সিক্ত হাওয়া দখিনের বারান্দায়। জানালার কোল ঘেঁষে শীতের লুকোচুরি। রোদের জন্য অপেক্ষা! অনেকে রোদকে তোয়াক্কা না করেই আগুন পোহাচ্ছে। আর ওদিকের চুলায় পড়েছে পিঠা তৈরির ধুম। জামাই আসবে! হবে জামাই-বরণ! অনেক অঞ্চলের প্রাণের উৎসব জামাই-বরণ। শীতের সময় আঞ্চলিক মজার মজার পিঠা দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। দুপক্ষের মধুর অপেক্ষা এই উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে-
আগে থেকেই গ্রামীণ মানুষের কাছে পিঠা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পিঠার এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রাম ও শহরের সবখানে এখন ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ অন্য ঋতুর চেয়ে শীত ঋতু এলেই যেন খুব বেশি পিঠা উৎসবের আয়োজন করে। যুগ যুগ ধরে পিঠা উৎসব হয়ে আসছে।
হেমন্ত আসতে না আসতেই বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন। চলে পিঠা বানানোর প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে গ্রামেগঞ্জে তৈরিও হচ্ছে নানান স্বাদের পিঠা। শীতকালের আমেজে খেজুর গুড় আর রস ছাড়া তো পিঠা তৈরির পূর্ণতা কখনোই উৎকৃষ্ট হয় না। খেজুরের রস দিয়ে ভাপা পিঠা, পুলি, দুধ চিতই, পায়েস যা-ই হোক না কেন শীত ঋতু আর খেজুর গাছ ছাড়া অসম্ভব। শীত ঋতুতে গ্রামে-গঞ্জে খেজুর রস আর শীতের হরেক রকম পিঠা নিয়েই তো হয় উৎসবের আমেজ। বাড়িতে তাদেরই নিজ আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো ও জামাই মেয়েদের বাড়িতে নিয়ে এসে নতুন কাপড়চোপড় উপহার দেওয়ার যেন হাজার বছরের রীতি। উনুনের পাশে বসে গরম গরম ধোঁয়া বা ভাপ ওঠা ভাপা পিঠা খেজুর গুড় বা গাঢ় খেজুর রসে চুবিয়ে খাওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ হয় না শীত ঋতু ছাড়া। শুভ সকালে সারারাত্রির বাসি, ঠান্ডা ভাপা পিঠা খেজুর রসে চুবিয়ে খেতে মন্দ লাগে না।
এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামকরণে চিহ্নিত পিঠা বা আলাদা গঠনে নকশাকৃতির পিঠা লক্ষণীয়। গ্রামীণ জনপদের মানুষ অগ্রহায়ণ মাসে সাধারণত নতুন ধান ওঠার পরপরই যেন পিঠা তৈরির আয়োজন শুরু করে। শীত ঋতুতে হরেক রকম পিঠার বাহারি উপস্থাপন এবং আধিক্য হয় বলেই কিশোর-কিশোরীরা মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ততা দেখায়। মামার বাড়ি মধুর হাঁড়ি- এই কথাটি যে যুগে যুগে হয়তো সত্যিই রয়ে যাবে। গ্রামবাংলার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী পিঠার অনেক নাম গ্রামের মানুষের দ্বারে এসে হানা দেয় আজও। বিভিন্ন পিঠা উৎসবের প্রস্তুতি গ্রামাঞ্চলের ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি ঘরে ঘরেই শুরু হতে দেখা যায়। নানার বাড়িতে কিশোর-কিশোরীরা শীতকালীন ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাবে বলে তাদের যেন দুচোখে ঘুম আসে না। মেয়েজামাই তাদের সন্তানদের সঙ্গেই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছাটাও পোষণ করে। সে সময় হয় এক নতুন উৎসব।
খেজুরগুড়ের পিঠার জন্য বিখ্যাত যশোর। শীতে প্রতি ঘরে ঘরে ভুর ভুর করে খেজুর গুড়ের ঘ্রাণ। চলতে থাকে জামাই আমন্ত্রণের তোড়জোড়। সাইকেল কিংবা মোটরবাইক নিয়ে ছুটে যান নতুন-পুরোনো জামাইয়ের দাওয়াত দিতে। জামাই আসার আগের দিন থেকে শুরু হয় নানান রকম পিঠা বানানো। তবে জামাইয়েরও কিন্তু খরচ আছে! বড় মাছ, নানান রকম মিষ্টান্ন নিয়ে জামাই চলে আসে। শুরু হয় জামাই-বরণ।
মৌলভীবাজার ও সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্য পিঠে-পুলির অন্যতম চুঙ্গাপুড়া পিঠা। শীতের রাতে খড়কুটো জ্বালিয়ে সারারাত চুঙ্গাপুড়ার দৃশ্য দেখা না গেলেও জামাই এলে কিন্তু এখনো এই পিঠা তৈরি হয়। বাজারে মাছের মেলা বসে। সেই মেলা থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদীর হতে বড় বড় রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর মাছ ধরে নিয়ে এসে হালকা মসলা দিয়ে ভেজে দিয়ে চুঙ্গাপুড়া পিঠা খাওয়া একটি অন্যতম ঐতিহ্য। বাড়িতে জামাইকে শেষ পাতে চুঙ্গাপুড়া পিঠা মাছ বিরান আর নারকেলের পিঠা পরিবেশন না করলে যেন লজ্জায় মাথা কাটা যায়। জানা যায়, মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথরিয়া পাহাড়, জুড়ীর লাঠিটিলা, রাজনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার টিলায় টিলায় ও চা-বাগানের টিলায়, কুলাউড়ার গাজীপুরের পাহাড় ও জুড়ী উপজেলার চুঙ্গাবাড়ীতে এবং কমলগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেত। তম্নধ্যে চুঙ্গাবাড়ীও একসময় প্রসিদ্ধ ছিল ঢলুবাঁশের জন্য। পাহাড়ে বাঁশ নেই বলে বাজারে এই ঢলুবাঁশের দামও এখন তাই বেশ চড়া। ঢলুবাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না কারণ ঢলুবাঁশে একধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা আগুনে বাঁশের চুঙ্গাকে না পোড়াতে সাহায্য করে। ঢলুবাঁশে অত্যধিক রস থাকায় আগুনে না পুড়ে ভেতরের পিঠা আগুনের তাপে সেদ্ধ হয়। ঢলুবাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারকেল ও চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে হয় জামাই-বরণ ও মাছের মেলা। মেলার নাম কুড়িগাই, এ মেলার পেছনে রয়েছে ৮০০ বছরের ইতিহাস। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতিবছর পালন করা হয় মেলা। এ মেলা মাছে নতুন মেয়ের জামাইকে বরণ করে নেওয়া হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের ৫০টি গ্রামে উৎসবের আমের বিরাজ করে। আর পিঠা খাওয়া তো অবিচ্ছেদ্য। মেলায় মিষ্টি, খেলনা, মিঠাই-মন্ডা, ফিরনি-বাতাসা, বিন্নি খই ছাড়াও সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলাসহ আরও অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।
রোদসী/আরএস