকার সবাই বিভিন্ন ধরনের বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। বিশেষ করে কোনো নারী যে আলোকচিত্রী হতে পারে, সেটা তাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। যদিও বাড়ির বড়দের চেষ্টায় অনেক আলোচনার পর মানুষের সমালোচনার বাক্য কিছুটা রোধ করা গিয়েছিল, কিন্তু সাইদা খানম কোনোভাবেই দমে যাননি। তিনি বরং তার কাজের প্রতি আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

সাইদা খানম বাংলাদেশের আলোকচিত্র শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি নাম। তিনি তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ছিলেন প্রচারবিমুখ। যে কারণে প্রথম দিকে তেমনভাবে পরিচিতি পাননি। তিনি শুধু এ দেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রীই নন, তিনি এ দেশের প্রথম মহিলা আলোকচিত্রশিল্পী, যিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
প্রথম থেকেই আলোকচিত্রকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য সামাজিক কারণে তাকে বিভিন্ন সময় নানা বাধাবিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। সে সময় তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খালা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, বড় বোন অধ্যক্ষ হামিদা খানম, মহসিনা আলীসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া তাকে কাজ করার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন এ দেশের নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন ও ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান।

সাইদা খানমের এক ভিন্নমাত্রার ব্যক্তি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ছিল সে সময়ে ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টুডিও ‘জায়েদী স্টুডিও’র মালিক জায়েদী সাহেবের। সাইদা খানম যখন আলোকচিত্রীর পেশা গ্রহণ করেন, তখন এ দেশে ছবি তোলার স্টুডিওর সংখ্যা খুবই কম ছিল। পুরো রাজধানী ঘুরে দুটি স্টুডিওর খোঁজ পাওয়া যেত। স্টুডিও দুটির মধ্যে এই ‘জায়েদী স্টুডিও’ই ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে পরিচিত স্টুডিও। এই স্টুডিওর মালিক জায়েদী সাহেব সাইদা খানমের ফটো কম্পোজিশন সম্পর্কে স্পষ্ট ধ্যানধারণা দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সাইদা খানমকে ছবি তোলার বিষয়ে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকা, জার্মানির ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন রাখতেন। এগুলো দেখেই ছবি তুলতে গিয়ে অ্যাপারচার এবং এক্সপোজার সম্পর্কে ভালো ধারণা পান সাইদা খানম। সাইদা খানম বলেন, ‘জায়েদী সাহেবই আমার ফটোগ্রাফির প্রথম শিক্ষক’। যদিও এরপর আর কারও কাছে সেভাবে ক্যামেরাবিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করতে যাননি তিনি। সব মিলিয়ে একজন আদর্শ আলোকচিত্রী হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাইদা খানমের পেছনে জায়েদী সাহেবের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কর্মজীবনে বেশ কিছুকাল পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবে দূরে ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। তবে আলোকচিত্রী সাংবাদিক হিসেবেই তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সে সময় দুটি জাপানি পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার তোলা আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছিল।

নিজের কাজের পাশাপাশি সাইদা খানম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করে আলোকচিত্রে বাংলাদেশেকে তুলে ধরেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। এরপর জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে তার ছবি প্রদর্শিত হয়। শুধু বিদেশে নয়, ঢাকাতেও তিনি কয়েকবার একক ও দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। সাইদা খানম ১৯৭৩ সালে কলকাতায় ‘অল ইন্ডিয়া ফটো জার্নালিজম কনফারেন্সে’ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করে প্রচুর প্রশংসিত হন। ১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ এশিয়ান গেমসে তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করেন। সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি নিয়ে তিনবার আয়োজন করেন একক প্রদর্শনীর। এতে অতিথি হিসেবে ছিলেন দেশি-বিদেশি শিল্পীরা। শুধু তা-ই নয়, নিজের তোলা মাদার তেরেসার ছবির প্রদর্শনী করার আয়োজন করেও দেশে-বিদেশে প্রচুর প্রশংসিত হয়েছিলেন সাইদা খানম। তিনি ২০০০ সালে দৃক লাইব্রেরিতে ‘শান্তিনিকেতন ও কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়’ শীর্ষক একটি প্রদর্শনী করেন।

নিজের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সাইদা খানম বিভিন্ন সময়ে জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন লাভ করেন। ১৯৬০ সালে ‘অল পাকিস্তান ফটো প্রতিযোগিতা’য় প্রথম স্থান লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ফটো প্রতিযোগিতায় সার্টিফিকেট লাভ করেন।

তিনি প্রায়ই ‘চিত্রালী’ পত্রিকার জন্য ছবি তুলতে কলকাতায় যেতেন। ১৯৬২ সালে এই পত্রিকার সুবাদে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলে সমাদৃত হন সাইদা খানম। তিনি বলেন, ‘মাঝেমাঝেই আমি চিত্রালীর জন্য ছবি তুলতে যেতাম কলকাতায়। সে সময়ে অনেকের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাহাড়ি সান্যাল, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন প্রমুখ। সময়টা ষাটের দশকের মাঝামাঝি। আর মধ্যে অনেকবারই ভেবেছি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারে। কিন্তু সেভাবে সময় সুযোগ হয়নি। একবার পত্রিকা থেকেই আমাকে বলা হলো সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কাজ করতে। আমি একদিন গেলাম তার বাড়িতে। এটি ছিল লেক টেম্পল রোডে অবস্থিত। একবার ভাবলাম চলে যাই, তিনি হয়তো ব্যস্ত আছেন, বিরক্ত হতে পারেন। আবার কী মনে করে গেলাম তার বাসায়, তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কী চাই? সে সময়টাতে অল্প সময় হয়েছে তিনি “কাঞ্চনজঙ্ঘা” সিনেমাটি শেষ করেছেন। ওই সিনেমাটি নিয়েই আমি কথা বললাম। তারপর কথায় কথায় আমি একফাঁকে তার কাছে ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। পরে শুনেছিলাম, তিনি আমার ছবি তোলার প্রশংসা করেছিলেন।’

তিনি পৃথিবীখ্যাত তিন চন্দ্রমানব নিল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিনস জুনিয়র এবং মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলে গোটা ভারতবর্ষে প্রচুর প্রশংসিত হয়েছিলেন।

সারাজীবন শিল্পের সঙ্গে একান্তে কাটাতে চেয়েছেন সাইদা খানম। হয়তো তাই বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হননি তিনি। তিনি শুধুই একজন আলোকচিত্রী নন, তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী, নারী জাগরণের পথিকৃৎ এবং সুসাহিত্যিক। তার লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ধুলোমাটি’, ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’, ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’, ‘আলোকচিত্রী সাইদা খানমের উপন্যাসত্রয়ী’ ইত্যাদি। বিভিন্ন গল্পের সংকলন ‘ধুলোমুঠি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। এ ছাড়া ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় আলোকচিত্রের গ্রন্থ ‘আমার চোখে সত্যজিৎ রায়’।

সাইদা খানম বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির একজন সদস্য। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি এবং ইউএনএবির আজীবন সদস্য। যুক্ত রয়েছেন দেশের অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করে চলছেন।

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail

পোর্টফোলিও

প্রকাশিত সংখ্যা

রোদসীর পছন্দ

  • ঘরেই বানিয়ে নাও মেকআপ সেটিং স্প্রে

তুমিই রোদসী

  • আলোয় ভুবন ভরা







rodoshee logo

© স্বত্ব রোদসী ২০১৪ - ২০২১
সম্পাদক ও প্রকাশক:   সাবিনা ইয়াসমীন
৯১/এ, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা, ব্লক-এফ, রোড-৩, চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮০-২-৫৫০৪১০৪৬-৪৮, ই-মেইল: info@rodoshee.com

রোদসী

রোদসী

ক্যাটাগরি

আর্কাইভ

@2014-2018 -রোদসী. All Right Reserved.

রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
Facebook