২০১৯-এর শেষ প্রান্তে চীনের উহান প্রদেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে করোনা বিশ্বব্যাপী জনজীবন বিপর্যস্ত করেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ২১০টি দেশে প্রায় ১২ কোটি ৫৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে প্রায় ২৭ লাখ ৫৬ হাজার জন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আমেরিকা, ব্রাজিল ও ভারত শীর্ষ তিনে। অবস্থানে ৩৪ নাম্বারে থাকা বাংলাদেশেও এর প্রভাবে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এবং প্রাণ হারিয়েছে ৮ হাজার ৭৬৩ জন (২৫ মার্চ ২০২১)।
ওপরের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে দিন দিন করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা লকডাউনের মধ্যেও দেশের আইসিইউ এবং কোভিড হাসপাতালগুলোতে ছিল রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।
তবে আশার কথা হচ্ছে, নভেল করোনা বা কোভিড-১৯ রোগটি কিছু সাধারণ দৈনন্দিন জীবন শিষ্টাচার মেনে চললে খুব সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই শিষ্টাচারগুলো ভালো করে মেনে চলার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ এমনকি আমাদের প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান করোনা নিয়ন্ত্রণে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে।
প্রথমেই আমাদের জানা দরকার কোভিড-১৯ কী এবং কীভাবে হয়। কোভিড-১৯ হলো শ্বাসযন্ত্রের একটি ছোঁয়াচে রোগ, যার জন্য দায়ী একটি আবরণীবদ্ধ আর এন এ ভাইরাস। এটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মতো এবং নতুন আবিষ্কৃত বলে নাম করা হয় নভেল করোনা এবং রোগের নাম দেওয়া হয় করোনাভাইরাস ডিজিজ-১৯ বা কোভিড-১৯। রোগটি মূলত ছড়ায় বায়ু ফোঁটা বা এয়ার ড্রপলেটের মাধ্যমে। ফলে আমাদের এই মাধ্যমটি যদি রোধ করা যায়, তাহলে রোগটিও প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এয়ার ড্রপলেট ছড়ায় রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। এই ড্রপলেট পানির কল, চেয়ার, টেবিল, দরজার হাতল, কমোড, কোনো সিট, সুইচ, বাসন বা অন্য কিছু যা কেউ ধরতে পারে বা সংস্পর্শে আসতে পারে এমন কিছুতে লেগে থাকে এবং পরে অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে। লক্ষণ প্রকাশ হতে সাধারণত ২-১৪ দিন সময় লাগে। ২০২০ সালের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে ষাটোর্ধ্ব বা অন্য রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, হাঁপানি আছে এমন ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকলেও ২০২১ সালে তরুণেরাও মোটেও নিরাপদ নয়।
করোনার লক্ষণের মধ্যে প্রথমেই আসে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, হাঁচি। এরপর শারীরিক দুর্বলতা বাড়তে থাকে। সঙ্গে যোগ হতে পারে ঘ্রাণ না পাওয়া, স্বাদ না পাওয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়া।
আমাদের দৈনন্দিন জীবন শিষ্টাচার এর মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, কমপক্ষে ৩ ফুট সঙ্গে মাস্ক পরা এবং হাত ধোয়ার অভ্যাস করে ফেলতে হবে। ঘরের বাইরে গেলে, বাইরের কিছু ধরলে, বাসায় নতুন কিছু আনলে, হাঁচি- কাশি দিলে, নাক ঝাড়লে, নাক-মুখ ধরার আগে প্রতিবার হাত ধুতে হবে ৭০% অ্যালকোহল বা সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে কিছু ভুলে গেলে বা কী করতে হবে মনে এলেই হাত ধুতে হবে। মাস্ক পরার অভ্যাস আমাদের জন্য একটু কষ্টকর, বিশেষত এই গরমে কিন্তু মাস্কের চেয়ে বড় পিপিই নেই। ঘরের বাইরে গেলে বা বাইরের কেউ ঘরে এলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। অনেক সময় নাক ও মুখ ঢেকে মাস্ক পরে না কিন্তু এটি না করলে মাস্ক পরার আসল উদ্দেশ্যটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে এখন যদিও অনেক শৈথিল্য আছে, কিন্তু ব্যক্তিগত সাবধানতার জন্য যথাসম্ভব পরিহার করা উচিত।
হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই রুমাল, টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ঢাকনাযুক্ত ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হবে। সম্ভব না হলে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বা কনুইয়ের ভাঁজে হাঁচি-কাশি দিতে হবে এবং এরপর অবশ্যই হাত ধুতে হবে। পারস্পরিক সৌজন্য বিনিময়ের জন্য করমর্দন করা থেকে বিরত থাকা, খুব প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে না যাওয়া বা কিছু ধরে নাক-মুখ-চোখ না ধরার মাধ্যমে আমরা অনেকাংশে করোনা প্রতিরোধ করতে পারি।ব্যক্তিগত বদভ্যাস পরিহার করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সারা দিন ঘরে বসে থাকা পীড়াদায়ক। এ সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা, খেলাধুলা, গল্প করা, বই পড়া, ব্যায়াম করা, ছবি আঁকা, গান করা, রান্না করা, বাগান করা ও ব্যক্তিগত চরিত্র উন্নয়ন করার মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করা সম্ভব।
সকল প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়ার পরও আমদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আক্রান্ত হলেও ভয় না পেয়ে খুব দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। বর্তমানে রোগীর চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল সুবিধা সেভাবে বাড়ছে না। তাই মৃদু লক্ষণ হলে বাসায় স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে থাকা সর্বোত্তম। সামাজিক শিষ্টাচার আর প্রয়োজনে ঘরের বাইরে না গেলে এবং মানসিকভাবে নিজেকে উজ্জীবিত রাখলে কোভিড-১৯-এর এই সময়টা আমরা খুব সহজেই মোকাবেলা করতে পারব। সবার জন্য শুভকামনা থাকল।
লেখা : ডা। শ্রাবণী দাস, আর এম ও, আজগর আলী হাসপাতাল, ঢাকা।
ছবি: সংগৃহীত