এখন লকডাউন তো দুদিন পর আবার ঠিকঠাক। তবু অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ায় যেন মহা আতঙ্ক। কিন্তু আর কত! হাঁসফাঁস অবস্থা ছোট-বড় সবারই। ভ্রমণ কী জিনিস, তা যেন সবাই জীবনের সিলেবাস থেকে হারিয়ে ফেলেছে! লকডাউনে সবকিছু খুলে দিলেও পর্যটন খাত সেভাবে আলো দেখেনি। তো এখন কী অবস্থা পর্যটন খাতের? পর্যটনশিল্পের আইকন বেগম আজিজা সেলিম আলো বললেন সেই প্রসঙ্গ নিয়ে। কথা বলে লিখেছেন সুরাইয়া নাজনীন
পর্যটনশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি
করোনাকালীন অন্যান্য খাতের অবস্থা মোটামুটি ভালো হলেও পর্যটন খাত একেবারেই থেমে গেছে। করোনার ভয়ে সরকারি পদক্ষেপগুলো নেওয়া যাচ্ছে না। তবে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছে, তাদের অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, তা-ও ভেবে দেখা দরকার, বললেন আজিজা সেলিম আলো। দুই বছরে প্রায় তিন কোটি রেমিট্যান্স হারিয়েছি। হোটেল, গাইড, ট্রান্সপোর্ট সবকিছু মিলে সর্বনিম্ন তিন কোটি টাকার মতো আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে এখনো হাল ছাড়িনি। পর্যটন খাত আমার একটি ভালোবাসার জায়গা। দেখেছি অনেকেই পেশা বদলেছে, তবে না বদলে উপায় নেই। জীবন তো আর থেমে থাকবে না। কিন্তু আমি, আমার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করিনি। প্রত্যাশা রেখেছি নিশ্চয়ই ভালো সময় আসবে। প্রকৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। আর আমরা মানুষকে প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিই।
নতুন করে বিশ্ব দেখা
কেটে যাক অমানিশার কালো মেঘ। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিক আবার পৃথিবী, সেই প্রত্যাশা যেন ভ্রমণপ্রিয় মানুষের। ঘরে থাকতে থাকতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। এই তো এখন বুঝি খুলে দিল সবে! তাই সবাই জীবনের নতুন পরিকল্পনা করছেন। কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন, কী কী করবেন, পরিবারের সদস্যরা, বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে ভ্রমণ পরিকল্পনার জোয়ারে ভাসছেন। পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য এখন থেকে আমাদের আরও বেশি নিরীক্ষা করা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ প্রচুর ইনবাউন্ড ট্যুর করে। দুদিন ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ে। তাই প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায়ও আমাদের সবার সচেতন হওয়া দরকার।
যেভাবে পর্যটনশিল্পের শুরু
১৯৯৬ সাল। তখন আমি শিক্ষার্থী আর আমার হাজব্যান্ড সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সব সময় আমাকে অসম্ভব সাপোর্ট দিয়েছেন, যা আজকে রূপ নিয়েছে আমার গ্রিন চ্যানেল। গ্রিন চ্যানেলের মাধ্যমে আমি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরি। দেশ ও দেশের বাইরেও বিভিন্ন ট্যুর অপারেট করি। এমভি মাহিরা এবং এমভি জেরিন নামে আমার দুটি নিজস্ব জাহাজ রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ট্যুর পরিচালনা করা হয়। ২০১২ সালে ‘দ্য রোর টাইগার অব সুন্দরবন’ মুভিটিতে এমভি মাহিরা জাহাজটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেটিতে শাহরুখ খান উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি করা হয়, যাতে গ্রিন চ্যানেল অনেক কাজ করেছে। আমরা দেশের বাইরে বিভিন্ন মেলার আয়োজন করি, যেখানে বাংলাদেশকে তুলে ধরি। বাংলাদেশ ট্যুর অ্যাসোসিয়েশনের অনেক সদস্যই গ্রিন চ্যানেল থেকে তৈরি হওয়া।
লড়াই যখন টিকে থাকার
তেমনটা লড়াই করতে হয়নি আসলে। তবে ২০০৭ সালের দিকে কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হই। কিন্তু ২০০৮ সালের দিকে সেটা কাটিয়ে উঠতে সফল হই। করোনাকালে তো সারা বিশ্বেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যগুলো আগের মতো অবস্থানে নেই। এই করোনাকালে পর্যটন সেক্টরে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে কাজ করছি প্রতিনিয়ত। আমি মূলত এখন আমার দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে বেশি কাজ করছি, যাতে করে মানুষ আরও বেশি আগ্রহী হয় নিজের দেশ ঘুরে বেড়াতে। কারণ, অনেকেই আছে, যারা নিজের দেশের বিভিন্ন স্থান দেখেনি। এখন যেহেতু দেশের বাইরের ট্যুরগুলো বন্ধ রয়েছে, তাই দেশের অভ্যন্তরীণ ট্যুরে বেশি জোর দিচ্ছি।
তরুণদের জন্য
অনেক তরুণই এখন এই পেশায় আসছে। আমি তরুণদের উদ্দেশে বলতে চাই, যদি পর্যটন নিয়ে কাজ করতে চাও, তবে দেশসেবার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজে আসো। এখানে কাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো তুলে ধরতে আমরা সবাই কাজ করতে পারি। আমার সঙ্গে অনেক তরুণ কাজ করে, আমি তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করি।
নারীর জন্য
নারীদের জীবনের নানা ক্ষেত্রে লড়াই করতে হয় টিকে থাকার জন্য। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারকে একসঙ্গে কাজ করা উচিত নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর এর শুরু হওয়া উচিত ঘর থেকেই। যখন পরিবার সচেতন নারীর অধিকার ও নারীর প্রাপ্য অধিকার নিয়ে, তখন সমাজে পরিবর্তন আসবেই। অনেক সময় দেখা যায়, পাবলিক পরিবহনগুলোয় নারীর জন্য আসন থাকলেও সেখানে নারীদের বসার সুযোগ থাকে না। এতে করে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় একজন নারীকে। নারীর আসনে যেন কোনো পুরুষ না বসতে পারে, এ বিষয়টিতে আরও জোর দেওয়া দরকার। যাতায়াতে নারীর হয়রানি দূর করতে হবে। কারণ, এখন অনেক নারীই কাজ ও উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাতায়াত করে।
লড়াইয়ের আরেক নাম করোনা
আমরা কখনোই আগে এমন মহামারি মোকাবিলা করিনি। এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য একেবারেই নতুন। আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এই সমস্যা মোকাবিলা করছে বছরের পর বছর। আমি চেষ্টা করেছি আমার প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছে, তাদের পাশে থাকতে। তবে আমি করোনা শুরুর তিন মাস চট্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে ১০০ পরিবারকে সাহায্য করেছি। এই করোনায় অনেক কর্মজীবী নারী চাকরি হারিয়েছে। আবার অনেক নারী পরিবারের প্রয়োজনে প্রথম কাজে যুক্ত হয়েছে। নারীরা কেউ বসে ছিল না। তারা তাদের নিজের হাতের কাজ বা রান্না দিয়েই নিজের মতো করে কাজ করেছে। ঘরে বসেই ব্যবসা করে অনেক নারী এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রযুক্তির সাহায্য আর মেধা ও ইচ্ছা দিয়েই নারীরা নতুন পথের সূচনা করেছে। তবে সব মিলিয়ে এখন টিকে থাকাটাই বড় ব্যাপার। ২০২১ সালের করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ উঠেছে। যার জন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়েছি। আমার জানামতে, অনেক ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান আছে, যারা তাদের প্রতিষ্ঠান একেবারেই সিলগালা করে দিয়েছে। কেউ কেউ এখনো বেকার হয়ে আছে। ন্যূনতম ছোট ব্যবসা দাঁড় করানোর পুঁজি নেই। জীবনে খেয়ে-পরে বাঁচার নিশ্চয়তাটুকু নেই কারও কারও। তাই এই পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা সরকারি সহযোগিতা পেলে সামনের দিকে আগানোর সাহসটুকু পেতাম।
হালের জমানায় প্রাকৃতিক রিসোর্ট
রেইন ফরেস্ট ইকো রিসোর্টটি করা হচ্ছে তাদের কথা ভেবে, যারা প্রকৃতিকে সব সময় খুঁজে ফেরে কিন্তু সময়ের অভাবে প্রকৃতির সান্নিধ্য পায় না। আমরা রাজধানীর খুব কাছেই রিসোর্টটি করছি। অনেক দূর কাজ এগিয়ে গেছে। কাজ সব শেষ না হতেই এর মধ্যে আমরা সাড়া পাচ্ছি। চাহিদা তৈরি হয়েছে প্রকৃতির কাছাকাছি আসার। ২৪ একর জমির ওপর রিসোর্টটি করা হচ্ছে। ফাইভ স্টার মানের করে তৈরি হচ্ছে রেইন ফরেস্ট ইকো রিসোর্ট। কাপল কটেজ, ফ্যামিলি কটেজ, করপোরেট সুবিধা, কিডস সুবিধা, গেমিং জোন, সুইমিং পুল, কনফারেন্স রুমসহ দুর্দান্ত সব আয়োজন রেখেছে রেইন ফরেস্ট ইকো রিসোর্ট। যাবে কনসার্ট করাও। এমন কোনো ফলগাছ নেই, এখানে থাকবে না। প্রকৃতির নিবিড় ছায়াঘেরা পরিবেশ। আমরা করোনাকালীন একটু হলেও বুঝতে পেরেছি অক্সিজেন ছাড়া আমাদের কী হাল হতে পারে! তাই আমি আমার নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি আমি অক্সিজেন তৈরি করব। সেই প্রত্যয় নিয়ে আমি আমার রিসোর্টটি তৈরি করছি।
জীবনের অর্জন
স্বপ্নের পথে হাঁটতে হাঁটতে জীবনে কিছুটা অর্জনের দেখা মিলেছে। বর্তমানে গ্রিন চ্যানেলের সিইও হিসেবে কাজ করছি। ইস্টউড লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও আছি। বাংলাবেস্ট লিমিটেডের এমডি হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছি। তা ছাড়া গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রোর ডিরেক্টর হিসেবেও সঙ্গে আছি। এফবিসিসির জেনারেল মেম্বার হিসেবে আছি। রেইন ফরেস্ট ইকো রিসোর্টের সিইও হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। বিডি ইনবাউন্ডের মেম্বার হিসেবেও আছি। টোয়াবের সিনিয়র মেম্বার হিসেবে রয়েছি। গ্রিন প্রোপার্টির প্রোপ্রাইটার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। সবকিছুর সঙ্গে আছি কাজের ভালোবাসা ভালোলাগা থেকে। ওই যে আগেই বলেছি প্রকৃতির মুগ্ধতায় মানুষকে আরেকটু বাঁচিয়ে রাখে। মানুষকে প্রকৃতির বন্ধু বানাতে আমার অবিরাম ছুটে চলা।