লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
প্রচন্ড তাপের কারণে কর্মব্যস্ত মানুষের শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, তাপ-শ্রান্তি, তাপাঘাত, শিরটান বা খিঁচুনি, মূর্ছা যাওয়া, এমনকি মৃত্যুর খবরও আসছে প্রায়ই। এই প্রচন্ড গরমে বড়দের চেয়ে শিশুদের অবস্থা আরও নাজেহাল। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাপমাত্রাজনিত রোগে ভুগে থাকে-
বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে গ্রীষ্ম শুরুর আগেই বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। প্রচ- দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এ দাবদাহে মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস, উৎপাদনে নিম্নগতি, চলাচলে ব্যাঘাতসহ জনস্বাস্থ্য নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্রমাগত দাবদাহ বিরাজ করার কারণে কর্মব্যস্ত মানুষের শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, তাপ-শ্রান্তি, তাপাঘাত, শিরটান বা খিঁচুনি, মূর্ছা যাওয়া, এমনকি মৃত্যুর খবরও আসছে প্রায়ই। এই প্রচন্ড গরমে বড়দের চেয়ে শিশুদের অবস্থা আরও নাজেহাল। ইউনিসেফের মতে, বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাপমাত্রাজনিত রোগে ভুগে থাকে।
পরিণত বয়সে না পৌঁছার কারণে শিশুদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠনে পরিপূর্ণতা আসে না। তাই তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। এ জন্য প্রচন্ড গরমে শিশুদের নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তন্মধ্যে পানিশূন্যতা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ যথা : সর্দি-কাশি-নিউমোনিয়া, চামড়ার ব্যাধি যেমন : ঘামাচি ও র্যাশ এবং তাপমাত্রার আধিক্যের কারণে মূর্ছা যাওয়া, হিট স্ট্রোক ও হিট এক্সাশন ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া গরম ও অতিরিক্ত আর্দ্রতায় বিভিন্ন জীবাণু সংক্রমণের কারণে খাদ্য, পানি ও বায়ুবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও দেখা যায়, যথা জলবসন্ত বা চিকেন পক্স, ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং, জন্ডিস, টাইফয়েড ইত্যাদি।
পানিশূন্যতা
শিশুরা এমনিতেই পানি পান করতে চায় না। গরমের সময় প্রয়োজনমতো তরল বা পানি পান না করার কারণে তারা সহজেই পানিস্বল্পতা বা পানিশূন্যতায় ভোগে। বমি বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে শিশুদের পানিস্বল্পতা হতে পারে। মৃদু বা মাঝারি ধরনের পানিশূন্যতায় তাদের জিহ্বা শুকিয়ে যেতে পারে, কান্নায় চোখ দিয়ে সামান্য পানি পড়ে বা একেবারেই পানি পড়ে না, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, প্রস্রাব কম হয় কিংবা অস্থিরতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। তীব্র পানিশূন্যতায় মুখগহ্বর শুকিয়ে যায়, পেটের চামড়া ঢিলা হয়ে যায়, শরীর নিস্তেজ ও ঘুম ঘুম ভাব থাকে, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, নবজাতকদের মাথার চাঁদি ভেতরে বসে যায় এবং দ্রুত ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থা শিশুদের নাড়ির গতি দ্রুত ও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
পানিশূন্যতা দেখা দিলে শিশুদের বারবার তরল খাবার বা পানীয় যথা পানি, ডাবের পানি, ফলের জুস বা তরল-জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে বয়স অনুযায়ী পরিমাণমতো খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ঘামাচি
গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় শিশুদের শরীরে প্রায়ই ঘামাচি দেখা দেয়। অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীরে ঘাম বের হওয়ার নালিমুখ বন্ধ হয়ে ঘামাচির সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো ঘামাচি লাল হয়ে শিশুর ঘাড়ে, গলায়, পিঠে ও বুকে ছড়িয়ে পড়ে এবুং প্রচন্ড চুলকানির সৃষ্টি হয়। অনেক সময় ঘামাচির মুখ পেকে পুঁজেরও সৃষ্টি হতে পারে। ঘামাচি প্রতিরোধে শিশুকে সরাসরি রোদে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। এ সময় স্কুলে বেশিক্ষণ বহিরাঙ্গন খেলাধুলা না করা ভালো। শিশুদের যথাসম্ভব সুতি জামাকাপড় পরাতে হবে। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে শিশুর গা ঠান্ডা পানিতে মুছিয়ে দিলে ঘামাচি প্রতিরোধে সহায়ক। বাজারে সজলভ্য ঘামাচিরোধী পাউডার এ কষ্ট লাঘবে অনেক সময় সহায়তা করে।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ-সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়া
গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া বাতাসে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রভৃতি রোগজীবাণু বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ সময় শিশুদের সর্দি, কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ তথা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এ ধরনের সর্দি, কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধে শিশুদের পরিষ্কার পরি”ছন্ন রাখতে হবে। ভিটামিন সি-যুক্ত ফলমূল যথা: আনারস, কমলা, কামরাঙা, পেয়ারা, আম ইত্যাদি এবং নানা ধরনের মৌসুমি ফল এসব রোগ প্রতিরোধে উপকারী। সর্দিতে নাক বন্ধ হলে নরসলজাতীয় ড্রপ নাকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কুসুমকুসুম গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে পরিষ্কার নরম কাপড়ে ভিজিয়ে নাকে দেওয়া যেতে পারে। কাশি হলে ছোট শিশুদের লেবুর রস মেশানো গরম পানি ও তুলসীপাতার রস কার্যকর। শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
জ্বর
শিশুরা নিজের অজান্তে অনেক সময় অপরিষ্কার ও জীবাণুযুক্ত দ্রব্যসামগ্রীর সংস্পর্শে আসে বিধায় জীবাণু সংক্রমণ ও জ্বরের প্রবণতা বেশি থাকে। গরমের সময় এ হার আরও বেড়ে যায়। তবে এ জ্বর তেমন মারাত্মক নয়। জ্বর হলে নিজেরা কোনো ওষুধ শুরু না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবে জ্বর কমাতে গরম পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে শিশুর পুরো শরীর মুছে দিলে জ্বর কমে আসে এবং শিশু তাৎক্ষণিক আরাম বোধ করে থাকে। আইসপ্যাক বা ঠান্ডা পানি না ব্যবহার করাই ভালো। কারণ, এতে পরবর্তী সময়ে জ্বর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। জ্বরের সময় শিশুর শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। পানিস্বল্পতা রোধে বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় খাওয়াতে হবে; তবে চা বা কফি ইত্যাদি পরিহার যুক্তিযুক্ত। জ্বরের সঙ্গে বমি বা পাতলা পায়খানা থাকলে মুখে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
হিট এক্সাশন, হিট ক্র্যাম্প, হিট স্ট্রোক, হিট সিনকোপ বা মূর্ছা যাওয়া
অত্যধিক গরমে আমাদের শরীরের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ঘটে। প্রথমে অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যায়। এতে শরীর কিছুটা অবসাদগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। হাত ও পা কিছুটা ফুলে যায় ও চামড়া লালচে হয়ে পড়ে। এ পর্যায়কে হিট ক্র্যাম্প বলা হয়। হিট ক্র্যাম্পের পরবর্তী পর্যায় হিট এক্সাশন। এ সময় শিশুর পুরো শরীর ঘামে ভেজা থাকে, শিশু অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, মাথাব্যথা, বমিভাব ও ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। নাড়ির গতি দ্রুত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তৃতীয় ধরনের মারাত্মক সমস্যাটিকে বলে হিট স্ট্রোক। এ পর্যায়ে শরীর শুকিয়ে যায়, নাড়ির গতি দুর্বল, দ্রুত ও অনিয়মিত হতে দেখা যায়। শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, শ্বাসের গতি বেড়ে যেতে পারে; শিশু খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রলাপ বকা বা খিঁচুনি হতে পারে কিংবা মূর্ছাও যেতে পারে। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না নিলে শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এসব পরিস্থিতিতে শিশুকে তাড়াতাড়ি শীতল স্থানে বা ছায়ায় নিয়ে আসতে হবে। শরীর থেকে পরিধেয় কাপড়চোপড় খুলে পাখার বাতাস বা ফ্যান ছেড়ে দিতে হবে। শিশুর পায়ের দিক উঁচু করে শুয়ে রাখতে হবে। জ্ঞান থাকলে ঠান্ডা পানিতে শরীর মুছে দিন। ঠান্ডা, পরিষ্কার, তরল বা পানীয় খেতে দিন। শিশু যদি বমি করতে থাকে, তাকে এক পাশ করে রাখুন, বমি শ্বাসনালিতে চলে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
ডায়রিয়া বা ফুড পয়জনিং
গরমের সময় দ্রুত খাবার বা পানিতে রোগজীবাণুর বংশবৃদ্ধি ঘটে। এ সময় শিশুদের নানা ধরনের পানি বা খাদ্যবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা যায়, যথা : ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিং, আমাশয়, টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি। শিশুর ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত শিশুর পায়খানা স্বাভাবিক না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘন ঘন স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সঙ্গে পানি অথবা ডাবের পানি খাওয়ানো ভালো। একই সঙ্গে তাকে তরল খাবারও দিতে হবে। শিশুর শরীরে যাতে পানিশূন্যতা না হয় এবং তার প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুর পায়খানা নিয়ন্ত্রণ না হলে বা সঙ্গে রক্ত গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শরীরে জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে এবং তরল ও স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে।
গরম ও অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত শিশুদের সিংহভাগ শারীরিক সমস্যাই প্রতিরোধযোগ্য। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এবং সংশ্লিষ্টদের অসচেতনতা তাপমাত্রাজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুর বর্তমান সংখ্যা ৫০ কোটি থেকে ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২০০ কোটি টাকা। তাই ইউনিসেফ বিশ্বের সব দেশকে শিশুদের বাঁচাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
ক্স রোদের সরাসরি প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করুন।
ক্স গরমের দিনে শিশুদের বেশি বেশি পানি পান করাবেন।
ক্স গরমের দিনে শিশুদের সহজপাচ্য ও স্বাস্থকর খাবার দিন।
ক্স এ সময় শিশুদের ঢিলেঢালা ও সুতি কাপড় পরিধানের ব্যবস্থা নিন।
ক্স বা”চাদের নিয়মিত গোসল করান।
ক্স যথাসম্ভব ছেলেমেয়েদের ইনডোর বা শীতল স্থানে খেলাধুলার ব্যবস্থা করুন।
ক্স বাসস্থানে যথাসম্ভব আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
ক্স গরমে বাচ্চাদের নিয়ে দূরপাল্লার ভ্রমণ কিংবা আউটডোর কর্মকান্ড পরিহার করুন।
গরমের দিনে অভিভাবকেরা কিংবা স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলেমেয়েদের অতিরিক্ত পিপাসা লাগা, হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন পাতলা পায়খানা, বমি, কিছু খেতে না চাওয়া, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, চোখ বসে যাওয়া বা জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া এবং বা”চাদের দুর্বল ও নিস্তেজভাব দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
সাধারণত শিশুদের শরীরের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ গড়ে ওঠে না। যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের শরীরের ওপর প্রতিক্রিয়া শিশুরা বুঝতে পারে না। তারা ঠিকমতো বলতে পারে না কী ধরনের সমস্যায় ভুগছে। শিশুদের শারীরিক গঠন এমন যে দাবদাহের কারণে যেকোনো মুহূর্তে পূর্বসতর্কতা ছাড়াই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এসব পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে শিশুরা অজ্ঞ। তীব্র গরমে নানান স্বাস্থ্য জটিলতার মুখোমুখি হয় শিশুরা। তাই অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত এ সময় শিশুদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থাকা।
লেখক : লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান, এমপিএইচ, এমফিল
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ