ক্যারিয়ার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত যত আর্লি নেওয়া যায়, ততই ভালো। আমাদের দেশে অনেকেরই এটা বুঝতে বুঝতে দেরি হয়ে যায় যে সে ভবিষ্যতে কী হতে চায়। এমনকি অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পরও অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে যে এখন সে কী করবে।
ক্যারিয়ার বলতে এখানে বোঝানো হয় যে কোনো একটা কাজ বা পেশা, যাতে কিছু আয় হবে। কিন্তু ক্যারিয়ার আদতে এমন কিছু না। ক্যারিয়ার হচ্ছে সফলতার উদ্দেশ্যে যাত্রা, স্বপ্নের পথে যাত্রা। মানে আমি যে পেশাটায় নিয়োজিত আছি সেখানে আরাম পাচ্ছি, সুখ পাচ্ছি, স্বাচ্ছন্দ্যে আছি। যদি আমি কমফোর্টই ফিল না করি, তাহলে টাকা দিয়ে আমি করব কী!
বিদেশে ক্যারিয়ার গঠনে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হেল্প করে। ছাত্রছাত্রীদের কোন দিকে আগ্রহ এটা বুঝতে পেরে বাবা-মা বা স্কুলশিক্ষকেরা খুব অল্প বয়সেই বাচ্চাদের তার শখ-স্বপ্ন ও আগ্রহের জায়গাগুলোতে চালিত করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই।
অনেকেই মনে করেন, ভারতবর্ষে শিক্ষার যাত্রাটাই শুরু হয়েছে কিছু কর্মসংস্থান তৈরির জন্য! এ দেশে কর্ম অনেকটা বোঝার মতো। কিন্তু কাজও যে আনন্দময় হতে পারে এবং তাতে ব্যক্তি ও দেশের মঙ্গল হতে পারে, এমন নজির খুব বেশি নেই। ক্যারিয়ার হতে হবে এমন, যাতে নিজের মঙ্গল হয়, দেশ ও দশেরও উপকার হয়। তা না হলে অসংখ্য শ্রম অকারণে বৃথা যাবে।
যেখানে পৌঁছাতে চাও
তুমি কোথায় পৌঁছাতে চাও, এটা তোমাকেই আগে বুঝতে হবে। সত্যিই এটা আর কেউ বুঝবে না। কিন্তু বুঝতে পারলেও এই সিদ্ধান্ত নিতে তোমার দেরি হতে পারে যে সত্যিই তুমি এ পথে চলতে চাও কি না! কারণ, তোমার পরিবার হয়তো অন্য রকম কিছু চাইতে পারে। সাধারণত আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো ক্যারিয়ার বলতে বোঝে কেবল ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ আরও কিছু নির্দিষ্ট আদি পেশা, যার মাধ্যমে ভালো আয় হয় কিন্তু গত ২০-৩০ বছরে যে ক্যারিয়ার ফিল্ডের অনেক কিছুই বদলে গেছে এ বিষয়ে বাবা-মায়ের খুব ভালো ধারণা নেই।
তোমরা যারা আমির খান অভিনীত ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটি দেখেছ তারা খুব ভালো করেই জানো বাবা-মায়েরা এখনো কেমন করে ছেলেমেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে থাকে। কিন্তু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী না হয়েও তুমি শুধু একজন আর্টিস্ট বা লেখক হয়েও মাসে লাখ টাকা আয় করতে পারো। যদি তুমি চাও তোমার স্বপ্নের পথে যেতে, যে কোনো পেশাতেই তুমি সফলতার চূড়ায় উঠতে পারো। বিষয়টা হচ্ছে আগে তোমাকে চাইতে হবে, নিজের কাজটার প্রতি হানড্রেড পারসেন্ট পেশন্যান্ট থাকতে হবে।
তা না হলে যত বড় পেশাই হোক, তুমি ছিটকে পড়ে যাবে। এমন উদাহরণ চোখের সামনে আছে, আত্মীয়স্বজন বা ক্ষমতাবান কাউকে ধরে খুব বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু যোগ্যতার কারণে সেখানে আর টিকতে পারেনি। নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে মান বাঁচাতে। তাই তুমি কোথায় পৌঁছাতে চাও এবং সেখানে পৌঁছানোর জন্য তুমি কতটুকু তৈরি, সেটা তুমিই সবচেয়ে ভালো জানো।
ক্যারিয়ারে সফলতা কী?
ক্যারিয়ারে সফলতা কী? প্রশ্নটা একটু জটিল। সফলতা বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? ধরো, তোমার এক বন্ধু বিরাট ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দিয়ে এর মধ্যেই কোটিপতি হয়ে গেছে। কিন্তু তার এক মুহূর্তের অবসর নেই। দিন-রাত ছুটছে। ভোরবেলা সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে। প্রিয়জনের সান্নিধ্যও পায় না ঠিকমতো। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারে না মাসে একবারও। বন্ধুরা ফোন করলেই বলে, ‘ব্যস্ত রে, রাখি, পরে কথা বলব।’ এমন লোককে আর যা-ই হোক সফল বলা যায় না। তার হয়তো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে, কর্মক্ষেত্রে সে সফলও, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কি আসলেই সে সফল?
আবার ধরো, তোমার এক বন্ধু একটা পত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলে কাজ করে। মাসিক বেতন ধরো তার মাত্র ৩০-৪০ হাজার টাকা। একটু টানাটানি আছে। তারপরও এ দিয়ে ভালোই চালিয়ে নেয়। নিয়মিত গান শুনে, সিনেমা দেখে, বই কেনে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। নিজের অলস-অবসর সময়টা দারুণভাবে উপভোগ করে। তাহলে কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি সফল বলবে? আসলেই সফলতার সংজ্ঞা বোঝাটা একটু কঠিন। এ নিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দারুণ একটা কথা আছে। তিনি বলেছিলেন,
চোর-বাটপারও অনেক সময় সফল হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের সফল লোকদের মধ্যে ৮০ ভাগই তো দুর্বৃত্ত। এমন জিনিস নিয়ে পাগল হওয়ার আর কী আছে? সবচেয়ে বড় যা জিনিস সাফল্য নয়, সার্থকতা।
তাই তো। শেষ পর্যন্ত দিন শেষে আমি শান্তিমতো ঘুমাতে যেতে পারছি কি না, আর আমি আমার স্বপ্নের পথে স্থির আছি কি না, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।
বাংলাদেশে সফল ক্যারিয়ার হিসেবে যে পেশাগুলোকে আইডেন্টিফাই করা হয়
তারপরও কিছু পেশা আছে, যা আর্থিক নিরাপত্তা দেয়, সামাজিক সম্মানও দেয়। এ রকম কিছু পেশার মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার ছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশে এমন কিছু নতুন পেশার উদ্ভব হয়েছে, যেখানে খুব সহজেই আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক সম্মানও আসতে পারে। যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, ডিজাইনার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং। এগুলোর পাশাপাশি নানা রকম ক্রিয়েটিভ কাজ তো আছেই। চাইলেই এখন কেউ শুধু ফটোগ্রাফি করে লাখ টাকা ইনকাম করতে পারে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এখন খুবই আকর্ষণীয় একটি পেশা। এর সঙ্গে মেকআপ আর্টিস্ট, স্টাইলিস্ট, ক্যারিয়ার গ্রুমিং, করপোরেট ট্রেইনার, মোটিভেশনাল স্পিকার, ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট তো আছেই। তুমি চাইলে ইউটিউবে একটা চ্যানেল খুলে তথ্যচিত্র নির্মাণ করে কিংবা মোটিভেশনাল কথাবার্তা বলে কিংবা নানা মজার মজার ভিডিও আপলোড করেও এখন টাকা কামাতে পারো। মোট কথা টাকা কামানোর একটা অসংখ্য পথ আছে এবং তা তুমি করতে পারবে তোমার শখ, স্বাধীনতা বজায় রেখেই।
তোমার শুধু দরকার হবে ইচ্ছাশক্তি আর স্বপ্ন। এসব করতে, শিখতে খুব বেশি টাকাপয়সারও প্রয়োজন হয় না। তা তুমি করতে পারবে কিছু ধারদেনা করেই। গুগল সার্চ দিয়েই তুমি জেনে নিতে পারবে কীভাবে কী করতে চাও। আর বন্ধুদেরও হেল্প পাবে। আর এসবও যদি না পারো, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ-বিজিবিতেও প্রচুর লোক নেয় প্রতিবছর। এগুলো যে কোনো দেশেরই সম্মানজনক ও নিরাপদ পেশা। নিজের পছন্দমতো কোথাও ঢুকে পড়ো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দরকার শুধু দক্ষতার আর পথযাত্রার।
যারা উচ্চমর্যাদার পেশা ছেড়েছিলেন
সত্যি বলতে নিজের পছন্দমতো পেশা বেছে নেওয়াটা সহজ কথা নয়। সবার এ সৌভাগ্যটা হয় না। খুব অল্প কিছু মানুষই এ বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন। আসলে সৌভাগ্যবান না, তারা সাহসী ও পরিশ্রমী। তারা নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে শিখেছেন। অনেক সময় আর্থিক-সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা নিজের পছন্দকে বিসর্জন দিই। আবার এমন বিরল দৃষ্টান্ত আছে, যারা নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অনেক উচ্চমর্যাদার পেশা ছেড়েছেন।
যেমন বাংলাদেশের জনপ্রিয় নাট্যকার হাসান ফেরদৌস। তিনি আর্মি অফিসার ছিলেন। নাটক লেখার জন্য সামরিক বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলম হাতে তুলে নিলেন এবং সফল হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বাংলাদেশের সফল নাট্যকারের খ্যাতি ধরে রেখেছেন। নাটক-সিনেমা বানানোর জন্য এবং সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে যুক্ত থাকার জন্য হুমায়ূন আহমেদও একসময় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তত দিনে তিনি অবশ্য সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাও শেষ বয়সে এসে এমন সম্মানজনক একটি চাকরি ছেড়ে দেওয়া সহজ কথা না।
তার চেয়েও বড় উদাহরণ কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একটা স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেই ষাটের দশকে। তখনো আমেরিকা এক স্বপ্নের দেশ, আর ভারতীয় কিংবা উপমহাদেশের লোকদের জন্য সেখানে যাওয়াটা সহজ কথা নয়। সুনীল সেখানে গিয়ে সারা জীবনেরই থাকা-খাওয়া এবং চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন, আমেরিকা থেকে তিনি কী করবেন? তিনি তো লিখবেন, আর তাকে লিখতে হবে বাংলাতেই। নিতান্তই শূন্য হাতে তিনি নিজের দেশে ফিরে এলেন। তারপর তার উত্থান আর কারও জানার বাকি নেই। তিন-চার দশক ধরে তিনি বাংলা সাহিত্য শাসন করে গেছেন। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।
রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে পড়তে গিয়েও ব্যারিস্টার না হয়ে ফিরে এসেছিলেন। তাতে তার সফলতা কেউ আটকাতে পারেনি।
আজকের প্রযুক্তি জগতের দুই মহান দিকপাল মার্ক জাকারবার্গ এবং বিল গেটসও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ছিলেন বিরাট ফাঁকিবাজ। কিন্তু আজকের পৃথিবীর তারাই সবচেয়ে সফলতম ব্যক্তি। আমি এটা বলতে চাচ্ছি না যে স্কুল ফাঁকি দিলেই কেউ রবীন্দ্রনাথ হয়ে যায়, বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে নিজের কাজটা ভালোবাসা দিয়ে করলে যে কোনো উপায়েই মানুষ সফল হতে পারে। কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারে না।
বাবা-মায়েরা আরেকটু সচেতন হতে পারো
আমাদের সমাজে পরিবার, পিতা-মাতা এখনো সন্তানবান্ধব নয়, বরং তারা খুব কর্তৃত্বপরায়ণ। বেশির ভাগ বাবা-মা’ই সন্তানদের নিজের ইচ্ছা ও খেয়ালখুশিমতো চালাতে চায়। তারা মনে করে এটা তারা সন্তানদের ভালোর জন্যই করছে। তাতে সন্তান হয়তো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতও হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই সন্তান বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীও হয়ে ওঠে। এটা বোঝা যায় অনেক পরে, যখন সন্তান স্বাভাবিকভাবে আর কারও সঙ্গে চলতে-ফিরতে পারে না।
পড়াশোনা থেকে শুরু করে ক্যারিয়ার পর্যন্ত বাবা-মায়েরা তাদের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন। তারা শুধু মানুষের কাছ থেকে শুনেছে এটা করলে ভালো হবে, ওটা পড়লে ভালো হবে, ওই চাকরিটা ভালো। ব্যস, এতটুকু জেনেই তারা সন্তানের ওপর জোর করে সেই বোঝা চাপিয়ে দেয়। খুব অল্প বাবা-মা’ই সন্তানের ইচ্ছা ও স্বপ্নকে মূল্য দেয়।
এখন বিসিএস বা সরকারি চাকরির জন্য অনেক বাবা-মা’ই সন্তানদের চাপ দিয়ে থাকে। কিন্তু সন্তানের হয়তো কোনো সৃষ্টিশীল পেশায় আগ্রহ, বেতনের চেয়ে, সামাজিক স্ট্যাটাসের চেয়ে সে বেশি প্রাধান্য দিতে চায় নিজের ইচ্ছা ও স্বাচ্ছন্দ্যকে। কিন্তু বাবা-মা তার ইচ্ছাকে কোনো গুরুত্বই দিল না। উল্টো বলবে, এটা কোনো কাজ হলো, এসব করলে মানুষকে মুখ দেখাব কী করে! ও দেখো কত বড় জব করে, তোমার খালাতো ভাইকে দেখো ব্যাংকের অফিসার, তোমার মামাতো বোন ডাক্তার, আর তুমি এসব করবে! এতেই সন্তানের মনটা মরে যায়।
বরং সন্তান যা-ই করতে চায়, তাতেই যদি উৎসাহ দেওয়া যায় তাহলে সেখানে ভালো করার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। আর পরিবার থেকেই যদি সে উৎসাহ না পায়, তখন আসলে খুব বেশি দূর আর এগোনো যায় না। আজকালকার আধুনিক বাবা-মায়েরা অবশ্য সন্তানের ইচ্ছাকে অনেক মূল্য দেয়। তবে সন্তানের ইচ্ছাকে মূল্য দেওয়ার জন্য সেই সব বাবা-মাকে কতখানি সুশিক্ষিত হতে হবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, তাহলে কাউকে ঠেকানো যায় না। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে পৃথিবীজুড়েই। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্রেডিং সাইট আলিবাবার কর্ণধার জ্যাক মার কথা আমরা জানি। তিনি চীনের শীর্ষ ধনী। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলেন না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বারবার ফেল করে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। সেখানেও কৃতকার্য না হওয়ায় লেখাপড়ার পাট জীবনের তরে চুকিয়ে দেন।
বহু চাকরির আবেদন করে ব্যর্থ হন। চীনে যখন প্রথম কেএফসি আসে, সেখানেও তিনি আবেদন করেন। ২৪ জন প্রার্থীর মধ্যে ২৩ জনকে নেওয়া হয়, একমাত্র যে ব্যক্তিটিকে নেওয়া হয়নি তিনি জ্যাক মা। তাও তিনি আশা ছাড়েননি। এখন বিশে^র অন্যতম ধনী ব্যক্তি। এখন তিনি হাসতে হাসতে নিজের ব্যর্থতার কথা বলে বেড়ান।
এমন উদাহরণ আছে, জনপ্রিয় প্রযুুক্তিবিদ অ্যাপেল ইনকরপোরেশন ও পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিভ জবসকে নিয়েও। তার আসল বাবা-মা এত গরিব ছিলেন যে তাকে ছোটবেলায় দত্তক দিতে বাধ্য হন। হাইস্কুল শেষ করার পর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ক্যালিগ্রাফিসহ কিছু কোর্স শিখেছিলেন। আর ছিল কম্পিউটারের প্রতি প্রচুর আগ্রহ। পরে বন্ধু রোনাল্ড ওয়েনকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান অ্যাপেল গড়ে তোলেন। কিন্তু একসময় ভুল-বোঝাবুঝির কারণে এই প্রতিষ্ঠান তাকে ছেড়ে দিতে হয়। নিজের হাতে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে তিনি হতাশায় বিমর্ষ হয়ে যান।
পরবর্তী সময়ে সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে আবার উঠে দাঁড়ান। গড়ে তোলেন নিজের প্রতিষ্ঠান নেক্সট ইনকরপোরেটেড। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে অসংখ্য সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। তার আশা-জাগানিয়া বক্তব্যগুলো পৃথিবীজুড়েই অনেক জনপ্রিয়। তার কথাগুলো এখন বাণী চিরন্তনীর মতো স্মরণীয়। তার জনপ্রিয় উক্তিগুলোর মধ্যে আছে,
আপনাকেও পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে, এমন চিন্তাই কেবল কোনো কিছু হারানোর দুশ্চিন্তা থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে। আপনার জীবনের একটি বড় অংশজুড়েই থাকবে আপনার কর্ম এবং যে কাজটি নিজের কাছে সেরা বলে মনে হয় সেই কাজটি করতে পারাই হলো আত্মতুষ্টির একমাত্র উপায়। কবরস্থানে সবচেয়ে ধনী হয়ে থাকার ব্যাপারটি আমার কাছে তেমন কিছুই মনে হয় না…রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় এটা ভেবে ঘুমানো উচিত যে আমরা দারুণ কিছু করতে পেরেছি…এটাই আমার কাছে বড় ব্যাপার।
সুতরাং তুমি কী হতে চা-ও সেটাই হচ্ছে বড় ব্যাপার। যদি তোমার লক্ষ্য অটুট থাকে, তোমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। একটা কথা আছে, যদি তুমি কিছু চাও তাহলে অবশ্যই পাবে, আর যদি না পাও তাহলে ধরে নিও তুমি আসলে মন থেকে ওটা চাওনি।
আবার এ কথাও সত্য, আমরা সবাই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব নই। ইচ্ছা করলেই আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি না। তারা তো লাখ, কোটিতে একজন-দুজন। আমরা বেশির ভাগ মানুষই তো খুব গড়পড়তা সাধারণ মানুষ। কোনো রকমে একটা কাজকর্ম করে একটু ঘুরেফিরে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। এত সফল আমরা সবাই হতেও চাই না। চেষ্টা করলে সেটা করা কঠিন কিছু না। এ কথা সত্য ভয়ংকর প্রতিযোগিতার এই পৃথিবী।
দিন দিন সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বাড়ছে। আবার এ কথাও সত্য, প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কর্মক্ষেত্র, নানা সুযোগ-সুবিধাও। আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে কোনো একটা কাজে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলে অন্য পথ খুঁজতে হবে। নিজের আগ্রহের সবগুলো জায়গায় টোকা দিয়ে দেখতে হবে। একটা কথা আছে, তুমি টোকা দাও, দরজা খুলে যাবে। হাঁটো, পথ পাবে।
আজকাল অনেকেই একটা নির্দিষ্ট বিশ^বিদ্যালয়ে বা নির্দিষ্ট সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। যেন ওই একটা মাত্র সাবজেক্ট বা বিশ্বিবদ্যালয়েই তার জীবন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পায়নি বলে তিন দিন হতাশায় ভাত খায়নি এমন ছেলে আমি চোখের সামনে দেখেছি। অথচ ডাক্তার হতে চাইলে দেশে এখন অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সে শেষ পর্যন্ত একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ডেন্টালে ভর্তি হয়েছিল এবং এখন সে সফল।
আমার আরেক বন্ধু ইংরেজি সাহিত্যে পড়ত জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের একটা কলেজে। এ নিয়ে তার মনে খুব সংকোচ ছিল। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে সে কী করবে? যেখানে বড় বড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করে নাকি ছেলেমেয়েরা বেকার থাকে বলে সে শুনেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার সে এখন একটা বিদেশি ফার্মে কাজ করে। কয়েকবার বিদেশে গিয়ে ঘুরে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সে পড়াশোনাটাকে নিয়েছিল প্রেম হিসেবে, যা-ই পড়ত বুঝে পড়ত, আগ্রহের জায়গা থেকেই সে ইংরেজি সাহিত্য বুঝতে চেষ্টা করেছিল। এখন সে সফল।
কেউ যদি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে দক্ষ হয় তাকে ঠেকিয়ে রাখার মতো শক্তি এই পৃথিবীতে কারও নেই। আজকাল তো একটু ভালো ইংরেজি জানলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় একটু ভালো হলে বিদেশে পড়তে যাওয়াটাও কোনো ব্যাপার না। প্রচুর ছেলেমেয়ে এখন প্রতিবছর লন্ডন, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে। বিদেশে যাওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ পড়াশোনার মাধ্যমেই।
শেষ করি অসামান্য একটা গল্প দিয়ে। এক পাথুরে পাহাড়ের ওপরে বড় একটা গাছ বেড়ে উঠেছে। এটা দেখে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা তো বিস্মিত, আরে এখানে এই গাছটা এত বড় হলো কী করে! এখানে তো পানির কোনো উৎস নেই। পানি ছাড়া তো এই গাছ বাঁচার কথা না। আর তো এ রকম কোনো গাছ নেই আশপাশে। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, গাছটা যখন এত বড় হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও পানির উৎস আছে। তারা গাছটার গোড়া থেকে খুঁড়তে শুরু করলেন। অনেক দূর খোঁড়ার পর দেখেন শিকড়ের মূলটা বাঁকা হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে। তারা সেদিকেও খুঁড়লেন এবং কী আশ্চর্য, সেদিক দিয়ে পানির একটা শীর্ণ ধারা বয়ে যাচ্ছে।
গাছ যদি নিজের পথ খুঁজে নিতে পারে, তুমি তো মানুষ। তুমি এত ভয় পাও কেন!
লেখা: কামরুল আহসান
ছবি: সংগ্রহীত