রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
ট্যাগ:

গল্প

গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

পাহাড়ের চাঁদ – কাজী রাফি

করেছে Wazedur Rahman এপ্রিল ৫, ২০২০

উঁচু এবং শেষ পাহাড়টা অতিক্রম করলেই আমরা পৌঁছে যাব আমাদের গন্তব্যে। সেখানে আছে প্রাচীন আমলের এক মন্দির, বর্তমানকালে গড়ে ওঠা কয়েকটা নান্দনিক অবকাশযাপন কক্ষ। তার আশপাশে ট্র্যাকিং করলে পাওয়া যায় নাকি বেশ কিছু ঝরনা। সেই সব বাংলো থেকে পাহাড়ের চাঁদটাকে নির্জন রাতে কেমন লাগে, তা নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প। যে যেভাবে এই পাহাড়ের চাঁদকে অনুভব করে, এখান থেকে ফিরে গিয়ে সেভাবেই তারা ফেসবুকে গল্প ছড়িয়ে দেয় বলে এখন এত মানুষের আনাগোনা এই দুর্গম পাহাড়েও। অথচ দশ বছর আগে এখানে মানুষ আসার ঘটনা খুব কম ঘটত। পথের যাতনাটুকুই বড় ছিল। যারা আসতেন তাদের কাছ থেকে এই পাহাড়-মন্দিরে গল্প যত মানুষ শুনতেন তার চেয়ে বেশি শুনতেন যন্ত্রণাভোগের করুণ কাহিনি। বেশি মানুষের উপস্থিতির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেলে মানুষ মনে হয় যন্ত্রণার মাঝে বীরত্ব খোঁজে। কষ্ট পাওয়ার চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করার স্মৃতি তখন তখন তাদের কাছে বড় হয়ে যায়।

আমার কেন যেন মনে হয়- মানুষের উপস্থিতি দেখার আনন্দ-নেশায় মেতে ওঠার জন্য স্রষ্টা এমন করে সাজিয়েছেন এই অপরূপ বিশ্বকে। মানুষের উপস্থিতিতেই পাহাড়ের সত্তা সাত্তিক, ঝরনার হৃদয় কলকল, প্রকৃতির আত্মা উন্মুখ, নদী-সাগরের মন টলমল করে ওঠে! কারণ আর কিছুই নয়- প্রকৃতি হয়তো মানুষের অনুভূতিকেই নিজের মাঝে ধারণ করে। তারই প্রতিফলন ঘটে মানুষের উপস্থিতে। সে জন্যই এই ব্রহ্মাণ্ডের লুকানো আত্মা মানুষের স্বপ্নের ভাষা বুঝতে ব্যগ্র এবং ব্যাকুল বলে নির্জন পাহাড়ে রাতের ডেকে যাওয়ার তান বড় অনন্য।
গত পাঁচটা দিন পাহাড় অতিক্রম করতে করতে আমাদের শরীরে ভয়ানক শ্রান্তি আর অবসন্নতা। ক্লান্তিও যে উপভোগ্য- এমন নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতির কাছে না এলে তা আর টের পেতাম না।
জনমানবহীন নীরব, নিস্তব্ধ প্রকৃতি-আকাশের কাছাকাছি এবং ঘাস-গাছ-লতাপাতার এই সবুজ বেষ্টনীর মাঝে ক্লান্তিতে প্রায় বিধ্বস্ত আমাদের শরীর। সামান্য বিশ্রাম, ঝরনার জল আর খাবার পেলেই কী এক সঞ্জীবনী শক্তিতে সামনে যাওয়ার তাড়নায় তা জেগে উঠছে। অদ্ভুত এবং অনন্য প্রেরণায় এগিয়ে যেতে যেতে ভাবি, সামনে তো এমনি লতা-ঘাস আর পাহাড়ি গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই। তবু কী আর নতুনত্ব দেখার নেশায় এমন কষ্টকর পথ পাড়ি দেওয়া!  সতীর্থ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে তার উত্তরও পাই- আমরা কয়েকজন আসলে এই পথচলাতেই মানবের সমগ্র জীবনের তুচ্ছতাকে উপলব্ধি করছি বলে অজানা গন্তব্যও আজ আমাদের কাছে মহার্ঘ! তা ছাড়া ডাক্তারি বিদ্যায় নতুন এক ডিগ্রি লাভ করতে গিয়ে কঠোর সময়ানুবর্তিতার নির্মম চাবুকে আমাদের জর্জরিত জীবন যেন নির্বাণ লাভ করেছে। পাঠ শেষের আনন্দ মিশে গেছে এসব থেমে থাকা পাতার মর্মরে। নিস্তব্ধ রাতে নির্মল নীলের অবারিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথার কাছে নেমে আসা আলোয় ধোয়া চাঁদের দিকে তাকালে কত-কী যে অনুভব করি- তা আর ভাষায় বোঝাই কী করে!

আমাদের মতো আরও বেশ কিছু দলবদ্ধ মানুষও জীবনের এই মায়ার কুহেলিকা খুঁজতে ছুটছে উঁচুতে। আরও উঁচুতে। মানুষের আত্মা, খুব সম্ভবত জগতের প্রাকৃতিক মিথস্ক্রিয়ায় ধুয়ে উঠলেই তৃপ্ত হয়। অবারিত দিগন্তের দিকে না তাকাতে পারলে তাদের সৃজনশীল সত্তা জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যায়। সে জন্যই কি উঁচুতে উঠে দূর-দূর দিগন্তকে দেখার নেশা মানুষের রক্তে লুকানো? হবে হয়তো। এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর একজন দার্শনিকের কাছেও নেই বলেই আমার ধারণা। দলবদ্ধ মানুষগুলো তাই হয়তো নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ছুটছে পাহাড়ে। নিজেকে জোছনায় ধুয়ে তারা এক একজন চাঁদ হয়ে উঠবে বলে! তাদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে গেলেই তারা পরশপাথর গোছের কিছু একটা পেয়ে যাবে অথবা এই জগৎ এবং ঈশ্বরের মাঝে যে সম্পর্ক সেখানে লুকিয়ে আছে- তার সূত্রের সন্ধান পাওয়ার কাছাকাছি তারা প্রায় পৌঁছে গেছেন। এ মানবজীবনের এক ট্র্যাজেডি বটে!

জীবনের এই মায়াময় সব সূত্র একসঙ্গে আমার অনুভবে তোলপাড় আন্দোলন তুলল, যেদিন সন্ধ্যা নামার আগেই পূর্ণিমার চাঁদকে মাটিতে দেখলাম। তার আগে বলে নিই, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি খাড়া পথ এত উঁচুতে এসে যেন একটু থিতু হয়েছে। হাঁটুতে হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দূরে নিচুতে ফেলে আসা সমতল ভূমির দিকে তাকালাম। একদম মানচিত্রের মতো না হলেও মনে হলো ছোট ছোট টিলাগুলো পেরিয়ে অসংখ্য রেখার সীমানা অঙ্কিত মনুষ্য বসতির ওই স্থানটুকু সবুজের গালিচা আর জলের ফোয়ারা দিয়ে সাজানো। অস্তমিত হওয়ার আগে সূর্যমামা তার ঝাঁজ কমালেও প্রকৃতির মাঝে যে ভ্যাপসা গরম নিজেদের বিকিরিত করছে, তাতে দুপুরের চেয়ে এখন শরীর থেকে বেশি ঘাম ঝরছে। ‘ভ্যাপসা’ শব্দ যখন উচ্চারণ করছি অথবা যখনই শব্দটা মনে আসছে তখন তার সঙ্গে পাহাড়ি বুনো ফুলের ঘ্রাণটুকু আমাকে আচ্ছন্ন করছে।

আর সঙ্গে সঙ্গে প্রবল তেষ্টায় শুকনা ঠোঁট এবং পিপাসায় কাতর আমার খাদ্যনালি জলে ভিজতে চাইল। আর বিশ্বাস হলে করুন, না হলে না-ই বা করুন এই শব্দের সঙ্গে আরও কিছু ব্যাপার-স্যাপার আমাকে আনমনা স্বপ্নের ঘোরে তলিয়ে নিচ্ছে, যা বলতে আমি দ্বিধান্বিত। তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি, আমি এই শব্দের সঙ্গে পাহাড়ের ঘ্রাণ মিশিয়ে কোনো একজন স্বপ্নতরুণীকে কল্পনা করছি, যার ঘর্মাক্ত শরীরে এমন বুনো সব ফুলের ঘ্রাণ আর বনস্পতির স্নিগ্ধতা জেগে থাকে। ওপর থেকে দূর, বহুদূর পর্যন্ত দেখার সময় স্মৃতিগুলোও কেমন মায়াময় হয়ে ওঠে!

পাহাড়ে কি মানুষ আসে তাহলে নিচে, এক অনন্ত আকাশতলে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষদের জীবন-অভিযোজনে সুখ-দুঃখের ব্যঞ্জনার আড়ালে অনিত্যতাকে দেখে নেওয়ার জন্য? স্রষ্টাও কি একই উদ্দেশ্যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছেন? বিচিত্র সব প্রাণ আর প্রাণীর মাঝে মানুষকে লাগামহীন বিবেক-বুদ্ধি দিয়েও ‘সময়’ নামক এক যাযাবরের লাগামে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অনন্ত লীলা দেখে দেখে নিজের অসীম সময়কে উড়ে চলার পাখনা বানিয়েছেন? আমার নিজের কাছেই এই সব কোনো সম্ভাবনাকে খুব জুুতসই বলে মনেও হয় না। আবার কোনো ভাবনা যে একেবারেই অর্থহীন তা-ও মনে হয় না। সম্ভাবনাহীনতার মাঝে জীবনের যে উদ্দেশ্য, ডাক্তারি বিদ্যা পাঠের কারণে আমার চেয়ে তা আর কে বেশি জানে!

আমার দলের কারও মনে হয় ওপর-নিচ, এই জীবন আর তার অনিত্যতা- এসবে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। তারা গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথবা তারা এত ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত যে পাহাড়ের বিশ্রাম কক্ষের প্রশান্তি-কল্পনার তাড়নায় তারা দ্রুত পৌঁছাতে চাইছে পাহাড়চূড়ায়। কিন্তু পেছনে ফেলে আসা সমতলভূমির দিকে তাকিয়ে কী এক নস্টালজিয়ায় আমার আর সামনে এগোতে ইচ্ছা করল না। মাটিতে হেলে পড়া একটা গাছের ডালে শরীর এলিয়ে কাঁধের থলে থেকে জলের বোতল বের করলাম। হ্যাঁ, তখনই দেখলাম তাকে। পড়ন্ত বেলায় সেই পাহাড়ের চাঁদ আমার পাশে আমার ভঙ্গিতেই তার শ্রান্ত শরীরকে বিশ্রামে নিল। জলের বোতলের মুখটা আর খোলা হলো না। কেন না, তার শরীর থেকে বনস্পতি আর আপেলের মিষ্টি ঘ্রাণটুকু আমার কাছে তখন এত মহার্ঘ্য যে, পিপাসার্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তের প্রচেষ্টার কারণে তা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি স্থির হয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকাল। মিষ্টি করে হাসল। তারপর জলের বোতলে চোখ পড়তেই পরক্ষণেই সেই হাসি তার মিলিয়ে গেল। তার চোখের নিচে, গলার কাছে ঘামের স্বেদবিন্দু যদিও আমার জলতেষ্টা দ্বিগুণ করে তুলল। তবু আমি মেয়েটার দিকে বোতল এগিয়ে বললাম, তুমি মনে হয় খুব পিপাসার্ত।

কোনো দ্বিধা এবং দ্বিরুক্তি ছাড়াই তরুণী আমার জলের বোতল হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে গলায় জল ঢালতে ঢালতে হঠাৎই থামল। ততক্ষণে আধা বোতল জল শেষ! আমার দিকে মিনতির চোখে তাকিয়ে সে বলল, সরি, আমি এত পিপাসার্ত যে, তার বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই তাকে আশ্বস্ত করলাম, ঠিক আছে, তোমার পিপাসা না মেটা পর্যন্ত তুমি জলটুকু খেতে পারো। তরুণী আমাকেও তুমি সম্বোধন করতে দ্বিধাহীন।
বলল, কিন্তু, তুমি-
আমার তেমন পিপাসা নেই, একটু আগেই আমি জলপান করেছি। এবার বোতলের বাকি জলটুকু মুখে চালিয়ে দেওয়ার আগে থেমে গিয়ে সে বলল, এখন বললে ‘জলপান’, তখন বললে ‘জল-খাওয়া’- মাথাটা তোমার পুরাই গেছে।
এবার ঢকঢক করে বাকি জলটুকু সে এত পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করল যে আমার খুব ইচ্ছা করল হাঁ করে জলপানরত তার মুখের ভেতর থেকে চঞ্চু দিয়ে একটু পানি দিয়ে আমার জিহ্বা ভিজিয়ে নিই। আহা, আমার মুখটা যদি এখন একটা পাখির ঠোঁট হয়ে যেত! জলপানের মাঝে জগতে এত বিস্ময় থাকে তা আমার জানা ছিল না। আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি বলতে কি, আমি এটুকু বলতে মোটেও লজ্জিত নই যে, আমি তার জলপানের দিকে নয়, তাকিয়ে আছি তার গোলাপি ঠোঁট হয়ে লাল টুকটুকে মুখগহ্বরের ভেতর। যেখানে জল পড়লেও তার আগুনটুকু নিভে যাচ্ছে না! কোনো নারীকে এত কাছ থেকে এমন করে দেখার জন্য এবার একটু লজ্জা পেলাম। মেয়েটা খালি বোতল আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, সত্যিই তোমার পিপাসা নেই তো? চার ঘণ্টা আগেই আমার সব পানি শেষ হয়েছে। কত মানুষের কাছে এক ঢোঁক জল চাইলাম। সবাই বলে যে তার পানি শেষ হয়ে গেছে- আর তুমি কিনা আস্ত এক বোতল পানি বাঁচিয়ে রেখেছ! তোমার বউ খুব ভাগ্যবতী হবে-
কেন? আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা এবার ডালের উঁচু অংশে গিয়ে বসল। পা দোলাতে দোলাতে বলল,
এই যে, তোমার এত ধৈর্য, সে জন্য। বাপ রে, পাহাড় যে কী বস্তু, আজ তা টের পাচ্ছি।
দেখলে তো এক বোতল পানি, এক ঢোঁকের বেলায় কেমন ‘জল’ হয়ে যায়!

আমার কথায় লাজুক ভঙ্গিতে চোখে আড়াল তুলে তবু মুগ্ধ হয়ে সে আমাকে দেখল। ঠিক তখন ভ্যাপসা গরমকে পাশ কেটে স্নিগ্ধ আর মিষ্টি বাতাস বয়ে গেল। না, তা আমার মনে শুধু নয়; শরীরে স্পষ্ট অনুভূত হলো। অপরূপা সেই ভঙ্গিমায় তখনো আমাকে দেখছিল। তার অপলক চাহনি আমাকে করাত দিয়ে কেটে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। আমি এক থেকে দুই, দুই থেকে চার এবং শেষে অযুত সংখ্যায় পরিণত হয়ে নিযুত অনু-পরমাণুতে মিশে গেলাম। মিশে গেলাম করতল হয়ে কপোলে, শরীর থেকে হৃদয়ে স্নিগ্ধ আবেশ তোলা সেই মিষ্টি হাওয়ার সঙ্গে। এবং আমি হাওয়ার পাখনায় নিজের পাখনা মেলে পাশের এই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তরুণীকে নিয়ে উড়ে চললাম নীল আকাশের শেষ সীমানায় যেখানে এক বিন্দু সাদা মেঘ একটা কুঁড়েঘরের অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রবল পিপাসার বোধ আমাকে আবার অসীম থেকে নিযুতে ফিরে আনল। ফিরে আনল আমার এই একটা মানব শরীরে। পিপাসার্ত আমি পানির বোতলটার দিকে তাকালাম। তার তলানিতে কয়েক ফোঁটা জল। আহা, এটুকু জল দিয়েই যদি জিহ্বাটা একবার ভিজিয়ে নিতে পারতাম! তরুণী বোতলটার মুখ অ্যান্টি-ক্লক ঘুরিয়ে বন্ধ করে তবেই আমার হাতে ফেরত দিয়েছে। জলের ফোঁটাগুলোর দিকে একবার আর তরুণীর কাঁধে-গলায়, চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দুর মতো ঘামের দিকে কয়েকবার তাকালাম। মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যের এক আধারকে ঈশ্বরবিন্দুর মতো কয়েক ফোঁটা পবিত্র শিশির আঁকড়ে আছে। জলপিপাসার চেয়ে তা হৃদয়পিপাসা এত বাড়াল! বোতলের জল খেয়ে যত না বাঁচতে ইচ্ছা করল, কেন যেন মেয়েটাকে ভালোবেসে তার চেয়েও বেশি মরে যেতে ইচ্ছা করল। সারা জীবন পড়েছি, শিখেছি- বেঁচে থাকার চেয়ে বড় আর কিছুই নয়। কিন্তু আজ আমি এই প্রথম জানলাম, মরে যাওয়ার কোনো এমন কারণ পৃথিবীতে থাকতে পারে যার জন্য মরে যাওয়ার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো বড় শিল্পময় আনন্দ আর হয় না। আমি মরে গিয়ে তার গলগণ্ডের টিলায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নীলজলের খালের মতো চোখের নিচে জমা স্বেদবিন্দু হয়ে থাকতে চাই। যদি সে আমাকে তার লম্বা আঙুলের অধিকারী হাত-বাহুতে একবার জড়িয়ে নেয়, তাহলে জীবনভর কল্পনা করা স্বপ্ন নামের সব পিপাসা; সত্যি নিমেষেই মিটে যেত।

এবার মেয়েটা তার হাতের নিকষ-কালো বিড়ালের চোখের মতো ঘড়িটায় চোখ রেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে ওপরের দিকে তাকাল এবং কাউকে কোথাও না দেখে বলল, আমার দলের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ওরা মনে হয় এতক্ষণে অবকাশকেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।
না, উঁচুতে দূরের বস্তুকেও অনেক কাছের বলে মনে হয়। আমার দলও নিশ্চয়ই এখনো পৌঁছায়নি।
জানো, আমার সারাজীবন ইচ্ছা করত-
আমি আমার আগ্রহ ধরে রাখতে পারছিলাম না। অধৈর্য কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, কী ইচ্ছা করত?
কোনো একদিন এমন আকাশ-মেঘের কাছে, সবুজ ঘাস-গালিচার পরিচ্ছন্ন এক পাহাড়ে একটা কুঁড়েঘর পেলে সেখানেই থেকে যেতেÑ
মেয়েটার কথায় কী হলো আমি জানি না। তাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো এক কুঁড়েঘর খোঁজার ইচ্ছা মনে হয় প্রবল হলো। কিন্তু পিপাসায় ছটফট করা শরীর এই ইচ্ছার ভার সইতে পারল না। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

২

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি এক কুঁড়েঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে বাঁশের তৈরি এক ছোট্ট ঝাঁপির ওপর যে অদ্ভুত মাটির প্রদীপ। আমার মুখের দিকে ঝুঁকে থাকা নারীর আলোময় বিভাকে ছড়িয়ে দেওয়াই যেন প্রদীপের সামান্য আলোর ইচ্ছা। আকাশ-পাহাড়ে এক কুঁড়েঘরে নেমে আসা পূর্ণিমার চাঁদ আমার হৃদয়কে ঝলসে দিল। বেড়ার ঘরের ফাঁক দিয়ে দূরদিগন্তে ছড়িয়ে পড়া জোছনায় রহস্যময় পাহাড়ি প্রকৃতি বিছিয়ে রেখেছে মায়ার কুহেলিকা। আমি অপরূপার দিকে তাকালাম। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
বড্ড ভয় পেয়েছিলাম। তুমি ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, বুঝিনি। তোমার মুখ খুলে পানি দিতে গিয়ে বুঝলাম, আমার কারণেই তুমি মরতে বসেছিলেÑ
আমি তাকে বলতে চাইলাম, না, না বরং তোমার জন্য আমি নতুন করে বাঁচলাম। এমনই এক জীবন সব সময় কল্পনা করেছিলাম। আকাশ-মেঘের কাছে বাইরে জোছনার রূপালি আস্তরণ আর ভেতরে এক মাটির প্রদীপের পাশে তোমার মতো আকাশ থেকে নেমে আসা এক চাঁদপরি!

কিছুই বলা হলো না। আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে বলেই চলছে, তোমার এত পিপাসা ছিল অথচ তুমি কিনা সব পানি আমাকে পান করালে। শোনো বোকা, মেয়েরা নিজের প্রয়োজন ঠিক বোঝে। তুমি কেন তোমারটা বুঝলে না?

এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব জানি না। তাকে আবার বলতে চাইলাম, আমি তো আসলে এভাবে মরার আনন্দেই মেতে উঠতে চেয়েছিলাম। এই পাহাড়ে আমার সঙ্গে কীভাবে তুমিও দলচ্যুত হলে তা ভাবতে গিয়ে মনে হয়েছিল ঈশ্বর নিশ্চয়ই কেউ আছেন। না হলে এই পাহাড়ের আত্মা কীভাবে সারাজীবন লালিত আমার মনের কথাকে এখানে উসকেই শুধু দিল না, সত্যিও করল।

কিন্তু আমার ভেতরের এত কথা সব কথার কাঁপন হয়ে ভেতরেই রয়ে গেল। সে আমাকে প্রশ্ন করল, তুমি কি কথা বলতে ভুলে গেছ? কিছু মনে পরছে না?
আমি মায়াভরে তার দিকে তাকালাম। তার একটা আঙুল স্পর্শ করতেই তুমুলভাবে আবার বেঁচে উঠলাম। বললাম, আমি আর অতীত মনে করতে চাই না। আজ থেকে যদি আমার অনন্ত জীবন শুরু হতো! পেছনে ফেলে আসা জীবন নয়, শুধু সামনে থাকবে পাহাড়ি এই অবারিত দিগন্ত আর-

এতক্ষণে মনে পড়ল ওর নামটাও আমার জানা হয়নি। ওর নামটা জানার জন্য অস্থির হয়ে তার চোখে চোখ রাখলাম। তার নীল-কালো অক্ষিগোলক আমাকে নিবিরভাবে দেখার সঙ্গে আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যেন আমার কথার অর্থটুকু বোঝার চেষ্টা করছে। ধীর গতিতে একটা শব্দের দুই অক্ষর তার ঠোঁটে খেলা করল, আর? তার প্রশ্নে দ্বিধাহীন হয়ে তাকে বললাম, তুমি এবং তোমার আকাশ-মেঘের কাছে একটা কুঁঁড়েঘর! কিন্তু দেখো, তোমার নাম, জন্মস্থান কিছুই আমার জানা হয়নি।

আমি ইয়াগমুর মার্ভি। তুমি আমাকে মার্ভি বলেই ডেকো। আমার জন্ম সেখানে যেখানে দুই মহাদেশ মিলেছে এক বিন্দুতে। আমার জন্মস্থান বিশ্বের সেই বিন্দুতে যেখানে মাঝে মাঝে বরফ দিনের সূর্য আর রাতে চাঁদের আলোর সঙ্গে খেলা করে।
অমন সৌন্দর্যের মাঝে তোমার দেশের মানুষ চিত্রকর্ম, সুর, আর গানের মাঝে তলিয়ে গিয়ে জীবনের অর্থটুকু বেশি খুঁজে পায়, না?
তা তো হবার নয়। এই বিশ্বের সব প্রান্তেমানুষ এখন মানুষকে নিয়েই ব্যবসার ফন্দি আঁটতে গিয়ে আত্মার সব সৌন্দর্য হারিয়েছে। তোমার এখন কি একটু ভালো লাগছে।

লাগছে। খুব লাগছে। কিন্তু আমাকে এখানে-
হ্যাঁ, তুমি অজ্ঞান হয়ে গেলে। বেলা ডুবে যাচ্ছিল। আমি চিৎকার করে সাহায্য চাইলাম। এই পাহাড়ের একজন বাসিন্দা দুইদিন আগে বাজার করতে সমতলে গিয়েছিলেন। তিনি ঘরে ফিরছিলেন। তার কাছ থেকে জল নিয়ে তোমার মুখে ঢাললাম। তারপর আমার দলের গন্তব্য বাদ দিয়ে এখন আমরা তারই বানানো বিশ্রাম-কক্ষে। অতিথিদের ভাড়া দেওয়ার জন্য এমন নির্জনে তিনি ভাগ্যিস ঘরটা বানিয়েছিলেন। ঘরটার নাম দিয়েছেন তিনি জুমঘর।
কী আশ্চর্য! মনে হচ্ছিল, কোনো এক চলচ্চিত্রের নায়িকার কাছ থেকে তারই মাত্র সম্পন্ন করা অভিনয়ের একটা পর্বের গল্প শুনছি এবং সেই নায়িকার নায়কটাকে ভাবতে গিয়ে আমার হৃৎস্পন্দন এত দ্রুত হলো যে, আমি ঘেমে উঠলাম।
অনেকেই নাকি পৃথিবীর মনুষ্য-জগৎ পালিয়ে থেকে নিরিবিলি আর নির্জনে ‘জুমঘর’ নামের এই প্রশান্তির নিবাসে আসে।
মানুষের কাছ থেকে মানুষ কি আসলে পালায়?
-না
তাহলে?
যে মানুষের সঙ্গে এই জুমঘরে কেউ কয়েকদিন বাস করে তারা আসলে একে অন্যকে আবিস্কার করে। খুঁজে ফিরে। প্রিয় মানুষকে আবিস্কার করে তার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ কি আর আছে, বলো?

মার্ভি নামের স্বর্গের এক পরির মুখে জীবনবোধের অথবা দর্শনের কথা শোনার চেয়ে তার চোখে চেয়ে তা উপলব্ধি করাতেই চেয়ে যে বেশি প্রশান্তি তা জীবনে এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। তার কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে তাই তার চোখের দিকে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে তার কপাল হয়ে কানের পাশে বিস্রস্ত বিন্যাসের কেশের লালিত্যে তাকিয়ে আমি কত কী যে কল্পনা করলাম। তাকে নিয়ে কত কত রঙিন জীবন এক নিমিষেই পার করে দিলাম। মার্ভিকে বলতে চাইলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’ বলা হলো না। কেন যেন ভয় হয়।

এমন এক রাষ্ট্রে আমার যৌবন শুরু হয়েছে, যেখানে মানুষ স্বপ্নের চেয়ে তার পতনবিন্দুকে আগাম দেখার অভ্যাসে আমরা অভ্যস্ত। স্বার্থের কারণে একে-অন্যকে দোষারোপ এবং গুম হয়ে যাওয়ার এক অনিশ্চিত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হলে মনে হয় এমনই হয়! তাকে পাওয়ার আগে তাই তাকে হারানোর ভয়ে মনে হয় ভিতরে কেমন এক আন্দোলন শুরু হয়েছে। মার্ভি উঠে গেল। জুমঘরের মালিকসহ একটু পরে ঘরে ঢুকল। মালিকের পুত্র-কন্যা গরম খাবার নিয়ে তাদের পেছনে এসে দাঁড়াল। পাশের উঁচু মাচাতে তারা পর পর খাবারগুলো সাজিয়ে রাখল। আমার মরে যাওয়া খিদে পুনর্বার চনমনে হয়ে উঠল। মার্ভি আমার হাত ধরে উঠাল। তার প্রয়োজন ছিল না। তবু, মার্ভির হাত ধরার ইচ্ছায় এই দুর্বলতার ভানটুকু নিজের কাছেই মহার্ঘ্য মনে হলো।

পরম তৃপ্তিতে দুজন খেলাম পেটপুরে। তারপর কুঁড়েঘর ছেড়ে বাইরে এলাম। পাহাড়ের প্রান্তে কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। অন্য একটা দেশের আরো উঁচু উঁচু পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসেও আমার সব মনোযোগ বস্তুত মার্ভির দিকে। চাঁদের আলোয় নিচে নেমে আসা আকাশের নীলের সঙ্গে ফিসফিস কথোপকথনের অন্তরালে গাঢ় প্রেমে মেতে ওঠা পাহাড়ি প্রকৃতির প্রেম-নিবেদনের কৌশল থেকে মার্ভির প্রতিনিজের প্রেম নিবেদনের ধরণ কেমন হবে তা ভাবছি। প্রাণ-মন শীতল করেও শরীরে প্রেমের অনল ছড়ানো, নয়নে স্বপ্নের বান ডাকা ঝির ঝির বাতাস ঘাসে-পাতায় শিরশির শিহরন তোলার তালে আমাকেই কি কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে? যাই-ই করুক পাতার শব্দ কেন মর্মর তা আজ আমি আত্মার অনুরনণে অনুভব করছি। জোছনার ডানা মেলা পাহাড়ের এমন প্রান্তর কি এটা? নাকি আমার মৃত্যুর পর স্রষ্টা আমাকে স্বর্গে পাঠিয়েছেন?

মার্ভিই আমার হাত ধরল। শরীর ঘেঁষে নিবিড় হতেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ প্রেমানল হয়ে আমাকে পোড়াল। দ্বিধা ভেঙে আমি মার্ভিকে বাহুলগ্না করলাম। মার্ভির ত্বক আর চুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে যেন পাহাড়ের প্রতিটি ঘাস-গুল্মের প্রাণ হয়ে চিরহরিৎ পাতার অনুতে, আকাশের নীল থেকে বাতাসের ছুটে চলা পথের বাঁকে বাঁকে।

মার্ভি আমাকে জড়িয়ে ধরল। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বিভাময় মুখশ্রী ছাড়া সমগ্র বিশ্বে আর কিছুই যেন সত্যি নয়। আমি বাঁধনহীন হয়ে উঠতে চাওয়ার আগেই সে তাঁর ঠোঁটের স্পর্শে আমার সব স্বপ্নকে একসঙ্গে তোলপাড় অনুভূতির সঙ্গে তলিয়ে নিল। এবার শুধু মুখশ্রী নয়, মার্ভি তার নিজের আলো ছড়িয়ে পাহাড়ের এই রাতকে ঝলসে দিতে তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। খোলামেলা স্থানবলে আমি দ্বিধান্বিত হলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এক বিদেশিনীকে নিয়ে এই পাহাড়ে আমি! কয়েকদিনের মধ্যে পত্র-পত্রিকা যদি তার ‘গুম’ হয়ে যাওয়া নিয়ে খবর ছড়ায়? ভেবে আমি শিহরিত আর চিন্তিত হয়ে উঠলাম। মার্ভির হাতে তখন আমার টি-শার্ট। সে বলল, তুমি আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের সবচেয়ে প্রিয় সেন্টটা নিজের শরীরে মেখে আমার সর্বনাশ করেছ!

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণযুক্ত পৃথিবীখ্যাত এক সুগন্ধির সঙ্গে টি-শার্টটা আমার মামা লন্ডন থেকে ফেরার সময় আমার জন্য এনেছিলেন। বিয়ের জন্য দেশে আসার তিন মাসের মাথায় আমার মামাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিয়ের পরপরই মামি বিধবা হয়েছেন। প্রিয় ভাইয়ের অন্তর্ধানে আমার মা পাগলপ্রায়। আমার কিছু হলে মাকে আর হয়তো বাঁচানোই যাবে না। এ ভাবনা আমার উদ্বিগ্নতা এত বাড়িয়ে তুলল যে আমি ‘ভালোবাসা’সংক্রান্ত সব অনুভূতি হারিয়ে ফেললাম। অথচ মার্ভির উদ্ভিন্ন, বুনো সৌন্দর্য দেখে তখন প্রকৃতিও এত মাতাল হয়ে উঠেছে যে, বাতাসের এলোমেলো দিক পরিবর্তন মার্ভির ছোট করে রাখা কেশগুচ্ছেও উন্মাতাল। মার্ভি ছোট বেঞ্চটায় আমাকে ততক্ষণে শুইয়ে দিয়েছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে তার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করলাম। সে আঙুলটা কামড়ে দিল। উন্মত্ত হওয়ার পরিবর্তে আমি আরও শান্ত হয়ে তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা করলাম। সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে অনেকক্ষণ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ফিসফিস করে বলল, এই-ই আমার প্রথম ছিল এবং আমি যতদূর জানি, ছেলেদের জীবনে ‘পিরিয়ড’ বলে কোনো শব্দ নেই।

আমি তার চুলে বেণি কাটলাম। উদ্বিগ্ন একজন মানুষের স্পর্শ মার্ভির কাছে প্রেমিকের চেয়ে মনে হয় পিতার স্পর্শের মতোই লাগল। সে তবু প্রশ্ন করল, ভদ্রছেলে! বাইরে অস্বস্তি বোধ করছ? ঘরে চলো। কিন্তু সারাজীবন ধরে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, পণ করেছিলাম যে, পাহাড়ে-জোছনায় এমন নির্জনে প্রিয় কাউকে যদি কখনো পাই তাহলে তার কাছেই অবারিত হয়ে যাব।

কথাগুলো বলে মার্ভি অবাক বিস্ময়ে চতুর্দিকে এমন করে তাকাল যেন সে একজন স্রষ্টাকে তার চোখ খুঁজছে। সে আবার বলেই চলল, কী আশ্চর্য, আমার চাওয়া স্রষ্টা এভাবে মিলিয়ে দিলেন! ঠিক আমার কল্পনার ছকে ছকে। নিজের মাঝে সযত্নে লালিত আমার আলোটুকু বিলিয়ে দেওয়ার জন্য এই রাতের এই লগ্নের মতো আর কোনো লগ্ন উত্তম হতে পারে না। এবং আমার জন্য আজকের সব ঘটনা এবং এমন পাহাড়ি রাত স্রষ্টার ইঙ্গিতেই নির্ধারিত হয়েছে বলে তোমার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করতে চাই।

একজন প্রাণবন্ত মানুষ হঠাৎ নাই হয়ে গেলে এবং তার বেঁচে না থাকার পরও লাশটুকুও পাওয়া না গেলে এক পরিবারের সদস্যদের কেমন অনুভূতি হয় তা মার্ভিকে কীভাবে বোঝাই। আমার ভেতরের উদ্বিগ্নতার কথা তার কাছে গোপন করলাম। মিষ্টি হেসে বললাম, আমি তোমাকে পেতে চাই নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।
মানে?
এত সহজে স্বর্গের অপ্সরাকে পেলে যদি তাকে অবমূল্যায়ন করি কখনো। ইউ আর ভেরি এক্সপেনসিভ মার্ভি।

খুলে ফেলা পোশাকগুলো শরীরে সামলে নিয়ে উঠে বসল সে। খুলে দেওয়া ঘন চুলগুচ্ছকে বেঁধে নিয়ে বলল, আই’ম স্যরি! বলে সে মাথা নত করল। আমি বুঝলাম, ভেতরের উদ্্গীরিত লার্ভাকে সে তখনো সামলাতে পারেনি। তার মুখে ‘স্যরি’ শব্দটুকু তার উদ্্গীরিত অনলের জন্য জল হয়ে উঠল তাও বুঝলাম। উঠে বসে তাকে ধরতে গেলেও সে নিজেকে আর ধরতে দিল না। ক্লিপ দিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে সে দ্রুত বেঞ্চির এক প্রান্তে গিয়ে বলল, ফার্স্ট বি এক্সপেনসিভ ফর মি। আই’ম ভেরি এক্সপেন্সিভ। কিছুক্ষণ আমার চুপচাপ কেটে গেল। একসময় মৃদু স্বরে মার্ভি বলল, ঈশ্বর আর মানুষের ভালোবাসার কত তফাত। তিনি ভালোবাসার জন্য এই বিশ্বকে এমন অবারিত করে সাজিয়েও মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হলেন না এত অপরাধ করার মতো, ষড়যন্ত্র করার মতো এবং তা প্রতিকারে কানুন তৈরি এবং তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার মতো সময় তিনি মানুষকে দেননি!

কথাটা বলেই সে দ্রুত পদেই ঘরে চলে গেল। প্রদীপ নিভিয়ে দিল এবং দুই বিছানার মধ্যে একক বিছানায় শুয়ে কাঁথা দিয়ে শরীর মুড়িয়ে ঘুমিয়ে গেল কি জেগেই থাকল তা আর জানা হলো না।

৩

পরের সারাটা দিন আমাদের কাটল আশপাশের পাহাড়ে ঘুরে। পাহাড়ি ফল সংগ্রহ করে এবং ঝরনায় গোসল করে। দুপুরের খাবার আমি তাকে মুখে তুলে তুলে খাওয়ালে সে কৃতজ্ঞতা আর গভীর মায়ার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা খুবই সত্যি, ঈশ্বর আর শয়তানের ভালোবাসায় অনেক পার্থক্য। তুমি অনেক ভালো।

আমি মার্ভিকে বারবার আমার মুগ্ধতা আর ভালোবাসার কথা জানালাম। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। সে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছুই না বলে বারবার আমাকেও মনে করিয়ে দিল এক্সপেন্সিভ কিছু পেতে হয় না, তা অর্জন করতে হয়।

রাত নেমে এলে আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। মার্ভি তার ঠোঁট পর্যন্ত বাধা না দিলেও আমি উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। সে আলতো ভঙ্গিতে একসময় আমার ঠোঁটে আঙুল রেখে শান্ত হতে বলল। সে আমাকে যতই শান্ত হতে বলল, ততই তাকে পাওয়ার জন্য আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকল। পরিশেষে আমার আগ্নেয়গিরির লার্ভাসম অনল নিভে গেল তার একটা বাক্যে,
আজ রাতে নয়। আই’ম স্যরি।
কবে তাহলে?
কয়েক দিন পর। ছেলেদের না হলেও মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ শব্দটার ভেতর দিয়ে যেতে হয় তো। বাক্য দুটি বলার তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল। সে পুনরায় বলল, সময় বলো, স্রষ্টা বলো তারা চেয়েছিলেন বলে আমি অবারিত হয়েছিলাম। তবে সময়ের ইঙ্গিতে আমাদের সংকুচিত হতেই হয়।
পরদিন দুপুর হওয়ার আগেই আমি কুঁড়েঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত গত বছরের একটা দেয়ালপঞ্জিতে চোখ রেখে সময়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে তারিখ লেখা অক্ষরের দিকে তাকিয়ে অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে উঠলাম। মার্ভিকে নিয়ে ঝরনায় গোসলের চেয়ে তারিখ নামের বস্তুটার চলে যাওয়ার দিকে আগ্রহ তখন আমার রক্তে পাহাড়ের বুনো গন্ধের মতো উন্মাতাল।

কিন্তু রক্তের এই ডাক দেয়ালপঞ্জির তিনটা দিন অতিক্রম করতে না করতেই ঘাম ঝরিয়ে শীতল হয়ে এল। তিন দিনের মাথায় মার্ভির দলের ঘর্মাক্ত সদস্যরা আরও ঘামে জবুথবু পুলিশের সঙ্গে এই পাহাড়ে এসে হাজির হলো। পাহাড়ের নিচু ঢালে আড়াল নিয়ে তারা কলস্বরে মার্ভিকে ডাকল। পুলিশের সদস্যরা তাদেরও পেছনে এমন ভঙ্গিতে গোলাগুলির শায়িত অবস্থান নিয়েছে যেন মার্ভিকে একজন মাফিয়া হাইজ্যাক করে এখানে এনেছে এবং কাছাকাছি হলেই যে হাইজ্যাকার একে-৪৭ বের করে গোলাগুলি শুরু করতে প্রস্তুত। তাদের কার্যকলাপ জানালার ফাঁক দিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। একজন নারী কণ্ঠের চিকন চিৎকার আমার রক্ত হিম করে দিল,
মার্ভি আমরা জানি তুমি এক সন্ত্রাসীর সঙ্গে এখানেই অবস্থান করছ। সামরিক হেলিকপ্টার তোমাদের গতিবিধি সব দেখেছে। শয়তানটাকে সমর্পণ করতে বলো। তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে সে কোনোভাবেই বাঁচবে না।
সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে রিকোনাইসেন্স করে মার্ভির অবস্থান কখন বের করে ফেলেছে নিজেদের মধ্যে আমরা এত ডুবে ছিলাম, ডুবে ছিলাম একে অন্যের চোখের মমতামাখা নিমেষহীন চাহনির মাঝে যে, আমরা ওসবের কিছুই টের পাইনি। আমি কেন হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠি এমন প্রশ্নের উত্তরে মার্ভিকে তার রহস্যও পরিশেষে বলেছিলাম। সে জন্যই পুলিশ দেখে মার্ভি হয়তো ভয় পেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘দেশ’ কখনোই ‘স্বাধীন’ হয় না যতক্ষণ না সে দেশের মানুষের আত্মা ‘পরাধীন’ থাকে। আমি চাই না, ওরা তোমার অবস্থান জানুক। টয়লেটের দরজা দিয়ে পেছনের দিকে পালিয়ে যাও। ভালো থেকো। যত্ন নিয়ো নিজের। চলে গেলেও আমি থেকে যাব এই জোছনার আলোধোয়া পাহাড়ি প্রকৃতিতে। তোমাকে আমি মনে রাখব এই পাহাড়ের ঈশ্বর হিসেবে। মনে রেখো।

মার্ভি ধীর পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। একটু থেমে কিছুই না বোঝার ভান করে, যেন সে প্রশান্তির ঘুম থেকে উঠে নিজের মানুষদের দেখে আনন্দিত এমন উদ্বেগহীন গতি নিয়ে সামনে এগুলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপ আমার থেকে যত দূরত্ব বাড়াল আমি ততই ক্ষুদ্র এই জীবনের অর্থবহতার মাঝে অর্থহীনতার সব আয়োজনকে আলিঙ্গন করলাম।

আমার দলের লোকগুলো আমাকে আর খুঁজতেও এলো না। গুম হওয়া সংস্কৃতি একবার চালু হলে এবং তা নিয়ে কথা বলার ভয় যে সমাজে তৈরি হয় সে সমাজ মানুষ তো আর হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে হারানোর পরিস্থিতি তৈরি করবে না।

মার্ভি চলে গেলে পাহাড়ি এই অনাড়ম্বর অবকাশকেন্দ্রের মালিক এসে আমার হাত ধরে বলল, তুমি যে গেলে না, বাবু? তোমরা পালিয়ে এসেছিলে, তাই না? আমার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি অস্থির হয়ে বললেন, মন খারাপ করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। হেঁটে বিকেলের আগেই আমরা গঞ্জে পৌঁছাতে পারি। ওখানে তোমার জন্য একটা চেম্বার রাখব।

৪

দিন দিন রোগী আসে। রোগী ফিরে যায়। থেকে যায় একজন ডাক্তার। পাহাড়ের চাঁদের দিকে মুগ্ধ তাকিয়ে চাঁদটার সঙ্গে কী সব কথা বলে যায় সে। প্রদীপের আলোয় পেনসিল স্কেচে সে মার্ভির শরীরে চাঁদের আলো পরিয়ে দিতে গিয়ে উল্টো জোছনার আলোতে মার্ভির ত্বকের লাবণ্য ছড়িয়ে দেয়। তারপর সেই বিমূর্ত শরীরকে ধরতে গিয়ে তার মনে পড়ে তার প্রেমে পড়া বারণ! সে মার্ভির কণ্ঠস্বর আঁকে। ঝরনায় গোসলের সময় দুজনের উচ্ছলতার আনন্দ আঁকে। আঁকে কলকল ধ্বনি। মার্ভির সুন্দর আঙুলগুলো ছুঁতে গিয়ে সে থমকে যায় আবদ্ধ চেতনা দিয়ে অমন সুন্দর এবং অবারিত স্বাধীনতার প্রতীক আঙুলগুলো তো ছুঁতে নেই।

পৃথিবীর আর কেউ জানল না, যার প্রেমে পড়া নিষিদ্ধ তারই প্রেমে একজন ডাক্তারি বিদ্যা অর্জন করা মানুষ, পাশের ঝরনায় ক্ষণে ক্ষণে চাঁদের আলো ভেবে সেই নারীকে খুঁজে খুঁজে ছুঁয়ে দেয় বস্তুত নুড়ি-পাথরের হৃদয়। শুধু অনিন্দ্যে নিসর্গের পাহাড়গুলো হাজার বছর পর জেনে গেল একজন ডাক্তার মানুষের শরীর বুঝলেও, একজন শিল্পী কেন এবং কীভাবে আত্মা আর সত্তাকে খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজের আত্মাকে মিলিয়ে দেয় ব্রহ্মাণ্ডের ঝিঁঝি পোকার কলতান তুলে ডেকে যাওয়া অযুত সত্তার সঙ্গে!

অলংকরণ: শাহরিন 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
.রোমান্সরোমান্স রসায়নশিল্প ও সাহিত্য

ভালোবাসার চোখে জল

করেছে Sabiha Zaman মার্চ ২২, ২০২০

কিছুই ভাবতে পারছে না তপন। মাথার রগ দুটো দপদপ করছে বারবার। প্রচণ্ড ব্যথায় কী যেন একটা বেরিয়ে যেতে চাইছে হৃদয় থেকে। সম্পূর্ণ সত্যি হলেও আজ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে  সবকিছু। শুকনো ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছে বারবার রমা, তুমি কেমন করে বদলে গেলে?

পুরোনো স্মৃতিগুলো আজ এক এক করে সব মনে পড়ছে তপনের। সেদিন জানালার কাছে বসে কী যেন ভাবছিল তপন। হঠাৎ হাজির হলো রমা। রোজই রমা এ পথ দিয়ে স্কুলে যায়। আজও স্কুলে যাওয়ার পথে তপনকে দেখে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ভেজা দুটো ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল তপন দা, একটু বাইরে আসুন, কথা আছে।

একই পাড়ার মেয়ে রমা। চেহারাটা এত সুন্দর, এত আকর্ষণীয় সহজেই মুগ্ধ করত সবাইকে। তাই তো অনেকেই ভালোবাসতে চেয়েছে ওকে। তপনেরও ভালো লাগত ওকে খুব। ভালো লাগবে না-ইবা কেন! সুন্দরের পূজারি সবাই। কিন্তু মুখ ফুটে তপন বলেনি কোনো দিন ওকে ভালোবাসার কথা। বলার সাহসও হয়নি কোনো দিন। আজ রমা স্বয়ং এসে ডাকাতে ত্বরিতগতিতে বাইরে বেরিয়ে এল তপন বীর সৈনিকের মতো। আজ যেন সবকিছুকে জয় করে ফেলেছে সে খুব সহজে। তবু মনের গভীর কোণে একটা জিজ্ঞাসা কী বলবে রমা!

হ্যাঁ, এবার চলুন।

কোথায়? অবাক কণ্ঠে তপনের জিজ্ঞাসা।

এই তো, একটু হাঁটব।

রমার সঙ্গে হাঁটবে তপন। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থা। একটা অপূর্ব আনন্দের মিশ্রিত ঘামে ভিজে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে তপন। মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক সবুজ পাখি উড়ে গেল কিচিরমিচির করে। ঝোপ জড়ানো পাশের বিলটায় খেলা করে উঠল দুটো হাঁস পরম তৃপ্তিতে। তপনের মনের গহিনে কী যেন একটা ঢেউ খেলে ওঠে অজান্তে।

কিছুদূর হাঁটার পর একটি নির্জনে এসে দাঁড়ায় রমা। কাছের বাঁশঝাড় হতে ভেসে আসছে মৃদু শনশন শব্দ। গাছে বসা কয়েকটি পাখি নীরব ঠোঁটে পালক ঝাড়ছে। পাশের গাছে বাঁধা সাদা গরুটা বাছুরটার গায়ে পরম আদরে জিহ্বা দিয়ে আদর করছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর লজ্জাজনিত কণ্ঠে রমা বলল, ‘আমি…আমি আপনাকে ভালোবাসি তপন দা।’

রমার মুখ থেকে হঠাৎ করে যে কথাটি বেরিয়ে এল কোনো ভূমিকা না রেখে, তাতে বেশ অবাক হয় তপন। অনেক দিনের প্রত্যাশার পাখিগুলো যেন ওর হৃদয়াকাশে গান গেয়ে উঠল প্রচণ্ড উল্লাসে। রমা…! বিস্ময়ভরা অস্পষ্ট কণ্ঠে ডেকে ওঠে তপন।

‘হ্যাঁ তপন দা। আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি কথাটা আপনার মুখ থেকে শুনব বলে। কিন্তু….. কিন্তু…… আর পারলাম না। লজ্জা-দ্বিধা ভুলে নিজেই আমার মনের কথাটা আপনাকে জানালাম। কী, ফিরিয়ে দিবেন না তো?’

তপনের জন্য যে এটা কত বড় পাওয়া, তা একমাত্র ও ছাড়া আর কে জানে! ফিরিয়ে দেওয়া, সে তো প্রশ্নই আসে না! তপন শুধু অবাক চোখে উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রমার অপরূপ সুন্দর মুখটির দিকে। একটা অপূর্ব তৃপ্তি আর আনন্দে ওর বুকটা যেন ফুলে ওঠে যুদ্ধে জয়ী হওয়া বীর সৈনিকের মতো।

দিন খসে পড়ছে একটির পর একটি। বেড়ে চলল ওদের হৃদ্যতা। ‘আপনি’ কথাটা আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে এখন স্থান নিয়েছে ‘তুমি’ নামের অত্যন্ত আপন শব্দটি। রমা এরপর থেকে রোজই চলে আসে তপনদের বাড়ি। খুব চঞ্চলা মেয়ে। সরাসরি সব বাধা উপেক্ষা করে ও তপনের রুমে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় কত ধরনের কথাবার্তা। মিষ্টি হাসিতে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো ঘর। শরীরের নরম ভাঁজগুলাতে অঙ্কিত হয় ভালোবাসার মানচিত্র। এই তো প্রেম, এই তো ভালোবাসা! আঃ! কী শান্তি! এত সুখ কোথায় ছিল এত দিন?

তপন ভাবেওনি কোনো দিন রমা ঠিক এভাবে তাকে ভালোবাসবে! নরম জঘনে মাথা রেখে দেখবে রঙিন স্বপ্ন! আজ যেন ওর মতো সুখী আর কেউ নেই। না চাইতেই যেন সবকিছু পেয়ে গেছে সে। রমা শুধু আমার হবে, শুধুই আমার।

কী ভাবছ? তপনের ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে রমার কোমল আঙুলের মৃদু সাঁতার।

ভাবছি আমাদের ভালোবাসার কথা। যদি তুমি আমার কাছ থেকে কখনো হারিয়ে যাও!

ওসব অলক্ষুণে কথা বলো না তো! আমি তো তোমারই! সারাজীবন তোমারই থেকে যাব। এই তোমার গা ছুঁয়ে শপথ করছি।

গভীর এক প্রশান্তিতে কেটে যাচ্ছে ওদের দিন। তারপর মাস। একটি বসন্তও পেরিয়ে গেছে সুখস্বপ্নে বিভোর থেকে। কত না স্বপ্নের জাল বুনিয়েছে ওরা দুজন।

একদিন সকালে তপনের সঙ্গে দেখা হলো রমার। কেমন যেন মনে হলো ওকে দেখে! বিশাল এক পরিবর্তনের ছোঁয়া ওর গোটা মুখটাতে

লেগে আছে। আগের মতো হৃদয় জয় করা হাসি নেই, ভালোবাসার আহ্বান নেই। অবাক হয় তপন। তবে কী ওর শরীরটা ভালো নেই!

এমনি কিছু ভাবনার মধ্যে যখন বিচরণ করছিল তপন, ঠিক সে মুহূর্তে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রমা বিরক্তিকর একটা ভঙ্গি এঁকে বলে উঠল তপন, এত দিন আমি তোমার ছিলাম; আজ থেকে আমাকে ভুলে যাও।

রমার মুখে হঠাৎ এভাবে অপ্রত্যাশিত এমন একটি কথা শুনে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে তপন নিথর পাথরের মতো। এত দিনের ভালোবাসা

তাহলে কি নিঃশেষ হয়ে গেল এক মুহূর্তে!

রমার এই আকস্মিক অবাঞ্ছিত কথাটা লোহার তীক্ষ্ণ খণ্ডের মতো বিঁধে গেল তপনের হৃদয়ে। লজ্জা-ঘৃণা আর অপমানে সারাটা মাথা ঝিম ধরে গেছে। দপ দপ করছে মাথার রগগুলো এলোপাতাড়িভাবে। কপালের ঘামগুলো এদিক-ওদিক গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে রমা ওর সঙ্গে প্রতারণা করতে পারল!

গোধূলির কালো আবছা ছায়া যখন গাঢ় অন্ধকারে পরিণত হয়েছে, তখনো কথাগুলো একমনে ভেবে চলেছে তপন। কী একটা অচেনা পাখির বিরক্তিকর ডাকে একসময় তার কল্পনার রাজ্যে বাধা পড়ল। কিছুই ভালো লাগছে না। বারবারই ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে। প্রচণ্ড জোরে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে।

ব্যর্থতা আর নিষ্ঠুরতার বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়ে এভাবে দিন কাটছে তপনের। বিমূঢ় বিস্ময়ে শুধু ভেবেই চলেছে একাকী। এ কী করে সম্ভব? ওকে যে আমি ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি।

এক নিস্তব্ধ বিকেলে সেদিন রমার সঙ্গে দেখা হয় তপনের। সেই একই জায়গায়, যেখানে রমা প্রথম ওকে বলেছিল ভালোবাসার কথা। গাছের ডালে টিয়ে পাখিটা পালকের ভাঁজে মাথা গুঁজে নীরবে বসে আছে। তপ্ত বাতাসে শ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে দুটি কুকুর। আজ রমা একা নয়। ওর সঙ্গে রয়েছে এক সুদর্শন যুবক। অবশ্য এ সুদর্শন যুবকটি আর কেউ নয়, তপনেরই বন্ধু রাহুল। একান্ত ঘনিষ্ঠ না হলেও একই সঙ্গে লেখাপড়া করেছে ওরা। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে এসেছে বিরাট অঙ্কের টাকা নিয়ে। তবে কি ওর জন্যই রমার এ নিষ্ঠুর পরিবর্তন? কিš‘ কেন? অর্থের প্রলোভনেই কি সে এত দিনের সাজানো সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ করে দিল? স্মৃতির পর্দায় রঙিন সেই অতীতগুলো বিষাক্ত অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরল তপনকে। কাঁদাল ভীষণভাবে।

রাহুলের সঙ্গে রমাকে দেখার পর থেকে না খেয়ে এবং অর্ধাহারে সময় কাটছে তপনের। অ্যাশট্রেতে সাজানো সিগারেট একটির পর একটি পুড়ে মরে নির্বিবাদে। বাড়ির কেউ বুঝতে পারে না, চঞ্চল ছেলেটার হঠাৎ কেন এ নীরবতা, কেন এ পরিবর্তন।

রমাকে হারানোর ব্যথা কিছুতেই সইতে পারছে না তপন। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো তাই সে একদিন এগিয়ে আসে ওর কাছে ভালোবাসার দাবি নিয়ে। ঘৃণার সঙ্গে তপনের ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করে রমা। তপনকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে যেন খুব বড় মনে করল রমা। ওর চোখের সামনে এখন রাহুলকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন খেলা করছে। তপনকে নিয়ে সাজানো দিনগুলোর কথা একটিবারও মনে হয় না রমার। অপ্রত্যাশিত নিষ্ঠুর এ ব্যবহার তপনকে আহত করে ভীষণ।

সেই সকালে স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনো ফেরার নামটি পর্যন্ত নেই। অথচ স্কুল ছুটি হয়েছে অনেক আগেই। বান্ধবীর কাছ থেকে জানা গেছে রমা আজ স্কুলেও যায়নি। তাহলে কোথায় গেল? রমার বাবা-মা সবাই বেশ  চিন্তিত। এদিক-ওদিক, এমনকি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি খোঁজ নিয়েও কোনো খোঁজ মেলে না ওর। এক এক করে পাড়ার সবাই জেনে যায় ব্যাপারটা। জেনে যায় তপনও। একটা সন্দেহ ওকে ঘিরে ধরে তখনই গভীরভাবে। তাহলে কী…!

তখন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা। লোকমুখে প্রচার হয়ে যায় রমা এসেছে। সঙ্গে এসেছে রাহুল। ব্যাপার কী, বোঝার জন্য সবারই কৌতূহল জেগে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই সবাই জেনে যায়, রমা কাউকে না জানিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে এসেছে। সারা মহল্লায় এ নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোড়ন।

আকস্মিক এ ঘটনায় বাবা-মা এবং বাড়ির সবাই প্রথমে একটু আপত্তি জানালেও পরে খুব সহজেই মেনে নেয় ওদের এ বিয়ে। এতগুলো মুহূর্ত একমাত্র মেয়ের জন্য যে বিপুল ব্যস্ততা ছিল, তা খুব সহজেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওদের এ অনাকাক্সিক্ষত শুভকাজে সবাই যেন পরিতৃপ্ত। মনে হয়, তারা যেন সবাই মনে মনে এমনটিই চেয়েছিল।

সম্পূর্ণ না জানলেও এই কয়েকটি দিনে মোটামুটি কয়েকজন অনুমান করতে পেরেছিল তপন আর রমার মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারটা। রাহুলও কিছুটা ধারণা করতে পেরেছিল। অবশ্য এ নিয়ে তেমন মাখামাখি বা উল্টো কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। সবাই এখন রমার বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত। আনন্দের রোল পড়ে যায় বাড়িটাতে। একটা কাক সেই সকাল থেকে একটানা ডেকে একটু আগে উড়ে গেল।

রমা চন্দনাছন্ন মুখে লাল শাড়ির ঘোমটা টেনে বধূবেশে বসে আছে। ফুল দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সাজানো হয়েছে খাট। সুগৌর কপালের ওপর সিঁদুরের লাল টকটকে টিপ জ্বলজ্বল করছে। সিঁথিতে সিঁদুরের জ্বলন্ত আঁচড়। সেই ইদানীং তৈরি করা যুবকটি একটু পরই ওকে এসে আদর করবে। অট্টহাসিতে দুজনে মাতিয়ে তুলবে সাজানো ফুলশয্যা। অথচ রমার পাষণ্ড হৃদয়ে একটিবারও ব্যথা দিচ্ছে না অতীত স্মৃতি। তপনকে দেওয়া কষ্ট, অবহেলা তাকে কাঁদাচ্ছিলো না একটিবারও।

টেবিলের অ্যাশট্রেতে অসংখ্য সিগারেট জ্বলছে নির্বিবাদে। হুইস্কি ও ক্যারোজের বোতল দুটো শূন্য হয়ে যেন উপহাস করছে।

ছটফট করছে তপন। চোখের সামনে বারবারই ভেসে আসছে রমার রঙিন ফুলশয্যা বাসররাতের অনাবিল আনন্দ। এ যেন তার জন্য বিরাট লজ্জা! বিরাট অপমান! মাথার রগ দুটি দপ দপ করে লাফাচ্ছে। ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে চুলগুলো। শুধু পায়চারি করে চলেছে বারবার রমা, তুমি কেমন করে বদলে গেলে! আমি যে তোমাকে ভালোবাসি ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না…।

দেয়ালঘড়িটা একসময় অ্যালার্ম দিয়ে জানিয়ে দিল রাত দুটো বাজার সময়সংকেত। টেবিলের অ্যাশট্রেতে অসংখ্য সিগারেট জ্বলছে নির্বিবাদে। হুইস্কি ও ক্যারোজের বোতল দুটো শূন্য হয়ে যেন উপহাস করছে। কী করবে তপন! প্রচণ্ড ব্যথা আর ব্যর্থতায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন তো মরে গেছে ওর জীবন থেকে! রাতের নিঝুম পরিবেশ আর হৃদয়ের কঠিন অস্থিরতায় তপন কিছুই ভাবতে পারে না আর। চোখের সামনে বারবারই রমাকে নিয়ে সুখের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে কষ্ট দিতে থাকে ভীষণভাবে।

লেখা : প্রদীপ সাহা

 

 

 

 

 

 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

মন্থন – রুখসানা কাজল

করেছে Wazedur Rahman মার্চ ১১, ২০২০

কাটা পেঁয়াজের খোসার ভেতর আঙুল চালিয়ে কী যেন খুঁজছেন আমার শাশুড়িমা।
কী খুঁজছেন মা?
অমলিন হাসি দিয়ে তিনি জানালেন, কুঁচোনো কিছু পেঁয়াজ পড়ে গেছে, তাই তুলছি মা।
এহে, ময়লা লেগে গেছে তো। ওগুলো ফেলে দিলেই তো হয়। অকৃত্রিম ঘৃণায় সিঁটিয়ে উঠি আমি।
খুঁজে পাওয়া পেঁয়াজের টুকরোগুলো পরম যত্নে টিউবওয়েলের পানিতে ধুয়ে মিশিয়ে দিলেন বাটিতে উঁচু হয়ে থাকা কাটা পেঁয়াজের সঙ্গে, খাওয়ার যোগ্য জিনিস হেলাফেলায় ফেলতে নেই গো মেয়ে। ওরাও অভিশাপ দেয়।

উপচে পড়া চিনিগুলো অন্য বয়ামে তুলে রাখতে রাখতে আমি ভাবি, জীবনভর কী তুলছি আমি? স্নেহ, ভালোবাসা, ঘৃণা নাকি অবিশ্বাসের সুতোনলি সাপ? জয়ঢাক পেট নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াই। কখনো পড়তে বসি। কখনো পুরোনো বাড়ির বালু খসে পড়া দেয়াল, ছাদের কড়িকাঠ দেখি। মাঝে মাঝে কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেয়ালের ক্ষতগুলো থেকে আরও বালু-সিমেন্ট ঝরিয়ে দিই। শাশুড়িমা হাসেন। স্নেহ ছলকে ওঠে তার চোখেমুখে। যদিও তার মনের ভেতরে শতেক অশান্তি। এই তো বয়েস মেয়েটার। সামনে পড়ে আছে অসীম সময়। জীবনের অসংখ্য ঘাট, ঘুলঘুলি, আলোছায়ার নানা বাঁক কী করে এতটা পথ একা একা পেরোবে এই মেয়ে?

বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই স্বামী মরে গেল। তার আদরের সর্বশেষ সন্তান। মৃত্যু কী অপরিমেয় অবিবেচক। তিনিও তো ছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দ্বিধাহীন আলিঙ্গনে তিনিও পারতেন মৃত্যুকে তার জীবন দিয়ে দিতে। হাসির সঙ্গে কান্না মিশে যায়। আমার মাথায় হাত রেখে জানতে চান, শিশুটিকে কি রাখবে মা? তোমার তো অধিকার আছে দ্বিতীয় জীবন বেছে নেওয়ার! নিজেকে নিয়ে ভাববার! জীবন যে মস্ত বড়, ভেবে দেখো আরেকবার।

সাঁঝসন্ধ্যায় সবাই ব্যস্ত ঘরে ঘরে সন্ধ্যাকে আলো দেখাতে, ধূপধুনো, নামাজ পড়ে নাশতা বানাতে। শাশুড়িমা আমার পাশে জায়নামাজে বসে আছেন পশ্চিম দিক মুখ করে। আমার রায় শোনার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছেন এক সন্তানহারা মা।
আমি পেটের ওপর হাত রেখে বলি, এই আছিস?

দীর্ঘ নিস্তব্ধতা। আমার হাত কাঁপে। মেরুদণ্ডে স্রোত ভাঙে টেনশনের। আর ঠিক তক্ষুনি চিনচিনে এক নাড়াচাড়া মাতৃবন্ধি নাড়িতে টান দেয়। আমি মাথা শক্ত করে বলি, থাকুক মা। একা লড়াইয়ে ও না হয় আমার বন্ধু হবে।

শাশুড়িমার কালো মুখে মুক্তো গড়ায়। তিনি নদীতে বইঠা ফেলার মতো হাত দুলিয়ে বলে ওঠেন, আসুক, আসুক। আসুক তবে তোমার রাজাধিরাজ। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো মা। জোরসে পড়ো। লড়তে গেলে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে যে! একা একা সন্তান পালন! সে বড় কঠিন কাজ। তুমিই মা, আবার তোমাকেই বাবা হতে হবে।

 

হাসপাতালের কেবিনে চোখ খুলে দেখি অনেকগুলো মুখ। ঝাপসা। কে যেন খুশি খুশি গলায় বলে ওঠে, শুনছ ডক্টরকে জানাও ওর সেন্স এসেছে। ব্যথার সাগরে ছেঁড়া পাতার মতো দুলছি আমি। একেকটি ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে আর আমি কুঁকড়ে কেঁদে ফেলছি। কেউ একজন জেতা ট্রফির মতো একটি শিশুকে তুলে ধরল খানিক উঁচুতে। প্রচণ্ড রাগে কাঁদছে শিশুটি। কে এই শিশু? ওর হাতে নম্বর লেখা সাদা কাগজটি প্রতিটি কান্নার সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এত ক্রোধ কেন শিশুটির! ও কি ভুল কোলে এসে পড়েছে! এরা কারা? পরাজিতের উঠোনে এ কোন বিজয় উৎসব?

একটি শীর্ণ বয়স্ক নারী তার হাতে আমার কপাল ছুঁয়ে দিয়ে হাসছে, ও মেয়ে শুনতে পাচ্ছ, তোমার সেনাপতি এসে গেছে। তুমি আর একা নও। আমার শাশুড়িমাও উদ্ভাসিত চাঁদমুখে হেসে গলে পড়ছে। তার পাশে আরও কিছু উজ্জ্বল মায়ামুখ। চেনা চেনা অথচ হারিয়ে যাচ্ছে অচেনার অলিগলিতে। আমি প্রাণপণে সেন্স ধরে রাখার চেষ্টা করছি, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি, আমিই জন্ম দিয়েছি শিশুটিকে। তীব্র আলোর সেই ওটি, ডাক্তার-নার্সদের সেই গাঢ় নীল মুখোশ মুখ! আমার মনে পড়ে যায় সবকিছু।

জুতায় খটাখট শব্দ তুলে সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন ডাক্তার দ্রুত এসে আঁতকে ওঠেন। কাকে যেন ধমকে ডেকে পাঠান, এখন তো সেন্স আসার কথা নয়! নার্স সিস্টার সিরিঞ্জ উঠে আসে ডাক্তারের হাতে। অচেতনার গোলাপি ঘরে চলে যেতে যেতে আমি দেখি আপন রক্তের নয় মানুষগুলো সজল ব্যাকুলতায় চেয়ে আছে। ভালোবাসার কি কোনো নির্দিষ্ট ঘর থাকে? গোত্র? ভালোবাসার পিতা কে? কে মাতা? কতজন ভাইবোন আছে ভালোবাসার? কাছের-দূরের লতায়-পাতায় জড়ানো ছড়ানো আত্মীয়রা কী করে কোন মায়ায় বেঁধে রাখে ভালোবাসাকে? ভালোবাসায় এত জল! আনন্দের! প্রাপ্তির! হারানো! মৃত্যুতে!

শিশুটির কপালে কালো টিপ, চোখে কাজল পরাতে না পেরে আমার শাশুড়িমা ওর পায়ের নিচে কাজলের টিপ পরিয়ে দিলেন। ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল। কাজল পরাতে দেখলেই ডাক্তার আন্টি আমার শাশুড়িমাকে বকে দিয়ে বলবেন, বড় আপা, এসব কুসংস্কার। তারপর নিজেই দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া লিস্ট দেখিয়ে বলে যাবেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে নবজাতকের যত্ন-আত্তি, লালনপালনের নির্দেশনামা। শাশুড়িমার মুখে দুষ্টুমিষ্টি হাসি খেলে মিলিয়ে যায়। চকিতে শালিকের মতো মাথা নেড়ে মেনে নেয় ডাক্তার বোনের সব কথা। তারপর নির্জন দুপুরে সবাই চলে গেলে খালি বাসায় শিশুটিকে গোসল করিয়ে, পাউডার মাখিয়ে চুলের ফাঁকে কাজলের টিপ পরিয়ে তিনি গুনগুন করে সুর তোলেন, পরথমে বরননা করি আল্লাহ রসুলের নাম॥ তারপরেতে শোনো পুত্র তোমার মাতার নাম॥ পুবদিকে সূর্যি ওঠে পশ্চিমেতে ডোবেএ এ এ-

কী বোঝে কে জানে! সুর থামলেই শিশুটি চেঁচিয়ে কাঁদে। পায়ের ধাক্কায় জানিয়ে দেয় প্রতিবাদ। ঘুম তাড়িয়ে আবার সুরে ফিরে আসেন মা। ক্লান্তিহীন অবিরাম সুরের সুতায় বাঁধা পড়ে যায় দুটি অসম প্রাণ। দুজনেই একসঙ্গে জাগে। একসঙ্গে ঘুমোয়। আমি বয়সী মানুষটির গায়ে এক পাত্তার নরম কাঁথা ছড়িয়ে দিই। শিশুটিও জড়িয়ে আছে নানা রঙের সুতায় গাঁথা কাঁথায়। আড়াই দিন বয়সী শিশুটির গায়ে হাস্নাহেনার সুগন্ধ। ওর মুঠো করা লাল হাতের ভেতর একটি আঙুল রাখতেই আশ্চর্য আন্দাজে আমার দিকে ওর মাথা ঘুরে আসে। এক অস্ফুট অভিমানের শব্দ করে আদরে জড়িয়ে ধরে আবার ছেড়ে দেয় আমার আঙুল। চোখের দীর্ঘ পাপড়িতে মেঘজমা ভেজা রং। পাপড়ি ছুঁতেই হঠাৎ তাকিয়ে দুটি হাতই পুরে দেয় মুখের ভেতর।

পায়ের আঘাতে সরে যায় গায়ের কাপড়। নাভিবাঁধা ব্যান্ডেজ দুলছে। ছোট্ট আদুরে পেট। পেটের নিচে পুরুষ পরিচয়ের দিকচিহ্ন খয়েরি লিঙ্গটি নমিত কোমল সুন্দর। আমি আরেকটু ছুঁয়ে দিই। পায়ের পাতায় পদ্ম রং। তাতে শাশুড়িমায়ের আঁকা বিপদ তাড়ানো স্বস্তিশেল। আমার বিস্মৃতির খাম থেকে মুছে যায় অচেনা সব স্বাক্ষর। কী অসহায় ছোট্ট মিষ্টি মানুষ। শরীর কাঁপিয়ে ধেয়ে আসে রক্তকণা। দুটি বুকে দোল খায় আসমুদ্র বাঁচার রসদ। এই প্রথম শিশুটিকে দুহাতে তুলে নিই। কী করে যেন বুঝতে পারি, ক্ষুধা লেগেছে বাবুটার। খাওয়ার যোগ্য অমিত সুধা ঝরে যাচ্ছে যুগল স্তন থেকে। সভ্যতায় অভিশাপ ছোঁয়ার আগে আমি স্তন তুলে দিই ওর মুখে।

পড়তে পড়তে মেকিয়াভ্যালি রেখে দিই। লম্বা শিকের জানালার বাইরে কলাগাছের ঝাড়। মা কলাগাছের আশপাশে অসংখ্য ছোট-বড় শিশু কলাগাছ। হাতে হাতে ছুঁয়ে আছে সবাই সবাইকে, আমিও ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি আমার সুনির্মিত শিল্প। হাত, পা, কান, একমাথা কালো চুল, চোখ, দৃষ্টির গভীরতা। ও দেখে আমাকে। ওর চোখে চিরচেনার সাদা আলো।

শাশুড়িমা দুকাপ চা এনে ঘন হয়ে কাছে বসেন, শিশুরাই ঈশ্বর। ওরাই পথ। ঘর। মাঠ। আকাশ। সমুদ্র। ওরাই পৃথিবী। বেঁচে থাকার অপাপ শক্তি। স্বপ্ন। সাহস। ওদের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছে করে। বাঁচতে হয়। ওরাই বাঁচিয়ে রাখে। এই যে আমার বেঁচে থাকা, সে তো তোমাদের জন্য মা।

আশ্বিনের ঝোরা বৃষ্টিতে নেয়ে গেছে কলাঝোপ। বড় গাছগুলো থেকে পানি ঝরে পড়ছে ছোটদের মাথায়। হাতে-পায়ে। মানুষের ঝোপে শাশুড়িমাকে ছুঁয়ে থাকি আমি। আমার কোলে এক নতুন শিশু। দুদিন পরেই পরীক্ষা। পলিটিক্যাল থট। শিশুটির নরম ঠোঁটে, গালে, কপালে, লাল পায়ের তালুতে চুমু খাই। গুনগুন করছে মা, এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…আমি দোল দিই। ঝুলনের দোল। মা আমিনার কোলে। যশোদা মাঈয়ের কোলে, আমার কোলে…দোলে পৃথিবী দোলে।

 

ছবি: সংগ্রহীত 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসগল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরণ্ময় নীরবতা (গল্পগ্রন্থ)

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৫, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে মোহাম্মদ নাজিম উচ্চিনের গল্পগ্রন্থের কথা।

দুই বাংলার জনপ্রিয়তম থৃলার লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। এরইমধ্যে ঢাকার পাশপাশি তার এগারোটি থৃলার উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ‘রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরণ্ময় নীরবতা’ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের প্রথম গল্পগ্রন্থ। আঠারোটি থৃলার এবং নন-থৃলার গল্পের সঙ্কলন এটি। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের জাদু কলমে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে একেবারে অবহেলায় পথের প্রান্তে পড়ে থাকা বিষয় পর্যন্ত মায়াময় গল্পে রূপান্তরিত হয়েছে এই গ্রন্থে। তার অলীক শব্দজালে আটকা পড়ে পাঠক মহৎ সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে–এ আমাদের বিশ্বাস।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন পেশায় একজন প্রকাশক। তবে পুরোদস্তর একজন লেখক এবং অনুবাদকও বটে। দ্য ভিঞ্চি কোড, সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস কিংবা দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্রাগন ট্যাটুর মতোর বিশ্বখ্যাত সব বই অনুবাদ করেছেন তিনি। তারপর মৌলিক থ্রিলার উপন্যাস রচনা করে তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করেছেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাতিঘর প্রকাশনী। থ্রিলার প্রেমীদের এক আঁতুড়ঘর। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন নিজেও দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন বেগ-বাস্টার্ড সিরিজ, রবীন্দ্রনাথ সিরিজ এবং কেউ কেউ কথা রাখে ধরণের নিরীক্ষাধর্মী বই রচনা করে। দেশের পরিধি পেড়িয়ে ওপাড় বাংলায় জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন তিনি।

বই: রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরণ্ময় নীরবতা ।। লেখক: মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ।।
প্রচ্ছদ: লৌকিক পার্থ ও ডিলান, পৃষ্ঠা: ২৭২, মূল্য: ৩২০ টাকা

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার (গল্পসংকলন)

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে ভিন্ন ধারার এক গল্পগ্রন্থ বইয়ের কথা।

গল্পকে কি আদৌ নতুন করে সৃষ্টি করা যায়? নাকি বাতাসের মতোই চারপাশ থেকে আমাদের জড়িয়ে রাখে ওরা; স্থান-কাল-পাত্রের কাঁধে ভর করে ছড়িয়ে যায়, ঘুরে বেড়ায় সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে! 

কেন এক কাকডাকা ভোরে আব্দুল মোত্তালেবের লোমশ পাজোড়া শূন্যে ঝুলে থাকে? চর্যাপদের আদি কবি লুইপার সাথে এক বৃষ্টিভেজা অন্ধকার সন্ধ্যায় নিলক্ষেতে আটকে পড়া কয়েকজন যুবকের কী সম্পর্ক? মধ্যদুপুরে জনৈক গৃহিণীর জীর্ণশীর্ণ হাত জানালার বাইরে কাকে খোঁজে? অবিরাম জ্বরের দিনগুলোতে শহরের রাস্তায় হাজির হয় কোন সে আগন্তুক?

রোমাঞ্চ, পারিপার্শ্বিক জীবন, রহস্য, আধিভৌতিকতা, দর্শন, পরাবাস্তবতা- এমন অসংখ্য সুতোয় বোনা গল্পে উত্তর মিলবে সব প্রশ্নের। বিচিত্র বিষয়ের আবর্তনেও যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিষণ্ণতার ছাপ, যে বাক্যে মিশে থাকে অশ্রুত অন্ধকার! 

সূচীপত্র:  

-সংক্ষোভ
-জীবনের এইসব নিভৃত কুহক
-একজন ব্যধিগ্রস্ত মানুষ
-কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
-অবান্তর অথচ অকাট্য
-জ্বরের দিনগুলোতে এক কাল্পনিক নগরীর মিথ্যা উপাখ্যান
-বিকৃতি 

বই: যে বাক্য অশ্রুত অন্ধকার ।। লেখক: ওয়াসি আহমেদ রাফি।। প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী ।।
প্রকাশনী: অবসর প্রকাশনা সংস্থা ।। পৃষ্ঠা: ৯৬ ।। মলাট মূল্য: ১৮০/- টাকা মাত্র

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক 

০ মন্তব্য করো
1 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসগল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – দ্য গার্ল অন দ্য ফ্রিজ এবং অন্যান্য গল্প

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলা প্রায় শেষের দিকে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে ভিন্ন ধারার এক অনুবাদিত পরাবাস্তব বইয়ের কথা।

জীবনের বাস্তবতা সাধারণ কোনো মানুষের চোখে যেভাবে ধরা পড়ে, একজন শিল্পীর চোখেও কি ঠিক সেভাবে ধরা পড়ে? পুরানো দেয়াল বেয়ে সারি সারি পিঁপড়েদের প্রায়ই হাঁটতে চলতে দেখা যায়। এই দৃশ্য হয়তো চোখে আটকে যাবার কিছু নেই। কিন্তু এই অতি সাধারণ দৃশ্যটাও একজন কবি বা লেখককে উদ্বেলিত করতে পারে। সেই পিঁপড়ের সারি তাদের চোখে আকাশ থেকে ছুঁড়ে ফেলা কোনো লেখা হয়ে ফুটতে পারে বা মনে হতে পারে লেড জ্যাপলিনের “স্টেয়ারওয়েস টু হেভেন”।

একজন সেলসম্যানের জীবনের অসাড়তা আর অসহায়ত্ব বোঝানোর জন্য জার্মানির কাফকা তাঁর একজন চরিত্রকে এক সকালে কিলবিল করতে থাকা পোকা হিসেবে জাগিয়ে তুলেছিলেন। জাপানের মুরাকামি আকাশ থেমে নামিয়েছিলেন মাছের বৃষ্টি। স্পেনের কবি লোরকা ঘুমোতে চেয়েছিলেন আপেলের ঘুম। বাংলাদেশের শহীদুল জহির হঠাৎ এক দুপুরে কাকশূণ্য শহরের গল্প শুনিয়েছিলেন, জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন হাজার বছর ধ’রে পৃথিবীর পথে হেঁটে বনলতা সেনকে খুঁজে বেড়ানোর কথা।

কথা বলছিলাম, সাহিত্যের একটি শক্তিশালী ধারা পরাবাস্তবতা (ইংরেজী প্রতিশব্দ Surrealism) নিয়ে। অবচেতন মনের কাজকর্ম রূপকের মাধ্যমে প্রকাশকে বলা হয় পরাবাস্তববাদ। ফরাসি সমালোচক এবং কবি আন্দ্রে ব্রেটন এই আন্দোলনের প্রবক্তা। এই মতবাদের অনুসারিরা বলে থাকে- সত্য শুধু অবচেতনে বিরাজ করে এবং একজন পরাবাস্তববাদীই কেবল সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনতে পারে।

পরাবাস্তববাদ বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডাডাবাদী কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে। ১৯২০ সালের দিকে এ আন্দোলনের সূচনা হয় ফ্রান্সের প্যারিস থেকে। ডাডাবাদীরা চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে। পরাবাস্তববাদ সেক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে।

পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা। তারপর থেকেই এই ধারাটি ঢুকে পড়ে বিভিন্ন দেশ ও ভাষার সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত আর শিল্পের মাঝে। শুধু তাই নয়, এটি রাজনৈতিক চিন্তা ও চর্চা, দর্শন এবং সামাজিক তত্ত্বেও স্থান পায়।

পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যে বাস্তবতার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার মিল থাকতেও পারে। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। অন্যদিকে, পরাবাস্তবতার জগত সম্পূর্ণভাবে যুক্তির বাইরে আরেক জগত। কাজেই পরাবাস্তব সাহিত্যে পরিপাটি করে কোনকিছু গোছানো থাকে না। ভাষা ও চেতনায় মিশে থাকে বিচিত্র স্বপ্নময়তা।

স্বপ্নে যেমন ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতর কোনো যৌক্তিক সম্পর্ক বা বিন্যাস থাকে না, এবং সবকিছু কেমন বিবর্ণ মনে হয়, তেমনি এক্ষেত্রে ঘটনা ও ভাষায় সেই অযৌক্তিকতার দেখা পাওয়া যায়। অনেক সময় ন্যারেটিভে সেটিং-এ টাইম বা স্পেস বলেও কিছু থাকে না। অর্থাৎ কাঠামো বা অবয়বহীনভাবে উপস্থাপিত হয় গল্পটি।

জার্মান শিল্পী মাক্স আনের্স্ট পরাবাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এভাবে – অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা সুররিয়ালিজমের লক্ষ্য নয়। অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও এর আওতার মাঝে পড়ে না। মূল লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সঙ্গে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া।

পরাবাস্তব সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এটগার কেরেট, যাকে ইসরায়েলের কাফকা বলেও ডাকা হয়। তুমুল জনপ্রিয় এই লেখক তার ছোট গল্প আর গ্রাফিক নভেলের জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য পরাবাস্তবতা; তাতে মিশে থাকে সূক্ষ্ম রস আর গভীর জীবনবোধ৷ মূলত এক/দুই পৃষ্ঠা কলেবরের ছোট গল্প লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। আবার শব্দসংখ্যার বিবেচনায় কখনও কখনও তা উপন্যাসিকার আকারও ধারণ করে থাকে।

কেরেটের গল্পে স্বর্গের দূতেরা আকাশ থেকে নেমে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়৷ মাঝরাতে ফিশবোল থেকে বেরিয়ে আসে নির্বাক গোল্ডফিশ, বাবার চটিজুতো পরে ঘুরে বেড়ায় ঘরে-বাইরে। খোকার মাটির ব্যাংক জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রেম অথবা বিচ্ছেদের অনুভূতিগুলো নতুন করে ধরা দেয়। ইসরায়েলের সংস্কৃতি, জীবনধারার পরিচয় মেলে বারবার। আবার কখনও মনস্তাত্ত্বিক দর্শন অথবা গভীর জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে সাহিত্যের অদৃশ্য ক্যানভাসে।

হলোকাস্টের স্মৃতি, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ভয়াবহ অত্যাচার, লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে মৃত্যুকূপে ঠেলে দেয়ার ঘৃণ্য ইতিহাস তাকে তাড়না দেয়। ঘুরেফিরে সেই বিষয়গুলোও জাদুবাস্তবতার আড়ালে স্থান পায় তার শক্তিশালী সৃষ্টিকর্মে। “সাইরেন” নামের গল্পটি ইসরায়েলের মাধ্যমিক পরীক্ষার পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত।

প্রাগুক্ত মুখবন্ধটি লিখেছেন অনুবাদক ওয়াসি আহমেদ রাফি। যিনি একাধারে একজন বই সংগ্রাহক, লেখক, অনুবাদক এবং পেশায় ডাক্তার। বইটিতে অনুবাদে তার সাথে আছেন অনুবাদক কৌশিক জামান। বর্তমান সময়ের এই দুই জনপ্রিয় অনুবাদকের এই বই পাঠক সানন্দে গ্রহণ করবে বলেই আশা পোষণ করেছেন অবসর প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক।

এটগার কেরেটের সেরা এবং বাছাইকৃত ৩১টি গল্প নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনা সংস্থা। ১০৮ পৃষ্ঠার বইটির মলাট মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন কৌশিক জামান। বইমেলার মাঠে অবসর প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন নং ১৩ ছাড়াও রকমারি এবং অন্যান্য অনলাইন বুকশপেও পাওয়া যাবে বইটি।

লেখা ও ছবি: রোদসী ডেস্ক 

 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – ইনভিজিবল প্ল্যানেটস (সমকালীন চাইনিজ সাইফাই সংকলন)

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২১, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলার ইতিমধ্যেই অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে সমকালীন চাইনিজ এক সাইফাই সংকলনের কথা।

সাইন্স ফিকশন বা সাই-ফাই জনরা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় ধারা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলা হয় যাকে। বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সূত্রের সাহায্যে কাল্পনিক গল্পের আবহ তৈরি করে পাঠকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিস্তার ঘটানোই মূলত এই ধারার মূল উদ্দেশ্য। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয় এই জনরাটি সম্প্রতিকালে আমাদের দেশেও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আর সেটা নেটফ্লিক্সের ব্ল্যাকমিরর সিরিজের জনপ্রিয়তাই বলে দেয়।

তবে সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেশে সাইন্স ফিকশন বা সাই-ফাই জনরা খুব বেশি একটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেনি। যেখানে মারশিয়ান বইতে মঙ্গলে আটকা পড়ে প্রধান চরিত্র সেখানে আমাদের চিন্তাধারা এখনো গৎবাঁধা সেই আদিকালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতেই আটকে আছে। আর এরকম গৎবাঁধা চিন্তাধারা থেকে পাঠকদের মুক্তি দিতে একদল তরুণ অনুবাদক আফসার ব্রাদার্সের ব্যানারের মেলায় নিয়ে এলো সমকালীন চাইনিজ সাইফাই সংকলন – ইনভিজিবল প্লানেটস।

সূচীপত্র:

  • মূল লেখক – চেন কুইফেন 
  • দ্য ইয়ার অফ দ্য র‍্যাট, অনুবাদ – প্রান্ত ঘোষ দস্তিদার
  • দ্য ফিশ অফ লি জিয়াং, অনুবাদ – ওয়াসি আহমেদ
  • দ্য ফ্লাওয়ার অব শাজুই, অনুবাদ – ইশরাক অর্ণব 

 

  • মূল লেখক – শিয়া জিয়া
  • এ হান্ড্রেড ঘোস্ট প্যারেড টুনাইট, অনুবাদ – সালমান হক
  • টংটং’স সামার, অনুবাদ – সালমান হক  

 

  • মূল লেখক – মা বয়ং
  • দ্য সিটি অফ সাইলেন্স, অনুবাদ – উচ্ছ্বাস তৌসিফ 

 

  • মূল লেখক –  হাও জিংফ্যাং
  • ইনভিজিবল প্ল্যানেটস, অনুবাদ – আশিকুর রহমান খান 

 

  • মূল লেখক – ত্যাং ফেই
  • কল গার্ল, অনুবাদ: ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ 

 

  • মূল লেখক – চ্যাং জিংবো
  • গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাই, অনুবাদ – ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ 

 

  • মূল লেখক – লিউ সিশিন
  • দ্যা সার্কেল, অনুবাদ – কৌশিক জামান
  • টেইকিং কেয়ার অফ গড, অনুবাদ – কৌশিক জামান

 

বইয়ের নাম: ইনভিজিবল প্ল্যানেটস ।। সম্পাদনা: কেন লিউ ।। অনুবাদ সমন্বয়কারী: আশিকুর রহমান খান ।।
প্রচ্ছদ: কৌশিক জামান ।। পৃষ্ঠা: ২৭১ ।। মলাট মূল্য: ৩৭৫/- টাকা

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এর আফসার ব্রাদার্সের স্টলে পাওয়া যাবে বইটি। এছাড়াও রকমারি ডট কম সহ অনলাইন বুকশপগুলোতেও পাওয়া যাবে।

ছবি ও লেখা: রোদসী ডেস্ক 

০ মন্তব্য করো
2 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পরোমান্সরোমান্স রসায়নশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

প্রকৌশলী প্রেম: রাজু আলীম

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২০

ক্লাস শেষে করিডরে জল, পেছনে রিমি; সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস ছিল ওদের। এখন বাজে দশটা। আজ একটাই ক্লাস। পুরো দিনই ফ্রি। জলকে রিমি বলে, এই চল রেললাইনে যাই।
-মরতে? সাতসকালে রেললাইনে?
-আরে, মরতে যাব কোন দুঃখে? যাব তো তোকে মারতে।
-কাকে?
-কেন, তোকে?
-হঠাৎ আমারে মারার সুপারি নিলি কেন?
-তোর মরা আমার হাতেই; আমি তোর আজরাইল।
-রেললাইনে নিয়ে মারতে পারবি তো?
-কেন পারব না?
-রেললাইনে বডি দেব, মাথা দেব না। মারবি কী করে? মারতে তো পারবিই না, উল্টো নিজে মরবি।
-কেন?
-মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে আর রেললাইনে গিয়ে তুই প্রেমে কাটা পড়বি। রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম, বুঝলি, সুন্দরী?
-এই ইয়ারকি রাখ, নিয়ে যাবি কি না বল?
-সকাল সকাল তোর যদি মরার পাখনা গজায়, তবে ঠেকায় কে? পিপীলিকার পাখা ওড়ে মরিবার তরে, কাহার ষোড়শী কন্যা তুমি আনিয়াছ ঘরে? চল, রেলে তোর মরিবার সাধ পুরা করি, আমার কী? চল, তোকে মরতে সাহায্য করি।

ফ্যাকাল্টি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে এসে রিকশা নেয় ওরা। জল উঠে বসে সিটে।
-এই পাশে বসলি কেন? কত দিন বলেছি আমার সাথে রিকশায় বসলে তুই ডান পাশে আর আমি বাঁ দিকে বসব? এক কথা কত দিন আর বলব? সামান্য এইটুকু মনে রাখতে পারিস না? এই মেমোরি নিয়ে তুই কী করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? আমার না ডাউট হয়!
-এত ডাউট করা লাগবে না, এই তো সরেছি বাঁ দিকে, এবার ওঠ।

ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে ভিসির বাংলো হয়ে রিকশা আসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে।
-এই মামা দাঁড়াও, দাঁড়াও।
-রিকশা থামালি কেন?
-বল, যা চাইব দিবি?
-কী চাই তোর?
-আগে বল দিবি?
-ন্যাকামি করিস না, কী চাই বল।
-ওই যে আমড়া মামা। বেশি করে কাসুন্দি দিয়ে আমড়ামাখা খাব।
-শোন, নেকু নেকু করবি না। আমড়া খাবি তো এত ঢং করছিলি কেন? একি এমন মহামূল্যবান জিনিস যে তার জন্য তোকে কথা দিতে হবে?
-তুই তো দেখি পুরাই পাগলি, মাথায় ছিট আছে? জুতা থুইয়া পা কালি করে?
-হুম, আমার মাথায় ছিট আছে আর সেই ছিট খালিও আছে, তুই বসবি ছিটে? যা পাগলু আমড়া মাখা নিয়ে আয়। এই শোন, সকালে না নাশতাও করিনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে; ওই দোকানে বানরুটি আছে। মাসকা করে মাখন লাগিয়ে একটা নিয়ে আসিস, প্লিজ। মাখন লাগানো রুটি আন, তোকে একটা দারুণ জিনিস শেখাব?

রিকশা থেকে জলকে ঠেলে নামিয়ে দেয় রিমি। ধাক্কাতে পড়ে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। পড়ে যেতে দেখে হো হো করে হাসে রিমি।
-সামান্য এটুকু ধাক্কাতেই নিজেকে সামলাতে পারিস না। এর চেয়ে বড় ধাক্কা আসলে কী করবি? এই শক্তি নিয়ে কী করে তুই বড় বড় বিল্ডিং বানাবি, শুনি? তোর বানানো বাড়ি তো তোর মতোই নড়বড়ে তালপাতার সেপাই হবে। সামান্য হাওয়াতেই পড়ে যাবে।
-হ্যাঁ, আমার বানানো বাড়ি নড়বড়ে হবে। আর সেই বাড়ি ভেঙে পড়বে তোর ওপর আর তার তলে চাপা পড়ে মরবি তুই।
-আমি মরলে তুই তো বেঁচে যাবি।
-আরে তুই মরলে আমি বেঁচে যাব কেন? তুই মরলে তো বড়জোর বেঁচে যাবে ওই বেটা, যার সাথে আল্লা তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আর তা না হলে তোকে বিয়ে করে ওই বেটাকেই তো নির্ঘাত সারা জীবন কাঁদতে হবে।
-আচ্ছা, যা আপাতত এখন ওই লোকের জায়গায় প্রক্সি দিয়ে তুই মর। আমার জন্য মাখন লাগানো রুটি আর আমড়া মাখা নিয়ে আয়।

রিকশায় বসে রিমি। কাসুন্দিমাখা আমড়া আনতে ছোটে জল। ছোট্ট পলিব্যাগে চারটা আমড়া, একটা দেড় লিটার মামের বোতল, কয়েকটা বেনসন, একটা ম্যাচ, দুই প্যাকেট চিপস আর দুইটা বড় বড় ছানার মিষ্টি সঙ্গে মাখন রুটিও নিয়ে নেয় জল।

রিকশা চলে লাইব্রেরির দিকে। সকালের নাশতা রিকশায়। মাখন লাগানো রুটি।
-কী নাকি শেখাবি আমাকে?
-হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করে দিলি তো! তোকে মজার একটিা জিনিস শেখাব। একটা প্রশ্ন, উত্তর দিবি?
-কী প্রশ্ন?
-এই যে আমি মাখন-রুটি খাচ্ছি। এই মাখন নিয়ে, তোকে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে।
-কী প্রশ্ন?
-মাখন লাল সরকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মামা ছিলেন- এর ইংরেজি কী?
-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। কোনো রকম ভনিতা ছাড়া একদমে উত্তর দেয় জল।
ভড়কে যায় রিমি। খাওয়া বন্ধ। থ হয়ে তাকিয়ে জলের দিকে-তুই পারলি কী করে?
-হাঁস পাড়ে, মুরগি পাড়ে। আমি কেন পারব না?
হো-হো-হো-হো-হো-দুজন হাসতে হাসতে একসঙ্গে বলে-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস।

জল থামে। রিমি এবার একা-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। হো-হো- হো-হো-হো-রিমির হাসি থামে না; বারবার বলে আর হাসে। জানিস, কালকে না প্রথম আমি এটা নেটে পড়েছি, তারপর সারারাত হেসেছি-হো-হো-হো-হো-হো-আবারও হাসে, রিমির এত হাসি দেখে এবার হাসে জলও।

ইলেকট্রিক্যাল ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে লেডিস হলের দিকে রিকশা যায়, পলিব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমড়া খায় রিমি। টকের স্বাদে চোখ বন্ধ করে আঙুল চেটে কাসুন্দি খেতে থাকে; আচ্ছা জল, আজকে তোর ব্যাপারটা কী বল তো। তুই এত কিছু আনলি কেন? আমি আনতে বললাম শুধু আমড়া-কাসুন্দি আর রুটি, তুই আনলি মিষ্টি, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, সিগারেট-এত কিছু, ব্যাপার কী তোর? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি আবার? আমাকে তো আবার লাইন মারার চক্করে নেই তুই?
-তার আগে তুই বল। সকাল সকাল আজ আমাকে রেললাইনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? লাইন মারার চক্করে যে থাকে সেই কিন্তু রেললাইনে যায়? আগে তোর মতলবটা শুনি?
-তোর মতো নড়বড়ে ইঞ্জিনিয়ারকে লাইন মারব আমি? শোন, আমিও তো ইঞ্জিনিয়ার। আমি লাইন মারলে মারব আমার চেয়ে বড় কারও সাথে?
-তো কে সে শুনি?
-আমার বিয়ে হবে কোনো পাইলট টাইলটের সাথে? তেমন কারও সাথেই লাইন মারব।
-পাইলট? মানে আমাদের ভার্সিটির বাসের ড্রাইভার মামা? হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তোর জন্য পারফেক্ট ম্যাচিং? ঠিকঠাক মানাবে।
-এই একদম ইয়ারকি মারবি না।
-ইয়ারকি কই? আমাদের ক্যাম্পাসের বাসের ড্রাইভার মামাদের আমরা তো পাইলটই বলি? কেন তুইও তো বলিস।
-হ্যাঁ, ওটা তো আমরা মজা করে বলি।
-আমি মনে করলাম ভার্সিটির বাসে চড়তে চড়তে হয়তো তুই কোনো পাইলট মামার প্রেমে পড়ে গেছিস? তা তো হতেই পারে, তাই না?
-না, পারে না? আরে গাধা, আমি প্লেনের পাইলটের কথা বলেছি।
-ও আচ্ছা বুঝলাম, বিমানচালক, তাহলে বাসচালক না? তো দুজনে কিন্তু একই-চালক। একজন চালায় আকাশে আর একজন মাটিতে, পার্থক্য এই যা। এয়ারবাসও তো বাস, তাই না? বাসচালক আর বিমানচালকের জাত আলাদা হলেও ক্লাস কিন্তু একই, বল ঠিক না? সেই হিসেবে তোর পছন্দ ঠিকই আছে; ঠিক আছে কি না বল।
-তুই একটা হারামি, শয়তান।

কাসুন্দিমাখা হাতে জলের বাঁ হাত ধরে কিল মারতে থাকে রিমি, -তুই একটা বানর, গাধা, বলদা।
-এই আমার হাত ছাড় রিমি। একদম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না-হাত ছাড় দূরে সরে বয়; কাছে ঘেঁষবি না-নো, নো, নো, নো-অ্যাডভান্টেজ; হাত ছাড় বলছি রিমি।
-ছাড়ব না, দেখি তুই কী করিস? জলের হাত আরও শক্ত করে এবার বুকের সাথে ধরে রিমি
-তুই কি পাগল হলি? আমার হাত তোর কোথায়, দেখ তো?

বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাত ছাড়ে রিমি। লজ্জায় তাকায় না জলের দিকে; মাথা নিচু করে বসে আছে। মুখে কথা নেই। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি পেরিয়ে যায় রিকশা।
-এই রিমি কি হলো? নির্বাক চলচ্চিত্র হয়ে গেলি? কথা বল কী হলো?
-তোর আমড়া খুব টেস্টি ছিল রে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
-আরে, আমড়া আমার হতে যাবে কেন? আমি কি আমড়া বেচি? ও তো আমড়া মামার আমড়া।
-তুই নিজেই তো একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি। তাই ভাবলাম আমড়াটাও তাই তোরই হবে?

হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি, না হেসে পারে না জলও। হাসে দুজনে। হেসে হেসে এবার জলের কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে রিমি।
-হাসতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হাসির ছুতোয় কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়া চলবে না। নো অ্যাডভান্টেজ; দূরে যা রিমি দূরে। ব্যাপার কী তোর আজ? তুই আমার শরীরের কাছে ঘেঁষছিস? ব্যাপার কী?
-তোর শরীর কি সুইমিংপুল যে ওখানে ঘেঁষতে হবে? ওটা তো একটা পচা ডোবা?
-কীভাবে টের পেলি? ডোবাতে নেমেছিস কোনো দিন?
-কোনটা সুইমিংপুল আর কোনটা পচা ডোবা তা বোঝার জন্য নেমে দেখার দরকার হয় না। পাড়ে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। বুঝলি কিছু বুদ্ধুরাম? আবারও একসঙ্গে হাসে দুজনে।

লেডিস হলের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। বাঁ দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের একবারে পাড় ঘেঁষে ছোট্ট পিচঢালা রাস্তা সোজা বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরিয়ে চলে গেছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির দিকে। ওই ফ্যাকাল্টির পাশেই রেললাইন।
-ওই দেখ, পুকুরের জলে আমাদের ছায়া।

তাকিয়ে দেখে পুকুরের জলে রিকশা মামা রিমি আর ও সাঁতার কাটে; পানির জলে রিকশা চলে, জলেতে রিকশায় বসে চলে দুজন। হলের পুকুরের একেবারে পাড় ঘেঁষে যায়;
-আচ্ছা, তুই কি এই পুকুরের জল? নাকি তুই নদী সাগর কুয়ো বৃষ্টি খাল বিল ডোবা নালা চোখের জল নাকি তুই নর্দমার? কিসের জল তুই, বল? কষ্টের নাকি সুখের? নাকি তুই নাকের জল?

হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি উত্তর দেয় না জল; উদাস তাকিয়ে রিমির হাসা দেখে।
-আচ্ছা, যেভাবে আমড়া খাওয়ালি, সারা জীবন আমাকে এইভাবে খাওয়াবি তো?
-তোকে সারা জীবন আমড়া খাওয়াতে যাব কোন দুঃখে? কী হয়েছে? আজ মন যে খুব উরু উরু তোর! এত রোমান্টিক কথা বলছিস? অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার মতলব? সামথিং সামথিং?
-আরে, নাথিং নাথিং।
-বল, এভাবে সারা জীবন আমড়া খাওয়াবি?
-দয়াল বাবা আমড়া খাবা, গাছ লাগায়ে খাও। আমি পারব না। এসব কথা আর বলবি না-নো অ্যাডভান্টেজ।
-আরে, তুই তো আমড়া কাঠের ঢেঁকি। আমড়া খাওয়ানোর তাই দায়িত্ব তোকেই দিতে চাই। তোর মতো আমড়ার ঢেঁকি আমি আর কই পাব?

এবার পুকুরের জলের ছায়াতে রিকশা মামা খিলখিল করে হাসে-রিকশা মামার হাসিতে যোগ দেয় ওরাও। ডাঙায় তিনজন, পানিতে তিনজন মোট হাসে ছয়জন। কিন্তু মানুষ তো তিনজন।

পুকুরের পাড় পেছনে ফেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। গা ছমছমে নীরবতা এই রাস্তায় সব সময়। অসম্ভব সুন্দর রোড। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা- রাস্তার দুই পাশে বড় বড় মেহগনিগাছ। জীবনানন্দের কবিতার মতো মেহগনির ছায়াঘন পল্লবে মোড়া। গাছের গভীর ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ও হাওয়ার খেলা আর এখানে ওখানে-দু এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া তেমন কেউ সাধারণত থাকে না এখানে -এই তুই নাকি সব কি কবিতা জানিস? একটা কবিতা আবৃত্তি কর না প্লিজ?
জলের হাত ধরে রিমি। এই হাত ছাড় বলছি। কোন অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, সেন্টিমেন্টাল কোনো ডায়ালগবাজি করবি না। যদি কাছে ঘেঁষার পাঁয়তারা করিস আমি কিন্তু তোকে ফেলে চলে যাব।
-তুই এত পার্সোনালিটি দেখাস কেন? তোর তো কোনো পার্সোনালিটি থাকার কথা না। তুই হলি জল, দ্য ওয়াটার হ্যাজ নো কালার। জলের নিজস্ব কোনো রং নেই; যখন যেখানে যে পাত্রে রাখা হয় জল সেই পাত্রের রং ধারণ করে। সুতরাং তোকে যেভাবে ইচ্ছা যেখানে সেখানে রাখব যা তা বলব তুই ঠিকঠিক সে রকম হবি? পার্সোনালিটি জলের মানায় না? তুই তো নামেই জল? জলের মতো সহজ সরল হ। খালি ত্যাড়াব্যাঁকা কথা?

জল চুপ হয়ে আছে।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সামনে এসে রিকশা দাঁড়ায়। রাস্তা শেষ। একটু হেঁটে গেট পেরিয়েই রেললাইন। রিকশা মামাকে টাকা দিয়ে সিগারেট ধরায় জল, আজ আমি সিগারেট খাব?
তা তো খাবিই মনে তো রং? কত কিছুই করবি আজ?

গেট পেরিয়ে রেললাইনে এসে দাঁড়ায় দুজন। পুব দিকে হাঁটে জল; এই আমাকে ফেলে আগে আগে যাচ্ছিস কেন? আমার কাছে আয়? আমি তোর হাত ধরে রেললাইনের ওপরে দিয়ে হাঁটব?

-আমাকে যত কাছে টানবি, আমি তত দূরে চলে যাব। সো নো অ্যাডভান্টেজ।
-আর যদি দূরে চলে যেতে বলি তখন কি কাছে চলে আসবি?
-নো, ইমোশনাল ডায়ালগবাজি? দূরত্ব বজায় রেখে হাঁট?
-আচ্ছা, তোর হাত ধরে হাঁটতে চেয়েছি, তোকে তো আমি হাগ করতে বলিনি। তুই এত ভিতু, ইঞ্জিনিয়ার হবি কীভাবে?
-তোর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে সাহসী হওয়ার প্রমাণ দিতে চাই না।
-হাত তোকে দিতেই হবে?
-শোন, হিমুরা কখনো কারও হাতে হাত রাখে না; আমি হলাম হিমু বুঝলি? সো ডোন্ট ট্রাই টু টেক এনি অ্যাডভান্টেজ।
-তুই হিমু আর আমি রুপা
-হিমু রুপার হাতেও হাত রাখে না। হিমুদের কোনো বন্ধন থাকতে নেই।

সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় জল। কী এক অজানা আবেগ এসে জড়ো হয় চোখে। সমান্তরাল এই রেললাইন যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি দূরে চলে। সারি সারি উঁচু উঁচু নাম না জানা গাছের মিতালি। রোদ-ছায়ার খেলা সত্যিই অপূর্ব জীবন আর বেঁচে থাকা। মনের অজান্তে কবিতা চলে আসে মুখে। পেছনে হাঁটা রিমিকে শোনানোর জন্যই হয়তো গলা জোরে ছাড়ে জল;

-আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভেতর এক নিরালা নীড়ে। তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালি শস্যের ভেতর গা ভাসিয়ে দিতাম- তোমার পাখনায় আমার পালক-আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-নীল আকাশে খইখেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে।

সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ। হয়তো গুলির শব্দ: আমাদের তির্যক গতিস্রোত, আমাদের পাখনায় পিষ্টনের উল্লাস, আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান। হয়তো গুলির শব্দ আবার: আমাদের স্তব্ধতা আমাদের শান্তি। আমাদের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না থাকত না আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার। আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে।
কখন যে রিমি এসে হাত ধরেছে টের পায়নি জল, হাতে হাত রেখে কবিতার ঘোরে অনেকটা পথ এসেছে দুজন।

-এই চল ওই দেবদারুগাছের নিচে একটু বসি। তোর আবৃত্তি কিন্তু জোশ, মাইন্ড ব্লোয়িং রিয়েলি।
-রিমি একদম ফ্ল্যাট করবি না। আর অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, তুই আমার হাত ধরেছিলি কেন?
-ওরে নেকা ষষ্ঠী দুধে-ভাতে মনে হয় কিচ্ছু বোঝো না? আমি হাত ধরেছি। তুই তো সরিয়ে দিতে পারতি? আরে বুঝি বুঝি সবই বুঝি। তোর যত বাহানা ওপরে ওপরে। সামনে এ রকম সুন্দরী থাকলে সবার মনই না উরু উরু করে? আর তোর করবে না? তোর মনও যে আঁকুপাঁকু করে আমি বুঝি?
-মোটেও না। আমি কবিতার ঘোরে ছিলাম। টেরই পাইনি কখন এসে তুই হাত ধরেছিস? নইলে আমি তোকে পাত্তা দেব? কোন চান্সই নেই ইয়ার।
-এই তুই এত ভালো আবৃত্তি করিস, কবিতা লিখিস, তোর তো সাহিত্যে পড়া দরকার ছিল?
-সাহিত্যে পড়তে কপালটা চওড়া হতে হয়। সে কপাল আমার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখব। সাহিত্যে পড়ব অথচ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সাহিত্যে চান্স পেলাম না। চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টসে শুধু সাহিত্যের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু একটাতেও টিকিনি, শেষমেশ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলাম। এখানে আমার কপালটা দেখ, ভালো লাগে যে বিষয় তা নিয়ে পড়তে পারলাম না। আসলে মা-বাবা চায়নি আমি সাহিত্যে পড়ি। তারা চেয়েছে ইঞ্জিনিয়ার হই। তাই হয়তো হয়নি? কী আর করা। এখন আর আফসোস করে লাভ কী বল? সবই কপাল। আর এখানে পড়তে এসে কপালে জুটেছে তোর মতো এক পিস। আফসোস করে কী লাভ, সবই কপাল?
-এই কী বললি? জলের গায়ে কিল মারতে থাকে রিমি। কিছুক্ষণ কিলিয়ে হাঁপিয়ে গলা টিপে ধরে, মেরেই ফেলব তোকে। আজ মেরেই ফেলব।

কোনো রকমে রিমির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দূরে গিয়ে বসে জল। এই পালালি কেন? কাছে আয়; আজ তোকে মেরেই ফেলব। রেললাইনের পাথর হাতে নিয়ে ভয় দেখায় রিমি, কাছে আয়, নইলে কিন্তু সত্যি সত্যি এই পাথর ছুড়ব। বলা যায় না মেরেও দিতে পারে। কোনো গ্যারান্টি নেই। এর আগে একদিন ঝগড়া করতে করতে রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল জলকে। এই মেয়েকে একটু বিশ্বাস নেই, রাগলে মাথা ঠিক থাকে না ওর।

-ঠিক আছে কাছে আসব কিন্তু আর কোনো ঝামেলা করবি না তো?
-কাছে আয়, আর কিছুই করব না।
-সত্যি তো?
-হ্যাঁ, সত্যি।

হাত থেকে পাথর ফেলে দেয় রিমি। জল এসে ওর কাছে বসে; পাশাপাশি দুটো স্লিপারের ওপর দুজন।
-খুব খিদে পেয়েছে রে।
-জানি তো তোর খিদে পাবে।
-এই নে খা।

মিষ্টি চিপস, পানির বোতল এগিয়ে দেয় জল,
-প্যাকেট ছিঁড়ে দে।
-সামান্য একটা চিপসের প্যাকেট ছিঁড়তে পারিস না। তুই কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? ডাউট হচ্ছে বুঝলি?

প্যাকেট ছিঁড়ে জল। মিষ্টি চিপস খেতে থাকে দুজন। হাত উঁচিয়ে দূরে দেখায় রিমি;
-ওই দেখ কেন্নো আসে;
-সেকি কিরে গাড়ি আসছে? তাড়াতাড়ি খা।

ওরা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। পানি খেয়ে দাঁড়ায় দেবদারুগাছের নিচে। সামনে-পেছনে সারি সারি দেবদারুগাছ। তার ভেতর দিয়ে ছুটে আসে ট্রেন। রিমিকে দূরে দেখায় জল-
-কী যে মনোহারি, দেবদারু সারি সারি দেদার দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতার।
-বাহ্ বাহ্, তুই তো দেখি চারণ কবিও?

গাড়ি আরও কাছে চলে আসে। ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ওরা যাত্রী নয়, কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে দুজন কিন্তু গাড়ি দাঁড়াবে না ওদের জন্য। পথের কোনো যাত্রীর প্রতি ট্রেনের মায়া থাকে না। মাঝপথে থেমে রাস্তা থেকে ট্রেন কাউকে তুলে নেয় না। ট্রেনের মায়া শুধু স্টেশনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীর ওপর। ঠিক সময়ে যাত্রীকে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে গাড়ি রোজ সকালে বাড়ি ছাড়ে। গাড়ি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে দুজনে। কখনো সখনো কারও চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যাওয়ার সময়ে কারও মুখে যেমন কথা থাকে না তেমনি মুখ বুজে দাঁড়িয়ে ওরা। হু..হু..হু..শ..শ..শ.. শব্দে ধুলো বাতাসের ঝড়ে ওদের ছেড়ে গাড়ি ছোটে অন্য কোনো পথিকের দিকে। যে আছে সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরই মতো ট্রেন যাওয়ার অপেক্ষায়। পেছন থেকে কেন্নোর চলে যাওয়া উদাস তাকিয়ে দেখে রিমি-এই কী হোলো তোর? আয়?

রিমির চোখ গাড়িতে আটকে আছে। ডাকের শব্দে ফিরে তাকায়-
এসে বসে জলের পাশে গা ঘেঁষে; বলেছি না আজ বিড়ি খাব; দে বিড়ি? একটা বেনসন হাতে দেয় জল, ম্যাচের কাঠি ঠুকে জ্বালায়।
খুক, খুক, খুক, খুক কাশি। থামে না আরও জোরে টানে খুক। খুক, খুক, খুক আবারও কাশে যত টান তত কাশ।
টানের চেয়ে কাশিই বেশি-

কাশি আর ধোঁয়াতে রিমির চোখে জল। তবু টান থামে না।
-এই সব ছাইপাঁশ তোরা যে কী করে গিলিস, মাথায় আসে না? রাবিশ, ফেলে দেয় সিগারেট। পার্স থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে জলের বা হাত টেনে নেয়; তোর হাতের কনুই থেকে নখ পর্যন্ত খুব সুন্দর। দুই হাতের মধ্যে জলের হাত চেপে ধরে আছে রিমি, তোর মুখের কালার হাতের মতো এত সুন্দর না? হাতের মতো হলে আরও ভালো হতো। সপাটে হাত টেনে নিয়ে আলতো চুমু খায় রিমি-
-হাত নেওয়া পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায় কিন্তু তুই এ কী করলি? হাউ ননসেন্স ইউ আর?
আরও শক্ত করে এবার জলের হাত ধরে একের পর এক চুমু দেয় হাতে।
-যত বাধা দিবি, তত বাড়বে।

জল দমে যায়। জানে বাধা দিয়ে লাভ নেই। তাতে রিমির পাগলামি আরও বাড়বে। ঝমঝম বৃষ্টি। শোঁ শোঁ শব্দ। দমকা বাতাসে হঠাৎ অন্ধকার চারদিকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাকভেজা দুজন। রেললাইনের ওপর হাত ধরে বসে থাকে। মুষলধারে জলের ঢল। ভারী ভারী ফোঁটার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। কেউ নেই চোখের সীমায়। অন্ধকারে ঝাপসা একটু দূরেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির তোড়ে উঠে দাঁড়ায় ওরা। জলের হাত ধরে টেনে নিয়ে ঝাঁকড়া দেবদারুগাছের নিচে দাঁড়ায় রিমি। অন্য হাতও টেনে নেয়। গাছের নিচে সামনাসামনি দাঁড় করায় জলকে দুই হাত দিয়ে বুকে জাপটে ধরে। তুমুল বাতাস। দমাদম বাজ পড়ার তীব্র শব্দে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রিমি।

দুই প্রকৃতির কাছে অসহায় জল। মেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আসল প্রকৃতি মিলেমিশে টালমাটাল করে দেয় ওকে। রক্ত-মাংস শিউরে ওঠে জলের। ভারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে ৪৪০ ভোল্ট কারেন্টের তেজ। জলের ভেজা বারুদের স্তূপে দাউদাউ আগুন জ্বলে। হেরে যায় দিশেহারা। ধরে রাখতে পারে না নিজেকে। জেগে ওঠে শরীর। দুই হাতে শক্ত করে জাপটে বাহুতে পেষে রিমিকে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে একজনকে পিষে চলে বুকে। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালের এই বৃষ্টি জলের জন্য শুভ কি না? তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে বারো বছর?

 

ছবিসূত্র: সংগ্রহীত 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পশিল্প ও সাহিত্য

দ্য লাস্ট লিফ মূল: ও. হেনরি

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২, ২০২০

ওয়াশিংটন স্কয়ারের পশ্চিমে এক ছোট জেলা, যেখানে রাস্তাগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে এবং ভেঙে ভেঙে নিজেদের ভেতরে ছোট ছোট ‘গলি’ তৈরি করেছে। এই গলিগুলোতে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত সব কোনাকানচি আর বাঁক। একটি রাস্তা নিজের ওপর দিয়ে এক-দুবার করে অতিক্রম করে গেছে। একবার এক চিত্রশিল্পী এই রাস্তাটির মধ্যে এক মূল্যবান সম্ভাবনা আবিষ্কার করে বসল। মনে করো, একজন সংগ্রাহক রং, কাগজ এবং ক্যানভাসের জন্য বিল সঙ্গে নিয়ে এই পথের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কিছুটা পথ এগিয়ে হঠাৎ সে দেখতে পেল, আগের জায়গায়ই ফিরে এসেছে, এর জন্য তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয়নি! তাই চিত্রশিল্পীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এই অদ্ভুত পুরোনো গ্রিনিচ গ্রামে চলে এল, খুঁজে বের করল উত্তর দিকের জানালাসহ আঠারো শতকের পুরোনো গ্যাবল। এরপর তারা ছয় নম্বর অ্যাভিনিউ থেকে রান্না করা ও খাবার গরম রাখার জন্য চুল্লিযুক্ত দু-একটি পাত্র এবং কিছু পিউটর মগ নিয়ে এসে এখানে কলোনি গড়ল।

তিনতলা পাকা বাড়িটির নিচতলায় ছিল সিউ ও জনসির স্টুডিও। জনসি ‘জোয়ান্না’ নামে পরিচিত ছিল। একজন এসেছিল মেইন থেকে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া। আট নম্বর স্ট্রিটের ‘ডেলমনিকো’স হোটেলের খাবার টেবিলে তাদের পরিচয় হলো এবং তারা দেখল শিল্প, চিকরি সালাদ ও ফুল হাতার এক বিশেষ জামার সঙ্গে তাদের রুচির অনেক মিল। এর ফলে এই যৌথ স্টুডিওটি দাঁড়িয়ে গেল।

সময়টা ছিল মে মাস। এক অদেখা আগন্তুক, যাকে ডাক্তাররা ডাকত নিউমোনিয়া, কলোনিতে জেঁকে বসল। তার হিমশীতল আঙুলগুলো এখানে-সেখানে স্পর্শ করল। এই ধ্বংসকারী দুঃসাহসিকভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে পূর্ব দিকে এগোল, তার শিকারকে আঁচড় বসিয়ে সজোরে আঘাত করল; তবে এই সরু ও শেওলা পড়া গোলকধাঁধার ‘গলি’ দিয়ে তার পা ধীরে ধীরে সামনে বাড়াল।

একজন আদর্শ নাইট, বয়স্ক সজ্জন ব্যক্তিকে তুমি যা ডাকতে পারো, নিউমোনিয়া সাহেব তেমনটি নন। ক্যালিফোর্নিয়ার মৃদুমন্দ পশ্চিমা বায়ুর সহানুভূতির পাত্র রক্তশূন্য ছোট মেয়েটি ছিল লাল মুঠো, স্বল্পস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নির্বোধ বুড়োটার জন্য নামে মাত্র বৈধ আক্রমণস্থল। তাই জনসিকে সে সজোরে আঘাত করে বসল; জনসি বিছানায় পড়ে গেল, হাঁটাচলা করত না বললেই চলে, নিজের আলপনা আঁকা লোহার খাটে শুয়ে শুয়ে ছোট গ্যাবলের জানালার শার্সির কাচের ভেতর দিয়ে সামনের পাকা বাড়িটার শূন্য দিকটায় চেয়ে থাকত।

একদিন সকালে সিউয়ের আমন্ত্রণে ছাইরঙা ভ্রুঅলা এক ব্যস্ত ডাক্তার বিল্ডিংয়ে এলেন।

‘তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশে এক।’ ডাক্তার তার ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারের পারদ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘এবং তার জন্য এই সম্ভাবনাটি হলো তার নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছা। শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়া মানুষজন এই উপায়েই আবার ফিরে আসে যে সীমানায় মৃত্যুদূত সমগ্র ফার্মাকোপিডিয়াকে নিরর্থক বানিয়ে ফেলে। আপনার এই ছোট মেয়েটি নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে আর সুস্থ হতে যাচ্ছে না। তার মনে এ ছাড়া আর অন্য কিছু আছে কি?’

‘সে কিছুদিন নেপলস উপসাগরকে আঁকতে চেয়েছিল।’ সিউ বলল।

‘চিত্রাঙ্কন? নাহ্! তার মনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো চিন্তা একবারের বেশি এসেছিল কি? যেমন ধরুন কোনো মানুষকে নিয়ে?’

‘কোনো মানুষ?’ জিউস হার্পের মতো নাকি সুরে সিউ বলল, ‘কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ…কিন্তু, না, ডাক্তার! এমন কিছু হয়নি।’

‘আচ্ছা, এটাই তাহলে তার দুর্বলতা। আমার ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব, বিজ্ঞান অনুসারে আমি তার সবটুকুই করব। কিন্তু যখনই আমার রোগী তার শবযাত্রার দিন গুনতে শুরু করবে, আমি ওষুধের উপশম-সহায়ক ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসব। নতুন শীতের ধরনে তার ক্লোক স্লিভ পোশাকে কেমন লাগছে যদি আপনি তাকে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারতেন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছিÑ তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে দশে একের পরিবর্তে পাঁচে এক হবে।’

ডাক্তার চলে গেলে সিউ তার ওয়ার্করুমে গিয়ে নরম জাপানি ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদল। এরপর সে ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে তর্জন-গর্জন করতে করতে জনসির রুমে গিয়ে সিটি বাজিয়ে র‌্যাগটাইম গাইতে লাগল।

জনসি কাঁথার নিচে বড়জোর একটু নড়াচড়া করে, জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। সিউ সিটি বাজানো থামিয়ে ভাবল, জনসি ঘুমিয়ে আছে। সে বোর্ড সাজিয়ে ম্যাগাজিনের গল্প ফুটিয়ে তোলার জন্য কলম-কালি দিয়ে চিত্র আঁকতে শুরু করল। একজন নবীন চিত্রশিল্পীকে শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অবশ্যই ম্যাগাজিনের গল্পের জন্য চিত্র আঁকতে হয়, যেমন একজন নবীন লেখককে প্রতিষ্ঠা পেতে গল্প লিখতে হয় ম্যাগাজিনের জন্য। সিউ ঘোড়দৌড়ে পরার জন্য এক জোড়া রুচিশীল পায়জামা এবং গল্পের নায়কÑ ইডাহো রাখালের একপার্শ্বিক চিত্রের স্কেচ আঁকছিল, তখন সে বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তিসহ নিচু স্বরের একটি শব্দ শুনতে পেয়ে সে দ্রুত বিছানার পাশে ছুটে গেল। জনসির চোখ পুরোপুরি খোলা ছিল। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে গুনছিল উল্টো দিক থেকে গণনা। ‘বারো।’ সে বলল এবং অল্প সময় পরে, ‘এগারো।’ এরপর, ‘দশ…নয়…আট… সাত…!’

সিউ উৎকণ্ঠিতভাবে জানালার বাইরে তাকাল। কী আছে সেখানে গোনার মতো? সেখানে দেখা যাচ্ছিল একটি শূন্য, বিষণ্ন উঠোন এবং কুড়ি ফুট দূরে এক পাকা বাড়ির শূন্য অংশ। একটি পুরোনো, গাঁটযুক্ত ও ক্ষয়ে যাওয়া শিকড়যুক্ত বয়স্ক আইভিলতা ইটের দেয়ালের অর্ধেকটায় বেয়ে উঠেছিল। পরিত্যক্ত ইটের দেয়ালে প্রায় শূন্য লতাটির কাঠামো প্রশাখা দৃঢ়ভাবে লেগেছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না হেমন্তের শীতল হাওয়া লতাটি থেকে পাতাগুলোকে দুর্বল করে ফেলেছিল।

‘কী করছ, সোনা?’ সিউ জিজ্ঞাসা করল।

‘…ছয়।’ প্রায় ফিসফিস করে বলল জনসি।

‘ওরা এখন খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। তিন দিন আগেও প্রায় একশটা ছিল। সেগুলো গুনতে গুনতে আমার মাথাটা ধরে এসেছিল। কিন্তু এখন সহজ হয়ে এসেছে। আরেকটা পড়ে গেল। এখন আর মাত্র পাঁচটি বাকি আছে।’

‘পাঁচটি কি, সোনা? তোমার সিউডিকে বলো?’

‘আইভি লতার পাতা। যখন শেষ পাতাটি পড়ে যাবে, আমিও অবশ্যই চলে যাব। তিন দিন হলো এটি আমি জেনেছি। ডাক্তার কি তোমাকে বলেনি?’

‘ওহ্! এই ধরনের অর্থহীন কথা আমি আর কখনো শুনিনি।’ আশ্চর্য রকম অবজ্ঞার সুরে অভিযোগ করে বলল সিউ।

‘তোমার সুস্থ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে বুড়ো আইভি পাতার কী সম্পর্ক? তুমি ওই লতাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছ, দুষ্ট মেয়ে। বোকার মতো আচরণ করো না। কেন, ডাক্তার তো আজ সকালেই আমাকে বলল তোমার দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে, মনে আছে তোমার, ডাক্তার ঠিক কী বলেছিল?’

সে বলল, ‘সম্ভাবনা দশে এক!’

‘কেন, এটা তো প্রায়ই একটি ভালো সম্ভাবনা হতে পারত যদি আমরা নিউইয়র্কে স্ট্রিট কারে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম অথবা একটি নতুন বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। এখন কিছুটা স্যুপ খাওয়ার চেষ্টা করো এবং তোমার সিউডিকে তার ড্রয়িংয়ের কাছে আবার ফিরে যেতে দাও, যাতে সে সেগুলো সম্পাদক সাহেবের কাছে বিক্রি করে তার অসুস্থ বাচ্চাটার জন্য পোর্ট ওয়াইন এবং নিজের জন্য লোভনীয় শূকরের চপ কিনতে পারে।’

‘তোমাকে আর ওয়াইন কিনতে হবে না।’ জানালার বাইরের তার দৃষ্টি স্থির রেখে বলল জনসি।

‘আরেকটা পড়ে গেল। না, আমি কোনো স্যুপ চাই না। আর মাত্র চারটা পাতা আছে। অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। এর পরে আমিও চলে যাব।’

‘জনসি, সোনা!’ তার ওপর নুয়ে পড়ে সিউ বলল, ‘তুমি কি আমাকে কথা দেবে তোমার চোখ দুটো বন্ধ রাখবে এবং আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি জানালার বাইরে তাকাবে না? আমাকে ছবিগুলো কালকেই জমা দিতে হবে। আমার আলো দরকার, না হলে আমি পর্দা টেনেই আঁকতাম।’

‘তুমি অন্য রুমে গিয়ে আঁকতে পারো না?’ নিরুৎসাহী গলায় বলল জনসি।

সিউ বলল, ‘আমাকে এখানে তোমার পাশেও থাকতে হবে। এ ছাড়া আমি চাই না তুমি ওসব তুচ্ছ আইভি পাতার দিকে তাকিয়ে থাকো।’

‘তোমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে বলো। কারণ, আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আমি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। আমি সব বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাই, ক্রমে ডুবে যেতে চাই, ঠিক ওসব শুকনো, একাকী, অবশ পাতাগুলোর মতো।’

সিউ বলল, ‘ঘুমোতে চেষ্টা করো। আমাকে বেহরম্যানকে ডাকতে যেতে হবে। আমার যেতে বেশি সময় লাগবে না। আমি ফিরে আসার আগে তুমি নড়াচড়ার চেষ্টা করো না।’

বৃদ্ধ বেহরম্যান ছিল একজন পেইন্টার। থাকত বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ষাট পেরোনো এই বৃদ্ধ মজেসের মতো, অনেকটা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো লম্বা দাড়ি ছিল। বেহরম্যান চিত্রশিল্পে ছিল অসফল। চল্লিশ বছর ধরে শিল্পচর্চা করেও তার বউয়ের পোশাকের এক আঁচলের কাছাকাছি কিছু একটা আঁকতে পারেনি। তবে সব সময় সে ভালো কোনো চিত্রকর্ম আঁকার কথা ভাবত; কিন্তু কখনোই সেটা শুরু করতে পারেনি। অনেক বছর শুধু দু-একটা বাণিজ্যিক ও বিজ্ঞাপনী ছবি এঁকে কেটে যায়। যারা পেশাদার চিত্রশিল্পীদের মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তারাই কেবল বেহরম্যানকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিত। আর তাতে সে অল্প কিছু অর্থ উপার্জন করত। সে প্রচুর জিন বা মদপান করত এবং সব সময় তার না আঁকা সেরা শিল্পকর্মটি সম্পর্কে কথা বলত। অবশিষ্ট সময়ে সে ছিল একজন কিছুটা রাগী মানুষ- যে অন্যের স্নেহ-মমতা পাওয়ার জন্য ছিল ক্ষুধার্ত আর নিজেকে গণ্য করেছিল অপেক্ষমাণ মাস্টিফ একটি শক্তিশালী কুকুর হিসেবে…।

বেহরম্যানকে অনালোকিত কক্ষে জুনিপার বাসবুজ কিছু লতাগুল্ম ঘ্রাণ নিতে দেখল। এক কোনায় কাঠের ফ্রেমে একটি শূন্য ক্যানভাস সাজানো ছিল, শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটির রূপ পেতে প্রথম তুলির আঁচড়টির জন্য যা পঁচিশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। জনসির অবাস্তব কল্পচিত্রের কথা বেহরম্যানকে বলল সিউ। তখন বেহরম্যানের রক্তিম চোখ দুটোতে অশ্রুর বন্যা বয়ে গেল এবং উঁচু গলায় এই নির্বোধ ধরনের কল্পনাকে উপহাস করতে লাগল, ‘পৃথিবীতে এমন ব্যক্তিও আছে, যারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতার জন্য মারা যাবে, এ জন্য শুকনো লতা থেকে পাতাগুলো ঝরে পড়ছে- আমি এ ধরনের কথা আগে কখনো শুনিনি। না, আমি আপনার বোকা নির্জনবাসী নির্বোধ ব্যক্তির মডেলের পোজ দিতে পারব না।’

সিউ বলল, ‘সে এখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল। আজব সব অবাস্তব কল্পনায় তার মন ভরে উঠেছে। খুব ভালো, বেহরম্যান সাহেব, যদি আপনি আমার জন্য পোজ দিতে না চান, আপনাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি একজন কুৎসিত গসিপিং প্রিয় বুড়ো খোকা।’

‘আপনিও সাধারণ মেয়ে মানুষের মতো! কে বলল আমি পোজ দেব না? চলুন। আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আধা ঘণ্টা ধরে আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করছি, পোজ দিতে আমি প্রস্তুত। হায় ঈশ্বর! এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে না, যেখানে মিস জনসির মতো একজন ভালো মানুষকে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। একদিন আমি আমার শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকব এবং একদিন আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। হায় ঈশ্বর!’ কথাগুলো রূঢ় ও উঁচু গলায় বলল বেহরম্যান।

তারা ওপরের তলায় যখন গেল, জনসি তখন ঘুমোচ্ছিল। সিউ জানালার গরাদ পর্যন্ত পর্দা টেনে দিয়ে বেহরম্যানকে ইশারা করে বলল অন্য কক্ষে যেতে। সেখানে তারা ভীরু চোখ মেলে জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে আইভি লতাটিকে দেখল। এরপর নীরব হয়ে কিছু খানিক সময়ের জন্য একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। বাইরে তখন অবিরাম তুষারপাত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে পড়ছিল শীতল বৃষ্টি। বেহরম্যান পুরোনো নীল শার্টটি গায়ে চড়িয়ে, উল্টে রাখা কেটলির ওপর বিমূঢ় শ্রমিকের মতো বসে পড়ল। পরদিন সকালে সিউ যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল, জনসিকে দেখতে পেল ধুলো পড়া, মলিন টেনে দেওয়া সবুজ পর্দাটার দিকে উন্মীলিত চোখে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

‘এটাকে ওপরে টেনে দাও, আমি দেখতে চাই।’ জনসি ফিসফিসিয়ে নির্দেশ দিল।

সিউ ক্লান্ত হয়ে পড়লেও নির্দেশ পালন করল। সারারাত ধরে তীব্র তুষাপাত ও ঝোড়ো হাওয়া উপেক্ষা করে ইটের দেয়ালে আইভি পাতাটি তখনো টিকে আছে। এটা ছিল লতাটির শেষ পাতা। কাণ্ডের কাছে এটি এখনো গাঢ় সবুজ; মলিন ও ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজ কাটা হলুদ অংশ নিয়েও মাটি থেকে বিশ ফুট ওপরে এক প্রশাখার সঙ্গে চমৎকারভাবে ঝুলে আছে।

জনসি বলল ‘শেষ পাতাটি। আমি ভেবেছিলাম এটি নিশ্চিতভাবেই কাল রাতে পড়ে গেছে। আমি বাতাসের শব্দ শুনেছিলাম। এটা আজকে পড়ে যাবে এবং তখন আমিও মরে যাব।’

সিউ মলিন মুখখানা বালিশে চেপে বলল, ‘যদি তুমি তোমার কথা ভাবতে না চাও, তবে আমার কথা ভাবো। তবে আমার এখন কী করতে হবে?’

জনসি কোনো উত্তর দিল না। একটি আত্মা যখন তার রহস্যময় ও মহাযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন এটি হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিসঙ্গ ও দুঃখকাতর কোনো অস্তিত্ব। অবাস্তব যত কল্পনা সব তার মাঝে এতটা তীব্রভাবে ভর করে যেন সব ধরনের বন্ধন ছিন্ন করে এক এক করে মুক্ত হয়ে যায়।

দিন ফুরোল, সন্ধ্যার সময়ও তারা নিঃসঙ্গ আইভি পাতাটিকে দেয়ালের ওপর তার কাণ্ডের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সেঁটে থাকতে দেখল। তাপর রাত নেমে এলে উত্তরীয় হাওয়া বইতে শুরু করল, জানালার ওপর বৃষ্টি আছড়ে পড়তে লাগল এবং ছাদের সামনের দিকের নিচু অংশ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ল।

রাত শেষে যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, তখন নির্দয় জনসি পর্দাটিকে ওপরে টেনে দিতে আদেশ দিল। আইভি পাতাটি তখনো সেখানে ছিল। জনসি বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এটার দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর সিউকে ডাকল, সিউ তখন গ্যাসের চুল্লির ওপর রাখা চিকেন স্যুপে চামচ নাড়ছিল।

জনসি বলল, ‘আমি খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি, সিউ।’ কোনো একটা কারণে শেষ পাতাটি সেখানে থেকে গিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে কতটা মন্দ আমি। মরতে চাওয়াটা পাপ। তুমি আমাকে অল্প একটু স্যুপ এনে দাও আর এনে দাও একটু দুধের সঙ্গে অল্প একটু পোর্ট ওয়াইন। আর হ্যাঁ, তার আগে তুমি আমার জন্য একটা হাত-আয়না নিয়ে আসো, এরপর আমার জন্য কিছু বালিশ জড়ো করো- আমি এর ওপর বসে তোমার রান্না করা দেখব।’

বিকেলে ডাক্তার এল। সিউ ডাক্তারের সঙ্গে বারান্দায় গেল। ডাক্তার সিউর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘ভালো সেবায় আপনি জয়ী হবেন। এখন আমাকে নিচতলায় আরেকজন রোগীকে দেখতে যেতে হবে। তার নাম বেহরম্যান। সে একজন চিত্রশিল্পী। আমি বিশ্বাস করি, তারও নিউমোনিয়া হয়েছে। সে একজন বুড়ো ও দুর্বল মানুষ, অসুখটার আক্রমণ মারাত্মক। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একদম নেই; তবু সে আজ হাসপাতালে গেছে আরও আরেকটু আরাম পেতে।’

পরের দিন ডাক্তার সিউকে জানায়, ‘সে এখন বিপদমুক্ত। আপনি জিতে গেছেন। পুষ্টিকর খাবার আর যত্ন-আত্তি এখন শুধু এইটুকুই যথেষ্ট।’

সেই বিকেলে জনসি যে বিছানায় শুয়েছিল, সিউ সেখানে এল। জনসি এক হাতে একটি গাঢ় নীল এবং ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য উলের তৈরি ওড়না মনের আশ মিটিয়ে সেলাই করছিল এবং অন্য হাতে বালিশের চারপাশে বোলাচ্ছিল।

সিউ বলল ‘সাদা ইঁদুর আমার, তোমাকে কিছু বলার আছে। বেহরম্যান সাহেব আজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। সে মাত্র দুই দিন অসুস্থ ছিল। প্রথম দিন সকালে দারোয়ানেরা তাকে নিচতলায় তার কক্ষে অসহায়ভাবে ব্যথায় কাতরানো অবস্থায় পেয়েছিল। তার কাপড়চোপড় ও জুতো ছিল ভেজা এবং বরফশীতল। তারা কল্পনাও করতে পারেনি অমন ভয়ংকর রাতে সে কোথায় ছিল। এরপর তারা একটি বাতি দেখতে পেল, সেটা তখনো জ্বলছিল এবং আর একটি মই, যেটি এখান থেকে টেনে নেওয়া হয়েছিল, আর কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তুলি, ব্রাশ ও একটি প্যালেট ছিল- যার ওপর মেশানো হয়েছিল সবুজ এবং হলুদ রং। জানালার বাইরের দিকে দেয়ালের ওপর শেষ আইভি পাতাটার দিকে একটু তাকাও। বাতাস বয়ে গেলে এটি কেন দুলে ওঠে না কিংবা নড়াচড়া করে না? তুমি কি তা ভেবে কেন একটুও বিস্মিত হওনি? এটাই যে বেহরম্যানের সেই শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মÑ সেদিন রাতে শেষ পাতাটি পড়ে যাওয়ার পর সেখানে এটি এঁকেছে সে।’

[লেখক পরিচিত – ও. হেনরি, বিশ্ব সাহিত্যে একটি জনপ্রিয় নাম। ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলাইনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ^সাহিত্যেও অনেক লেখক আসল নাম গোপন রেখে ছদ্মনামে নিজেকে প্রকাশিত করেছেন। উইলিয়াম সিডনি পোর্টারও এর ব্যতিক্রম নন। ও. হেনরি হলো তার ছদ্মনাম। রসিকতা, বিশেষ ধরনের গল্পায়ন ও গল্পের শেষে চমক সৃষ্টির জন্য বিশ্বসাহিত্যে পরিচিত ও বিখ্যাত ও. হেনরি। তিনি আমেরিকান জীবনযাপন নিয়ে ছয় শতাধিক গল্প লিখেছেন। ১৯১০ সালের ৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে মারা যান ও. হেনরি। ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ (ঞযব এরভঃ ড়ভ ঃযব গধমর) তার অন্যতম সেরা একটি গল্প। তার অন্যান্য সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘রোডস টু ডেসটিনি’ ও ‘সিক্সেস অ্যান্ড সেভেনস’। তার গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার গল্প বিভিন্ন দেশে পাঠ্যক্রমে স্থান পেয়েছে। নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার পাঁচটি গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ও. হেনরিস ফুল হাউস’। এতে স্থান পেয়েছে ‘দ্য কপ অ্যান্ড দ্য অ্যান্থেম’ ‘দ্য ক্লারিওন কল’ ‘দ্য রানসাম অব রেড চিফ’ ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’ এবং ‘দ্য লাস্ট লিফ।’ ও. হেনরি ১৯১০ সালের ৫ জুন নিউইয়র্ক সিটিতে মৃত্যুবরণ করেন।পাঠকের উদ্দেশে বাসার তাসাউফের অনূদিত ও হেনরির বিখ্যাত গল্প ‘দ্য লাস্ট লিফ’ দেয়া হলো।] 


ফিচার ইমেজ: কে.জুগার ফটোগ্রাফি
ছবিসূত্র: সংগ্রহীত 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
এই সংখ্যায়গল্পশিল্প ও সাহিত্য

সমাজ বিবর্তনবাদের প্রবক্তাদের || রুমা মোদক

করেছে Rodoshee Magazine আগস্ট ১৪, ২০১৮

‘ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে যে লালন করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে
আপনি বলুন মার্ক্স, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয়
নতুন যন্ত্রের যারা মাসমাইনের কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিক গৃহিণী
প্রতিদিন জল তুলে ঘর মোছে খাবার বানায়
হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয়?’
(মল্লিকা সেনগুপ্ত)
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে আলোচিত কিশোরী বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা তার বাবা সায়েদ আলী নিজেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে ধর্ষক বাবুল মিয়াকে ফাঁসাতে নিজেই মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ময়না মিয়া। ঘটনার সঙ্গে আরও একজন পেশাদার ভাড়াটে খুনি জড়িত। শনিবার বিকেলে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার।
এই সংবাদে যখন আপনারা নড়েচড়ে বসছেন আমূল বিশ্বাস আর মূল্যবোধের বুকে কুঠারাঘাতের আঘাত সইতে না পেরে, তখন কাঞ্চন বিবি ঘরে ফিরে মাত্র ভাতের হাঁড়ি চাপিয়েছে চুলায়। ঘর বলতে যেমন বোঝায় নিত্যপ্রয়োজনের দু-চারটি আসবাব, একটু নিকানো মেঝে, বিনোদনের আবশ্যিক অনুষঙ্গ টিভি আর একই মায়ার চাদরে মোড়ানো কয়েকজন মানুষ। এর সবই আছে এখানে। আর যেটুকু থাকলে পরিপূর্ণ আনন্দে ঝলমল করত সংসার, নেই শুধু সেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। মেসে মেসে রান্না করে কাঞ্চন বিবি যা পায়, তাতেই টিকে আছে ঘরখানা কিংবা সংসারখানা। আপনারা যে নামেই বাইরে থেকে ডাকুন এই প্রক্রিয়াকে, অন্দরে সেই একই প্রয়োজন, টিকে থাকার প্রয়োজন, নিরাপদে বেঁচে থাকার আয়োজন। আদিম প্রবৃত্তি সামাজিক রূপ নিয়ে যা মহিমান্বিত হয়ে আছে আমাদের কাছে।
ঘর লাগোয়া আধখেঁচড়া বেড়ায় ঢাকা রান্নাঘর। এই বৈশাখে এবার প্রতিদিন ঝড়-তুফান। জান-প্রাণ উজাড় করে জ্বালানো আগুন টিমটিম করে তেলহীন কুপির মতো, না জ্বলা কাঠের টুকরোগুলো অবিরাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছেড়ে আচ্ছন্ন করে তোলে ঘরসহ চারপাশ। ঘরের ভেতর বসে টিভিতে শাকিব-অপুর নাচ দেখতে দেখতে সেই গ্যাসের আক্রমণে খুক খুক কাশে বাচ্চাগুলো।
বাচ্চা, বাচ্চাই তো। জননীর কাছে বুড়ো ধ্যাংড়াও বাচ্চা, কিন্তু এরা সেই আহ্লাদের বাচ্চা নয়। আহ্লাদ বড়লোকের ব্যাপার। ওই যাদের জীবনে ক্ষুৎপিপাসার প্রয়োজন বড়ই তুচ্ছ, বরং নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি কিংবা নিত্যনতুন দেশ ভ্রমণ যাদের জীবনের প্রয়োজন প্রতিদিন বিলাস-ব্যসনে বদলায় তাদের জন্য। কাঞ্চন বিবির মতো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের নয়। একটুখানি আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে এই বয়সের হিসাবের কত হিসাব-নিকাশ! একটারও বয়স আঠারো পার হয়নি। অথচ এখন মাথার ওপর যে সবচেয়ে বড়টার দ্রুত আঠারো না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। কেন? সে উত্তরে পরে আসি।
কাঞ্চন বিবি নানা কসরত করেও ভেজা কাঠের সঙ্গে পেরে ওঠে না। ওদিকে বাজার থেকে কিনে আনা ট্যাংরা মাছগুলো পলিথিনের ভেতর ফুলে উঠছে। বাকি তিনটার সঙ্গে ধিঙ্গি আছমাকেও হাঁ করে শাকিব-অপুর নাচ গিলতে দেখে মাথা চড়ে যায় কাঞ্চন বিবির, ওই জমিদারের বেডি, বইয়া একটুত্তা মাছলাইনও কাটতে পারছ নানি? আমি একলা বেডি কতখানদি দৌড়াইতাম? তরারে কিতা আল্লায় একটুত্তাও আকল-পছন্দ দিছে নানি বে! কথা থামার আগেই পড়িমরি আছমা বঁটি নিয়ে মাছ কাটতে বসে যায় সুবিধাজনক জায়গায়। যেন সিনেমা দেখায় বিঘ্ন না ঘটে। মায়ের মারকে বড় ভয় তার। রাগ চড়লে হাতের কাছে যা পায় তাই পিঠে ভাঙে। ভাঙে আর বলে, এই হাতের জোরেই ধইরা রাখছি হাইব্বা গোষ্ঠীরে। কাঞ্চন বিবি রেগে গেলে বাকি ঘর ঠান্ডা। কারও আর কিচ্ছু বলার সাহস জোগায় না। হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলতে ডলতে মাছ কুটে আর সিনেমা দেখে আছমা।
চুলায় চুঙ্গা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে, আগুনটাকে জিইয়ে রাখে কাঞ্চন বিবি, এই অল্প আঁচেই যতক্ষণে ভাত নামে। রশিদ মিয়া চিৎকার করে, ওই হারামজাদার গোষ্ঠী একটুত্তা কাইত কইরা দেসনে! পোক পোলাপানগুলা যেন বধির, নির্বিকার নয় ঠিক সিনেমার আবেগের সঙ্গে একাত্ম দৃষ্টিও ফেরায় না। রশিদ মিয়া পুনঃ হাঁকে ওই হারামজাদার গোষ্ঠী! হাটকাল হইছস নি? এই ডাকেও বিন্দুমাত্র কাঁপন জাগে না বাচ্চাদের মগ্নতার পানাডোবায়। কাঞ্চন বিবি চুলার পাশ থেকে নিজেই উঠে এসে রশিদ মিয়াকে কাত করে শুইয়ে দেয়। পিঠের ঘা থেকে চাটাইয়ে লেগে থাকা কয়েকটা পোকা কিলবিল করে হেঁটে চলে যেতে থাকে দিগ্্বিদিক। কাঞ্চন বিবি, হুস হুস করে ভাগায় পোকাগুলা। রশিদ মিয়ার যন্ত্রণার গোঙানি অপু-শাকিবের কান্নার প্যানপ্যানানি অতিক্রম করে এক প্রাগৈতিহাসিক মাতম তোলে ঘরময়। ঘায়ের পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরময়, কাঁচা মাছের গন্ধের সঙ্গে সে গন্ধ মিশে এক বিবমিষাময় অস্বস্তি চেপে ধরে পুরো পরিবেশকে। কিন্তু এদের কাছে এই নরকযন্ত্রণা প্রাত্যহিক। কারও নৈমিত্তিক কোনো কাজে বিঘœ ঘটে না।
কাঞ্চন বিবি আচ্ছন্ন ধোঁয়া ঠেলে চুলার কাছে গিয়ে একটা চ্যালাকাঠ হাতে নেয়, আর এবার প্রবল জোয়ার জাগে স্থির মগ্নতায়। টিভির সুইচ বন্ধ করে তিনটা দৌড়ায় তিন দিকে যে দিকে খালি রাস্তা দেখা যায়, দৌড়ে অনেক দূর যাবার বিঘœহীন। চ্যালাকাঠ নিয়ে দরজার সামনে গালির বন্যা ছোটায় কাঞ্চন বিবি, হারামজাদার গোষ্ঠী, হাভাইত্যার গোষ্ঠী, শয়তানের গোষ্ঠী খালি টাইলের টাইল খাওন গিলন ছাড়া বাদাইম্যার গোষ্ঠীর আরাদিন আর কোনো কাম নাই। এ গালি তো কেবল গালি নয়, জীবনযাপনের যাবতীয় আক্ষেপ, সংগ্রাম আর ক্লান্তির অনিবার্য অবিশ্রান্ত বর্ষণ। কত আর লড়াই শেষে কেবল পরাজয় নিয়ে নিয়ে ক্লান্ত সৈনিক হয়ে ফিরে ফিরে আসা। একটিবারও যদি জেতা যেত জীবনের যুদ্ধে। ভেতরের তীব্র উত্তাপ তবু একটু শীতল হবার ফাঁকফোকর খুঁজে নিত।
এবার জুয়া খেলতে নেমেছে কাঞ্চন বিবি। ঘরে ফিরে মাছ কাটারত আছমার দিকে তাকায় কাঞ্চন বিবি। গায়ে-গতরে আঠারো কেন বিশ-বাইশ বললেও কেউ অবিশ্বাস করবে না মাশাল্লা। ওকে নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনামতো জুয়ার ঘুঁটির চাল আগাচ্ছে কাঞ্চন বিবি, সফল হতে হবে। এটাও বড়টার মতো বিগড়ে না গেলে হয়। কী নিপুণ হিসাবের যোগফল মিলে গিয়েছিল বড়টার বেলায়। ভাত চাওয়ার আগেই পোলাও হাজির! নিজের কপালরে নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন।
বাইরে বাহারউদ্দিনের গলা শোনা যায়, আম্মা ঘরে আছুইন? মাথার ঘোমটা টেনে দৌড়ে বাইরে আসে কাঞ্চন বিবি, আও বাজান আও, ঘরের ভিত্রে আও। বাহারউদ্দিন কখনো খালি হাতে আসে না। পোলাপানের পছন্দমতো চিপস, চকলেট, নিমকি, চানাচুর, বিস্কুট হরেক রকম বাজার-সওদা নিয়ে আসে। বাহারউদ্দিন ঘরে ঢুকলে, চেয়ার ঝেড়েমুছে বসতে দিয়ে ঘরের গুমোট গন্ধ দূর করার জন্য আগরবাতি জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু বাহারউদ্দিনের গন্ধ যেন আগরবাতির চেয়ে আরও দ্রুত বাতাসে ছড়ায়, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া পোলাপানগুলা নিমিষে ঘরে জুটে যায় বাহারউদ্দিনের আশপাশে। কাঞ্চনবিবি যতই চোখ রাঙায়, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। চিপস আর চানাচুরের প্যাকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করে তারা সব নির্লজ্জতা অস্বীকার করে।
কাঞ্চন বিবি অনুসরণ করে বাহারউদ্দিনের দৃষ্টি। ঠিকই আছমার দিকে ফিরে ফিরে উষ্টা খায়। যতই লুকানোর চেষ্টা করুক সে কাঞ্চন বিবির পাক্কা নজর, বুঝতে কষ্ট হয় না। আছমাকে দ্রুত মাছ রেখে ওঠার তাড়া দেয় সে। উঁচু তাক থেকে নামিয়ে সাবান হাতে দেয়, জলদি কইরা ধুইয়া আয়। আছমার দৃষ্টিতে চলনে কোনো বাড়তি তাড়া না দেখে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয় কাঞ্চন বিবি। ইচ্ছে করে মেয়ের ঘাড়ে ধড়েপিঠে কয়েক ঘা বসায়, কিন্তু না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাহারউদ্দিনের সামনে তো আর নিজের চ-াল মেজাজ দেখানো যাবে না। মেয়ে হাত ধুয়ে ফিরে এলে তারে দিয়ে চা আর বাহারউদ্দিনের আনা বিস্কুট সাজিয়ে পাঠায় কাঞ্চন বিবি। চায়ের কাপ নিতে নিতে বাহারউদ্দিন যে আছমার হাতটায় একটু চেপে ধরে তাও দৃষ্টি এড়ায় না তার। এই দৃশ্যটি দেখারই আকুল আকাক্সক্ষা ছিল ভেতরে। একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস দীর্ঘ অথচ শব্দহীন বেরিয়ে এসে মিশে যায় গুমোট ঘরের অস্থির ভবিষ্যৎ আর ক্লান্ত অতীতে। কাঞ্চনবিবি ভাবে কোনো ভুলে না আবার জুয়ার গুঁটি চালে ভুল হয়ে যায়।

প্রসঙ্গটা নিজেই ওঠায় বাহারউদ্দিন। আম্মা, উকিল কইছে কোনো ফ্যাক্টর না। চরিত্রহীন কইয়া একখান নালিশ সাজাইলে ওই মামলা খালাস। কী কন আপনে? কাঞ্চন বিবি আর কী বলে! এই বাহারউদ্দিনের কী তার মেয়েরে বিয়ে করার কথা। শহরে যার বাপের তো বটেই, বাপের একমাত্র পোলা হিসেবে নিজেরও নামডাক আছে। নিজের বাড়িঘর, ব্যবসা সবই আছে। যে কোনো কন্যাপক্ষ যেচে কন্যা দিয়ে কৃতার্থ হবে এর কাছে। আর সেই বাহারউদ্দিনের কিনা চোখে লাগল তার বড় মেয়ে সালমারে! মেসে মেসে ভাত রাঁধা পেশা তার, বিনিময়ে ছয় ছয়টা পেট আর ঘরভাড়া চলে। পোলাপানগুলোর বাপ অ্যাক্সিডেন্টে লুলা হয়ে আজ বছর কয় ধরে উপার্জনহীন বিছানায়। ওষুধহীন, পথ্যহীন, যত্নহীন আদিম বেঁচে থাকা শুধু। শুয়ে থাকতে থাকতে সারা পিঠে ঘা, সেখানে কিলবিল কিলবিল পোকা। উটকো গন্ধে কাছে ভেড়া যায় না। উপার্জন যখন করত, নিজের মদগাঞ্জা, মাইয়া মানুষ নিয়ে ফুর্তির পেছনেই ওড়াত সিংহভাগ। সংসারের দায় সব সময় ষোলো আনাই কাঞ্চনবিবির ঘাড়ে।
কাঞ্চনবিবির দিন তাই দয়ামায়াহীন যুদ্ধক্লান্ত। সে মনে মনে চায় ব্যাটা এইবার মরে মুক্তি দিক। সেও মুক্তি পাক, কাঞ্চনবিবিও মুক্তি পাক, পরিবারটাও মুক্তি পাক। কিন্তু তার মুক্তির হিসাবে তো আর আল্লার দুনিয়ার হিসাব মেলে না। ঠিক তিনবেলা পেট ঠেসে ভাত খায়। কোত্থেকে জোগান হয় সে ভাবনা নেই, দুমুঠো কম হলে কাঞ্চনবিবির বাপদাদা চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে গালাগাল করে। তারপর পায়খানা করে চাটাই কাঁথা সব চটচট! ব্যাটার খাবারের জোগান দিতে গিয়ে কত যে না খেয়ে থাকতে হয় কাঞ্চনবিবির নিজের। তার ওপর নিত্য এসব পরিষ্কার করার ঝক্কি!
সেই পরিবারে ফেরেশতার মতো আবির্ভাব ঘটেছিল বাহারউদ্দিনের। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সালমাকে নজরে লাগলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল সে। না চাইতে আসমানের চাঁদ হাতে পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি সে। ঘটনা ঘটিয়ে দিতেও সময় নেয়নি। নিজের পেটের মেয়ে হলে হবে কী, এর মতিগতির ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা ছিল না কাঞ্চনবিবির। তাই সপ্তাহ সময়ও নেয়নি কবুল পড়িয়ে দিতে। বাহারউদ্দিনের ইচ্ছে ছিল সোনাদানা দিয়ে, ময়মুরব্বি পাড়া-পড়শি দাওয়াত দিয়ে বউ ঘরে নেবে সে। কিন্তু কাঞ্চনবিবিই ঝুঁকি নিল না, আগে কবুল পইড়া কাবিন কইরা লও। বউ ঘরে তুইলা নে ফুরসত কইরা। বাহারউদ্দিন আপত্তি করেনি।
তারপর মাস ছয়েক, আহা যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ কয়টা দিন। চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ঘরভাড়া কিছুর জন্যই ভাবতে হয়নি কাঞ্চনবিবির। চাইবার আগেই নিয়ে হাজির হতো বাহারউদ্দিন। ঘরের ভেতর বেড়া দিয়ে আরেকটা আলগা কোঠাঘর তৈরি করিয়ে নিয়েছিল কাঞ্চনবিবি সালমা আর বাহারউদ্দিনের জন্য। বাহারউদ্দিন যেদিন রাতে থাকত, মায়ের খোলস ছিঁড়ে খানিক নির্লজ্জের মতো রংঢং শিখিয়ে দিত মেয়েরে, দ্যাহস না সিনেমায়। মেয়ে মাথা নিচু করে সব মেনে নিলেও আশঙ্কা ঘুচত না কাঞ্চনবিবির। মেয়েটা যেন কেমন কাঠখোট্টা তার। রং ঢং কম জানে। আরে বাবা বয়সেরও তো একটা জোয়ার থাকে গতরে, সেইটাই কামে লাগা!
মেয়ে কামে লাগাত কী লাগাত না বেড়ার পাশে কান খাড়া করে রেখেও ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারেনি কাঞ্চনবিবি। তবে বাহারউদ্দিনের আসার ক্লান্তি ছিল না। দুদিন একদিন পরপরই আসত। আর আহারে! এই ছয় মাসে নিজের জীবনের যুদ্ধ ঘোচাতে কত নীলনকশাই না সে এঁকেছে মনে মনে। মেয়ের প্রতি জামাইয়ের এই অপ্রতিরোধ্য টান কাজে লাগিয়ে গুছিয়ে ফেলতে হবে আখের। বাকি চারটার গতি করে ফেলতে হবে। ধীরে ধীরে সে প্রক্রিয়ার কথাবার্তাও শুরু করেছিল কাঞ্চনবিবি। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বড় ছেলেটারে নিজের দোকানে কর্মচারী হিসেবেও নিয়ে গিয়েছিল বাহারউদ্দিন।

আর এই সময়ে সালমা কিনা সব পরিকল্পনার কাঁচামাটির দেয়াল ধাক্কা দিয়ে ভেঙে পালিয়ে গেল স্কুলের সামনে বসা চানাচুরওয়ালার সঙ্গে! খালি আকাশ না পুরো সৌরজগৎটাই চোখের সামনে আছড়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ অন্ধ করে দিয়েছিল কাঞ্চনবিবিকে। সামনে-পেছনে ডাইনে-বাঁয়ে কোনো দিকেই আর পথ খুঁজে পাচ্ছিল না সে। পরামর্শ করবে এমন সুহৃদও কেউ নেই তার। নিজের বুদ্ধিতে ভরসা করেই খুঁজে পেতে ঠিকানা বের করে গিয়েছিল মেয়েরে ফিরিয়ে আনতে। বাহারউদ্দিন বলেছিল লোক জানাজানির আগে ফিরে এলে সে ঠিক ঘরে তুলবে। কিন্তু মেয়ে ফিরবে কী উল্টা প্রথম মায়ের চোখের ওপর চোখ রাঙিয়ে জবাব দিয়েছিল, বেটি আমার সুখের লাইগ্যা বিয়া দিছস? দিছস ত নিজের হিসাবে। আমার হাউস আহ্লাদ নাই?
কাঞ্চনবিবি চুপসে যায়, নিজের পেটের মেয়েরে অচেনা লাগে তার, যার লাগি করি চুরি হে কয় চোর! পেটের মেয়েটা চোখের সামনে বড় হতে হতে কবে এভাবে ভাবতে শিখল! বিষণ্ণ, নিরানন্দ হতাশ ভবিষ্যৎহীন জীবনে ফিরতে ফিরতে কাঞ্চনবিবির সেদিন সাধ হয়েছিল রেলগাড়ির নিচে ঝাঁপ দেয়!
সেদিনই আবার এসেছিল বাহারউদ্দিন। খবর জানতে। কিছুই আশার খবর জানাতে না পেরে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল সে। নিত্য যার বেদনার সঙ্গে বসবাস, তার চোখে অভিমানী অশ্রুরা বেশি দিন বাস করে না। কিন্তু সেদিন কোথা থেকে এত কান্না এসেছিল তার বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। সেই কান্নায় আর্দ্র হয়ে হোক কিংবা অজানা কোনো অন্তর্নিহিত কারণে বাহারউদ্দিন সেদিন কাঞ্চনবিবির মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়েছিল, কাইন্দেন না আম্মা, একবার আম্মা কইয়া ডাকছি, জি আপনেরে ছাড়তে পারে, পুত আপনেরে ছাইড়া যাইতাম না। কী কয় পোলায়? কাঞ্চনবিবির স্বপ্ন আর আশা যত দূর পাখা মেলতে পারে, এ যে তার চেয়েও বেশি! বাহারউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে যায় সে।
তাইলে আম্মা কথা ইডাওঈ থাকল। সামনের হপ্তার মইধ্যে তালাকের কাগজপত্র ক্লিয়ার কইরা, পরের হপ্তায় কাজিরে খবর করি। কথা পরিষ্কার করে বাহারউদ্দিন। কাঞ্চনবিবির আপত্তির কোনোই কারণ নেই। যত তাড়াতাড়ি কাজটা সম্পন্ন হয় ততই তার দুশ্চিন্তার ভার হালকা হয়।
বাহারউদ্দিন বেরিয়ে গেলে নরম মাতৃমূর্তি ঝেড়ে ফেলে স্বমূর্তিতে ফেরে কাঞ্চনবিবি। ভেতরে স্বস্তির সমাহিত আনন্দ। মানে মানে কাজটুকু হয়ে গেলেই বুঝি জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় প্রাণ পাবে সেই আপাত স্বস্তি। এবার আর ভুল করবে না কাঞ্চনবিবি। একবারে ঘরে তুলে দেবে মেয়েকে। নিজের ঘাড়ে রেখে আর মাশুল গোনার বোকামি নয়। পোলাপানরে ডাকেন, আইন ইবলিশের গোষ্ঠী। খাইয়া ক্ষেমা দেন একবার। কিন্তু কারও খাওয়ার তেমন তাড়া নেই। বাহারউদ্দিনের আনা চিপস-চানাচুর খেয়ে সবার ভাতের ক্ষুধা মরে গেছে। তারা উঠানে ডাংগুলি খেলে। কেবল রশিদ মিয়া হাবলে তাবলে বারবার বলতে থাকেÑ আমারে খাওন দে…আমারে খাওন দে…। কাঞ্চনবিবি বিড়বিড় করে, আল্লারে আল্লাহ, কত্ত ভালা বান্দারে যহন তহন উডাইয়া নেয়, এই পাপীরে চোক্ষে দেহে না! রশিদ মিয়া কিছু শোনে কি শোনে না, জানতে চায়Ñ আমারে কিছু কছ? কাঞ্চনবিবি ঝাঁঝে উত্তর দেয়, না আফনেরে কী কমু, কই আমার কপাল রে। ফাডা কপাল আমার।
ঠিক তখন বাইরে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে মাইজ্যা পোলা আম্মাগো দেইখ্যা যান। তার গলার স্বরে এমন এক ভয়াবহ আর্তনাদ ছিল, কাঞ্চনবিবির অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে ওঠে। না দেখেই সে বুঝতে পারে এমন কিছু ঘটেছে যা কেবল অনাকাক্সিক্ষতই নয়, তার জন্য ভয়াবহ। দৌড়ে বাইরে আসে সে। যা দেখে তার জন্য মোটেই প্রস্তুতি ছিল না কাঞ্চনবিবি। মাইজ্যা পোলার ডাক আর ঘর থেকে দৌড়ে বের হওয়া এই সেকেন্ড কয়ের মধ্যে কত অমঙ্গল আশঙ্কা করেছে সে, হাত-পা ভাঙা, পালা মোরগ-মুরগির মৃত্যু, এমনকি সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা দ্বিতীয় কইন্যা আছমার কারও সঙ্গে ভেগে যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু চোখের সামনে যা সে দেখছে এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। মোটেও না।
বড় কইন্যা সালমা ফিরে এসেছে। কোঁচড়ে একটা পুটুলি, চোখ দুটি গর্তের ভেতরে, উষ্কখুষ্ক চুল, ভালো করে লক্ষ করলে বাহু কিংবা গালে কালশিটে দাগও দেখা যায়। কাঞ্চনবিবিকে দেখেই আহাজারিতে ফেটে পড়ে সালমা, আম্মাগো বড় ভুল করছি গো আম্মা। আমারে মাফ কইরা দেইন গো আম্মা। অপত্য ছাপিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার আদিম প্রবৃত্তি তীব্র হয়ে ওঠে তখন কাঞ্চনবিবির। ধীরে ধীরে হঠাৎ ছুটে যাওয়া বিছানো জালের রশি গুটিয়ে এনেছেন তিনি। এখন এই মানবিক অপত্য প্রশ্রয় দিলে উল্টেপাল্টে যাবে সব হিসাব-নিকাশ। ভূত-ভবিষ্যৎ। না এ হতে দেওয়া যায় না। ব্যথায় কুঁকড়ে থাকা মেয়েটাকে তিনি চুল ধরে টানতে টানতে বাড়ির সীমানা ডিঙিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসেন। শিয়াল, কুত্তায় ছিঁড়ে খাক তোরে। আমার হিসাবে আর গন্ডগোল লাগাইতে দিমু না কাউরে। আর পারি না। আর পারি না। সেই পনেরো বছর বয়স থিক্কা ঘানি টানতে টানতে সংসারে এক কুড়ি বছর পার করছি। আর পারি না…। নিজেও আহাজারি করতে করতে বাকি পোলাপান নিয়ে ঘরে ঢুকে খিল লাগিয়ে দেয় কাঞ্চনবিবি।

রোদসী/আরএস

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
নতুন লেখা
আগের লেখা

পোর্টফোলিও

প্রকাশিত সংখ্যা

রোদসীর পছন্দ

  • ঘরেই বানিয়ে নাও মেকআপ সেটিং স্প্রে

তুমিই রোদসী

  • আলোয় ভুবন ভরা







rodoshee logo

© স্বত্ব রোদসী ২০১৪ - ২০২১
সম্পাদক ও প্রকাশক:   সাবিনা ইয়াসমীন
৯১/এ, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা, ব্লক-এফ, রোড-৩, চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮০-২-৫৫০৪১০৪৬-৪৮, ই-মেইল: info@rodoshee.com

রোদসী

রোদসী

ক্যাটাগরি

আর্কাইভ

@2014-2018 -রোদসী. All Right Reserved.

রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
Facebook