রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
ট্যাগ:

সাহিত্য

গল্পশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

চায়না জার – ইশরাত জাহান ঊর্মি

করেছে Wazedur Rahman এপ্রিল ১, ২০২০

ইশতিয়াকের কথা

শোনো তৃষা, আমার খুব জানার ইচ্ছা তোমার কিসের এত অহংকার? অথবা এত এত অবহেলা তুমি আমাকে করার সাহস কী করে পাও? অথবা তুমি খুব দুঃখী? কেন? তোমাকে কী দিইনি আমি? আমার থেকে কী দুঃখ তুমি পেয়েছ বলো? আমি প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে এই কথাগুলোই ভাবি। ফ্রি থাকলেই ভাবি। ভাবি আর আহত হই। আমার আহত মুখ, আহত ভেতরটা তোমাকে কখনো পোড়ায় না। আমি অবশ্য সব সময় আহত মুখ দেখিয়ে বেড়াই না। বউয়ের আঁচল ধরা পাওনি আমাকে। বউয়ের আঁচল ধরে থাকা কি পুরুষের জন্য খুব সম্মানের? আমি তো তোমার কোনো অভাব রাখিনি!

তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আমার। আমাদের পরিবারের সবার। তুমি অনিন্দ্যসুন্দরী। পড়ালেখায় ভালো, সভ্য। আমার বাবা-মা, ভাইবোন, চাচা, ফুফু-খালা সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করল। তুমিও সবাইকে খুব ভালোবাসলে। সবাইকে আপন করে নিলে। আমাকেও তোমাদের বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে। এখনো তোমাদের বাড়িতে মানে আমার শ্বশুরবাড়িতে আমাকে সবাই যতটা সম্মান কওে, তা এমনি এমনি আসেনি। তা আমি অর্জন করেছি। তোমার বাবা-মাকে আমি ঠিক ততটাই সম্মান-শ্রদ্ধা করি, যেমনটা ওরা আমাকে ভালোবাসে। কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু দিন গেল আর তুমি আমার থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে। আমি অনেক ভেবেও এর কোনো কারণ খুঁজে পাই না। ছোটখাটো সমস্যা স্বামী-স্ত্রীতে হয়। পৃথিবীর সব স্বামী-স্ত্রীতেই হয়। কাদের মধ্যে হয় না? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী কি সুখী ছিলেন? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম আমি জানি না কিন্তু সেই ভদ্রমহিলা কি স্বীকার করতেন যে রবিঠাকুর খুব রোমান্টিক ছিলেন? জগৎজোড়া রোমান্টিসিজমের জন্য বিখ্যাত কবি তো শুনেছি তার বৌদির সঙ্গে পরকীয়া করতেন! বেশি রোমান্টিক পুরুষেরা এমনই হয়। আমি জানি আমার প্রতি তোমার অভিযোগ আছে যে আমি রোমান্টিক নই। আমি সত্যি, অত সব ইয়ে জানি না। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি তৃষা। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকেই ভালোবাসি না।

হ্যাঁ, আমার একটু রাগ বেশি। রেগে গিয়ে হয়তো অনেক সময় উল্টোপাল্টা বলি। কিন্তু সেটা কি আমার মনের কথা? বলে কি আমি নিজে শান্তি পাই? তোমার সঙ্গে ঝগড়া হলেই কি আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজের ওপর প্রতিশোধ নিই না? আমার একটা সমস্যা আছে, আমি সহজে সরি বলতে পারি না। সে তো আমি আমার মাকেও বলি না। মাকে কি আমি কম কড়া কথা বলি? কই মা তো তোমার মতো রাগ করে, অহংকার দেখিয়ে দূরে থাকে না। তাহলে তুমি কেন পারো না? মা যদি পাওে, তুমি কেন পারো না তৃষা? আমি তোমার সঙ্গে কী করেছি বলো তো? কোনো দিন তোমার গায়ে হাত তুলেছি? আমি কেন, আমার চৌদ্দগুষ্টিতে কেউ বউ পেটায়নি।

তোমাকে কোনো দিন রাগ করে বলেছি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও? কত শিক্ষিত লোকই তো শুনি বউকে খানকি বেশ্যা বলে গালি দেয়, আমি কোনো দিন এসব বলেছি তোমাকে? যখনই রাগারাগি করে দু-একটা গালি দিয়েছি, রাগ পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সরি না বললেও তোমার মন রাখতে নানান চেষ্টা করেছি। তুমি শাড়ি খুব পছন্দ করো, আমি রাগ ভাঙলেই টুক করে শাড়ি কিনে তোমাকে দিয়েছি। তুমি কোনো দিন হাসিমুখে সে উপহার গ্রহণ করোনি তৃষা। কিন্তু আমি তো চেষ্টা করেছি। তোমার কোনো অভাব-অভিযোগ রাখিনি। তোমাকে এত বড় বাড়িটা দিয়েছি। মা-বাবা খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছিল, তবু একটা ফ্ল্যাট আমি তোমার নামে করেছি, বলেছি ফ্ল্যাটের ভাড়া তুমিই তুলবে, তোমার মতো করে খরচ করবে।

তুমি হিসাবে খুব কাঁচা, তাই মাঝেমধ্যে হিসাবটা চেয়েছি। সে তো তোমার ভালোর জন্যই। আমার যা কিছু সম্পদ তা তো তুমিই ভোগ করবে। তাই তোমার বেহিসাবি স্বভাব মাঝেমধ্যে আমাকে চিন্তায় ফেললে আমি হিসাব চেয়েছি, এর বেশি কিছু না। একটা লাল রঙের গাড়ি আমি তোমার জন্য দিয়ে রখেছি। সর্বক্ষণ। মাকেও গাড়ি নিতে হলে আমার অনুমতি নিতে হয়, তোমার জন্য একজন ড্রাইভার বরাদ্দ রেখেছি। তৃষা, আমি একজন সুস্থ-সবল পুরুষ। আর কোনো নারীর প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু ঠিক কত দিন তোমার-আমার মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই, সেটা কি তোমার মনে আছে? হ্যাঁ, আমি সেক্স লাইফের কথাই বলছি। তুমি আমার সঙ্গে শোও না।

আমি অন্য পুরুষদের মতো জানোয়ার নই যে তোমার ওপর জোর খাটাব, জোর করে স্ত্রী ধর্ষণ করব। কিন্তু কেন তুমি এত শীতল তৃষা? আমি কি তোমাকে তৃপ্ত করতে পারি না? আমি মনোচিকিৎসকের সঙ্গে গোপনে কথা বলেছি তোমার এই শীতলতা নিয়ে। ডাক্তার বললেন, তুমি আর কারও সঙ্গে এনগেজ কি না খোঁজ নিতে। খোঁজ নিয়েছি। তেমন কিছু পাইনি। তবে ঠিক কি হয়েছে তৃষা তুমি আমাকে বলবে? বিয়ের ছয় বছর কেটে গেল, বাড়ির সবাই এত চাপ দিচ্ছে বাচ্চা নেওয়ার জন্য অথচ তুমি বাচ্চা নেবে না। আমি কী করেছি তুমি আমাকে বলবে প্লিজ? তৃষা, আমার কোমল হৃদয় ভেঙো না। ডোন্ট ব্রেক মাই চায়না জার তৃষা। ডোন্ট ব্রেক।

তৃষার কথা

ইশতিয়াক, বিয়ের দ্বিতীয় কি তৃতীয় দিন আমার ঠিক মনে নেই। তখনো রিসেপশনের অনুষ্ঠান হয়নি। রিসেপশনের পরদিন আমরা নেপাল যাব। হানিমুনে। আমি কী খুশি! নতুন পেয়েছি না হলেও শখানেক শাড়ি। শাড়ি-গয়না পরে নতুন বউ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের বাড়ি থেকে আমার মা একটা দশ-বারো বছরের মেয়েকে দিয়েছিল আমার ফাই-ফরমাশ খাটতে। মেয়েটা এসেই কান্নাকাটি। গ্রামের মেয়েদের যা হয় আরকি। এ বাড়ির যতই চাকচিক্য থাকুক না কেন, সে বাড়ি যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করল। বিয়েবাড়ির সবাই খুব বিরক্ত। তুমিসহ তোমার বাড়ির কেউ মেয়েটার সঙ্গে আদর করে কথা বললে না। আমার অলংকারের ঝনঝন শব্দের ভেতরেও একটু যেন কাঁটা মিশে রইল। এর মধ্যেই মেয়েটা হাত থেকে অসাবধানে ফেলে একটা তরকারির বাটি ভেঙে ফেলল।

সাধারণ তরকারির বাটি। তোমার মা মেয়েটার কান বরাবর সপাটে চড় লাগালেন। তুমি কিছুই বললে না, যেন কিছুই হয়নি। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুপুরে তোমরা আমাকে খুব যত্ন করে খাওয়ালে। আস্ত মুরগির রোস্ট, সেই মুরগির পেটে মসলা মাখানো ডিম। আমি কোনো খাবারের স্বাদ পেলাম না। আমরা পরদিন নেপাল গেলাম। প্লেনে আমার কানে ফিসফিসিয়ে কত কী বললে তুমি। আমার কিন্তু কিছুই ভালো লাগল না। বারবার শাপলা মানে ওই মেয়েটার মুখ মনে পড়ল। না আমি রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্রের মৃণালিনীর মতো সাহসী নই। তাই শাপলাও আমাকে মৃণালিনীর মতো ঘরের বাহির করেনি। কিন্তু বিয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ দিন থেকেই কানের নিচে একটা চড়ের অপমান নিয়ে আমি সংসার শুরু করলাম।

এরপর কত দিন গেছে। কখনো কখনো ঝগড়ার পর শান্তভাবে আমরা কথা বলতে শুরু করলে অনেকবার শাপলার ঘটনাটায় যে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, তা বলার চেষ্টা করেছি। তুমি হেসে উড়িয়ে দাও। বলো, কবে কোন কাজের মেয়েকে কী বলা হয়েছে সেইটা তুমি ধরে বসে আছো? ইশতিয়াক, সমাজসংসারের বিচারে তুমি খুবই ভালো মানুষ। আমাকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছ। আত্মীয়স্বজন সবাই আমার ভাগ্যে আনন্দিত, কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত। টাকাপয়সার অভাব নেই, বিলাসী জীবনযাপন করি। সবাই বলে, তৃষার তো অমনই হওয়ার কথা ছিল, অত সুন্দরী। কিন্তু তোমার এই সব ‘দেওয়া’র ভেতরে আমি একটা বৃত্ত টের পাই।

আমি জানি কতটুকু আমার সীমা, আমি জানি আমার স্বাধীনতা তোমার পকেটে। তুমি মোটা দাগে খুব ভালো মানুষ। আমি ছাড়া কোনো নারীর প্রতি তোমার কোনো আসক্তি নেই। কিন্তু ধরো কোনো দিন আমরা একসঙ্গে একটা সিনেমা দেখিনি, কোনো দিন একটা কবিতা পড়িনি। তোমার এসব ভালো লাগে না। কোনো দিন একটা বৃষ্টি বা জোছনার রাত আমরা একসঙ্গে উপভোগ করিনি। তুমি অত প্রকৃতিপ্রেমিক না। কিন্তু আমি তো তাই। আমার জন্যও তুমি কখনো এসব করোনি। তোমার মনেই আসেনি আমি কী চাই! কিন্তু স্বামী কবিতা পড়ে না বা জোছনা দেখে না এই অপরাধে তো তাকে ত্যাগ করা যায় না! তুমি ভালোবাসা বলতে বোঝ প্রতি রাতের শরীরী সম্পর্ক। ‘লাভ মেকিং’ বলে যে একটা শব্দ আছে, ক্রিয়া আছে, তা-ই তুমি জানো না।

সবচেয়ে বড় কথা ইশতিয়াক, তুমি আমার ভাষা বোঝো না। তোমার প্রেম আর পৌরুষ বা মর্দামিকে এক করে ফেলা ভালোবাসা আমি নিতে পারিনি। দিনে দিনে তাই শরীরের আগ্রহ কমেছে। শাপলার মতো বা শরীরের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার ফলাফল আমাদের আজকের অকার্যকর সম্পর্ক। আমি জানি তুমি এসব বুঝবে না। আমিও বুঝিয়ে বলতে পারব না। নারীর সেন্সিটিভিটি এক অদ্ভুত ব্যাপার। পুরুষেরা সেসব কখনো বুঝতে শেখেনি। নারীর কান্নার অনুবাদ পুরুষেরা করতে জানে না। সেই যে শাপলাকে তোমার চড়া গলার ধমক আর তোমার মায়ের চড়, সেই ধমক আর চড়েই ভেঙে গিয়েছিল সুদৃশ্য চায়না জার-আমার সেন্সিটিভিটি। তুমি আমার কোমল হৃদয় ভেঙেছ ইশতিয়াক। ইউ ব্রেক মাই চায়না জার। ইউ ব্রেক।

অলংকরন: শাহরিন

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই – ‘আঁধারের কাছে’

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলার ইতিমধ্যেই অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে সাদিয়া সিদ্দিকার নতুন উপন্যাসের কথা।

কাহিনী সংক্ষেপ:

রাত দেড়টা।প্রবল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। ঠিক সেসময় জবার কানে এলো অন্দরমহলের দক্ষিণ পাশের ঘরটায় কেউ একজন কিন্নর কণ্ঠে গান গাইছে। ভৌতিক কিংবা রহস্যের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সেদিন জবা মুখোমুখি হয় চরম এক অপার্থিব ঘটনার।

সেই অপার্থিব ঘটনার জের ধরেই এগোতে থাকে দুর্গাপুর থেকে কিছুটা দূরের এক গ্রামের অন্দরমহল, ইশরাক চাচার বাড়িতে বেশ কিছু গল্প। জবা গল্পটা আধিভৌতিক মনে করলেও পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে আরেক গল্প। চাচার বাড়িতে দিন কয়েক বেড়াতে আসা নিতুসহ তার বড় বোন জবা টের পায় তাদের থাকতে দেওয়া অন্দরমহলের দক্ষিণ পাশের ঘরে ওরা ছাড়াও কেউ একজন থাকে!

রহস্যের ঘ্রাণ থাকা দিনগুলোতে শাহেদ নামের ছেলেটির জন্য গল্পটি মোড় নেয় অন্যদিকে। একদিকে জোছনা রাতের সেই রহস্যময়ী তরুণী, অন্যদিকে শাহেদের জন্য জমিয়ে রাখা গোপন আবেগ। এ যেনো বিষাদমাখা এক রহস্যে ঘেরা বাড়ি। আঁধারের কাছেই লুকিয়ে আছে ভীষণ সত্যি এক জীবনের গল্প!

সাদিয়া সিদ্দিকা রচিত ‘আঁধারের কাছে’ বইটি প্রতীক প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পেয়েছে। রহস্য ঘরানার রোমান্টিক এই উপন্যাসটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। বইমেলা ২০২০-এ বইটির একমাত্র পরিবেশক অবসর প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাবে বইটি। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৫০ টাকা। এছাড়াও রকমারি ডট কম সহ অনলাইন বুকশপগুলোতে পাওয়া যাবে বইটি।

২০১৮ সালে কবিতাগ্রন্থ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরের বছরই সমকালীন উপন্যাস একটি বসন্ত অতঃপর কৃষ্ণচূড়া নিয়ে হাজির হয় সাদিয়া সিদ্দিকা। তারই ধারাবাহিকতায় আঁধারের কাছে প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবারের বইমেলায়।

লেখা ও ছবি: সংগ্রহীত 

০ মন্তব্য করো
1 FacebookTwitterPinterestEmail
উপন্যাসশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

বইমেলার বই

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২০

চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০। মাসব্যাপী এই মেলার ইতিমধ্যেই অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠছে মেলা প্রাঙ্গণ। লেখকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অটোগ্রাফ কিংবা ফটোগ্রাফ দিতে। পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছে তাদের কাঙ্ক্ষিত গ্রন্থ। আর আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের জন্য বই প্রকাশের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে প্রকাশকরা।

এবারের মেলায় ফিকশন-ননফিকশন সহ অসংখ্য বই প্রকাশ করেছে সকল প্রকাশকরা। তবে প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর না হয়ে পাশাপাশি তরুণ লেখকদের প্রতিও বেশ ভালো সুনজর দিয়েছে প্রকাশনী সংস্থাগুলো। তাই এবারের মেলা যেন তরুণ লেখকদের মিলনমেলা। অনেকেই ইতিমধ্যে বই কিনে ফেলেছে অনেকেই আবার এখনো অপেক্ষায় আছে। এই অপেক্ষার পালাটা খানিকটা কমিয়ে আনতে রোদসী ম্যাগাজিন পাঠকদের সুবিধার্থে বইয়ের প্রচার করবে। আজ থাকছে বলতে গেলে একদমই নতুন এক লেখকের উপন্যাসের কথা।

 

জন্মান্তর – ইমরান কায়েস

ঢাকার গাঢ় দম বন্ধ অন্ধকারে সবার অলক্ষে, আলো ঝলমলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঘিরে একটা ভক্স ওয়াগন তখন সন্তর্পণে একবার চক্কর খেলো। হোটেলের চারপাশে কড়া আর্মড গার্ড। জাতি সংঘের হাই কমিশনার ফর রিফিউজিজ প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের সম্মানে একটা ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। বিদেশী সাংবাদিক, ডেলিগেটস , পাকিস্তান মিলিটারির দুই তিন জন হোমরা চোমরা জেনারেল সে ডিনারে আমন্ত্রিত অতিথিদের আসনে বসে আছে।

হোটলের পরিবেশ দেখে ঢাকার অবস্থা বোঝার উপায় নেই। অতিথিরা শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, মদ এবং সুবাসিত খাদ্যে মশগুল। এসপারাগাছের বিশেষ স্যুপ এর স্বাদে কোন হেরফের নেই। হোটেল রিসিপশনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া ছেলেটার বো টাই কোন দিকে এক ডিগ্রীও হেলে পড়েনি। হাইজ্যাক করে আনা ভক্সওয়াগনের ড্রাইভিং সিটে থাকা বাদল নিজের প্যান্টে ঘসে বেশ কয়েকবার তাঁর হাত মুছে নিলো। একটু পর পর ঘামে হাত পিছলে যাচ্ছে ! উত্তেজনায় হাত পা ঘামা তার পুরনো সমস্যা। গাড়িটা হোটেলের গেটের কাছাকাছি আসতেই হোটলের দেয়াল ঘেঁসে নিয়ে গেলো আরো। পেছনের সিট থেকে তিনটা গ্র্যানেড পিন খুলে ছুঁড়ে দেয়া হলো হোটেলের ভিতরে!

লেখকের প্রথম উপন্যাস ছিল বিষাদ। তারপর দীর্ঘ দুই বছরের বিরতিতে এবার নিয়ে এলেন জন্মান্তর। তাই পাঠকের কাছে লেখকের প্রত্যাশাটা যেন একটু বেশীই।

০ মন্তব্য করো
1 FacebookTwitterPinterestEmail
গল্পরোমান্সরোমান্স রসায়নশিল্প ও সাহিত্যশিল্প-সংস্কৃতি

প্রকৌশলী প্রেম: রাজু আলীম

করেছে Wazedur Rahman ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২০

ক্লাস শেষে করিডরে জল, পেছনে রিমি; সকাল সাড়ে আটটায় ক্লাস ছিল ওদের। এখন বাজে দশটা। আজ একটাই ক্লাস। পুরো দিনই ফ্রি। জলকে রিমি বলে, এই চল রেললাইনে যাই।
-মরতে? সাতসকালে রেললাইনে?
-আরে, মরতে যাব কোন দুঃখে? যাব তো তোকে মারতে।
-কাকে?
-কেন, তোকে?
-হঠাৎ আমারে মারার সুপারি নিলি কেন?
-তোর মরা আমার হাতেই; আমি তোর আজরাইল।
-রেললাইনে নিয়ে মারতে পারবি তো?
-কেন পারব না?
-রেললাইনে বডি দেব, মাথা দেব না। মারবি কী করে? মারতে তো পারবিই না, উল্টো নিজে মরবি।
-কেন?
-মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে আর রেললাইনে গিয়ে তুই প্রেমে কাটা পড়বি। রেলগাড়ি ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম, বুঝলি, সুন্দরী?
-এই ইয়ারকি রাখ, নিয়ে যাবি কি না বল?
-সকাল সকাল তোর যদি মরার পাখনা গজায়, তবে ঠেকায় কে? পিপীলিকার পাখা ওড়ে মরিবার তরে, কাহার ষোড়শী কন্যা তুমি আনিয়াছ ঘরে? চল, রেলে তোর মরিবার সাধ পুরা করি, আমার কী? চল, তোকে মরতে সাহায্য করি।

ফ্যাকাল্টি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে এসে রিকশা নেয় ওরা। জল উঠে বসে সিটে।
-এই পাশে বসলি কেন? কত দিন বলেছি আমার সাথে রিকশায় বসলে তুই ডান পাশে আর আমি বাঁ দিকে বসব? এক কথা কত দিন আর বলব? সামান্য এইটুকু মনে রাখতে পারিস না? এই মেমোরি নিয়ে তুই কী করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? আমার না ডাউট হয়!
-এত ডাউট করা লাগবে না, এই তো সরেছি বাঁ দিকে, এবার ওঠ।

ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে ভিসির বাংলো হয়ে রিকশা আসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে।
-এই মামা দাঁড়াও, দাঁড়াও।
-রিকশা থামালি কেন?
-বল, যা চাইব দিবি?
-কী চাই তোর?
-আগে বল দিবি?
-ন্যাকামি করিস না, কী চাই বল।
-ওই যে আমড়া মামা। বেশি করে কাসুন্দি দিয়ে আমড়ামাখা খাব।
-শোন, নেকু নেকু করবি না। আমড়া খাবি তো এত ঢং করছিলি কেন? একি এমন মহামূল্যবান জিনিস যে তার জন্য তোকে কথা দিতে হবে?
-তুই তো দেখি পুরাই পাগলি, মাথায় ছিট আছে? জুতা থুইয়া পা কালি করে?
-হুম, আমার মাথায় ছিট আছে আর সেই ছিট খালিও আছে, তুই বসবি ছিটে? যা পাগলু আমড়া মাখা নিয়ে আয়। এই শোন, সকালে না নাশতাও করিনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে; ওই দোকানে বানরুটি আছে। মাসকা করে মাখন লাগিয়ে একটা নিয়ে আসিস, প্লিজ। মাখন লাগানো রুটি আন, তোকে একটা দারুণ জিনিস শেখাব?

রিকশা থেকে জলকে ঠেলে নামিয়ে দেয় রিমি। ধাক্কাতে পড়ে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। পড়ে যেতে দেখে হো হো করে হাসে রিমি।
-সামান্য এটুকু ধাক্কাতেই নিজেকে সামলাতে পারিস না। এর চেয়ে বড় ধাক্কা আসলে কী করবি? এই শক্তি নিয়ে কী করে তুই বড় বড় বিল্ডিং বানাবি, শুনি? তোর বানানো বাড়ি তো তোর মতোই নড়বড়ে তালপাতার সেপাই হবে। সামান্য হাওয়াতেই পড়ে যাবে।
-হ্যাঁ, আমার বানানো বাড়ি নড়বড়ে হবে। আর সেই বাড়ি ভেঙে পড়বে তোর ওপর আর তার তলে চাপা পড়ে মরবি তুই।
-আমি মরলে তুই তো বেঁচে যাবি।
-আরে তুই মরলে আমি বেঁচে যাব কেন? তুই মরলে তো বড়জোর বেঁচে যাবে ওই বেটা, যার সাথে আল্লা তোর বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। আর তা না হলে তোকে বিয়ে করে ওই বেটাকেই তো নির্ঘাত সারা জীবন কাঁদতে হবে।
-আচ্ছা, যা আপাতত এখন ওই লোকের জায়গায় প্রক্সি দিয়ে তুই মর। আমার জন্য মাখন লাগানো রুটি আর আমড়া মাখা নিয়ে আয়।

রিকশায় বসে রিমি। কাসুন্দিমাখা আমড়া আনতে ছোটে জল। ছোট্ট পলিব্যাগে চারটা আমড়া, একটা দেড় লিটার মামের বোতল, কয়েকটা বেনসন, একটা ম্যাচ, দুই প্যাকেট চিপস আর দুইটা বড় বড় ছানার মিষ্টি সঙ্গে মাখন রুটিও নিয়ে নেয় জল।

রিকশা চলে লাইব্রেরির দিকে। সকালের নাশতা রিকশায়। মাখন লাগানো রুটি।
-কী নাকি শেখাবি আমাকে?
-হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করে দিলি তো! তোকে মজার একটিা জিনিস শেখাব। একটা প্রশ্ন, উত্তর দিবি?
-কী প্রশ্ন?
-এই যে আমি মাখন-রুটি খাচ্ছি। এই মাখন নিয়ে, তোকে ঠিক ঠিক উত্তর দিতে হবে।
-কী প্রশ্ন?
-মাখন লাল সরকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মামা ছিলেন- এর ইংরেজি কী?
-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। কোনো রকম ভনিতা ছাড়া একদমে উত্তর দেয় জল।
ভড়কে যায় রিমি। খাওয়া বন্ধ। থ হয়ে তাকিয়ে জলের দিকে-তুই পারলি কী করে?
-হাঁস পাড়ে, মুরগি পাড়ে। আমি কেন পারব না?
হো-হো-হো-হো-হো-দুজন হাসতে হাসতে একসঙ্গে বলে-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস।

জল থামে। রিমি এবার একা-দ্য বাটার রেড গভর্নমেন্ট ওয়াজ দ্য ডাবল মাদার অব গড মুন এডুকেশন সিস। হো-হো- হো-হো-হো-রিমির হাসি থামে না; বারবার বলে আর হাসে। জানিস, কালকে না প্রথম আমি এটা নেটে পড়েছি, তারপর সারারাত হেসেছি-হো-হো-হো-হো-হো-আবারও হাসে, রিমির এত হাসি দেখে এবার হাসে জলও।

ইলেকট্রিক্যাল ফ্যাকাল্টির সামনে দিয়ে লেডিস হলের দিকে রিকশা যায়, পলিব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে আমড়া খায় রিমি। টকের স্বাদে চোখ বন্ধ করে আঙুল চেটে কাসুন্দি খেতে থাকে; আচ্ছা জল, আজকে তোর ব্যাপারটা কী বল তো। তুই এত কিছু আনলি কেন? আমি আনতে বললাম শুধু আমড়া-কাসুন্দি আর রুটি, তুই আনলি মিষ্টি, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট, সিগারেট-এত কিছু, ব্যাপার কী তোর? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি আবার? আমাকে তো আবার লাইন মারার চক্করে নেই তুই?
-তার আগে তুই বল। সকাল সকাল আজ আমাকে রেললাইনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন? লাইন মারার চক্করে যে থাকে সেই কিন্তু রেললাইনে যায়? আগে তোর মতলবটা শুনি?
-তোর মতো নড়বড়ে ইঞ্জিনিয়ারকে লাইন মারব আমি? শোন, আমিও তো ইঞ্জিনিয়ার। আমি লাইন মারলে মারব আমার চেয়ে বড় কারও সাথে?
-তো কে সে শুনি?
-আমার বিয়ে হবে কোনো পাইলট টাইলটের সাথে? তেমন কারও সাথেই লাইন মারব।
-পাইলট? মানে আমাদের ভার্সিটির বাসের ড্রাইভার মামা? হ্যাঁ, ঠিকই আছে। তোর জন্য পারফেক্ট ম্যাচিং? ঠিকঠাক মানাবে।
-এই একদম ইয়ারকি মারবি না।
-ইয়ারকি কই? আমাদের ক্যাম্পাসের বাসের ড্রাইভার মামাদের আমরা তো পাইলটই বলি? কেন তুইও তো বলিস।
-হ্যাঁ, ওটা তো আমরা মজা করে বলি।
-আমি মনে করলাম ভার্সিটির বাসে চড়তে চড়তে হয়তো তুই কোনো পাইলট মামার প্রেমে পড়ে গেছিস? তা তো হতেই পারে, তাই না?
-না, পারে না? আরে গাধা, আমি প্লেনের পাইলটের কথা বলেছি।
-ও আচ্ছা বুঝলাম, বিমানচালক, তাহলে বাসচালক না? তো দুজনে কিন্তু একই-চালক। একজন চালায় আকাশে আর একজন মাটিতে, পার্থক্য এই যা। এয়ারবাসও তো বাস, তাই না? বাসচালক আর বিমানচালকের জাত আলাদা হলেও ক্লাস কিন্তু একই, বল ঠিক না? সেই হিসেবে তোর পছন্দ ঠিকই আছে; ঠিক আছে কি না বল।
-তুই একটা হারামি, শয়তান।

কাসুন্দিমাখা হাতে জলের বাঁ হাত ধরে কিল মারতে থাকে রিমি, -তুই একটা বানর, গাধা, বলদা।
-এই আমার হাত ছাড় রিমি। একদম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না-হাত ছাড় দূরে সরে বয়; কাছে ঘেঁষবি না-নো, নো, নো, নো-অ্যাডভান্টেজ; হাত ছাড় বলছি রিমি।
-ছাড়ব না, দেখি তুই কী করিস? জলের হাত আরও শক্ত করে এবার বুকের সাথে ধরে রিমি
-তুই কি পাগল হলি? আমার হাত তোর কোথায়, দেখ তো?

বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হাত ছাড়ে রিমি। লজ্জায় তাকায় না জলের দিকে; মাথা নিচু করে বসে আছে। মুখে কথা নেই। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি পেরিয়ে যায় রিকশা।
-এই রিমি কি হলো? নির্বাক চলচ্চিত্র হয়ে গেলি? কথা বল কী হলো?
-তোর আমড়া খুব টেস্টি ছিল রে। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
-আরে, আমড়া আমার হতে যাবে কেন? আমি কি আমড়া বেচি? ও তো আমড়া মামার আমড়া।
-তুই নিজেই তো একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি। তাই ভাবলাম আমড়াটাও তাই তোরই হবে?

হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি, না হেসে পারে না জলও। হাসে দুজনে। হেসে হেসে এবার জলের কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে রিমি।
-হাসতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু হাসির ছুতোয় কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়া চলবে না। নো অ্যাডভান্টেজ; দূরে যা রিমি দূরে। ব্যাপার কী তোর আজ? তুই আমার শরীরের কাছে ঘেঁষছিস? ব্যাপার কী?
-তোর শরীর কি সুইমিংপুল যে ওখানে ঘেঁষতে হবে? ওটা তো একটা পচা ডোবা?
-কীভাবে টের পেলি? ডোবাতে নেমেছিস কোনো দিন?
-কোনটা সুইমিংপুল আর কোনটা পচা ডোবা তা বোঝার জন্য নেমে দেখার দরকার হয় না। পাড়ে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। বুঝলি কিছু বুদ্ধুরাম? আবারও একসঙ্গে হাসে দুজনে।

লেডিস হলের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। বাঁ দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের একবারে পাড় ঘেঁষে ছোট্ট পিচঢালা রাস্তা সোজা বোটানিক্যাল গার্ডেন পেরিয়ে চলে গেছে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির দিকে। ওই ফ্যাকাল্টির পাশেই রেললাইন।
-ওই দেখ, পুকুরের জলে আমাদের ছায়া।

তাকিয়ে দেখে পুকুরের জলে রিকশা মামা রিমি আর ও সাঁতার কাটে; পানির জলে রিকশা চলে, জলেতে রিকশায় বসে চলে দুজন। হলের পুকুরের একেবারে পাড় ঘেঁষে যায়;
-আচ্ছা, তুই কি এই পুকুরের জল? নাকি তুই নদী সাগর কুয়ো বৃষ্টি খাল বিল ডোবা নালা চোখের জল নাকি তুই নর্দমার? কিসের জল তুই, বল? কষ্টের নাকি সুখের? নাকি তুই নাকের জল?

হো-হো-হো-হো-হো হাসে রিমি উত্তর দেয় না জল; উদাস তাকিয়ে রিমির হাসা দেখে।
-আচ্ছা, যেভাবে আমড়া খাওয়ালি, সারা জীবন আমাকে এইভাবে খাওয়াবি তো?
-তোকে সারা জীবন আমড়া খাওয়াতে যাব কোন দুঃখে? কী হয়েছে? আজ মন যে খুব উরু উরু তোর! এত রোমান্টিক কথা বলছিস? অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার মতলব? সামথিং সামথিং?
-আরে, নাথিং নাথিং।
-বল, এভাবে সারা জীবন আমড়া খাওয়াবি?
-দয়াল বাবা আমড়া খাবা, গাছ লাগায়ে খাও। আমি পারব না। এসব কথা আর বলবি না-নো অ্যাডভান্টেজ।
-আরে, তুই তো আমড়া কাঠের ঢেঁকি। আমড়া খাওয়ানোর তাই দায়িত্ব তোকেই দিতে চাই। তোর মতো আমড়ার ঢেঁকি আমি আর কই পাব?

এবার পুকুরের জলের ছায়াতে রিকশা মামা খিলখিল করে হাসে-রিকশা মামার হাসিতে যোগ দেয় ওরাও। ডাঙায় তিনজন, পানিতে তিনজন মোট হাসে ছয়জন। কিন্তু মানুষ তো তিনজন।

পুকুরের পাড় পেছনে ফেলে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে দিয়ে রিকশা চলে। গা ছমছমে নীরবতা এই রাস্তায় সব সময়। অসম্ভব সুন্দর রোড। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা- রাস্তার দুই পাশে বড় বড় মেহগনিগাছ। জীবনানন্দের কবিতার মতো মেহগনির ছায়াঘন পল্লবে মোড়া। গাছের গভীর ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদ ও হাওয়ার খেলা আর এখানে ওখানে-দু এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া তেমন কেউ সাধারণত থাকে না এখানে -এই তুই নাকি সব কি কবিতা জানিস? একটা কবিতা আবৃত্তি কর না প্লিজ?
জলের হাত ধরে রিমি। এই হাত ছাড় বলছি। কোন অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, সেন্টিমেন্টাল কোনো ডায়ালগবাজি করবি না। যদি কাছে ঘেঁষার পাঁয়তারা করিস আমি কিন্তু তোকে ফেলে চলে যাব।
-তুই এত পার্সোনালিটি দেখাস কেন? তোর তো কোনো পার্সোনালিটি থাকার কথা না। তুই হলি জল, দ্য ওয়াটার হ্যাজ নো কালার। জলের নিজস্ব কোনো রং নেই; যখন যেখানে যে পাত্রে রাখা হয় জল সেই পাত্রের রং ধারণ করে। সুতরাং তোকে যেভাবে ইচ্ছা যেখানে সেখানে রাখব যা তা বলব তুই ঠিকঠিক সে রকম হবি? পার্সোনালিটি জলের মানায় না? তুই তো নামেই জল? জলের মতো সহজ সরল হ। খালি ত্যাড়াব্যাঁকা কথা?

জল চুপ হয়ে আছে।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সামনে এসে রিকশা দাঁড়ায়। রাস্তা শেষ। একটু হেঁটে গেট পেরিয়েই রেললাইন। রিকশা মামাকে টাকা দিয়ে সিগারেট ধরায় জল, আজ আমি সিগারেট খাব?
তা তো খাবিই মনে তো রং? কত কিছুই করবি আজ?

গেট পেরিয়ে রেললাইনে এসে দাঁড়ায় দুজন। পুব দিকে হাঁটে জল; এই আমাকে ফেলে আগে আগে যাচ্ছিস কেন? আমার কাছে আয়? আমি তোর হাত ধরে রেললাইনের ওপরে দিয়ে হাঁটব?

-আমাকে যত কাছে টানবি, আমি তত দূরে চলে যাব। সো নো অ্যাডভান্টেজ।
-আর যদি দূরে চলে যেতে বলি তখন কি কাছে চলে আসবি?
-নো, ইমোশনাল ডায়ালগবাজি? দূরত্ব বজায় রেখে হাঁট?
-আচ্ছা, তোর হাত ধরে হাঁটতে চেয়েছি, তোকে তো আমি হাগ করতে বলিনি। তুই এত ভিতু, ইঞ্জিনিয়ার হবি কীভাবে?
-তোর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে সাহসী হওয়ার প্রমাণ দিতে চাই না।
-হাত তোকে দিতেই হবে?
-শোন, হিমুরা কখনো কারও হাতে হাত রাখে না; আমি হলাম হিমু বুঝলি? সো ডোন্ট ট্রাই টু টেক এনি অ্যাডভান্টেজ।
-তুই হিমু আর আমি রুপা
-হিমু রুপার হাতেও হাত রাখে না। হিমুদের কোনো বন্ধন থাকতে নেই।

সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় জল। কী এক অজানা আবেগ এসে জড়ো হয় চোখে। সমান্তরাল এই রেললাইন যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি দূরে চলে। সারি সারি উঁচু উঁচু নাম না জানা গাছের মিতালি। রোদ-ছায়ার খেলা সত্যিই অপূর্ব জীবন আর বেঁচে থাকা। মনের অজান্তে কবিতা চলে আসে মুখে। পেছনে হাঁটা রিমিকে শোনানোর জন্যই হয়তো গলা জোরে ছাড়ে জল;

-আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভেতর এক নিরালা নীড়ে। তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে আকাশের রুপালি শস্যের ভেতর গা ভাসিয়ে দিতাম- তোমার পাখনায় আমার পালক-আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-নীল আকাশে খইখেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে।

সোনার ডিমের মতো ফাল্গুনের চাঁদ। হয়তো গুলির শব্দ: আমাদের তির্যক গতিস্রোত, আমাদের পাখনায় পিষ্টনের উল্লাস, আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান। হয়তো গুলির শব্দ আবার: আমাদের স্তব্ধতা আমাদের শান্তি। আমাদের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না থাকত না আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার। আমি যদি বনহংস হতাম, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে ধানখেতের কাছে।
কখন যে রিমি এসে হাত ধরেছে টের পায়নি জল, হাতে হাত রেখে কবিতার ঘোরে অনেকটা পথ এসেছে দুজন।

-এই চল ওই দেবদারুগাছের নিচে একটু বসি। তোর আবৃত্তি কিন্তু জোশ, মাইন্ড ব্লোয়িং রিয়েলি।
-রিমি একদম ফ্ল্যাট করবি না। আর অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না, তুই আমার হাত ধরেছিলি কেন?
-ওরে নেকা ষষ্ঠী দুধে-ভাতে মনে হয় কিচ্ছু বোঝো না? আমি হাত ধরেছি। তুই তো সরিয়ে দিতে পারতি? আরে বুঝি বুঝি সবই বুঝি। তোর যত বাহানা ওপরে ওপরে। সামনে এ রকম সুন্দরী থাকলে সবার মনই না উরু উরু করে? আর তোর করবে না? তোর মনও যে আঁকুপাঁকু করে আমি বুঝি?
-মোটেও না। আমি কবিতার ঘোরে ছিলাম। টেরই পাইনি কখন এসে তুই হাত ধরেছিস? নইলে আমি তোকে পাত্তা দেব? কোন চান্সই নেই ইয়ার।
-এই তুই এত ভালো আবৃত্তি করিস, কবিতা লিখিস, তোর তো সাহিত্যে পড়া দরকার ছিল?
-সাহিত্যে পড়তে কপালটা চওড়া হতে হয়। সে কপাল আমার ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখব। সাহিত্যে পড়ব অথচ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সাহিত্যে চান্স পেলাম না। চারটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টসে শুধু সাহিত্যের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু একটাতেও টিকিনি, শেষমেশ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলাম। এখানে আমার কপালটা দেখ, ভালো লাগে যে বিষয় তা নিয়ে পড়তে পারলাম না। আসলে মা-বাবা চায়নি আমি সাহিত্যে পড়ি। তারা চেয়েছে ইঞ্জিনিয়ার হই। তাই হয়তো হয়নি? কী আর করা। এখন আর আফসোস করে লাভ কী বল? সবই কপাল। আর এখানে পড়তে এসে কপালে জুটেছে তোর মতো এক পিস। আফসোস করে কী লাভ, সবই কপাল?
-এই কী বললি? জলের গায়ে কিল মারতে থাকে রিমি। কিছুক্ষণ কিলিয়ে হাঁপিয়ে গলা টিপে ধরে, মেরেই ফেলব তোকে। আজ মেরেই ফেলব।

কোনো রকমে রিমির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দূরে গিয়ে বসে জল। এই পালালি কেন? কাছে আয়; আজ তোকে মেরেই ফেলব। রেললাইনের পাথর হাতে নিয়ে ভয় দেখায় রিমি, কাছে আয়, নইলে কিন্তু সত্যি সত্যি এই পাথর ছুড়ব। বলা যায় না মেরেও দিতে পারে। কোনো গ্যারান্টি নেই। এর আগে একদিন ঝগড়া করতে করতে রিকশা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল জলকে। এই মেয়েকে একটু বিশ্বাস নেই, রাগলে মাথা ঠিক থাকে না ওর।

-ঠিক আছে কাছে আসব কিন্তু আর কোনো ঝামেলা করবি না তো?
-কাছে আয়, আর কিছুই করব না।
-সত্যি তো?
-হ্যাঁ, সত্যি।

হাত থেকে পাথর ফেলে দেয় রিমি। জল এসে ওর কাছে বসে; পাশাপাশি দুটো স্লিপারের ওপর দুজন।
-খুব খিদে পেয়েছে রে।
-জানি তো তোর খিদে পাবে।
-এই নে খা।

মিষ্টি চিপস, পানির বোতল এগিয়ে দেয় জল,
-প্যাকেট ছিঁড়ে দে।
-সামান্য একটা চিপসের প্যাকেট ছিঁড়তে পারিস না। তুই কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলি? ডাউট হচ্ছে বুঝলি?

প্যাকেট ছিঁড়ে জল। মিষ্টি চিপস খেতে থাকে দুজন। হাত উঁচিয়ে দূরে দেখায় রিমি;
-ওই দেখ কেন্নো আসে;
-সেকি কিরে গাড়ি আসছে? তাড়াতাড়ি খা।

ওরা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। পানি খেয়ে দাঁড়ায় দেবদারুগাছের নিচে। সামনে-পেছনে সারি সারি দেবদারুগাছ। তার ভেতর দিয়ে ছুটে আসে ট্রেন। রিমিকে দূরে দেখায় জল-
-কী যে মনোহারি, দেবদারু সারি সারি দেদার দাঁড়িয়ে আছে কাতারে কাতার।
-বাহ্ বাহ্, তুই তো দেখি চারণ কবিও?

গাড়ি আরও কাছে চলে আসে। ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ওরা যাত্রী নয়, কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে দুজন কিন্তু গাড়ি দাঁড়াবে না ওদের জন্য। পথের কোনো যাত্রীর প্রতি ট্রেনের মায়া থাকে না। মাঝপথে থেমে রাস্তা থেকে ট্রেন কাউকে তুলে নেয় না। ট্রেনের মায়া শুধু স্টেশনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রীর ওপর। ঠিক সময়ে যাত্রীকে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে গাড়ি রোজ সকালে বাড়ি ছাড়ে। গাড়ি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে দুজনে। কখনো সখনো কারও চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যাওয়ার সময়ে কারও মুখে যেমন কথা থাকে না তেমনি মুখ বুজে দাঁড়িয়ে ওরা। হু..হু..হু..শ..শ..শ.. শব্দে ধুলো বাতাসের ঝড়ে ওদের ছেড়ে গাড়ি ছোটে অন্য কোনো পথিকের দিকে। যে আছে সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরই মতো ট্রেন যাওয়ার অপেক্ষায়। পেছন থেকে কেন্নোর চলে যাওয়া উদাস তাকিয়ে দেখে রিমি-এই কী হোলো তোর? আয়?

রিমির চোখ গাড়িতে আটকে আছে। ডাকের শব্দে ফিরে তাকায়-
এসে বসে জলের পাশে গা ঘেঁষে; বলেছি না আজ বিড়ি খাব; দে বিড়ি? একটা বেনসন হাতে দেয় জল, ম্যাচের কাঠি ঠুকে জ্বালায়।
খুক, খুক, খুক, খুক কাশি। থামে না আরও জোরে টানে খুক। খুক, খুক, খুক আবারও কাশে যত টান তত কাশ।
টানের চেয়ে কাশিই বেশি-

কাশি আর ধোঁয়াতে রিমির চোখে জল। তবু টান থামে না।
-এই সব ছাইপাঁশ তোরা যে কী করে গিলিস, মাথায় আসে না? রাবিশ, ফেলে দেয় সিগারেট। পার্স থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে জলের বা হাত টেনে নেয়; তোর হাতের কনুই থেকে নখ পর্যন্ত খুব সুন্দর। দুই হাতের মধ্যে জলের হাত চেপে ধরে আছে রিমি, তোর মুখের কালার হাতের মতো এত সুন্দর না? হাতের মতো হলে আরও ভালো হতো। সপাটে হাত টেনে নিয়ে আলতো চুমু খায় রিমি-
-হাত নেওয়া পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায় কিন্তু তুই এ কী করলি? হাউ ননসেন্স ইউ আর?
আরও শক্ত করে এবার জলের হাত ধরে একের পর এক চুমু দেয় হাতে।
-যত বাধা দিবি, তত বাড়বে।

জল দমে যায়। জানে বাধা দিয়ে লাভ নেই। তাতে রিমির পাগলামি আরও বাড়বে। ঝমঝম বৃষ্টি। শোঁ শোঁ শব্দ। দমকা বাতাসে হঠাৎ অন্ধকার চারদিকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাকভেজা দুজন। রেললাইনের ওপর হাত ধরে বসে থাকে। মুষলধারে জলের ঢল। ভারী ভারী ফোঁটার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। কেউ নেই চোখের সীমায়। অন্ধকারে ঝাপসা একটু দূরেও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির তোড়ে উঠে দাঁড়ায় ওরা। জলের হাত ধরে টেনে নিয়ে ঝাঁকড়া দেবদারুগাছের নিচে দাঁড়ায় রিমি। অন্য হাতও টেনে নেয়। গাছের নিচে সামনাসামনি দাঁড় করায় জলকে দুই হাত দিয়ে বুকে জাপটে ধরে। তুমুল বাতাস। দমাদম বাজ পড়ার তীব্র শব্দে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে রিমি।

দুই প্রকৃতির কাছে অসহায় জল। মেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে আসল প্রকৃতি মিলেমিশে টালমাটাল করে দেয় ওকে। রক্ত-মাংস শিউরে ওঠে জলের। ভারী বৃষ্টি উপেক্ষা করে ৪৪০ ভোল্ট কারেন্টের তেজ। জলের ভেজা বারুদের স্তূপে দাউদাউ আগুন জ্বলে। হেরে যায় দিশেহারা। ধরে রাখতে পারে না নিজেকে। জেগে ওঠে শরীর। দুই হাতে শক্ত করে জাপটে বাহুতে পেষে রিমিকে। গায়ের সব শক্তি দিয়ে একজনকে পিষে চলে বুকে। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালের এই বৃষ্টি জলের জন্য শুভ কি না? তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে বারো বছর?

 

ছবিসূত্র: সংগ্রহীত 

 

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail
শিল্প ও সাহিত্য

হুমায়ূন আহমেদের বিয়ের স্মৃতি

করেছে Wazedur Rahman জানুয়ারী ৮, ২০২০

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন গুলতেকিন খানকে। ১৯৭৩ সালের ২৮ এপ্রিল তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন পার করে ২০০৩ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। ২০১২ সালে হুমায়ূন আহমেদ পরলোকগমন করেন। এখন শীতকাল। চলছে বিয়ের মৌসুম। রোদসীর পাঠকদের জন্য থাকল হুমায়ূন আহমেদ এবং গুলতেকিন খানের বিয়ের সেই স্মৃতি।

গুলতেকিনের সঙ্গে বিয়ে হয় এমন ঝোঁকের মাথায় তখন আমি হতদরিদ্র। লেকচারার হিসেবে ইউনিভার্সিটি থেকে সব মিলিয়ে সাত/আটশো টাকা পাই। দুই ভাইবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবর রোডের এক বাসায় থাকি। সে বাসা সরকারি বাসা। এভিকেশন নোটিশ হয়ে গেছে। ম্যাজিস্ট্রেট নিজে এসে বলে গেছেন বাড়ি ছেড়ে দিতে। পনেরো দিনের নোটিশ। বাড়ি না ছাড়লে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেয়া হবে। টাকা পয়সার দিক দিয়ে একেবারে নিঃস্ব। মাসের শেষের দিকে বেশির ভাগ সময়ই বাসে করে ইউনিভার্সিটিতে আসার পয়সাও থাকে না। হেঁটে হেঁটে আমি ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি। নিতান্ত পাগল না হলে এমন অবস্থায় কেউ বিয়ের চিন্তা করে না।

আমার মনে হলো গুলতেকিন নামের এই বালিকাটিকে পাশে না পেলে আমার চলবে না। গুলতেকিনের মা-বাবা আমার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। বড় মেয়েরই বিয়ে হয়নি। ক্লাস টেনে পড়া মেয়ের বিয়ে হবে কি করে? কি করা যায় কিছুই ভেবে পাই না। একদিন গুলতেকিন ডিপার্টমেন্টে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

হুমায়ূন আহমেদ এবং গুলতেকিন খানের দুর্লভ ছবি।

আমি বললাম, ‘চল এক কাজ করি- আমরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।’

সে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘কেন? কোর্টে গিয়ে বিয়ে করব কেন?’

‘খুব মজা হবে। নতুন ধরনের হবে। ব্যাপারটা খুব নাটকীয় না? তোমাকে ভাবার জন্য তিন মিনিট সময় দিলাম। তুমি ভেবে দেখ, তারপর বল।’

সে ভাবার জন্য তিন মিনিটের মতো দীর্ঘ সময় নিল না। এক মিনিট পরেই বলল, ‘চলুন যাই। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরে আসিনি। সালোয়ার-কামিজ পরে কি বিয়ে করা যায়?’

কোর্টে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না। কনের বয়স চৌদ্দ। এই বয়সে বিয়ে হয় না। আমি কোন উপায় না দেখে তার ফুপু খালেদা হাবীবকে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। আমার সাহিত্যপ্রতিভার পুরোটাই ঢেলে দিলাম চিঠিতে। চিঠি পড়ে তিনি বিস্মিত এবং খুব সম্ভব মুগ্ধ। কারণ তিনি গুলতেকিনের পরিবারের সবাইকে ডেকে দৃঢ় গলায় বললেন, ‘এই ছেলের সঙ্গেই গুলতেকিনের বিয়ে দিতে হবে। অন্য কোথাও নয়। ভবিষ্যৎ-এ যা হওয়ার হবে।’ আর আমার চিঠির জবাবে তিনি লিখলেন, ‘আপনার অদ্ভুত চিঠি পেয়েছি। এত বানান ভুল কেন?’

তারা ক্লাস টেনে পড়া মেয়েকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন। এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখে বিয়ে হবে। এই খবরে আমার এবং মার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হাতে একটা পয়সা নেই। যে কোন মুহূর্তে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। এই অবস্থায় বিয়ে। কে জানে নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসে দেখা যাবে পুলিশ দিয়ে সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। নতুন বউ নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে হবে।

হুমায়ূন আহমেদের পুরো পরিবার।

মা তাঁর সর্বশেষ সম্বল বাবার দেয়া হাতের এক জোড়া বালা, যা তিনি চরম দুঃসময়েও যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন, বিক্রি করে বিয়ের বাজার করলেন। জিনিসপত্রগুলি খুব সস্তা ধরনের কিন্তু তাতে মিশে গেল আমার বাবা এবং মার ভালোবাসা। আমি জানতাম ভালোবাসার এই কল্যাণময় স্পর্শেই আমার অনিশ্চয়তা, হতাশা কেটে যাবে।

বউ নিয়ে বাসায় ফিরে বড় ধরনের চমক পেলাম। আমার শোবার ঘরটি অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে আমার ছোট বোন। আমাদের কোন ফ্যান ছিল না। কিন্তু আজ মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বিছানায় কি সুন্দর ভেলভেটের চাদর। খাটের পাশে সুন্দর দুটি বেতের চেয়ার। বেতের চেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিলে একগাদা রক্ত গোলাপ। গোলাপের পাশে একটা চিঠিও পেলাম। মেজো বোন শিখুর লেখা চিঠি –

‘দাদা ভাই,

 

তুমি যে সব গান পছন্দ করতে তার সব ক’টি টেপ করা আছে। কথা বলতে বলতে তোমরা যদি ক্লান্ত হয়ে পড় তাহলে ইচ্ছা করলে গান শুনতে পার। দরজার কাছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার রেখে দিয়েছি।’

ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করতেই সুচিত্রা মিত্রের কিন্নর কণ্ঠ ভেসে এল –

ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা?

গভীর আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। আমি সেই জল গোপন করবার জন্য জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘কেমন লাগছে গুলতেকিন?’

সে নিচু গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছি না। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।’

‘ঘুম পাচ্ছে?’

‘না।’

সারা রাত আমরা গান শুনে কাটিয়ে দিলাম দু’জনের কেউই কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। গান শোনা ছাড়া উপায় কি?  পরদিন ভোরবেলা খুব দুঃখজনক ব্যাপার ঘটল। যাদের বাসা থেকে সিলিং ফ্যান ধার করে আনা হয়েছিল তারা ফ্যান খুলে নিয়ে গেল। গুলতেকিন বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ওরা আমাদের ফ্যান খুলে নিচ্ছে কেন?’

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। জবাব দিতে পারলাম না। বিছানার চমৎকার চাদর, বেতের চেয়ার, ক্যাসেট প্লেয়ার সবই তারা নিয়ে গেল। এমনকি টেবিলে রাখা সুন্দর ফুলদানিও অদৃশ্য। গুলতেকিন হতভম্ব। সে বলল, ‘এসব কি হচ্ছে বলুন তো? ওরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে কেন? আমরা বুঝি রাতে গান শুনব না?’

গুলতেকিনের প্রশ্নের জবাব দেবার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার নেই। আমার জন্য আরও বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে। বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এই কারণেই সবাই তড়িঘড়ি করে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছি। আমার ছোট বোন এসে বলল, ‘দাদাভাই, তুমি ভাবিকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারটা ভাবির সামনে না হওয়াই ভালো।’

হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন এবং তাদের পুত্র সন্তান নুহাশ।

আমি গুলতেকিনকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বৈশাখ মাসের ঘন নীল আকাশ, পেঁজা তূলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। হুড ফেলে দিয়েছি। আমার মনের গোপন ইচ্ছা – পৃথিবীর সবাই দেখুক, এই রূপবতী বালিকাটিকে আমি পাশে পেয়েছি। গভীর আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ। বাসায় এখন কি হচ্ছে তা এখন আমার মাথায় নেই। ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়েও ভাবছি না।

বর্তমানটাই সত্যি। অতীত কিছু না। ভবিষ্যৎ তো দূরের ব্যাপার। আমরা বাস করি বর্তমানে – অতীতেও নয়, ভবিষ্যতেও নয়।

 

সূত্র: হুমায়ূন আহমেদের অনন্ত অম্বরে
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

০ মন্তব্য করো
0 FacebookTwitterPinterestEmail

পোর্টফোলিও

প্রকাশিত সংখ্যা

রোদসীর পছন্দ

  • ঘরেই বানিয়ে নাও মেকআপ সেটিং স্প্রে

তুমিই রোদসী

  • আলোয় ভুবন ভরা







rodoshee logo

© স্বত্ব রোদসী ২০১৪ - ২০২১
সম্পাদক ও প্রকাশক:   সাবিনা ইয়াসমীন
৯১/এ, প্রথম ও দ্বিতীয়তলা, ব্লক-এফ, রোড-৩, চেয়ারম্যান বাড়ি, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮০-২-৫৫০৪১০৪৬-৪৮, ই-মেইল: info@rodoshee.com

রোদসী

রোদসী

ক্যাটাগরি

আর্কাইভ

@2014-2018 -রোদসী. All Right Reserved.

রোদসী
  • হোম
  • লাইফস্টাইল
  • রূপ ও ফ্যাশন
  • রোমান্স
  • কালচার
  • নারী
    • সাফল্য
    • সম্ভাবনা
    • সংগ্রাম
    • সমস্যা
Facebook