রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
বিভাগ

শিল্প-সংস্কৃতি

শিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতিসাফল্য

এবার একুশে পদক পেলেন যারা

করেছে Tania Akter ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২২

দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিককে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২২ সালের একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে।

রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘একুশে পদক-২০২২’ প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক অনুষ্ঠানে বিজয়ী ব্যক্তিদের পদক প্রদান করেন।

সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং স্বাগত বক্তব্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।

এবার দেশের ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক প্রদান করেছে সরকার। সরকার ৩ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদক ২০২২’ প্রদানের জন্য ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম ঘোষণা করে।

এ বছর ভাষা আন্দোলন বিভাগে ২ জন, মুক্তিযুদ্ধে ৪ জন, শিল্পকলা (শিল্প, সংগীত ও নৃত্য) বিভাগে ৭ জন , সমাজসেবা বিভাগে ২ জন, ভাষা ও সাহিত্যে ২ জন, গবেষণায় ৪ জন, সাংবাদিকতায় ১ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১ জন এবং শিক্ষায় ১ জন পুরস্কার পেয়েছেন।

ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে মোস্তফা এম এ মতিন (মরণোত্তর) ও মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল (মরণোত্তর) পুরস্কার পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মতিউর রহমান, রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (মরণোত্তর), কিউ এ বি এম রহমান ও আমজাদ আলী খন্দকার।

সাংবাদিকতায় পেয়েছেন এম এ মালেক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পেয়েছেন মো. আনোয়ার হোসেন। শিক্ষায় পেয়েছেন অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাস।

নৃত্যে পেয়েছেন জিনাত বরকতুল্লাহ। সংগীতে নজরুল ইসলাম (মরণোত্তর), ইকবাল আহমেদ ও মাহমুদুর রহমান। অভিনয়ে খালেদ মাহমুদ খান (মরণোত্তর), আফজাল হোসেন ও মাসুম আজিজ।

সমাজসেবা বিভাগে পেয়েছেন এস এম আব্রাহাম লিংকন ও সংঘরাজ ডা. জ্ঞানশ্রী মহাথেরো। ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন কবি কামাল চৌধুরী ও ঝর্ণা দাস পুরকায়স্থ।

গবেষণা বিভাগে পেয়েছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল, ডা. মো. এনামুল হক (টিম লিডার), ডা. শাহানাজ সুলতানা (টিম) ও ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস (টিম)।

 

একুশে পদকের নীতিমালা অনুযায়ী, এককালীন ৪ লাখ টাকাসহ ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, রেপ্লিকা ও একটি সম্মাননাপত্র প্রদান করা হয় নির্বাচিত প্রত্যেক বিজয়ীকে।

 

জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে একুশে পদক দেওয়া হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ও একুশের চেতনাকে ধারণ করে দেশের শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির বিকাশসহ আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রাখছেন, তাঁদের সবার প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকার প্রতিবছর গৌরবময় একুশে পদক প্রদান করে থাকে।

লেখা: রোদসী ডেস্ক

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
কবিতাশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ – কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের কাব্যগ্রন্থ

করেছে Wazedur Rahman জুন ৩, ২০২০

প্রেমহীন এই নিথর ধরা যেন অসার
পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করে আবার।

কবিতা হচ্ছে ছন্দ, দোলা এবং স্পন্দন নিয়ে রচিত একগুচ্ছ শব্দমালা। অথবা, কবিতা বা পদ্য হচ্ছে শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস; যা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে আর তা শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে।

কবিতা। তিনটি অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ অথচ এর বিশালতা আর গভীরতা অকল্পনীয়। হ্যাঁ সত্যিকার অর্থেই অকল্পনীয়। জীবনের প্রত্যেকটি উপাদান আর উপাত্ত নিয়েই কবিতা। একটি জীবনের আলোকে সামগ্রিক জীবন নিয়ে লেখা হয় কবিতা। কবিতা হাসায়, কবিতা কাদায়। কবিতা আনন্দ দেয়, কবিতা বেদনা শেখায়। তাই একজন কবির কাছে তার কবিতা নিজের সন্তানের মতো, নিজের সহধর্মিণীর মতো যে তাকে ভালোবেসে পাশে থাকে দুঃখের সময়েও।

২০২০ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নৈঋতা ক্যাফে থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ শিরোনামে। বইটির প্রচ্ছদ করেছে চারু পিন্টু। প্রচ্ছদ বেশ মানানসই হয়েছে কাব্যগ্রন্থের কাব্যগুলো অনুসারে।

ছবি: সংগ্রহীত

খুবই সাদামাটা না আবার খুব বেশি ঝমকালো নয়; যতটুকু অর্থপূর্ণ হওয়া দরকার ততটুকুই যেন। বইটির পেইজ, বাইন্ডিং বেশ স্ট্যান্ডার্ড মানের। আর যেহেতু কাব্যগ্রন্থ তাই গাউন পেপারের ব্যবহার যেন বইটির আউটলুককে আরও পরিপূর্ণ করেছে।  

শ্রাবণ জুড়ে মেঘ থাক, আশা রাখি  
কেটে যাক দাবদাহ জ্বর, প্রসন্ন হাসি;  
ফিরে আয় মেঘমালা- বিষণ্ণ ঢাকি  
পোড়া চোখে বৃষ্টি ঝরুক, তোমায় ভালোবাসি।

কবিতা এমন একটা ব্যাপার যেটা আসলে পড়ে, অনুভব করে অন্যকে ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানোর নয়। তবুও কিছু কথা জড়ো হয় যে কোন কাব্যগ্রন্থ পাঠ শেষেই। এই বইটি পাঠ শেষেও তেমন কিছু কথাই জড়ো হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে অর্ধশতেকের বেশি কবিতা স্থান পেয়েছে। সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করলে এই পর্যোলোচনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে আর পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। তাই যেসব কবিতা ভাবনার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো নিয়েই বরং আলোচনা করা যাক।

কবিতা লিখেন কে? একজন কবি। পাঠকের মনের অজানা কথাগুলোই যেন ভেসে উঠে পঙক্তি হয়ে কবির কবিতার। পাঠক নিজের না বলা কথাগুলো গুচ্ছ আকারে লিপিবদ্ধ দেখে আনন্দে হয় আত্মহারা; কিন্তু কখনো কি ভাবে কবির কথা! সেই আক্ষেপটাই যেন কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি। যেখানে তিনি বলেন –

কে শুনবে কার কথা?  
এই ধরো আমার কথা-  
নিদারুণ দুঃখ বোধ,  
ভিতরে-ভিতরে ক্ষয়রোগ;

কবির আক্ষেপটাই যেন প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভটাই যেন কবিকে প্ররোচিত করে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান দেয়ার। তখন কবি বলেন –

এই অন্ধকার থেকে আলোর মুখ কবে বের হয়ে আসবে?  
সেদিন কোথায় যেদিন সম্মিলিত প্রতিরোধ হবে… আর কত দিন…???

কবি মানেই রোমান্টিক আর কবিতা মানেই রোমান্টিকতা। হোক না তা দ্রোহের কবিতাগুচ্ছ সেখানেও চুপিসারে রয়ে যায় কবির অজানার প্রেমের কথা। কবির অজানায় হারিয়ে যাবার কথা। এমনই হারিয়ে যাবার উপাখ্যানে কবি বলেন –

দাঁড়াও, আমিও আসছি, হাওয়ার তরী –  
বেয়ে-বেয়ে তোমার অজানা দ্বীপে।

ছবি: সংগ্রহীত

হাজার মানুষের ভীড়ে ছুটে চলা মানুষটার একাকীত্ব আর ঝাঁকে উড়ে বেড়ানো পাখিটার শূন্যতায় কবি যেন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন খুঁজে পান। সেই মানুষটা কিংবা সেই পাখিটার যে ভালোবাসার মানুষটাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাই ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। কবির ভাষ্যে-

অসহ্য যন্ত্রণায় ওড়ে পাখি –  
নিয়ে ডানায় শ্বাসহীন রাখী।

তথাকথিত সমাজের ভালোবাসা মানেই যেন জৈবিক চাহিদার এক আঁতুড়ঘর। আসলেই কি তাই? ভালোবাসা তো মনের সঙ্গে মন বুনার এক কাজ। ভালোবাসা সে তো অশরীরী – না ধরা যায় না ছোঁয়া যায়। ভালোবাসার সেই অকথিত কোমলতার কথাই কবি বলেছেন ভালোবাসা এত কোমল কবিতাটিতে। কবি বলেন –

নশ্বর শরীর পাবে না এর নিগূঢ় ভেদ-  
তাইতো ভালোবাসা আজ অভাবনীয় নিঃশেষ!

স্বপ্ন আর মিছিল যেন একই সূত্রে গাঁথা দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। স্বপ্ন যেন কবিতার মতো। প্রতিবার পড়ার সময় তা নিজেকে আরো মেলে ধরে, নিজের আরো বিস্তৃতি বাড়ায়। আর মিছিল!! স্বপ্ন হোক কিংবা মিছিল সে তো শুরু করে একজনই। কিন্তু তার কি কোনো শেষ আছে? স্বপ্ন আর মিছিলের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ায় কোনো না কোনো এক সুবোধ। তাই কবি বলেন –  

স্বপ্নটা পৃথিবীর তাবৎ সুবোধ-  
প্রাণের আকুতি নিয়ে জনাকীর্ণ এক মিছিল।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে কত শিল্পী আর মনীষী এই দেশের প্রেমে পড়েছেন তার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু আধুনিকতার কবলে পড়ে ক্রমশ নদী হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। কিন্তু সেই নদীর এমন দগ্ধতা আর ক্ষতের কথা কতজনে মনে রাখে? কতজন সেই নদীর হাহাকার শোনে? কবি সেই হাহাকারের খানিকটা তুলে ধরেন এভাবে –  

আমি এখন খরায় পোড়া ক্ষত-
আমাকে নিয়ে ভাবছে সবাই কত?

ছবি: সংগ্রহীত

প্রেম। প্রকৃতির অদ্ভুত এক সৃষ্টি। প্রেমের বন্ধন যে কতটা গাঢ় তা তো যুগে যুগে ইতিহাসই প্রচার করে এসেছে। কিন্তু সেই গাঢ়তা কি খানিকটা ম্লান হয়নি? হয়েছে বটে আর তাই তো বেড়েছে প্রেমের ব্যর্থতা আর বিচ্ছিন্নতা। সেই বিচ্ছিন্নতার জ্বালা সইতে পারে এমন কজনাই বা আছেন? তাই কবি নিজের ভাষায় বলেন –  

নিঃস্ব জীবন- প্রেমহীন প্রেমিকা- 
এক দৌড়ে হচ্ছে সভ্যতার গণিকা!

কথার কোনো ক্ষয় আছে কিংবা শেষ আছে? কথা স্রোতস্বিনী নদীর মতো; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরে, যুগ থেকে যুগান্তরে। কথার কোনো ক্ষয় নেই কিংবা শেষ নেই তবে কথা থাকে অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষায় পালা শেষ হয় কিন্তু কথা তবু ফুরোয় না। গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে কথাগুলো জমতে জমতে একদা হারিয়ে যায় কোনো অতলে, কোনো এক অজানার দেশে। তাই কবি বলেন –

অবশেষে, অপেক্ষমাণ কথাসমূহের দল- 
ফিরে যায় অজানার দেশে!

এই আমরা প্রতদিন সমাজ বদলের কথা বলি। নিত্যনতুন নিয়ম গড়ি। সমাজকে নিয়ে চলি আগামীর তলে। কিন্তু আসলেই কি সমাজ বদলায়? যদি তাই হয় তাহলে দিনমজুর এখনো দিন এনে দিন খায় কেন? নাকি কেবল আমরা মুখেই বলি শুধু সমাজ বদলাই। কবি তার নিজের ভাষায় এভাবে বলেন-

এখনো দিনমজুর দিন আনে দিন খায়- 
আমরা সবাই অহরহ সমাজ বদলাই।

কবি সোহাগ ওবায়দুজ্জামানের জন্ম কুষ্টিয়াতে। তবে বর্তমানে ঢাকার বাসিন্দা। স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। সেই থেকেই কবিতার প্রতি মায়া, মমতা, ভালোবাসা এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ২০১২ সালের প্রথম কবিতার বই ‘একজন মোনালিসা চাঁদের গহবরে মুচকি হাসে।’ এরপর সময় যেন থমকে গেল দীর্ঘ আটটি বছরের জন্য। কিংবা হয়তো বলা যায় কবি আটটি বছরের জন্য কবিতায় সিদ্ধহস্ত হতে সময় নিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ‘পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ’।

কবিতার বই পড়ার সবচেয়ে ভালো সুবিধা হলো একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। অবাধ্য শৈশবকে যেমন অনুভব করা যায় তেমনি সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায়। এভাবেই কবি নিজের গান গেয়ে অন্যকে করে প্রভাবিত। আর কবিতার বই একরাশ মুগ্ধতায় রয়ে যায় পাঠকের মনে হয়তোবা ক্ষণিকের জন্যে কিংবা হয়তো আজীবনের জন্যে। যেমনটা কবিও যেতে যেতে বলে যান –

মনুষ্যত্বের বাহক খাক হয়ে যায়
কিছুমানুষ আমৃত্যু স্বপ্নহীন থেকে যায়।

বই: পালকখসা পাখির ঠোঁটে প্রতিবাদ
লেখক: সোহাগ ওবায়দুজ্জামান
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
প্রকাশনী: নৈঋতা ক্যাফে
মূল্য: ২৫০ টাকা মাত্র

লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবি: সংগ্রহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

পাহাড়ের চাঁদ – কাজী রাফি

করেছে Wazedur Rahman এপ্রিল ৫, ২০২০

উঁচু এবং শেষ পাহাড়টা অতিক্রম করলেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গন্তব্যে। সেখানে আছে প্রাচীন আমলের এক মন্দির, বর্তমানকালে গড়ে ওঠা কয়েকটা নান্দনিক অবকাশযাপন কক্ষ। তার আশপাশে ট্র্যাকিং করলে পাওয়া যায় নাকি বেশ কিছু ঝরনা। সেই সব বাংলো থেকে পাহাড়ের চাঁদটাকে নির্জন রাতে কেমন লাগে, তা নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প। যে যেভাবে এই পাহাড়ের চাঁদকে অনুভব করে, এখান থেকে ফিরে গিয়ে সেভাবেই তারা ফেসবুকে গল্প ছড়িয়ে দেয় বলে এখন এত মানুষের আনাগোনা এই দুর্গম পাহাড়েও। অথচ দশ বছর আগে এখানে মানুষ আসার ঘটনা খুব কম ঘটত। পথের যাতনাটুকুই বড় ছিল। যারা আসতেন তাদের কাছ থেকে এই পাহাড়-মন্দিরে গল্প যত মানুষ শুনতেন তার চেয়ে বেশি শুনতেন যন্ত্রণাভোগের করুণ কাহিনি। বেশি মানুষের উপস্থিতির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলে মানুষ মনে হয় যন্ত্রণার মাঝে বীরত্ব খোঁজে। কষ্ট পাওয়ার চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করার স্মৃতি তখন তখন তাদের কাছে বড় হয়ে যায়।

আমার কেন যেন মনে হয়- মানুষের উপস্থিতি দেখার আনন্দ-নেশায় মেতে ওঠার জন্য স্রষ্টা এমন করে সাজিয়েছেন এই অপরূপ বিশ্বকে। মানুষের উপস্থিতিতেই পাহাড়ের সত্তা সাত্তিক, ঝরনার হৃদয় কলকল, প্রকৃতির আত্মা উন্মুখ, নদী-সাগরের মন টলমল করে ওঠে! কারণ আর কিছুই নয়- প্রকৃতি হয়তো মানুষের অনুভূতিকেই নিজের মাঝে ধারণ করে। তারই প্রতিফলন ঘটে মানুষের উপস্থিতে। সে জন্যই এই ব্রহ্মাণ্ডের লুকানো আত্মা মানুষের স্বপ্নের ভাষা বুঝতে ব্যগ্র এবং ব্যাকুল বলে নির্জন পাহাড়ে রাতের ডেকে যাওয়ার তান বড় অনন্য।
গত পাঁচটা দিন পাহাড় অতিক্রম করতে করতে আমাদের শরীরে ভয়ানক শ্রান্তি আর অবসন্নতা। ক্লান্তিও যে উপভোগ্য- এমন নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতির কাছে না এলে তা আর টের পেতাম না।
জনমানবহীন নীরব, নিস্তব্ধ প্রকৃতি-আকাশের কাছাকাছি এবং ঘাস-গাছ-লতাপাতার এই সবুজ বেষ্টনীর মাঝে ক্লান্তিতে প্রায় বিধ্বস্ত আমাদের শরীর। সামান্য বিশ্রাম, ঝরনার জল আর খাবার পেলেই কী এক সঞ্জীবনী শক্তিতে সামনে যাওয়ার তাড়নায় তা জেগে উঠছে। অদ্ভুত এবং অনন্য প্রেরণায় এগিয়ে যেতে যেতে ভাবি, সামনে তো এমনি লতা-ঘাস আর পাহাড়ি গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু কী আর নতুনত্ব দেখার নেশায় এমন কষ্টকর পথ পাড়ি দেওয়া!  সতীর্থ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে তার উত্তরও পাই- আমরা কয়েকজন আসলে এই পথচলাতেই মানবের সমগ্র জীবনের তুচ্ছতাকে উপলব্ধি করছি বলে অজানা গন্তব্যও আজ আমাদের কাছে মহার্ঘ! তা ছাড়া ডাক্তারি বিদ্যায় নতুন এক ডিগ্রি লাভ করতে গিয়ে কঠোর সময়ানুবর্তিতার নির্মম চাবুকে আমাদের জর্জরিত জীবন যেন নির্বাণ লাভ করেছে। পাঠ শেষের আনন্দ মিশে গেছে এসব থেমে থাকা পাতার মর্মরে। নিস্তব্ধ রাতে নির্মল নীলের অবারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথার কাছে নেমে আসা আলোয় ধোয়া চাঁদের দিকে তাকালে কত-কী যে অনুভব করি- তা আর ভাষায় বোঝাই কী করে!

আমাদের মতো আরও বেশ কিছু দলবদ্ধ মানুষও জীবনের এই মায়ার কুহেলিকা খুঁজতে ছুটছে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। মানুষের আত্মা, খুব সম্ভবত জগতের প্রাকৃতিক মিথস্ক্রিয়ায় ধুয়ে উঠলেই তৃপ্ত হয়। অবারিত দিগন্তের দিকে না তাকাতে পারলে তাদের সৃজনশীল সত্তা জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। সে জন্যই কি উঁচুতে উঠে দূর-দূর দিগন্তকে দেখার নেশা মানুষের রক্তে লুকানো? হবে হয়তো। এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর একজন দার্শনিকের কাছেও নেই বলেই আমার ধারণা। দলবদ্ধ মানুষগুলো তাই হয়তো নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ছুটছে পাহাড়ে। নিজেকে জোছনায় ধুয়ে তারা এক একজন চাঁদ হয়ে উঠবে বলে! তাদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে গেলেই তারা পরশপাথর গোছের কিছু একটা পেয়ে যাবে অথবা এই জগৎ এবং ঈশ্বরের মাঝে যে সম্পর্ক সেখানে লুকিয়ে আছে- তার সূত্রের সন্ধান পাওয়ার কাছাকাছি তারা প্রায় পৌঁছে গেছেন। এ মানবজীবনের এক ট্র্যাজেডি বটে!

জীবনের এই মায়াময় সব সূত্র একসঙ্গে আমার অনুভবে তোলপাড় আন্দোলন তুলল, যেদিন সন্ধ্যা নামার আগেই পূর্ণিমার চাঁদকে মাটিতে দেখলাম। তার আগে বলে নিই, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি খাড়া পথ এত উঁচুতে এসে যেন একটু থিতু হয়েছে। হাঁটুতে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দূরে নিচুতে ফেলে আসা সমতল ভূমির দিকে তাকালাম। একদম মানচিত্রের মতো না হলেও মনে হলো ছোট ছোট টিলাগুলো পেরিয়ে অসংখ্য রেখার সীমানা অঙ্কিত মনুষ্য বসতির ওই স্থানটুকু সবুজের গালিচা আর জলের ফোয়ারা দিয়ে সাজানো। অস্তমিত হওয়ার আগে সূর্যমামা তার ঝাঁজ কমালেও প্রকৃতির মাঝে যে ভ্যাপসা গরম নিজেদের বিকিরিত করছে, তাতে দুপুরের চেয়ে এখন শরীর থেকে বেশি ঘাম ঝরছে। ‘ভ্যাপসা’ শব্দ যখন উচ্চারণ করছি অথবা যখনই শব্দটা মনে আসছে তখন তার সঙ্গে পাহাড়ি বুনো ফুলের ঘ্রাণটুকু আমাকে আচ্ছন্ন করছে।

আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল তেষ্টায় শুকনা ঠোঁট এবং পিপাসায় কাতর আমার খাদ্যনালি জলে ভিজতে চাইল। আর বিশ্বাস হলে করুন, না হলে না-ই বা করুন এই শব্দের সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার-স্যাপার আমাকে আনমনা স্বপ্নের ঘোরে তলিয়ে নিচ্ছে, যা বলতে আমি দ্বিধান্বিত। তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি, আমি এই শব্দের সঙ্গে পাহাড়ের ঘ্রাণ মিশিয়ে কোনো একজন স্বপ্নতরুণীকে কল্পনা করছি, যার ঘর্মাক্ত শরীরে এমন বুনো সব ফুলের ঘ্রাণ আর বনস্পতির স্নিগ্ধতা জেগে থাকে। ওপর থেকে দূর, বহুদূর পর্যন্ত দেখার সময় স্মৃতিগুলোও কেমন মায়াময় হয়ে ওঠে!

পাহাড়ে কি মানুষ আসে তাহলে নিচে, এক অনন্ত আকাশতলে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষদের জীবন-অভিযোজনে সুখ-দুঃখের ব্যঞ্জনার আড়ালে অনিত্যতাকে দেখে নেওয়ার জন্য? স্রষ্টাও কি একই উদ্দেশ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছেন? বিচিত্র সব প্রাণ আর প্রাণীর মাঝে মানুষকে লাগামহীন বিবেক-বুদ্ধি দিয়েও ‘সময়’ নামক এক যাযাবরের লাগামে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অনন্ত লীলা দেখে দেখে নিজের অসীম সময়কে উড়ে চলার পাখনা বানিয়েছেন? আমার নিজের কাছেই এই সব কোনো সম্ভাবনাকে খুব জুুতসই বলে মনেও হয় না। আবার কোনো ভাবনা যে একেবারেই অর্থহীন তা-ও মনে হয় না। সম্ভাবনাহীনতার মাঝে জীবনের যে উদ্দেশ্য, ডাক্তারি বিদ্যা পাঠের কারণে আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানে!

আমার দলের কারও মনে হয় ওপর-নিচ, এই জীবন আর তার অনিত্যতা- এসবে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। তারা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথবা তারা এত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত যে পাহাড়ের বিশ্রাম কক্ষের প্রশান্তি-কল্পনার তাড়নায় তারা দ্রুত পৌঁছাতে চাইছে পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু পেছনে ফেলে আসা সমতলভূমির দিকে তাকিয়ে কী এক নস্টালজিয়ায় আমার আর সামনে এগোতে ইচ্ছা করল না। মাটিতে হেলে পড়া একটা গাছের ডালে শরীর এলিয়ে কাঁধের থলে থেকে জলের বোতল বের করলাম। হ্যাঁ, তখনই দেখলাম তাকে। পড়ন্ত বেলায় সেই পাহাড়ের চাঁদ আমার পাশে আমার ভঙ্গিতেই তার শ্রান্ত শরীরকে বিশ্রামে নিল। জলের বোতলের মুখটা আর খোলা হলো না। কেন না, তার শরীর থেকে বনস্পতি আর আপেলের মিষ্টি ঘ্রাণটুকু আমার কাছে তখন এত মহার্ঘ্য যে, পিপাসার্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তের প্রচেষ্টার কারণে তা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি স্থির হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। তারপর জলের বোতলে চোখ পড়তেই পরক্ষণেই সেই হাসি তার মিলিয়ে গেল। তার চোখের নিচে, গলার কাছে ঘামের স্বেদবিন্দু যদিও আমার জলতেষ্টা দ্বিগুণ করে তুলল। তবু আমি মেয়েটার দিকে বোতল এগিয়ে বললাম, তুমি মনে হয় খুব পিপাসার্ত।

কোনো দ্বিধা এবং দ্বিরুক্তি ছাড়াই তরুণী আমার জলের বোতল হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে গলায় জল ঢালতে ঢালতে হঠাৎই থামল। ততক্ষণে আধা বোতল জল শেষ! আমার দিকে মিনতির চোখে তাকিয়ে সে বলল, সরি, আমি এত পিপাসার্ত যে, তার বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে আশ্বস্ত করলাম, ঠিক আছে, তোমার পিপাসা না মেটা পর্যন্ত তুমি জলটুকু খেতে পারো। তরুণী আমাকেও তুমি সম্বোধন করতে দ্বিধাহীন।
বলল, কিন্তু, তুমি-
আমার তেমন পিপাসা নেই, একটু আগেই আমি জলপান করেছি। এবার বোতলের বাকি জলটুকু মুখে চালিয়ে দেওয়ার আগে থেমে গিয়ে সে বলল, এখন বললে ‘জলপান’, তখন বললে ‘জল-খাওয়া’- মাথাটা তোমার পুরাই গেছে।
এবার ঢকঢক করে বাকি জলটুকু সে এত পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করল যে আমার খুব ইচ্ছা করল হাঁ করে জলপানরত তার মুখের ভেতর থেকে চঞ্চু দিয়ে একটু পানি দিয়ে আমার জিহ্বা ভিজিয়ে নিই। আহা, আমার মুখটা যদি এখন একটা পাখির ঠোঁট হয়ে যেত! জলপানের মাঝে জগতে এত বিস্ময় থাকে তা আমার জানা ছিল না। আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি বলতে কি, আমি এটুকু বলতে মোটেও লজ্জিত নই যে, আমি তার জলপানের দিকে নয়, তাকিয়ে আছি তার গোলাপি ঠোঁট হয়ে লাল টুকটুকে মুখগহ্বরের ভেতর। যেখানে জল পড়লেও তার আগুনটুকু নিভে যাচ্ছে না! কোনো নারীকে এত কাছ থেকে এমন করে দেখার জন্য এবার একটু লজ্জা পেলাম। মেয়েটা খালি বোতল আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, সত্যিই তোমার পিপাসা নেই তো? চার ঘণ্টা আগেই আমার সব পানি শেষ হয়েছে। কত মানুষের কাছে এক ঢোঁক জল চাইলাম। সবাই বলে যে তার পানি শেষ হয়ে গেছে- আর তুমি কিনা আস্ত এক বোতল পানি বাঁচিয়ে রেখেছ! তোমার বউ খুব ভাগ্যবতী হবে-
কেন? আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা এবার ডালের উঁচু অংশে গিয়ে বসল। পা দোলাতে দোলাতে বলল,
এই যে, তোমার এত ধৈর্য, সে জন্য। বাপ রে, পাহাড় যে কী বস্তু, আজ তা টের পাচ্ছি।
দেখলে তো এক বোতল পানি, এক ঢোঁকের বেলায় কেমন ‘জল’ হয়ে যায়!

আমার কথায় লাজুক ভঙ্গিতে চোখে আড়াল তুলে তবু মুগ্ধ হয়ে সে আমাকে দেখল। ঠিক তখন ভ্যাপসা গরমকে পাশ কেটে স্নিগ্ধ আর মিষ্টি বাতাস বয়ে গেল। না, তা আমার মনে শুধু নয়; শরীরে স্পষ্ট অনুভূত হলো। অপরূপা সেই ভঙ্গিমায় তখনো আমাকে দেখছিল। তার অপলক চাহনি আমাকে করাত দিয়ে কেটে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। আমি এক থেকে দুই, দুই থেকে চার এবং শেষে অযুত সংখ্যায় পরিণত হয়ে নিযুত অনু-পরমাণুতে মিশে গেলাম। মিশে গেলাম করতল হয়ে কপোলে, শরীর থেকে হৃদয়ে স্নিগ্ধ আবেশ তোলা সেই মিষ্টি হাওয়ার সঙ্গে। এবং আমি হাওয়ার পাখনায় নিজের পাখনা মেলে পাশের এই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তরুণীকে নিয়ে উড়ে চললাম নীল আকাশের শেষ সীমানায় যেখানে এক বিন্দু সাদা মেঘ একটা কুঁড়েঘরের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রবল পিপাসার বোধ আমাকে আবার অসীম থেকে নিযুতে ফিরে আনল। ফিরে আনল আমার এই একটা মানব শরীরে। পিপাসার্ত আমি পানির বোতলটার দিকে তাকালাম। তার তলানিতে কয়েক ফোঁটা জল। আহা, এটুকু জল দিয়েই যদি জিহ্বাটা একবার ভিজিয়ে নিতে পারতাম! তরুণী বোতলটার মুখ অ্যান্টি-ক্লক ঘুরিয়ে বন্ধ করে তবেই আমার হাতে ফেরত দিয়েছে। জলের ফোঁটাগুলোর দিকে একবার আর তরুণীর কাঁধে-গলায়, চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দুর মতো ঘামের দিকে কয়েকবার তাকালাম। মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের এক আধারকে ঈশ্বরবিন্দুর মতো কয়েক ফোঁটা পবিত্র শিশির আঁকড়ে আছে। জলপিপাসার চেয়ে তা হৃদয়পিপাসা এত বাড়াল! বোতলের জল খেয়ে যত না বাঁচতে ইচ্ছা করল, কেন যেন মেয়েটাকে ভালোবেসে তার চেয়েও বেশি মরে যেতে ইচ্ছা করল। সারা জীবন পড়েছি, শিখেছি- বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আর কিছুই নয়। কিন্তু আজ আমি এই প্রথম জানলাম, মরে যাওয়ার কোনো এমন কারণ পৃথিবীতে থাকতে পারে যার জন্য মরে যাওয়ার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো বড় শিল্পময় আনন্দ আর হয় না। আমি মরে গিয়ে তার গলগণ্ডের টিলায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নীলজলের খালের মতো চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দু হয়ে থাকতে চাই। যদি সে আমাকে তার লম্বা আঙুলের অধিকারী হাত-বাহুতে একবার জড়িয়ে নেয়, তাহলে জীবনভর কল্পনা করা স্বপ্ন নামের সব পিপাসা; সত্যি নিমেষেই মিটে যেত।

এবার মেয়েটা তার হাতের নিকষ-কালো বিড়ালের চোখের মতো ঘড়িটায় চোখ রেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওপরের দিকে তাকাল এবং কাউকে কোথাও না দেখে বলল, আমার দলের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ওরা মনে হয় এতক্ষণে অবকাশকেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।
না, উঁচুতে দূরের বস্তুকেও অনেক কাছের বলে মনে হয়। আমার দলও নিশ্চয়ই এখনো পৌঁছায়নি।
জানো, আমার সারাজীবন ইচ্ছা করত-
আমি আমার আগ্রহ ধরে রাখতে পারছিলাম না। অধৈর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী ইচ্ছা করত?
কোনো একদিন এমন আকাশ-মেঘের কাছে, সবুজ ঘাস-গালিচার পরিচ্ছন্ন এক পাহাড়ে একটা কুঁড়েঘর পেলে সেখানেই থেকে যেতেÑ
মেয়েটার কথায় কী হলো আমি জানি না। তাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো এক কুঁড়েঘর খোঁজার ইচ্ছা মনে হয় প্রবল হলো। কিন্তু পিপাসায় ছটফট করা শরীর এই ইচ্ছার ভার সইতে পারল না। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

২

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি এক কুঁড়েঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে বাঁশের তৈরি এক ছোট্ট ঝাঁপির ওপর যে অদ্ভুত মাটির প্রদীপ। আমার মুখের দিকে ঝুঁকে থাকা নারীর আলোময় বিভাকে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন প্রদীপের সামান্য আলোর ইচ্ছা। আকাশ-পাহাড়ে এক কুঁড়েঘরে নেমে আসা পূর্ণিমার চাঁদ আমার হৃদয়কে ঝলসে দিল। বেড়ার ঘরের ফাঁক দিয়ে দূরদিগন্তে ছড়িয়ে পড়া জোছনায় রহস্যময় পাহাড়ি প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে মায়ার কুহেলিকা। আমি অপরূপার দিকে তাকালাম। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
বড্ড ভয় পেয়েছিলাম। তুমি ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, বুঝিনি। তোমার মুখ খুলে পানি দিতে গিয়ে বুঝলাম, আমার কারণেই তুমি মরতে বসেছিলেÑ
আমি তাকে বলতে চাইলাম, না, না বরং তোমার জন্য আমি নতুন করে বাঁচলাম। এমনই এক জীবন সব সময় কল্পনা করেছিলাম। আকাশ-মেঘের কাছে বাইরে জোছনার রূপালি আস্তরণ আর ভেতরে এক মাটির প্রদীপের পাশে তোমার মতো আকাশ থেকে নেমে আসা এক চাঁদপরি!

কিছুই বলা হলো না। আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলেই চলছে, তোমার এত পিপাসা ছিল অথচ তুমি কিনা সব পানি আমাকে পান করালে। শোনো বোকা, মেয়েরা নিজের প্রয়োজন ঠিক বোঝে। তুমি কেন তোমারটা বুঝলে না?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব জানি না। তাকে আবার বলতে চাইলাম, আমি তো আসলে এভাবে মরার আনন্দেই মেতে উঠতে চেয়েছিলাম। এই পাহাড়ে আমার সঙ্গে কীভাবে তুমিও দলচ্যুত হলে তা ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিল ঈশ্বর নিশ্চয়ই কেউ আছেন। না হলে এই পাহাড়ের আত্মা কীভাবে সারাজীবন লালিত আমার মনের কথাকে এখানে উসকেই শুধু দিল না, সত্যিও করল।

কিন্তু আমার ভেতরের এত কথা সব কথার কাঁপন হয়ে ভেতরেই রয়ে গেল। সে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি কথা বলতে ভুলে গেছ? কিছু মনে পরছে না?
আমি মায়াভরে তার দিকে তাকালাম। তার একটা আঙুল স্পর্শ করতেই তুমুলভাবে আবার বেঁচে উঠলাম। বললাম, আমি আর অতীত মনে করতে চাই না। আজ থেকে যদি আমার অনন্ত জীবন শুরু হতো! পেছনে ফেলে আসা জীবন নয়, শুধু সামনে থাকবে পাহাড়ি এই অবারিত দিগন্ত আর-

এতক্ষণে মনে পড়ল ওর নামটাও আমার জানা হয়নি। ওর নামটা জানার জন্য অস্থির হয়ে তার চোখে চোখ রাখলাম। তার নীল-কালো অক্ষিগোলক আমাকে নিবিরভাবে দেখার সঙ্গে আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যেন আমার কথার অর্থটুকু বোঝার চেষ্টা করছে। ধীর গতিতে একটা শব্দের দুই অক্ষর তার ঠোঁটে খেলা করল, আর? তার প্রশ্নে দ্বিধাহীন হয়ে তাকে বললাম, তুমি এবং তোমার আকাশ-মেঘের কাছে একটা কুঁঁড়েঘর! কিন্তু দেখো, তোমার নাম, জন্মস্থান কিছুই আমার জানা হয়নি।

আমি ইয়াগমুর মার্ভি। তুমি আমাকে মার্ভি বলেই ডেকো। আমার জন্ম সেখানে যেখানে দুই মহাদেশ মিলেছে এক বিন্দুতে। আমার জন্মস্থান বিশ্বের সেই বিন্দুতে যেখানে মাঝে মাঝে বরফ দিনের সূর্য আর রাতে চাঁদের আলোর সঙ্গে খেলা করে।
অমন সৌন্দর্যের মাঝে তোমার দেশের মানুষ চিত্রকর্ম, সুর, আর গানের মাঝে তলিয়ে গিয়ে জীবনের অর্থটুকু বেশি খুঁজে পায়, না?
তা তো হবার নয়। এই বিশ্বের সব প্রান্তেমানুষ এখন মানুষকে নিয়েই ব্যবসার ফন্দি আঁটতে গিয়ে আত্মার সব সৌন্দর্য হারিয়েছে। তোমার এখন কি একটু ভালো লাগছে।

লাগছে। খুব লাগছে। কিন্তু আমাকে এখানে-
হ্যাঁ, তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে। বেলা ডুবে যাচ্ছিল। আমি চিৎকার করে সাহায্য চাইলাম। এই পাহাড়ের একজন বাসিন্দা দুইদিন আগে বাজার করতে সমতলে গিয়েছিলেন। তিনি ঘরে ফিরছিলেন। তার কাছ থেকে জল নিয়ে তোমার মুখে ঢাললাম। তারপর আমার দলের গন্তব্য বাদ দিয়ে এখন আমরা তারই বানানো বিশ্রাম-কক্ষে। অতিথিদের ভাড়া দেওয়ার জন্য এমন নির্জনে তিনি ভাগ্যিস ঘরটা বানিয়েছিলেন। ঘরটার নাম দিয়েছেন তিনি জুমঘর।
কী আশ্চর্য! মনে হচ্ছিল, কোনো এক চলচ্চিত্রের নায়িকার কাছ থেকে তারই মাত্র সম্পন্ন করা অভিনয়ের একটা পর্বের গল্প শুনছি এবং সেই নায়িকার নায়কটাকে ভাবতে গিয়ে আমার হৃৎস্পন্দন এত দ্রুত হলো যে, আমি ঘেমে উঠলাম।
অনেকেই নাকি পৃথিবীর মনুষ্য-জগৎ পালিয়ে থেকে নিরিবিলি আর নির্জনে ‘জুমঘর’ নামের এই প্রশান্তির নিবাসে আসে।
মানুষের কাছ থেকে মানুষ কি আসলে পালায়?
-না
তাহলে?
যে মানুষের সঙ্গে এই জুমঘরে কেউ কয়েকদিন বাস করে তারা আসলে একে অন্যকে আবিস্কার করে। খুঁজে ফিরে। প্রিয় মানুষকে আবিস্কার করে তার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ কি আর আছে, বলো?

মার্ভি নামের স্বর্গের এক পরির মুখে জীবনবোধের অথবা দর্শনের কথা শোনার চেয়ে তার চোখে চেয়ে তা উপলব্ধি করাতেই চেয়ে যে বেশি প্রশান্তি তা জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। তার কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে তাই তার চোখের দিকে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে তার কপাল হয়ে কানের পাশে বিস্রস্ত বিন্যাসের কেশের লালিত্যে তাকিয়ে আমি কত কী যে কল্পনা করলাম। তাকে নিয়ে কত কত রঙিন জীবন এক নিমিষেই পার করে দিলাম। মার্ভিকে বলতে চাইলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ বলা হলো না। কেন যেন ভয় হয়।

এমন এক রাষ্ট্রে আমার যৌবন শুরু হয়েছে, যেখানে মানুষ স্বপ্নের চেয়ে তার পতনবিন্দুকে আগাম দেখার অভ্যাসে আমরা অভ্যস্ত। স্বার্থের কারণে একে-অন্যকে দোষারোপ এবং গুম হয়ে যাওয়ার এক অনিশ্চিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হলে মনে হয় এমনই হয়! তাকে পাওয়ার আগে তাই তাকে হারানোর ভয়ে মনে হয় ভিতরে কেমন এক আন্দোলন শুরু হয়েছে। মার্ভি উঠে গেল। জুমঘরের মালিকসহ একটু পরে ঘরে ঢুকল। মালিকের পুত্র-কন্যা গরম খাবার নিয়ে তাদের পেছনে এসে দাঁড়াল। পাশের উঁচু মাচাতে তারা পর পর খাবারগুলো সাজিয়ে রাখল। আমার মরে যাওয়া খিদে পুনর্বার চনমনে হয়ে উঠল। মার্ভি আমার হাত ধরে উঠাল। তার প্রয়োজন ছিল না। তবু, মার্ভির হাত ধরার ইচ্ছায় এই দুর্বলতার ভানটুকু নিজের কাছেই মহার্ঘ্য মনে হলো।

পরম তৃপ্তিতে দুজন খেলাম পেটপুরে। তারপর কুঁড়েঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। পাহাড়ের প্রান্তে কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অন্য একটা দেশের আরো উঁচু উঁচু পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসেও আমার সব মনোযোগ বস্তুত মার্ভির দিকে। চাঁদের আলোয় নিচে নেমে আসা আকাশের নীলের সঙ্গে ফিসফিস কথোপকথনের অন্তরালে গাঢ় প্রেমে মেতে ওঠা পাহাড়ি প্রকৃতির প্রেম-নিবেদনের কৌশল থেকে মার্ভির প্রতিনিজের প্রেম নিবেদনের ধরণ কেমন হবে তা ভাবছি। প্রাণ-মন শীতল করেও শরীরে প্রেমের অনল ছড়ানো, নয়নে স্বপ্নের বান ডাকা ঝির ঝির বাতাস ঘাসে-পাতায় শিরশির শিহরন তোলার তালে আমাকেই কি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে? যাই-ই করুক পাতার শব্দ কেন মর্মর তা আজ আমি আত্মার অনুরনণে অনুভব করছি। জোছনার ডানা মেলা পাহাড়ের এমন প্রান্তর কি এটা? নাকি আমার মৃত্যুর পর স্রষ্টা আমাকে স্বর্গে পাঠিয়েছেন?

মার্ভিই আমার হাত ধরল। শরীর ঘেঁষে নিবিড় হতেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ প্রেমানল হয়ে আমাকে পোড়াল। দ্বিধা ভেঙে আমি মার্ভিকে বাহুলগ্না করলাম। মার্ভির ত্বক আর চুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে যেন পাহাড়ের প্রতিটি ঘাস-গুল্মের প্রাণ হয়ে চিরহরিৎ পাতার অনুতে, আকাশের নীল থেকে বাতাসের ছুটে চলা পথের বাঁকে বাঁকে।

মার্ভি আমাকে জড়িয়ে ধরল। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বিভাময় মুখশ্রী ছাড়া সমগ্র বিশ্বে আর কিছুই যেন সত্যি নয়। আমি বাঁধনহীন হয়ে উঠতে চাওয়ার আগেই সে তাঁর ঠোঁটের স্পর্শে আমার সব স্বপ্নকে একসঙ্গে তোলপাড় অনুভূতির সঙ্গে তলিয়ে নিল। এবার শুধু মুখশ্রী নয়, মার্ভি তার নিজের আলো ছড়িয়ে পাহাড়ের এই রাতকে ঝলসে দিতে তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। খোলামেলা স্থানবলে আমি দ্বিধান্বিত হলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এক বিদেশিনীকে নিয়ে এই পাহাড়ে আমি! কয়েকদিনের মধ্যে পত্র-পত্রিকা যদি তার ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নিয়ে খবর ছড়ায়? ভেবে আমি শিহরিত আর চিন্তিত হয়ে উঠলাম। মার্ভির হাতে তখন আমার টি-শার্ট। সে বলল, তুমি আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের সবচেয়ে প্রিয় সেন্টটা নিজের শরীরে মেখে আমার সর্বনাশ করেছ!

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণযুক্ত পৃথিবীখ্যাত এক সুগন্ধির সঙ্গে টি-শার্টটা আমার মামা লন্ডন থেকে ফেরার সময় আমার জন্য এনেছিলেন। বিয়ের জন্য দেশে আসার তিন মাসের মাথায় আমার মামাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিয়ের পরপরই মামি বিধবা হয়েছেন। প্রিয় ভাইয়ের অন্তর্ধানে আমার মা পাগলপ্রায়। আমার কিছু হলে মাকে আর হয়তো বাঁচানোই যাবে না। এ ভাবনা আমার উদ্বিগ্নতা এত বাড়িয়ে তুলল যে আমি ‘ভালোবাসা’সংক্রান্ত সব অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। অথচ মার্ভির উদ্ভিন্ন, বুনো সৌন্দর্য দেখে তখন প্রকৃতিও এত মাতাল হয়ে উঠেছে যে, বাতাসের এলোমেলো দিক পরিবর্তন মার্ভির ছোট করে রাখা কেশগুচ্ছেও উন্মাতাল। মার্ভি ছোট বেঞ্চটায় আমাকে ততক্ষণে শুইয়ে দিয়েছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে তার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করলাম। সে আঙুলটা কামড়ে দিল। উন্মত্ত হওয়ার পরিবর্তে আমি আরও শান্ত হয়ে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করলাম। সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে অনেকক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ফিসফিস করে বলল, এই-ই আমার প্রথম ছিল এবং আমি যতদূর জানি, ছেলেদের জীবনে ‘পিরিয়ড’ বলে কোনো শব্দ নেই।

আমি তার চুলে বেণি কাটলাম। উদ্বিগ্ন একজন মানুষের স্পর্শ মার্ভির কাছে প্রেমিকের চেয়ে মনে হয় পিতার স্পর্শের মতোই লাগল। সে তবু প্রশ্ন করল, ভদ্রছেলে! বাইরে অস্বস্তি বোধ করছ? ঘরে চলো। কিন্তু সারাজীবন ধরে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, পণ করেছিলাম যে, পাহাড়ে-জোছনায় এমন নির্জনে প্রিয় কাউকে যদি কখনো পাই তাহলে তার কাছেই অবারিত হয়ে যাব।

কথাগুলো বলে মার্ভি অবাক বিস্ময়ে চতুর্দিকে এমন করে তাকাল যেন সে একজন স্রষ্টাকে তার চোখ খুঁজছে। সে আবার বলেই চলল, কী আশ্চর্য, আমার চাওয়া স্রষ্টা এভাবে মিলিয়ে দিলেন! ঠিক আমার কল্পনার ছকে ছকে। নিজের মাঝে সযত্নে লালিত আমার আলোটুকু বিলিয়ে দেওয়ার জন্য এই রাতের এই লগ্নের মতো আর কোনো লগ্ন উত্তম হতে পারে না। এবং আমার জন্য আজকের সব ঘটনা এবং এমন পাহাড়ি রাত স্রষ্টার ইঙ্গিতেই নির্ধারিত হয়েছে বলে তোমার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে চাই।

একজন প্রাণবন্ত মানুষ হঠাৎ নাই হয়ে গেলে এবং তার বেঁচে না থাকার পরও লাশটুকুও পাওয়া না গেলে এক পরিবারের সদস্যদের কেমন অনুভূতি হয় তা মার্ভিকে কীভাবে বোঝাই। আমার ভেতরের উদ্বিগ্নতার কথা তার কাছে গোপন করলাম। মিষ্টি হেসে বললাম, আমি তোমাকে পেতে চাই নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।
মানে?
এত সহজে স্বর্গের অপ্সরাকে পেলে যদি তাকে অবমূল্যায়ন করি কখনো। ইউ আর ভেরি এক্সপেনসিভ মার্ভি।

খুলে ফেলা পোশাকগুলো শরীরে সামলে নিয়ে উঠে বসল সে। খুলে দেওয়া ঘন চুলগুচ্ছকে বেঁধে নিয়ে বলল, আই’ম স্যরি! বলে সে মাথা নত করল। আমি বুঝলাম, ভেতরের উদ্্গীরিত লার্ভাকে সে তখনো সামলাতে পারেনি। তার মুখে ‘স্যরি’ শব্দটুকু তার উদ্্গীরিত অনলের জন্য জল হয়ে উঠল তাও বুঝলাম। উঠে বসে তাকে ধরতে গেলেও সে নিজেকে আর ধরতে দিল না। ক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে সে দ্রুত বেঞ্চির এক প্রান্তে গিয়ে বলল, ফার্স্ট বি এক্সপেনসিভ ফর মি। আই’ম ভেরি এক্সপেন্সিভ। কিছুক্ষণ আমার চুপচাপ কেটে গেল। একসময় মৃদু স্বরে মার্ভি বলল, ঈশ্বর আর মানুষের ভালোবাসার কত তফাত। তিনি ভালোবাসার জন্য এই বিশ্বকে এমন অবারিত করে সাজিয়েও মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলেন না এত অপরাধ করার মতো, ষড়যন্ত্র করার মতো এবং তা প্রতিকারে কানুন তৈরি এবং তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার মতো সময় তিনি মানুষকে দেননি!

কথাটা বলেই সে দ্রুত পদেই ঘরে চলে গেল। প্রদীপ নিভিয়ে দিল এবং দুই বিছানার মধ্যে একক বিছানায় শুয়ে কাঁথা দিয়ে শরীর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল কি জেগেই থাকল তা আর জানা হলো না।

৩

পরের সারাটা দিন আমাদের কাটল আশপাশের পাহাড়ে ঘুরে। পাহাড়ি ফল সংগ্রহ করে এবং ঝরনায় গোসল করে। দুপুরের খাবার আমি তাকে মুখে তুলে তুলে খাওয়ালে সে কৃতজ্ঞতা আর গভীর মায়ার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা খুবই সত্যি, ঈশ্বর আর শয়তানের ভালোবাসায় অনেক পার্থক্য। তুমি অনেক ভালো।

আমি মার্ভিকে বারবার আমার মুগ্ধতা আর ভালোবাসার কথা জানালাম। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। সে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছুই না বলে বারবার আমাকেও মনে করিয়ে দিল এক্সপেন্সিভ কিছু পেতে হয় না, তা অর্জন করতে হয়।

রাত নেমে এলে আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। মার্ভি তার ঠোঁট পর্যন্ত বাধা না দিলেও আমি উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। সে আলতো ভঙ্গিতে একসময় আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে শান্ত হতে বলল। সে আমাকে যতই শান্ত হতে বলল, ততই তাকে পাওয়ার জন্য আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকল। পরিশেষে আমার আগ্নেয়গিরির লার্ভাসম অনল নিভে গেল তার একটা বাক্যে,
আজ রাতে নয়। আই’ম স্যরি।
কবে তাহলে?
কয়েক দিন পর। ছেলেদের না হলেও মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ শব্দটার ভেতর দিয়ে যেতে হয় তো। বাক্য দুটি বলার তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। সে পুনরায় বলল, সময় বলো, স্রষ্টা বলো তারা চেয়েছিলেন বলে আমি অবারিত হয়েছিলাম। তবে সময়ের ইঙ্গিতে আমাদের সংকুচিত হতেই হয়।
পরদিন দুপুর হওয়ার আগেই আমি কুঁড়েঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত গত বছরের একটা দেয়ালপঞ্জিতে চোখ রেখে সময়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে তারিখ লেখা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে উঠলাম। মার্ভিকে নিয়ে ঝরনায় গোসলের চেয়ে তারিখ নামের বস্তুটার চলে যাওয়ার দিকে আগ্রহ তখন আমার রক্তে পাহাড়ের বুনো গন্ধের মতো উন্মাতাল।

কিন্তু রক্তের এই ডাক দেয়ালপঞ্জির তিনটা দিন অতিক্রম করতে না করতেই ঘাম ঝরিয়ে শীতল হয়ে এল। তিন দিনের মাথায় মার্ভির দলের ঘর্মাক্ত সদস্যরা আরও ঘামে জবুথবু পুলিশের সঙ্গে এই পাহাড়ে এসে হাজির হলো। পাহাড়ের নিচু ঢালে আড়াল নিয়ে তারা কলস্বরে মার্ভিকে ডাকল। পুলিশের সদস্যরা তাদেরও পেছনে এমন ভঙ্গিতে গোলাগুলির শায়িত অবস্থান নিয়েছে যেন মার্ভিকে একজন মাফিয়া হাইজ্যাক করে এখানে এনেছে এবং কাছাকাছি হলেই যে হাইজ্যাকার একে-৪৭ বের করে গোলাগুলি শুরু করতে প্রস্তুত। তাদের কার্যকলাপ জানালার ফাঁক দিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। একজন নারী কণ্ঠের চিকন চিৎকার আমার রক্ত হিম করে দিল,
মার্ভি আমরা জানি তুমি এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে এখানেই অবস্থান করছ। সামরিক হেলিকপ্টার তোমাদের গতিবিধি সব দেখেছে। শয়তানটাকে সমর্পণ করতে বলো। তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে সে কোনোভাবেই বাঁচবে না।
সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে রিকোনাইসেন্স করে মার্ভির অবস্থান কখন বের করে ফেলেছে নিজেদের মধ্যে আমরা এত ডুবে ছিলাম, ডুবে ছিলাম একে অন্যের চোখের মমতামাখা নিমেষহীন চাহনির মাঝে যে, আমরা ওসবের কিছুই টের পাইনি। আমি কেন হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠি এমন প্রশ্নের উত্তরে মার্ভিকে তার রহস্যও পরিশেষে বলেছিলাম। সে জন্যই পুলিশ দেখে মার্ভি হয়তো ভয় পেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘দেশ’ কখনোই ‘স্বাধীন’ হয় না যতক্ষণ না সে দেশের মানুষের আত্মা ‘পরাধীন’ থাকে। আমি চাই না, ওরা তোমার অবস্থান জানুক। টয়লেটের দরজা দিয়ে পেছনের দিকে পালিয়ে যাও। ভালো থেকো। যত্ন নিয়ো নিজের। চলে গেলেও আমি থেকে যাব এই জোছনার আলোধোয়া পাহাড়ি প্রকৃতিতে। তোমাকে আমি মনে রাখব এই পাহাড়ের ঈশ্বর হিসেবে। মনে রেখো।

মার্ভি ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। একটু থেমে কিছুই না বোঝার ভান করে, যেন সে প্রশান্তির ঘুম থেকে উঠে নিজের মানুষদের দেখে আনন্দিত এমন উদ্বেগহীন গতি নিয়ে সামনে এগুলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার থেকে যত দূরত্ব বাড়াল আমি ততই ক্ষুদ্র এই জীবনের অর্থবহতার মাঝে অর্থহীনতার সব আয়োজনকে আলিঙ্গন করলাম।

আমার দলের লোকগুলো আমাকে আর খুঁজতেও এলো না। গুম হওয়া সংস্কৃতি একবার চালু হলে এবং তা নিয়ে কথা বলার ভয় যে সমাজে তৈরি হয় সে সমাজ মানুষ তো আর হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে হারানোর পরিস্থিতি তৈরি করবে না।

মার্ভি চলে গেলে পাহাড়ি এই অনাড়ম্বর অবকাশকেন্দ্রের মালিক এসে আমার হাত ধরে বলল, তুমি যে গেলে না, বাবু? তোমরা পালিয়ে এসেছিলে, তাই না? আমার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি অস্থির হয়ে বললেন, মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হেঁটে বিকেলের আগেই আমরা গঞ্জে পৌঁছাতে পারি। ওখানে তোমার জন্য একটা চেম্বার রাখব।

৪

দিন দিন রোগী আসে। রোগী ফিরে যায়। থেকে যায় একজন ডাক্তার। পাহাড়ের চাঁদের দিকে মুগ্ধ তাকিয়ে চাঁদটার সঙ্গে কী সব কথা বলে যায় সে। প্রদীপের আলোয় পেনসিল স্কেচে সে মার্ভির শরীরে চাঁদের আলো পরিয়ে দিতে গিয়ে উল্টো জোছনার আলোতে মার্ভির ত্বকের লাবণ্য ছড়িয়ে দেয়। তারপর সেই বিমূর্ত শরীরকে ধরতে গিয়ে তার মনে পড়ে তার প্রেমে পড়া বারণ! সে মার্ভির কণ্ঠস্বর আঁকে। ঝরনায় গোসলের সময় দুজনের উচ্ছলতার আনন্দ আঁকে। আঁকে কলকল ধ্বনি। মার্ভির সুন্দর আঙুলগুলো ছুঁতে গিয়ে সে থমকে যায় আবদ্ধ চেতনা দিয়ে অমন সুন্দর এবং অবারিত স্বাধীনতার প্রতীক আঙুলগুলো তো ছুঁতে নেই।

পৃথিবীর আর কেউ জানল না, যার প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ তারই প্রেমে একজন ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করা মানুষ, পাশের ঝরনায় ক্ষণে ক্ষণে চাঁদের আলো ভেবে সেই নারীকে খুঁজে খুঁজে ছুঁয়ে দেয় বস্তুত নুড়ি-পাথরের হৃদয়। শুধু অনিন্দ্যে নিসর্গের পাহাড়গুলো হাজার বছর পর জেনে গেল একজন ডাক্তার মানুষের শরীর বুঝলেও, একজন শিল্পী কেন এবং কীভাবে আত্মা আর সত্তাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজের আত্মাকে মিলিয়ে দেয় ব্রহ্মাণ্ডের ঝিঁঝি পোকার কলতান তুলে ডেকে যাওয়া অযুত সত্তার সঙ্গে!

অলংকরণ: শাহরিন 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

চায়না জার – ইশরাত জাহান ঊর্মি

করেছে Wazedur Rahman এপ্রিল ১, ২০২০

ইশতিয়াকের কথা

শোনো তৃষা, আমার খুব জানার ইচ্ছা তোমার কিসের এত অহংকার? অথবা এত এত অবহেলা তুমি আমাকে করার সাহস কী করে পাও? অথবা তুমি খুব দুঃখী? কেন? তোমাকে কী দিইনি আমি? আমার থেকে কী দুঃখ তুমি পেয়েছ বলো? আমি প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে এই কথাগুলোই ভাবি। ফ্রি থাকলেই ভাবি। ভাবি আর আহত হই। আমার আহত মুখ, আহত ভেতরটা তোমাকে কখনো পোড়ায় না। আমি অবশ্য সব সময় আহত মুখ দেখিয়ে বেড়াই না। বউয়ের আঁচল ধরা পাওনি আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে থাকা কি পুরুষের জন্য খুব সম্মানের? আমি তো তোমার কোনো অভাব রাখিনি!

তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আমার। আমাদের পরিবারের সবার। তুমি অনিন্দ্যসুন্দরী। পড়ালেখায় ভালো, সভ্য। আমার বাবা-মা, ভাইবোন, চাচা, ফুফু-খালা সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করল। তুমিও সবাইকে খুব ভালোবাসলে। সবাইকে আপন করে নিলে। আমাকেও তোমাদের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে। এখনো তোমাদের বাড়িতে মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে সবাই যতটা সম্মান কওে, তা এমনি এমনি আসেনি। তা আমি অর্জন করেছি। তোমার বাবা-মাকে আমি ঠিক ততটাই সম্মান-শ্রদ্ধা করি, যেমনটা ওরা আমাকে ভালোবাসে। কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু দিন গেল আর তুমি আমার থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে। আমি অনেক ভেবেও এর কোনো কারণ খুঁজে পাই না। ছোটখাটো সমস্যা স্বামী-স্ত্রীতে হয়। পৃথিবীর সব স্বামী-স্ত্রীতেই হয়। কাদের মধ্যে হয় না? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী কি সুখী ছিলেন? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম আমি জানি না কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা কি স্বীকার করতেন যে রবিঠাকুর খুব রোমান্টিক ছিলেন? জগৎজোড়া রোমান্টিসিজমের জন্য বিখ্যাত কবি তো শুনেছি তার বৌদির সঙ্গে পরকীয়া করতেন! বেশি রোমান্টিক পুরুষেরা এমনই হয়। আমি জানি আমার প্রতি তোমার অভিযোগ আছে যে আমি রোমান্টিক নই। আমি সত্যি, অত সব ইয়ে জানি না। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি তৃষা। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকেই ভালোবাসি না।

হ্যাঁ, আমার একটু রাগ বেশি। রেগে গিয়ে হয়তো অনেক সময় উল্টোপাল্টা বলি। কিন্তু সেটা কি আমার মনের কথা? বলে কি আমি নিজে শান্তি পাই? তোমার সঙ্গে ঝগড়া হলেই কি আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের ওপর প্রতিশোধ নিই না? আমার একটা সমস্যা আছে, আমি সহজে সরি বলতে পারি না। সে তো আমি আমার মাকেও বলি না। মাকে কি আমি কম কড়া কথা বলি? কই মা তো তোমার মতো রাগ করে, অহংকার দেখিয়ে দূরে থাকে না। তাহলে তুমি কেন পারো না? মা যদি পাওে, তুমি কেন পারো না তৃষা? আমি তোমার সঙ্গে কী করেছি বলো তো? কোনো দিন তোমার গায়ে হাত তুলেছি? আমি কেন, আমার চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ বউ পেটায়নি।

তোমাকে কোনো দিন রাগ করে বলেছি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও? কত শিক্ষিত লোকই তো শুনি বউকে খানকি বেশ্যা বলে গালি দেয়, আমি কোনো দিন এসব বলেছি তোমাকে? যখনই রাগারাগি করে দু-একটা গালি দিয়েছি, রাগ পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সরি না বললেও তোমার মন রাখতে নানান চেষ্টা করেছি। তুমি শাড়ি খুব পছন্দ করো, আমি রাগ ভাঙলেই টুক করে শাড়ি কিনে তোমাকে দিয়েছি। তুমি কোনো দিন হাসিমুখে সে উপহার গ্রহণ করোনি তৃষা। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেছি। তোমার কোনো অভাব-অভিযোগ রাখিনি। তোমাকে এত বড় বাড়িটা দিয়েছি। মা-বাবা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, তবু একটা ফ্ল্যাট আমি তোমার নামে করেছি, বলেছি ফ্ল্যাটের ভাড়া তুমিই তুলবে, তোমার মতো করে খরচ করবে।

তুমি হিসাবে খুব কাঁচা, তাই মাঝেমধ্যে হিসাবটা চেয়েছি। সে তো তোমার ভালোর জন্যই। আমার যা কিছু সম্পদ তা তো তুমিই ভোগ করবে। তাই তোমার বেহিসাবি স্বভাব মাঝেমধ্যে আমাকে চিন্তায় ফেললে আমি হিসাব চেয়েছি, এর বেশি কিছু না। একটা লাল রঙের গাড়ি আমি তোমার জন্য দিয়ে রখেছি। সর্বক্ষণ। মাকেও গাড়ি নিতে হলে আমার অনুমতি নিতে হয়, তোমার জন্য একজন ড্রাইভার বরাদ্দ রেখেছি। তৃষা, আমি একজন সুস্থ-সবল পুরুষ। আর কোনো নারীর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু ঠিক কত দিন তোমার-আমার মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই, সেটা কি তোমার মনে আছে? হ্যাঁ, আমি সেক্স লাইফের কথাই বলছি। তুমি আমার সঙ্গে শোও না।

আমি অন্য পুরুষদের মতো জানোয়ার নই যে তোমার ওপর জোর খাটাব, জোর করে স্ত্রী ধর্ষণ করব। কিন্তু কেন তুমি এত শীতল তৃষা? আমি কি তোমাকে তৃপ্ত করতে পারি না? আমি মনোচিকিৎসকের সঙ্গে গোপনে কথা বলেছি তোমার এই শীতলতা নিয়ে। ডাক্তার বললেন, তুমি আর কারও সঙ্গে এনগেজ কি না খোঁজ নিতে। খোঁজ নিয়েছি। তেমন কিছু পাইনি। তবে ঠিক কি হয়েছে তৃষা তুমি আমাকে বলবে? বিয়ের ছয় বছর কেটে গেল, বাড়ির সবাই এত চাপ দিচ্ছে বাচ্চা নেওয়ার জন্য অথচ তুমি বাচ্চা নেবে না। আমি কী করেছি তুমি আমাকে বলবে প্লিজ? তৃষা, আমার কোমল হৃদয় ভেঙো না। ডোন্ট ব্রেক মাই চায়না জার তৃষা। ডোন্ট ব্রেক।

তৃষার কথা

ইশতিয়াক, বিয়ের দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিন আমার ঠিক মনে নেই। তখনো রিসেপশনের অনুষ্ঠান হয়নি। রিসেপশনের পরদিন আমরা নেপাল যাব। হানিমুনে। আমি কী খুশি! নতুন পেয়েছি না হলেও শখানেক শাড়ি। শাড়ি-গয়না পরে নতুন বউ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের বাড়ি থেকে আমার মা একটা দশ-বারো বছরের মেয়েকে দিয়েছিল আমার ফাই-ফরমাশ খাটতে। মেয়েটা এসেই কান্নাকাটি। গ্রামের মেয়েদের যা হয় আরকি। এ বাড়ির যতই চাকচিক্য থাকুক না কেন, সে বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। বিয়েবাড়ির সবাই খুব বিরক্ত। তুমিসহ তোমার বাড়ির কেউ মেয়েটার সঙ্গে আদর করে কথা বললে না। আমার অলংকারের ঝনঝন শব্দের ভেতরেও একটু যেন কাঁটা মিশে রইল। এর মধ্যেই মেয়েটা হাত থেকে অসাবধানে ফেলে একটা তরকারির বাটি ভেঙে ফেলল।

সাধারণ তরকারির বাটি। তোমার মা মেয়েটার কান বরাবর সপাটে চড় লাগালেন। তুমি কিছুই বললে না, যেন কিছুই হয়নি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুপুরে তোমরা আমাকে খুব যত্ন করে খাওয়ালে। আস্ত মুরগির রোস্ট, সেই মুরগির পেটে মসলা মাখানো ডিম। আমি কোনো খাবারের স্বাদ পেলাম না। আমরা পরদিন নেপাল গেলাম। প্লেনে আমার কানে ফিসফিসিয়ে কত কী বললে তুমি। আমার কিন্তু কিছুই ভালো লাগল না। বারবার শাপলা মানে ওই মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। না আমি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্রের মৃণালিনীর মতো সাহসী নই। তাই শাপলাও আমাকে মৃণালিনীর মতো ঘরের বাহির করেনি। কিন্তু বিয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকেই কানের নিচে একটা চড়ের অপমান নিয়ে আমি সংসার শুরু করলাম।

এরপর কত দিন গেছে। কখনো কখনো ঝগড়ার পর শান্তভাবে আমরা কথা বলতে শুরু করলে অনেকবার শাপলার ঘটনাটায় যে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, তা বলার চেষ্টা করেছি। তুমি হেসে উড়িয়ে দাও। বলো, কবে কোন কাজের মেয়েকে কী বলা হয়েছে সেইটা তুমি ধরে বসে আছো? ইশতিয়াক, সমাজসংসারের বিচারে তুমি খুবই ভালো মানুষ। আমাকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছ। আত্মীয়স্বজন সবাই আমার ভাগ্যে আনন্দিত, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত। টাকাপয়সার অভাব নেই, বিলাসী জীবনযাপন করি। সবাই বলে, তৃষার তো অমনই হওয়ার কথা ছিল, অত সুন্দরী। কিন্তু তোমার এই সব ‘দেওয়া’র ভেতরে আমি একটা বৃত্ত টের পাই।

আমি জানি কতটুকু আমার সীমা, আমি জানি আমার স্বাধীনতা তোমার পকেটে। তুমি মোটা দাগে খুব ভালো মানুষ। আমি ছাড়া কোনো নারীর প্রতি তোমার কোনো আসক্তি নেই। কিন্তু ধরো কোনো দিন আমরা একসঙ্গে একটা সিনেমা দেখিনি, কোনো দিন একটা কবিতা পড়িনি। তোমার এসব ভালো লাগে না। কোনো দিন একটা বৃষ্টি বা জোছনার রাত আমরা একসঙ্গে উপভোগ করিনি। তুমি অত প্রকৃতিপ্রেমিক না। কিন্তু আমি তো তাই। আমার জন্যও তুমি কখনো এসব করোনি। তোমার মনেই আসেনি আমি কী চাই! কিন্তু স্বামী কবিতা পড়ে না বা জোছনা দেখে না এই অপরাধে তো তাকে ত্যাগ করা যায় না! তুমি ভালোবাসা বলতে বোঝ প্রতি রাতের শরীরী সম্পর্ক। ‘লাভ মেকিং’ বলে যে একটা শব্দ আছে, ক্রিয়া আছে, তা-ই তুমি জানো না।

সবচেয়ে বড় কথা ইশতিয়াক, তুমি আমার ভাষা বোঝো না। তোমার প্রেম আর পৌরুষ বা মর্দামিকে এক করে ফেলা ভালোবাসা আমি নিতে পারিনি। দিনে দিনে তাই শরীরের আগ্রহ কমেছে। শাপলার মতো বা শরীরের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ফলাফল আমাদের আজকের অকার্যকর সম্পর্ক। আমি জানি তুমি এসব বুঝবে না। আমিও বুঝিয়ে বলতে পারব না। নারীর সেন্সিটিভিটি এক অদ্ভুত ব্যাপার। পুরুষেরা সেসব কখনো বুঝতে শেখেনি। নারীর কান্নার অনুবাদ পুরুষেরা করতে জানে না। সেই যে শাপলাকে তোমার চড়া গলার ধমক আর তোমার মায়ের চড়, সেই ধমক আর চড়েই ভেঙে গিয়েছিল সুদৃশ্য চায়না জার-আমার সেন্সিটিভিটি। তুমি আমার কোমল হৃদয় ভেঙেছ ইশতিয়াক। ইউ ব্রেক মাই চায়না জার। ইউ ব্রেক।

অলংকরন: শাহরিন

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

মন্থন – রুখসানা কাজল

করেছে Wazedur Rahman মার্চ ১১, ২০২০

কাটা পেঁয়াজের খোসার ভেতর আঙুল চালিয়ে কী যেন খুঁজছেন আমার শাশুড়িমা।
কী খুঁজছেন মা?
অমলিন হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, কুঁচোনো কিছু পেঁয়াজ পড়ে গেছে, তাই তুলছি মা।
এহে, ময়লা লেগে গেছে তো। ওগুলো ফেলে দিলেই তো হয়। অকৃত্রিম ঘৃণায় সিঁটিয়ে উঠি আমি।
খুঁজে পাওয়া পেঁয়াজের টুকরোগুলো পরম যত্নে টিউবওয়েলের পানিতে ধুয়ে মিশিয়ে দিলেন বাটিতে উঁচু হয়ে থাকা কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে, খাওয়ার যোগ্য জিনিস হেলাফেলায় ফেলতে নেই গো মেয়ে। ওরাও অভিশাপ দেয়।

উপচে পড়া চিনিগুলো অন্য বয়ামে তুলে রাখতে রাখতে আমি ভাবি, জীবনভর কী তুলছি আমি? স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা নাকি অবিশ্বাসের সুতোনলি সাপ? জয়ঢাক পেট নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াই। কখনো পড়তে বসি। কখনো পুরোনো বাড়ির বালু খসে পড়া দেয়াল, ছাদের কড়িকাঠ দেখি। মাঝে মাঝে কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়ালের ক্ষতগুলো থেকে আরও বালু-সিমেন্ট ঝরিয়ে দিই। শাশুড়িমা হাসেন। স্নেহ ছলকে ওঠে তার চোখেমুখে। যদিও তার মনের ভেতরে শতেক অশান্তি। এই তো বয়েস মেয়েটার। সামনে পড়ে আছে অসীম সময়। জীবনের অসংখ্য ঘাট, ঘুলঘুলি, আলোছায়ার নানা বাঁক কী করে এতটা পথ একা একা পেরোবে এই মেয়ে?

বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই স্বামী মরে গেল। তার আদরের সর্বশেষ সন্তান। মৃত্যু কী অপরিমেয় অবিবেচক। তিনিও তো ছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দ্বিধাহীন আলিঙ্গনে তিনিও পারতেন মৃত্যুকে তার জীবন দিয়ে দিতে। হাসির সঙ্গে কান্না মিশে যায়। আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চান, শিশুটিকে কি রাখবে মা? তোমার তো অধিকার আছে দ্বিতীয় জীবন বেছে নেওয়ার! নিজেকে নিয়ে ভাববার! জীবন যে মস্ত বড়, ভেবে দেখো আরেকবার।

সাঁঝসন্ধ্যায় সবাই ব্যস্ত ঘরে ঘরে সন্ধ্যাকে আলো দেখাতে, ধূপধুনো, নামাজ পড়ে নাশতা বানাতে। শাশুড়িমা আমার পাশে জায়নামাজে বসে আছেন পশ্চিম দিক মুখ করে। আমার রায় শোনার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছেন এক সন্তানহারা মা।
আমি পেটের ওপর হাত রেখে বলি, এই আছিস?

দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। আমার হাত কাঁপে। মেরুদণ্ডে স্রোত ভাঙে টেনশনের। আর ঠিক তক্ষুনি চিনচিনে এক নাড়াচাড়া মাতৃবন্ধি নাড়িতে টান দেয়। আমি মাথা শক্ত করে বলি, থাকুক মা। একা লড়াইয়ে ও না হয় আমার বন্ধু হবে।

শাশুড়িমার কালো মুখে মুক্তো গড়ায়। তিনি নদীতে বইঠা ফেলার মতো হাত দুলিয়ে বলে ওঠেন, আসুক, আসুক। আসুক তবে তোমার রাজাধিরাজ। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো মা। জোরসে পড়ো। লড়তে গেলে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে যে! একা একা সন্তান পালন! সে বড় কঠিন কাজ। তুমিই মা, আবার তোমাকেই বাবা হতে হবে।

 

হাসপাতালের কেবিনে চোখ খুলে দেখি অনেকগুলো মুখ। ঝাপসা। কে যেন খুশি খুশি গলায় বলে ওঠে, শুনছ ডক্টরকে জানাও ওর সেন্স এসেছে। ব্যথার সাগরে ছেঁড়া পাতার মতো দুলছি আমি। একেকটি ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর আমি কুঁকড়ে কেঁদে ফেলছি। কেউ একজন জেতা ট্রফির মতো একটি শিশুকে তুলে ধরল খানিক উঁচুতে। প্রচণ্ড রাগে কাঁদছে শিশুটি। কে এই শিশু? ওর হাতে নম্বর লেখা সাদা কাগজটি প্রতিটি কান্নার সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত ক্রোধ কেন শিশুটির! ও কি ভুল কোলে এসে পড়েছে! এরা কারা? পরাজিতের উঠোনে এ কোন বিজয় উৎসব?

একটি শীর্ণ বয়স্ক নারী তার হাতে আমার কপাল ছুঁয়ে দিয়ে হাসছে, ও মেয়ে শুনতে পাচ্ছ, তোমার সেনাপতি এসে গেছে। তুমি আর একা নও। আমার শাশুড়িমাও উদ্ভাসিত চাঁদমুখে হেসে গলে পড়ছে। তার পাশে আরও কিছু উজ্জ্বল মায়ামুখ। চেনা চেনা অথচ হারিয়ে যাচ্ছে অচেনার অলিগলিতে। আমি প্রাণপণে সেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি, আমিই জন্ম দিয়েছি শিশুটিকে। তীব্র আলোর সেই ওটি, ডাক্তার-নার্সদের সেই গাঢ় নীল মুখোশ মুখ! আমার মনে পড়ে যায় সবকিছু।

জুতায় খটাখট শব্দ তুলে সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন ডাক্তার দ্রুত এসে আঁতকে ওঠেন। কাকে যেন ধমকে ডেকে পাঠান, এখন তো সেন্স আসার কথা নয়! নার্স সিস্টার সিরিঞ্জ উঠে আসে ডাক্তারের হাতে। অচেতনার গোলাপি ঘরে চলে যেতে যেতে আমি দেখি আপন রক্তের নয় মানুষগুলো সজল ব্যাকুলতায় চেয়ে আছে। ভালোবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট ঘর থাকে? গোত্র? ভালোবাসার পিতা কে? কে মাতা? কতজন ভাইবোন আছে ভালোবাসার? কাছের-দূরের লতায়-পাতায় জড়ানো ছড়ানো আত্মীয়রা কী করে কোন মায়ায় বেঁধে রাখে ভালোবাসাকে? ভালোবাসায় এত জল! আনন্দের! প্রাপ্তির! হারানো! মৃত্যুতে!

শিশুটির কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল পরাতে না পেরে আমার শাশুড়িমা ওর পায়ের নিচে কাজলের টিপ পরিয়ে দিলেন। ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। কাজল পরাতে দেখলেই ডাক্তার আন্টি আমার শাশুড়িমাকে বকে দিয়ে বলবেন, বড় আপা, এসব কুসংস্কার। তারপর নিজেই দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া লিস্ট দেখিয়ে বলে যাবেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে নবজাতকের যত্ন-আত্তি, লালনপালনের নির্দেশনামা। শাশুড়িমার মুখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি খেলে মিলিয়ে যায়। চকিতে শালিকের মতো মাথা নেড়ে মেনে নেয় ডাক্তার বোনের সব কথা। তারপর নির্জন দুপুরে সবাই চলে গেলে খালি বাসায় শিশুটিকে গোসল করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে চুলের ফাঁকে কাজলের টিপ পরিয়ে তিনি গুনগুন করে সুর তোলেন, পরথমে বরননা করি আল্লাহ রসুলের নাম॥ তারপরেতে শোনো পুত্র তোমার মাতার নাম॥ পুবদিকে সূর্যি ওঠে পশ্চিমেতে ডোবেএ এ এ-

কী বোঝে কে জানে! সুর থামলেই শিশুটি চেঁচিয়ে কাঁদে। পায়ের ধাক্কায় জানিয়ে দেয় প্রতিবাদ। ঘুম তাড়িয়ে আবার সুরে ফিরে আসেন মা। ক্লান্তিহীন অবিরাম সুরের সুতায় বাঁধা পড়ে যায় দুটি অসম প্রাণ। দুজনেই একসঙ্গে জাগে। একসঙ্গে ঘুমোয়। আমি বয়সী মানুষটির গায়ে এক পাত্তার নরম কাঁথা ছড়িয়ে দিই। শিশুটিও জড়িয়ে আছে নানা রঙের সুতায় গাঁথা কাঁথায়। আড়াই দিন বয়সী শিশুটির গায়ে হাস্নাহেনার সুগন্ধ। ওর মুঠো করা লাল হাতের ভেতর একটি আঙুল রাখতেই আশ্চর্য আন্দাজে আমার দিকে ওর মাথা ঘুরে আসে। এক অস্ফুট অভিমানের শব্দ করে আদরে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে দেয় আমার আঙুল। চোখের দীর্ঘ পাপড়িতে মেঘজমা ভেজা রং। পাপড়ি ছুঁতেই হঠাৎ তাকিয়ে দুটি হাতই পুরে দেয় মুখের ভেতর।

পায়ের আঘাতে সরে যায় গায়ের কাপড়। নাভিবাঁধা ব্যান্ডেজ দুলছে। ছোট্ট আদুরে পেট। পেটের নিচে পুরুষ পরিচয়ের দিকচিহ্ন খয়েরি লিঙ্গটি নমিত কোমল সুন্দর। আমি আরেকটু ছুঁয়ে দিই। পায়ের পাতায় পদ্ম রং। তাতে শাশুড়িমায়ের আঁকা বিপদ তাড়ানো স্বস্তিশেল। আমার বিস্মৃতির খাম থেকে মুছে যায় অচেনা সব স্বাক্ষর। কী অসহায় ছোট্ট মিষ্টি মানুষ। শরীর কাঁপিয়ে ধেয়ে আসে রক্তকণা। দুটি বুকে দোল খায় আসমুদ্র বাঁচার রসদ। এই প্রথম শিশুটিকে দুহাতে তুলে নিই। কী করে যেন বুঝতে পারি, ক্ষুধা লেগেছে বাবুটার। খাওয়ার যোগ্য অমিত সুধা ঝরে যাচ্ছে যুগল স্তন থেকে। সভ্যতায় অভিশাপ ছোঁয়ার আগে আমি স্তন তুলে দিই ওর মুখে।

পড়তে পড়তে মেকিয়াভ্যালি রেখে দিই। লম্বা শিকের জানালার বাইরে কলাগাছের ঝাড়। মা কলাগাছের আশপাশে অসংখ্য ছোট-বড় শিশু কলাগাছ। হাতে হাতে ছুঁয়ে আছে সবাই সবাইকে, আমিও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি আমার সুনির্মিত শিল্প। হাত, পা, কান, একমাথা কালো চুল, চোখ, দৃষ্টির গভীরতা। ও দেখে আমাকে। ওর চোখে চিরচেনার সাদা আলো।

শাশুড়িমা দুকাপ চা এনে ঘন হয়ে কাছে বসেন, শিশুরাই ঈশ্বর। ওরাই পথ। ঘর। মাঠ। আকাশ। সমুদ্র। ওরাই পৃথিবী। বেঁচে থাকার অপাপ শক্তি। স্বপ্ন। সাহস। ওদের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছে করে। বাঁচতে হয়। ওরাই বাঁচিয়ে রাখে। এই যে আমার বেঁচে থাকা, সে তো তোমাদের জন্য মা।

আশ্বিনের ঝোরা বৃষ্টিতে নেয়ে গেছে কলাঝোপ। বড় গাছগুলো থেকে পানি ঝরে পড়ছে ছোটদের মাথায়। হাতে-পায়ে। মানুষের ঝোপে শাশুড়িমাকে ছুঁয়ে থাকি আমি। আমার কোলে এক নতুন শিশু। দুদিন পরেই পরীক্ষা। পলিটিক্যাল থট। শিশুটির নরম ঠোঁটে, গালে, কপালে, লাল পায়ের তালুতে চুমু খাই। গুনগুন করছে মা, এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…আমি দোল দিই। ঝুলনের দোল। মা আমিনার কোলে। যশোদা মাঈয়ের কোলে, আমার কোলে…দোলে পৃথিবী দোলে।

 

ছবি: সংগ্রহীত 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
তুমিই রোদসীদিবস সবিশেষনারীরোদসীর পছন্দশিল্প-সংস্কৃতিসংগ্রামসাফল্য

ইতিহাসকথন: আন্তর্জাতিক নারী দিবস

করেছে Wazedur Rahman মার্চ ৮, ২০২০

আজ ৮ মার্চ। অন্য আর আট দশটা দিনের মতো হলেও এই দিনটার তাৎপর্য বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি। কারণ আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী এই দিনটি একটি সামাজিক দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীদের সাফল্য উদযাপন করা হয়ে থাকে বিশ্বব্যাপী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অবদান নিয়ে আলোচনা হয় বিশ্বব্যাপী। তবে নারী দিবসের মূল বক্তব্যটা কিন্তু সেই লিঙ্গ সমতাকেই ত্বরান্বিত করার মধ্যেই প্রথিত।

আন্তর্জাতিকভাবে, বেগুনি রঙ মূলত নারীদের প্রতীকরূপে মানা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের সামাজিক এবং রাজনৈতিক নারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বেগুনি, সবুজ এবং সাদা রঙের সংমিশ্রণের সূত্রপাত ঘটেছিল। বেগুনি ন্যায়বিচার ও মর্যাদার প্রতীক। সবুজ আশার প্রতীক। আর সাদা শুভ্রতা, বিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতার প্রতীক বলে মানা হলেও; এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কিত ধারণা থাকায় বর্তমানে এই রঙটিকে আড়াল করে রাখা হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস এক যুগ বা দেড় যুগের নয় বরং এক শতাব্দীর ইতিহাস। ১৯০০ শতকের শুরুতে পৃথিবী যখন বদলাতে শুরু করেছিল তখন একইসাথে বদলে গিয়েছিল নারীদের চিরাচরিত প্রথাকে ত্যাগ করা। মধ্যযুগের বর্বরতাকে দূরে ঠেলে সমাজকে অবাক করে দিয়ে শুরু হয়েছিল নারীদের বিশ্বজয়। আর আজকের দিনে নারী বিশ্ব জয় করে পা রেখেছে মহাকাশ জয়ে। তাই নারী দিবসের তাৎপর্যের মতোই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাসও তাৎপর্যমণ্ডিত।

১৯০৮ সাল

উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই নারীদের সকল প্রবঞ্চনা আর অশান্তিগুলো ক্রমশ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর সেসব সমালোচনা ধীরে ধীরে বিতর্কে রূপ নেয়। নারীদের প্রতি এই নিপীড়ন এবং বৈষম্যগুলো নারীদের পরিবর্তনের প্রচারে আরও সোচ্চার এবং সক্রিয় হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করছিল প্রতিনিয়ত।

১৯০৮ সালের সেই আন্দোলনের ছবি। Image Source: indiatoday.in

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায় পনের হাজার গার্মেন্টসকর্মী কাজের সময় কমানো, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে রাস্তায় মিছিল করে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও পঞ্চাশ বছর আগেই ঘটেছিল। ১৮৪৮ সালে দাসত্ববিরোধী সম্মেলনে নারীদের কথা বলতে নিষেধাজ্ঞার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন এবং লুক্রিয়া মট নিউ ইয়র্ক শহরে দেশে প্রথমবারের মতো নারীর অধিকার বিষয়ক সম্মেলনে কয়েকশ লোককে জড়ো করেছিলেন।

তারা সকলে অনুভূতি এবং সমাধানের ঘোষণাপত্রে নারীদের নাগরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার দাবি করে। আর এভাবেই একটি আন্দোলনের জন্ম হয়।

১৯০৯ সাল

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক দল পরের বছর ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ সমগ্র দেশব্যাপী জাতীয় নারী দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৩ সালের আগ অবধি নারীরা জাতীয় নারী দিবস (এনডব্লিউডি) ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবারই উদযাপন করতেন।

১৯১০ সাল

১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে কর্মজীবী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ক্লারা জেটকিন (জার্মানির সমাজতান্ত্রিক দলের একমাত্র নারী নেতা) নামে এক নারী আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণাটি উপস্থাপন করেন সেখানে।

ক্লারা জেটকিন। Image Source: bbc.com

তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, প্রতিবছর এই দিনে প্রত্যেকটা দেশে একযোগে একটা দিবস পালিত হবে – নারী দিবস – যেই দিবসে তারা তাদের দাবি আর অধিকারের কথাগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। সেই সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জনেরও অধিক নারী ছিলেন যাদের মধ্যে- ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক দল, কর্মজীবী নারী ক্লাবের সদস্য এবং ফিনিশ সংসদে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত তিনজন নারী সংসদ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন- যারা জেটকিনের এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয় এবং এভাবেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস তার দিক চিনে।

১৯১১ সাল

বিগত বছরের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯১১ সালের মার্চ মাসের ১৯ তারিখ প্রথমবারের মতো অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। এই দিবসে প্রায় এক লাখেরও অধিক নারী এবং পুরুষ আন্তর্জাতিক নারী দিবস শিরোনামের এক র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করে; যেখানে নারীদের কাজ করার, ভোট দেয়ার, প্রশিক্ষিত হওয়ার, সরকারি চাকুরি এবং বৈষম্যতার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করা হয়। তবে এর এক সপ্তাহ পরই ২৫ মার্চ ‘ট্রায়াঙ্গল ফায়ার’ অগ্নিকুণ্ড প্রায় ১৪০ জন কর্মজীবী নারীর জীবন কেড়ে নেয়; যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ইতালিয়ান এবং ইহুদি অভিবাসী। এই বিপর্যয়কর ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজের পরিস্থিতি আর শ্রম আইন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে যা পরবর্তীকালে নারী দিবসের পথ সুগম করেছিল।

১৯১৩-১৯১৪ সাল

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শান্তি প্রচারের প্রাক্কালে, রাশিয়ান নারীরা ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রবিবার তাদের জন্য প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে। ১৯১৩ সালের সেই দিবসেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চ স্থানান্তরিত করা হয় এবং তখন থেকেই এটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।

রাশিয়ান সেই বিক্ষোভ। Image Source: marxist.ca

পরবর্তী বছরে নারীরা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং মহিলাদের সংহতি প্রকাশের লক্ষে জনসমাবেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ নারীরা ভোটাধিকারের সমর্থনের আশায় বো থেকে ট্রাফালগার স্কয়ার অবধি পদযাত্রা করে।

১৯১৭ সাল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১ মিলিয়ন রাশিয়ান সৈন্যের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ফেব্রুয়ারির শেষ রবিবার রাশিয়ান নারীরা “রুটি ও শান্তির” জন্য ধর্মঘট শুরু করে। রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা বিরোধিতা হওয়া সত্ত্বেও নারীরা চার দিন ধরে ধর্মঘট চালিয়ে যান। এবং বাধ্যতামূলকভাবে জার সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। এবং চাপে পরে অস্থায়ী সরকার মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার প্রদান করে। মহিলা ধর্মঘট শুরু হওয়ার তারিখটি ছিল রবিবার ২৩ ফেব্রুয়ারি। রাশিয়ায় তখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হত। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এই দিনটি অন্য কোথাও মার্চ মাসের ৮ তারিখ ছিল।

১৯৭৫ সাল

১৯৭৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পোস্টার। Image Source: flashbak.com

আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথমবারের মতো ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়েছিল। তারপরে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের সদস্য দেশগুলির দ্বারা বছরের নির্দিষ্ট এক দিন নির্দিষ্ট এক দিবস হিসেবে পালিত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের নারী অধিকার ও আন্তর্জাতিক শান্তির দিবস হিসাবে ঘোষণার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

১৯৯৬ সাল

অবশেষে জাতিসংঘ ১৯৯৬ সালে একটি বার্ষিক বিষয় গ্রহণ করে – যা ছিল “অতীত উদযাপন আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা গ্রহণ।” এই বিষয়টিই পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে “উইমেন অ্যাট পিস টেবিল” এবং ১৯৯৮ সালে “উইমেন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস” মহিলা এবং ১৯৯৯ সালে “ওয়ার্ল্ড ফ্রি অভ ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন” গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে তা বছর বছর সংশোধিত হতে থাকে। সাম্প্রতিক বিষয়টি আরও বিস্তৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, “পল্লী মহিলাদের ক্ষমতায়ন”, “দারিদ্র্য ও ক্ষুধার সমাপ্তি” এবং “একটি প্রতিশ্রুতি কেবলই প্রতিশ্রুতি”, “কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতার অবসানে”।

২০০০ সাল

নতুন শতকের আগমন সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কার্যকলাপ স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিশ্ব এগিয়ে গেলেও নারীবাদ তখনো জনপ্রিয় বিষয় ছিল না। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পুনরায় উত্থান দরকার ছিল।

 

লেখা: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ
ছবি: সংগ্রহীত

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
টেলিভিশনঢালিউডবিনোদনশিল্প-সংস্কৃতি

মুন্নার নির্মাণে প্রস্থান-২ (বিষাদসিন্ধু) নিয়ে শহরতলী

করেছে Wazedur Rahman মার্চ ২, ২০২০

বুকে ধরে ভিসুভিয়াস, মিটবে না এই পিয়াস
সূর্য কি ভিজতে পারে সাগরের জলে?
খসে পড়া তারার খবর রাখেনা কভু আকাশ,
দীর্ঘশ্বাস মেলায় কি বাতাসে? 

 

একটি গোলকধাঁধা। মাঝে ঘূর্ণায়মান ঘড়ির কাঁটা। দুজন মানুষ। একে অপরের কাছে যাবার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু তারা কি পারবে দুই পৃথিবী দূরত্ব এই বাঁধা অতিক্রম করতে? নাকি শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গোণা? কেবল এক বুক দীর্ঘশ্বাস আর এক পৃথিবী বিষণ্ণতা।

মিউজিক ভিডিওর একটি দৃশ্য।

এমনই অদ্ভুত এক বিষণ্ণমাখা দৃশ্য দেখিয়ে দর্শকের মনকে নাড়া দিয়ে ইতি টানে, শহরতলী ব্যান্ডের ‘প্রস্থান-২’ (বিষাদসিন্ধু) শিরোনামের মিউজিক ভিডিওটি। থিয়েট্রিক্যাল রক ঘরানার এই ব্যান্ডটি শুরু থেকেই ভিন্ন ধারার গান উপহার দিয়ে শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১০ সালে প্রকাশ পাওয়া অ্যালবাম ‘বরাবর শহরতলী’ এর জনপ্রিয় গান প্রস্থান এর সিক্যুয়েল এই প্রস্থান-২ (বিষাদসিন্ধু) গানটি। সম্প্রতি ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্যান্ডের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে এই মিউজিক ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়।

গানটির গীতিকার ছিলেন তপন মাহমুদ। নিজের প্রবাস জীবনের তীক্ষ্ম অভিজ্ঞতাই এই গানের সূচনা। আর সে সুবাদেই গানটি উৎসর্গও করা হয়েছে প্রবাসী সকল মানুষদের। এই প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তপন মাহমুদ জানান,

প্রিয়জনদের ফেলে এত দূরে থাকার নিদারুণ কষ্টটাই আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। তাই এই গানটা তাদেরকেই উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রিয়জনকে ফেলে এত দূরে এসে থাকে; তাও কবে দেশে ফিরবে কিংবা আদৌ ফিরতে পারবে কিনা- এই ধরণের এক অনিশ্চয়তা, এক হাহাকার যেন বুকের মাঝে প্রতিনিয়ত ঘণ্টা বাজিয়ে চলে।

মিউজিক ভিডিওর একটি দৃশ্য।

গানটির সুরকার ব্যান্ডের লিড ভোকাল মিশু খান, যিনি একইসাথে ব্যাণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও। মিশু খান এই প্রসঙ্গে জানান,

‘আমাদের প্রস্থান গানটা অনেকেরই পছন্দের তালিকার শীর্ষে। এক দশক ধরে আমরাও তাই ভাবছিলাম এমন কোন একটা গল্প গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের শোনাতে যেটা আসলে প্রস্থানেরই সিক্যুয়েল। তাই এই বিষাদসিন্ধু গানটা ব্যান্ড শহরতলীর পক্ষ থেকে শ্রোতাদের জন্য উপহার। এই গল্পটাও প্রস্থানের মতোই দুজনার। ছেলেটাকে ছেড়ে মেয়েটা চলে যায়। পরবর্তীতে ফিরে আসে, তাদের বিয়েও হয়। কিন্তু এত চড়াই-উতরাই শেষেও কি তাদের একসাথে থাকার সৌভাগ্য হয়? নাকি একই আকাশের নীচে তারা যোজন দূরত্বে বসবাস করে?’

গানটির গীতিকারের মতোই গানটির মিউজিক ভিডিওর গল্পটিও তপন মাহমুদের। নির্মাতা হিসেবে ছিলেন আফজাল হোসেন মুন্না। এই মিউজিক ভিডিওতে মডেল হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা রিয়াজুল রিজু এবং অভিনেত্রী শারমিন আঁখি।

ব্যান্ডের সাথে শুটিংয়ের এক ফাঁকে পরিচালক আফজাল হোসেন মুন্না।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে আফজাল হোসেন মুন্নার অন্যতম সেরা কাজ টেলিফিল্ম ‘তোমায় ভেবে লেখা’ তে শহরতলী ব্যান্ডের প্রস্থান গানটি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। আফজাল হোসেন মুন্না বলেন,

শহরতলী ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতাকালীন সকল সদস্যই বন্ধু আমার। এই ব্যান্ডটার শূন্য থেকে এই অবধি প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ই আমার জানা। প্রস্থান গানটা আসলে আমার নিজেরও বেশ পছন্দের। আমার টেলিফিল্মে গানটা ব্যবহার করেছিলাম ২০১০ সালে। এর আগে ফিকশন আর ননফিকশন নিয়ে কাজ করলেও মিউজিক ভিডিও নিয়ে কখনো কাজ করা হয়নি। তাই চিন্তা ছিল কখনো বানালে শহরতলীরটাই আগে বানাব। আর তপনও গল্পটা এত সুন্দর আর সহজভাবে লিখেছে যাতে করে, যে কেউ এর গভীরতাটাকে অনুভব করতে পারবে। তবে এই সহজ গল্পটাকেই আরও সহজ আর নান্দনিক উপস্থাপনা দিতে গিয়ে, চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। তবে যদি দর্শকদের ভালো লাগে তাহলেই এই পরিশ্রম সার্থক।

শহরতলী ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘বরাবর শহরতলী’ ২০১০ সালে প্রকাশ পায়। এরপর তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৩ সালে ‘অপর পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য’ নামে দ্বিতীয় অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। তবে এবার অর্ধযুগেরও বেশি বিরতি দিয়ে নিজেদের তৃতীয় অ্যালবাম নিয়ে আসছে শহরতলী ব্যান্ড। ‘এখন, এখানে. . .’ নামক এই অ্যালবামটি বছরের শেষ দিকেই প্রকাশ পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ব্যান্ডের বেইজিস্ট রাজিবুল রহমান জানিয়েছেন,

‘শহরতলী ব্যান্ডের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে গতবছর আকাশ গানটি ছাড়ার মধ্য দিয়ে আমরা আসলে আমাদের তৃতীয় অ্যালবামটির ঘোষনা দিয়েছিলাম। একটি করে গান ছাড়ার মধ্য দিয়েই আমরা মূলত সম্পূর্ণ অ্যালবামটি শ্রোতাদের উপহার দিতে চাচ্ছি।’

শহরতলী ব্যান্ড

শহরতলী ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপ- মিশু খান (ভোকাল, অ্যাকোয়েস্টিক গিটার), জিল্লুর রহমান সোহাগ (পারফর্মিং ভোকাল), মোস্তফা জামান সুমন (লিড গিটার), খালেদ বাশার অতনু (কি-বোর্ড), ইসনাত জাবির আহমেদ (ড্রামস) ও রাজিবুর রহমান (বেজ গিটার)।

লেখা: রোদসী ডেস্ক 
ছবি: সংগ্রহীত 

 

০ মন্তব্য করো
1 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসগল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে ননফিকশন অথচ ফিকশনের চাইতেও বেশি আকর্ষণীয় এক বইয়ের কথা।

কাল্পনিক গোয়েন্দাকাহিনি তো আমরা প্রতিনিয়তই পড়ি। কিন্তু জটিল এই পৃথিবীতে সত্যিকারের গোয়েন্দাকাহিনির সংখ্যাই এতো বেশি, সেগুলো পড়তে গেলেই এক জীবন ফুরিয়ে যাবে।

তাছাড়া ফিকশনের তুলনায় নন-ফিকশন স্পাই স্টোরি পড়ার মধ্যে বাড়তি একটা লাভও আছে। গল্পের পাশাপাশি ইতিহাসের একটা অংশও জানা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণ সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

আর সেজন্যই নিজস্ব পছন্দমোতাবেক বইয়ের বিষয়বস্তু হিসেবে ট্রু স্পাই স্টোরিজগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। ছয় জন সত্যিকার গুপ্তচরের কাহিনি বাছাই করা হয়েছে, যাদের জীবনের গল্প কাল্পনিক গোয়েন্দা উপন্যাসকেও হার মানায়। 

চারটা কাহিনি নেয়া হয়েছে চারটা বিখ্যাত নন-ফিকশন থ্রিলার বই থেকে। আর বাকি দুটো কাহিনি বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, আর্টিকেল এবং লিকড ডকুমেন্ট থেকে তথ্য নিয়ে। 

সংক্ষেপে বলতে গেলে ‘স্পাই স্টোরিজ’-এ একই বইয়ের ভেতর থাকছে এসপিওনাজ জগতের ছয়টি শ্বাসরুদ্ধকর সত্য কাহিনি, যেগুলোতে মূল বইগুলোর থ্রিলিং অংশের আমেজ বেশ ভালোভাবেই উঠে এসেছে, কিন্তু বইগুলোর বাহুল্য অংশগুলো থাকছে না।

কাহিনিগুলো নির্বাচনের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেছি বিখ্যাত স্পাইদেরকে এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত, কিন্তু একইসাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্পাইদেরকে অগ্রাধিকার দিতে। সেই সাথে চেষ্টা করেছি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পেশাদার স্পাইদের গল্প না বলে এমন স্পাইদের গল্প বলতে, যারা গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে ঘটনাচক্রে– কেউ আদর্শের খাতিরে, কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য, আর কেউ নিছক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। আশা করছি বইটি পাঠকদের তৃপ্ত করতে পারবে। 

জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেও বাবার চাকরি সুবাদে মাত্র দু’বছর বয়সে পাড়ি জমান গাদ্দাফি শাসিত লিবিয়ায়। বেড়ে ওঠা আর একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠা সেখানে থেকেই। পেশাগত জীবনে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হলেও সবসময়ই পছন্দ করেছেন নিজে নতুন কিছু জেনে অন্যদের তা জানাতে। তাই নিজেকে একাডেমিক বিষয়াদির মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে, বরং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন ইতিহাস, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, তথ্যপ্রযুক্তির মতো নানাবিধ ক্ষেত্র জুড়ে। ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ দেখেছেন খুব কাছ থেকে,  হয়েছেন এর ভয়াবহতার শিকারও। এসব বিষয় তার মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। ফলশ্রুতিতে তার লেখালেখিতে প্রায় সময়ই উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ইতিহাসের কথা। 

নিয়মিত লেখালেখি করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একাউন্টে, অনলাইন মিডিয়া রোর বাংলায়, এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকাগুলোতে। ‘প্রেসিডেন্ট মুরসি’ শিরোনামের এক সংকলন বইয়ে স্থান পেয়েছে তার দুটি লেখা। সামনের দিনগুলোতে ইতিহাস ও রাজনীতির চমকপ্রদ সব বিষয় নিয়েই লেখালেখির ইচ্ছে গুণী এই তরুণ লেখকের, ইচ্ছে নিজের অর্জিত জ্ঞান সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার। 

বই: স্পাই স্টোরিজ – এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি ।। লেখক: মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা ।। প্রকাশক: স্বরে ‘অ’
পরিবেশক: ঐতিহ্য (১৪ নম্বর প্যাভিলিয়ন) ।। পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১২ ।। মলাট মূল্য: ২৭০ টাকা

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসগল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে বিজ্ঞানের বইয়ের কথা।

অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যেখানে গুড়িয়ে যায়, কাণ্ডজ্ঞান যেখানে প্রতারিত হয়, সেখানেই সক্রিয় হয়ে ওঠে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। একজন হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তার নীতি প্রয়োগ করে যেমন টলিয়ে দিয়েছিলেন চিরচেনা পদার্থবিজ্ঞানের জগত্টাকে, শ্রোডিঙ্গার তার বিরোধিতা করতে গিয়ে ফেঁদেছিলেন এক কাল্পনিক বিড়ালের গল্প। তাতে বরং হিতে-বিপরীতই হয়েছিল।

কল্পনার সেই বিড়াল নখর বাগিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিল শ্রোডিঙ্গারকে। আইনস্টাইনকেও ছাড়েনি। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের পর এক সময় রণে ভঙ্গ দেন শ্রোডিঙ্গার ও আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম কণাদের অদ্ভুত আচরণ বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এক শ বছর পেরিয়ে এসেও বিজ্ঞানের এই বনেদি শাখা এখনো সমান রহস্যময়।

কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কেন সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ভেঙে পড়ে, যুগযুগ ধরে চলে আসা পদার্থবিদ্যার সূত্র কেন অচল হয় খুদে কণাদের জগতে, তারই বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে। কোয়ান্টাম সুপারপজিশন, শূন্যতার শক্তি, প্রতিকণা আর বোস-আইনস্টাইন কন্ডেন্টসেট নিয়েও রয়েছে বিসস্তারিত আলোচনা। পড়তে শুরু করলে এই বই আপনাকে একটানে পৌঁছে দেবে কোয়ান্টামের রহস্যময়, বিচিত্র আর অবিশ্বাস্য জগতে।

আবদুল গাফফার রনি। খানিকটা ছন্নছাড়া আবার খানিকটা গোছানো স্বভাবের এই মানুষটা বিজ্ঞানের বইয়ের ভেতর থেকেও মজা খুঁজে নিতে জানেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর পথিক গুহকে আইডল মেনে লিখে যাচ্ছেন বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিষয়ক লেখা এমনকী গল্পও। পড়া, লেখা আর ভ্রমণের পাশাপাশি দেশের জনপ্রিয়তম বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২২টি। শিশুতোষ গল্পের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন ইউনিসেফের ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’।

বই: শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল ।। লেখক: আবদুল গাফফার ।।
প্রকাশক: অন্বেষা ।। পৃষ্ঠা: ১৬৮ ।। দাম: ২৭০ টাকা

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক

 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসগল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – বিজ্ঞানীদের গোপন জীবন

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা।

অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে বিজ্ঞানীদের জীবনী নিয়ে লেখা এক বইয়ের কথা।

দিন শেষে বিজ্ঞানীরাও মানুষ, তাই তাঁরাও প্রেমে পড়েন। কেউ একবার, কেউ বার বার। প্রেমে সুখি বিজ্ঞানীর অভাব যেমন নেই, তেমনি প্রেমের কারণে নিঠুর মৌন ঝড় কিংবা কলঙ্কের চোরাবালিতে সুখ হারানো রথী-মহারথীরও অভাব নেই বিজ্ঞানী সমাজে।

ডাকসাইটে বিজ্ঞানীরাও যেমন প্রেমে পড়েছেন, সাধাসিধে ভালো মানুষ গোছের বিজ্ঞানীরাও বাদ যাননি। শুধুই কি প্রেম, অবাধ যৌনাচার, পরকীয়ার কলঙ্কেও বিষিয়ে উঠেছে বিজ্ঞানীদের জীবন।

বিজ্ঞানীদের গোপন জীবনের সুলুক-সন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ইতিহাসের কানাগলিতে গুমরে মরা অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনি।

প্রেম-ভালোবাসার বাইরেও বিজ্ঞানীদের জীবনে রয়েছে অনেক অজানা অনেক কালো অধ্যায়। সেসব অধ্যায়ে লেখা হয়েছে বিজ্ঞানীদের শঠতা, নীচতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও জোচ্চুরির কাহিনি।

বিজ্ঞানীদের মতো মহৎ হূদয়ের মানুষগুলো ঈর্ষা-হিংসায় অনেক সময় অতি হিংসুককেও হার মানিয়েছেন। হিংসার বশবর্তী পদে পদে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েছেন তরম্নণ বিজ্ঞানীদের সাফল্যের পথে।

অনেক সময় বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের বিরোধিতা আর জিদের কারণে ধংস হয়ে গেছে সম্ভাবনাময় নবীন বিজ্ঞানীদের জীবন। অনেক বিজ্ঞানী আবার তাঁদের ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে এমন সব হাস্যকর কা্ল করেছেন, যেগুলো হয়ত অতি সাধারণ বোকারাও করবে না। বিজ্ঞানীদের গোপন জীবনের ফিরসিত্ম তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই জন্ম হয়েছে এই বইয়ের।

আবদুল গাফফার রনি। খানিকটা ছন্নছাড়া আবার খানিকটা গোছানো স্বভাবের এই মানুষটা বিজ্ঞানের বইয়ের ভেতর থেকেও মজা খুঁজে নিতে জানেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর পথিক গুহকে আইডল মেনে লিখে যাচ্ছেন বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিষয়ক লেখা এমনকী গল্পও।

পড়া, লেখা আর ভ্রমণের পাশাপাশি দেশের জনপ্রিয়তম বিজ্ঞান ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২২টি। শিশুতোষ গল্পের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন ইউনিসেফের ‘মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’।

বই: বিজ্ঞানীদের গোপন জীবন ।। লেখক: আবদুল গাফফার ।।
প্রকাশক: বাতিঘর ।। পৃষ্ঠা : ১৭৬ ।। দাম: ৩৪৭ টাকা

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
নতুন লেখা
আগের লেখা

পোর্টফোলিও

প্রকাশিত সংখ্যা

রোদসীর পছন্দ

  • ঘরেই বানিয়ে নাও মেকআপ সেটিং স্প্রে

তুমিই রোদসী

  • আলোয় ভুবন ভরা







rodoshee logo

© স্বত্ব রোদসী ২০১৪ - ২০২১
সম্পাদক ও প্রকাশক:   সাবিনা ইয়াসমীন
৯১/এ, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা, ব্লক-এফ, রোড-৩, চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮০-২-৫৫০৪১০৪৬-৪৮, ই-মেইল: info@rodoshee.com

রোদসী

রোদসী

ক্যাটাগরি

আর্কাইভ

@2014-2018 -রোদসী. All Right Reserved.

রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
Facebook